কার্ল মার্কস ও বিশ্ব-সাহিত্যের অতিমানবেরা – শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য (পর্ব ৬ )

শেয়ার করুন

কার্ল মার্কস ও বিশ্ব-সাহিত্যের অতিমানবেরা (কিছু মনন সমলয়ন কথা)

প্রথম অধ্যায়: কার্ল মার্কস ও বালজাক

মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব, Tendenzroman এবং বালজাক

ফরাসি বিপ্লবের দশ বছর পরে জন্মেও ব্যক্তিগত পরিসরে কিন্তু বালজাক আদ্যোপান্তই ছিলেন রাজতন্ত্রী। তাঁর মতামত ছিল সেকেলে ভাবনা চিন্তা ও প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যান-ধারণার পক্ষেই। এর পরেও মার্কস এঙ্গেলস ছিলেন এই মানুষটির তন্নিষ্ঠ পাঠক। তাঁর গল্প উপন্যাসে সেই সময়ের ফরাসি অভিজাত সমাজের যে জীবন্ত বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় তার প্রাণ খুলে প্রশংসা করেছেন দুজনেই। বালজাকের যে লেখাগুলি তাঁর প্রথম সারির রচনার মধ্যে পড়ে না, যেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক যোগাযোগ তেমন নেই, সেগুলি অধ্যয়ন করতেও মার্কসের উৎসাহ কম ছিল না। এর পিছনে অবশ্যই কারণ ছিল। বস্তুত অবিস্মরণীয় মহৎ সব বাস্তববাদীদের মতো বালজাক এমন সব চরিত্র সৃষ্টি করেছেন যারা আপাত অর্থে নিজেদের মতো করে স্বাধীন জীবন কাটালেও তাদের আসা-যাওয়া, বেড়ে ওঠা, দৈনন্দিন লেনদেন, নিয়তি সবই ঠিক হয় তাদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত অস্তিত্বের অন্তর্নিহিত দ্বান্দ্বিকতায়l

প্রখ্যাত আমেরিকান সাহিত্যতাত্ত্বিক পিটার ব্রুকস্(Peter Brooks) ‘La Comédie Humaine’-র মাহাত্ম্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন “It may seem a paradox, then, to link Balzac’s vast Human Comedy to the adjective “short.” We think of Balzac as long, often too long— descriptions, explanations that correspond to the leisure associated with reading nineteenth-century novels, of a length for evenings without television or smartphones…He stands as the first true realist in his ambition to see society as an organic system. Oscar Wilde came close to the heart of the matter when he declared: “The nineteenth century, as we know it, is largely an invention of Balzac’s.” Balzac “invents” the new century by being the first writer to represent its emerging urban agglomerations, its nascent capitalist dynamics, its rampant cult of the individual personality.” (1)
নান্দনিক সৌন্দর্যের সঙ্গে কোন রকম আপস না করে সামাজিক বাস্তবতাকে নির্ভুলভাবে উপস্থাপনা করার বালজাকের অসামান্য ক্ষমতাকেই কদর করতেন মার্কস। উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হল, বালজাক তাঁর সমকালীন বিশ্ব-সাহিত্যিকদের থেকে কোথায় আলাদা, তাঁর রচনার মাহাত্ম্য ঠিক কোন জায়গায়, সেই সবের চুলচেরা বিশ্লেষণে মার্কস কিন্ত একেবারেই শ্রম খরচ করেননি। তাঁর গ্যয়েটে, বালজাক বা শেক্সপিয়ার আলোচনার প্রসঙ্গেও এই একই কথাই খাটে। একথা প্রথমেই বুঝে নিতে হবে যে বালজাকের শ্রেণিচেতনা, তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন হয়ে নান্দনিক চেতনাকে প্রাধান্য দিয়েই মার্কসের বালজাক পাঠ। স্পষ্টত লেখকের নিজস্ব ভাবাদর্শ এবং দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করেই তাঁর লেখাকে বিচার করতে হবে এমন কথা মার্কস অন্তত কস্মিনকালেও ভাবেননি সে কথা প্রথমেই বুঝে নিতে হবে। লেখকের ধ্যান-ধারণা সঙ্গে আমার ধ্যান ধারণার মিল থাকলে তাঁর সাত খুন মাফ আর না থাকলে তিনি অচ্ছুৎ—এমন বিষয়ীসর্বস্বতাকে কখনোই প্রশ্রয় দেননি মার্কস-এঙ্গেলস। বরং বড় লেখক বলতে তাঁরা বুঝবেন এমন রূপকার যার লেখায় তাঁর ইচ্ছে না থাকলেও বাস্তব পরিস্থিতি যথাযথভাবে প্রতিফলিত হবে। সেটি যদি তাঁর ধ্যান-ধারণের বিরুদ্ধেও যায় তবু তাকে প্রতিফলিত না করে তিনি পারবেন না। অর্থাৎ বিষয়নিষ্ঠাই মার্কস-এঙ্গেলসের শিল্প-রুচির অন্যতম মাপকাঠি। এর জন্যেই তাঁরা অত খাতির করতেন বালজাককে, যদিও তাঁর রাজনৈতিক মতামত ছিল রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল। (2)

