কবিতায় অনুষঙ্গবাদ – গৌতম ভট্টাচার্য
মনোবিজ্ঞানের সূত্রপাত থেকে যে বিশেষ মতবাদটি মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন তথ্য ও প্রত্রিয়ায় সংব্যাখান ও সূত্র গঠনের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে এসেছে তা হল অনুষঙ্গবাদ। পূর্ণ ঊনবিংশ শতাব্দী এবং বিংশ শতাব্দীর একটি বড়ো অংশ এই অনুষঙ্গবাদ মনোবিজ্ঞানের উপর একপ্রকার একাধিপত্য করে এসেছে, বলা চলে।
চিন্তন, কল্পন, বিচারকরণ প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়াগুলির ক্ষেত্রে ‘মনে করা’ কাজটির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে সকল প্রতীকের সাহায্যে আমরা চিন্তন প্রভৃতি কাজ সম্পন্ন করি সেগুলি আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে পেয়ে থাকি এবং সেগুলি আমাদের মস্তিষ্কে সংরক্ষিত হয়ে থাকে। চিন্তনের সময় সেগুলিকে আমরা পুনরুজ্জীবিত করে তুলি অর্থাৎ লৌকিক ভাষণে সেগুলিকে আমরা ‘মনে করি’।
এই মনে করা কাজটিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে যে মানসিক প্রক্রিয়াটি তার নাম অনুষঙ্গ (Association)। অনুষঙ্গ বলতে বোঝায় দুটি বস্তুর মধ্যে এমন একটি বিশেষ ধরনের সম্পর্ক যার দ্বারা একটি আর একটির কথা মনে জাগাতে পারে। অনুষঙ্গ যে কোনো দুটি প্রতীকের মধ্যে স্থাপিত হতে পারে। যেমন, দুটি ধারণার মধ্যে বা দুটি প্রতিরূপের মধ্যে বা একটি ধারণা এবং একটি প্রতিরূপের মধ্যে অনুষঙ্গ সৃষ্টি হতে পারে। তেমনই আবার একটি প্রত্যক্ষিত বস্ত এবং একটি প্রতীকের মধ্যেও অনুষঙ্গ সৃষ্টি হতে পারে। অনুষঙ্গ আবার আর একদিক দিয়ে দু-শ্রেণির হতে পারে। যেমন, সর্বজনীন—কতগুলি ব্যাপারে একটি বিশেষ সমাজের অধিকাংশ ব্যক্তির মধ্যে একই প্রকারের অনুষঙ্গ গঠিত হতে পারে এবং ব্যক্তিগত—কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুষঙ্গ নিছক ব্যক্তিগত হতে পারে।
অনুষঙ্গের প্রকৃতি অনুযায়ী তিনটি প্রধান সূত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। যথা—
১) সাদৃশ্যের সূত্র (Law of Similarity)
২) সান্নিধ্যের সূত্র (Law of Contiguity)
৩) বৈসাদৃশ্যের সূত্র (Law of Contrast)
সাদৃশ্যের সূত্র (Law of Similarity):—
যখন দু’টি বস্তর মধ্যে আকারগত বা প্রকৃতিগত বা অন্য কোনো সাদৃশ্য থাকে তখন একটির প্রত্যক্ষণ বা চিন্তা অপরটির স্মৃতি আমাদের মনে জাগিয়ে তোলে।
“তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”
কবিতাংশে ‘পাখির নীড়’ ও ‘চোখ’-এর মধ্যে সাদৃশ্য কল্পনা করা হয়েছে। শুধু যে উপমেয় ও উপমানের বর্ণনা সর্বস্ব কারুকার্যেই কবি সন্তষ্ট হয়েছেন তা নয়। ক্লান্তপ্রাণ মানুষ জীবনের চারিদিকে যার সফেন সমুদ্র, তাকে যে নারী দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল তারই চোখ পাখির নীড়ের মতো। সমস্ত দিনের শেষে পাখি যখন ঘরে ফেরে তার কাছে নীড় আশা ও বিশ্রামের আশ্রয়, নির্ভয় স্থিতির প্রতীক। তেমনি বনলতা সেনের চোখ ওই ক্লান্তপ্রাণ মানুষের কাছে সমস্ত দিনের শেষে আশা ও ভালোবাসার ইঙ্গিতবহ চোখ। দুটিতে প্রীতির প্রতীক দ্যোতনা কবি সহজেই ব্যক্ত করেছেন। পাখির নীড় দেখলে বা তার প্রত্যক্ষণ বনলতা সেনের চোখের কথা মনে জাগিয়ে তোলে। এখানে ‘পাখির নীড়’ ও ‘চোখ’-এর মধ্যে ভাবগতঅনুষঙ্গ স্থাপিত হয়েছে।
সান্নিধ্যের সূত্র (Law of Contiguity):—
যখন দুটি বস্তু একসঙ্গে বা পরস্পর আমাদের সামনে উপস্থিত হয় তখন দুয়ের মধ্যে এমন একটি অনুষঙ্গ প্রতিষ্ঠিত হয় যার ফলে একটির প্রত্যক্ষণ বা চিন্তা অপরটির স্মৃতি আমাদের মনে জাগিয়ে তোলে। সান্নিধ্য আবার দু-প্রকারের হতে পারে—স্থানগত ও কালগত। কখনও কখনও দুটি বস্তু বা ঘটনার মধ্যে স্থানগত সমতা বা সান্নিধ্যের জন্য অনুষঙ্গ স্থাপিত হতে পারে। আবার কখনও সময়গত একতা বা সান্নিধ্যের জন্য একটি বস্তু বা ঘটনা আর একটি বস্তু বা ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়।
“মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু কখন খেলতে গিয়ে হঠাৎ অকারণে
একটি কি সুর গুনগুনিয়ে কানে আমার বাজে,
মায়ের কথা মিলায় যেন আমার খেলার মাঝে।
মা বুঝি গান গাইত আমার দোলনা ঠেলে ঠেলে—
মা গিয়েছে, যেতে যেতে গানটি গেছে ফেলে।”
কবিতাংশের দুটি ঘটনা হল ‘খেলা’ এবং ‘গান করে মায়ের দোলনা ঠেলা’। প্রথম ঘটনা অর্থাৎ ‘শিশুর খেলা’ অতীত এবং বর্তমান। দ্বিতীয় ঘটনা অর্থাৎ ‘গান করে মায়ের দৌলনা ঠেলা’ কেবলমাত্র অতীত। শিশুটি যেহেতু মাতৃহারা, সুতরাং দ্বিতীয় ঘটনাটি তার সঙ্গে ঘটত। শিশুটি যখন খেলে তার মায়ের গান আর দোলনা ঠেলার কথা তার সামনে উপস্থিত হয়। তাহলে একটির প্রত্যক্ষণ বা চিন্তা অপরটির স্মৃতিকে শিশুর মনে জাগিয়ে তোলে। ফলে দুটি ঘটনার মধ্যে অনুষঙ্গ স্থাপিত হয়। এখানে যেহেতু সময়গত একতা বা সান্নিধ্যের জন্য একটি ঘটনা আর একটি ঘটনাকে মনে করিয়ে দেয় তাই সান্নিধ্য এখানে কালগত। তৃতীয় স্তবকে কবি লিখেছেন—
“মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু যখন বসি গিয়ে শোবার ঘরের কোণে,
জানলা থেকে তাকাই দূরে নীল আকাশের দিকে—
মনে হয় মা আমার পানে চাইছে অনিমিখে।
কোলের ’পরে ধ’রে কবে দেখত আমায় চেয়ে,
সেই চাউনি রেখে গেছে সারা আকাশ ছেয়ে।”
এখানে ‘শিশুটির শোবার ঘরের কোণে বসে জানালা থেকে দূরে নীল আকাশের দিকে তাকানো’ এবং ‘মায়ের কোলের ’পরে ধ’রে তার দিকে চেয়ে দেখা’ এই দুটি ঘটনার মধ্যে অনুষঙ্গ স্থাপিত হয়েছে। ঘটনাটির সঙ্গে যেহেতু একটি নির্দিষ্ট স্থানের যোগসূত্র আছে তাই এখানে সান্নিধ্য স্থানগত।
বৈসাদৃশ্যের সূত্র (Law of Contrast):—
দুটি বস্তু বা ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈসাদৃশ্য থাকলেও একটির কথা মনে হলে অপরটির কথা মনে পড়ে যায়।
“. . . . . . . . .
দেখেছি আমারই হাতে হয়তো নিহত
ভাই বোন বন্ধু পরিজন প’ড়ে আছে,
পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন,
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।”
স্বার্থসিদ্ধি করবার জন্য মানুষের হাতে বিনাশপ্রাপ্ত হয় তার বন্ধুজনেরাও। অনেক সময় স্বেচ্ছাকৃত বিরুদ্ধতা না করলেও নিজের অস্তিত্ব অপরের অস্তিত্বের পথে বাধাস্বরূপ হয়ে ওঠে। ‘ভাই-বোন-বন্ধু-পরিজন’ ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃত আঘাতে বিপন্ন হয়। জটিল গভীর বেদনায় কবি উচ্চারণ করেছেন—“পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন।” উপলব্ধির প্রগাঢ়তা জীবন-বিশ্বাসকেই বিচলিত করেছে। কিন্তু স্তবকের শেষ পঙ্ক্তিতে এই পুঞ্জিত অন্তর্বেদনার অন্ধকার ভেদ করে জেগে উঠেছে কবির জীবন-ভালোবাসার প্রগাঢ় আলোকরেখা, “মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।” অন্য কিছুর জন্য না হোক এই মানব-জন্মের জন্য পৃথিবীর কাছে ঋণী থাকা ছাড়া উপায় নেই মানুষের। এই বন্ধন সুখের এবং দুঃখের একসঙ্গে এবং এই বন্ধন অবিচ্ছেদ্য। জীবনানন্দ জীবনকে নিরর্থক মনে করতে পারেনি। মানব-অস্তিত্বের শেকড় কঠিন ভূমিতে সঞ্চারিত। কবিতার চতুর্থ স্তবকে কবি লিখেছেন—
“সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে—এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি, হবে;”
সুচেতনা আসলে মানবীয় শুভৈষারই প্রতীকী অবয়ব। ‘এ-পথেই’ বলে বুঝিয়েছেন কর্মের পথেই মানুষের সভ্যতাকে, মানবিক পৃথিবীকে যতদূর সম্ভব শুদ্ধতার দিকে নিয়ে যাওয়া যেতেই পারে। জীবনানন্দের চেতনা আশা ও নৈরাশ্য—এই উভয় উপলব্ধির সংশ্লেষে স্পন্দিত। সূর্যের আহ্বান এবং সুড়ঙ্গলালিত অন্ধকার—এই দুই-ই মানব জীবনের বাস্তব সত্য। কবিতাটির আলোচ্য অংশে মানুষের সভ্যতার অন্যায়, শোষণ, বিষাদ, নৈরাশ্যের পাশাপাশি মানুষ তার মধ্যে থেকেই নিজের কর্তব্য সম্পাদনে অগ্রসর হয়। কল্যাণ-আকাঙ্ক্ষার প্রদীপ তুলে ধরে এগিয়ে চলে শুভ লক্ষ্যের দিকে। দুটি ভাবনার মধ্যে বৈসাদৃশ্য থাকলেও মানব জীবনে আশা ও নৈরাশ্যের এই যুগল বন্ধন প্রকৃত সত্য বলে ‘পৃথিবীর গভীরতর অসুখ’ ‘পৃথিবীর ঋণ’-এর কথা মনে করিয়ে দেয়।
অনেক মনোবিজ্ঞানী এই তিনটি সূত্রের পরিবর্তে সান্নিধ্যের সূত্রটিকেই মৌলিক সূত্র বলে বর্ণনা করেছেন এবং তাদের মতে অপর দুটি সূত্র এই সূত্রটিরই অন্তর্গত। আবার কোনো কোনো মনোবিজ্ঞানী সাদৃশ্যের সূত্রটিকেই মৌলিক সূত্র বলে বর্ণনা করে থাকেন। আবার হ্যামিল্টনের মতে সমষ্টিকরণের সূত্রটিকে (Law of Redintegration) অনুষঙ্গের মৌলিক সূত্র বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে এবং সাদৃশ্য, সান্নিধ্য, বৈসাদৃশ্য এসবগুলিকে এই সূত্রটির বিভিন্ন রূপ বলে ব্যাখ্যা করা যায়। এই সূত্রটির অর্থ হল যে একটি বিশেষ সমষ্টির যদি একটি অংশ আমাদের মনের সামনে উপস্থাপিত করা যায় তাহলে আমাদের মানসিক প্রচেষ্টা হবে বাকি অংশগুলিকে জাগিয়ে তুলে ওই সমষ্টিকে প্রতিষ্ঠিত করা। কবিতার ক্ষেত্রে অনুষঙ্গের এই সংখ্যাবানটি বেশ সুসঙ্গত এবং গেস্টাল্ট মনোবিজ্ঞানীদের তত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এই অনুষঙ্গবাদের সম্পূর্ণ একটি বিপরীত মতবাদ ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করে। এই মতবাদটিকে গেস্টাল্ট মতবাদ নাম দেওয়া হয়ে থাকে। গেস্টাল্টবাদীদের মত অনুযায়ী আমাদের প্রত্যক্ষণের বিষয়বস্ত সর্বদাই এমন একটি অবিচ্ছিন্ন সমগ্র সত্তা যাকে বিশ্লেষণ করলে বা যার অংশগুলিকে পৃথকভাবে বিচার করলে আমরা সেই সমগ্র সত্তাটিকে কখনও জানতে পারি না। কারণ, সমগ্র সত্তাটি কেবলমাত্র অংশগুলির যোগফল নয়, যোগফলের ওপরেও অতিরিক্ত, আরও কিছু। যেমন, একটি প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখলে এই দৃশ্যটির অন্তর্গত গাছপালা, ফুল, নদীগুলিকে পরপর যোগ করে দিলেই অভিজ্ঞতার সমগ্র সত্তাটিকে পাওয়া যাবে না। এই অংশগুলি অভিজ্ঞতার মধ্যে থাকবেই, তার ওপরে থাকবে অতিরিক্ত আরও কিছু। সমগ্র সত্তার এই অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্যটি গেস্টাল্টবাদী মনোবিজ্ঞানীদের মতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তারা মনে করেন যে বিভিন্ন অংশগুলির সংগঠন থেকে এই অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্যটি দেখা যায়। এককথায়, বিশেষ কোনো শিখন পরিস্থিতির অন্তর্গত বিভিন্ন অংশগুলি নিজেদের মধ্যে যে একটি সংগঠনের সৃষ্টি করে সেইটিকে গেস্টাল্টবাদীরা গঠন বা কাঠামো বা পূর্ণ আকার নাম দিয়ে থাকেন।