বস্তুত শিল্প সাহিত্যের প্রকৃত রসবেত্তা হিসেবে বালজাক, গ্যয়েটে,শেক্সপিয়ারকে মার্কস এঙ্গেলস যে চোখে দেখেছিলেন তা তাঁদের অখন্ড বিশ্ববীক্ষারই প্রকাশ। এ কথা মেনে নিতেই হয় যে অর্থনীতি ও রাজনীতি সংক্রান্ত কোনো আলোচনায় শ্রেণিচরিত্রের নিরিখে ব্যক্তি বা কোন গোষ্ঠীর বিশ্লেষণ জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু ভাষা, শিল্প, সাহিত্য বা বৈজ্ঞানিক আলোচনার ক্ষেত্রে শ্রেণিভিত্তিক প্রেক্ষিতের ছকে বিশ্লেষণ মোটেই মার্কসবাদী বীক্ষণ নয়। কিন্তু নন্দন তত্ত্বের সমাজতাত্ত্বিক আলোচনা প্রসঙ্গে আবার শ্রেণিবিশ্লেষণ অপরিহার্য। কিন্তু নন্দনতত্ত্বের কেন্দ্রে সৃষ্টি এবং তার রসগ্রহণের যে বিশুদ্ধ সংযোগ সেখানে শ্রেণি বিশ্লেষণ আরোপ করে আলোচনার পরিসরকে সংকীর্ণ করে দেওয়া একেবারেই আকাঙ্ক্ষিত নয়।
রাজতন্ত্রী এবং প্রতিক্রিয়াশীল হয়েও বালজাকের লেখায় যে সামাজিক বাস্তবতা ধরা পড়ে তাতে রাজতন্ত্র বা প্রতিক্রিয়াশীলতার পক্ষে থাকা দৃষ্টিভঙ্গির বিন্দুমাত্র আভাস তো নেই বরং বালজাক তার বিপরীতেই হেঁটেছেন। এর মূল কারণ হলো রাজনৈতিক মতামত নন্দনতত্ত্বের সমস্তটা অধিকার করে থাকে না। মানবিক সত্তার গভীরতম অঞ্চলের বহিঃপ্রকাশ, মানবিক যোগাযোগ, সম্পর্ক, ছোট বড় আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি কথাই সাহিত্যের সিংহভাগ জুড়ে থাকে। শ্রেণিবিশ্লেষণ, লেখকের রাজনৈতিক অবস্থান নন্দনতাত্ত্বিক বিচারের একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে তা অবশ্যই জরুরী কিন্তু সর্বক্ষেত্রে অপরিহার্য নয়। এঙ্গেলসের মতে, বালজাক তার নিজের শ্রেণি-সহানুভূতি আর রাজনৈতিক সংস্কারগুলোর বিরুদ্ধে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, তার প্রিয় অভিজাতদের পতনের অনিবার্যতা এবং ভবিষ্যতের সাচ্চা মানুষদের তিনি দেখেছিলেন, লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এখান থেকে এঙ্গেলস সিদ্ধান্ত টানেন, একেই আমি মনে করি বাস্তববাদের মহত্তম জয়গুলির একটি আর বৃদ্ধ বালজাকের সবচেয়ে চমৎকার দিকগুলি একটি। (3)
বালজাক প্রসঙ্গে এঙ্গেলসের সম্পূর্ণ বক্তব্যটির অনেকটাই হল এইরকম,

“আপনি একখানা বিশুদ্ধ সমাজতান্ত্রিক উপন্যাস লেখেননি বলে, গ্রন্থকারের নিজস্ব সামাজিক ও রাজনৈতিক মতামত কে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে আমরা জার্মানরা যাকে বলি Tenden-Zroman— তা রচনা করেননি বলে, আপনার দোষ ধরা থেকে আমি কিন্তু অনেক দূরে। আমার বক্তব্য আদৌ সেরকম নয়। রচনা-কর্তার মতামত যত বেশি প্রচ্ছন্ন থাকে, শিল্পকৃতির পক্ষে ততই ভালো। আমি যে বাস্তবতার কথা বলছি তা এমন কি রচনা-কর্তার মতামত সত্ত্বেও, বেড়িয়ে আসতে পারে। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক।
বালজাক যাকে আমি মান্য করি অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালের সমস্ত সমস্ত জোলার চেয়ে বাস্তববাদের ঢের মহত্তর প্রবক্তা বলে, তিনি তাঁর Comedie Humaine-এ- আমাদের দিয়েছেন ফরাসি সমাজের এক অতি আশ্চর্যজনক বাস্তববাদী ইতিহাস যেখানে তিনি বর্ণনা করেছেন, কালানুক্রম অনুসারে, ১৮১৬ থেকে ১৮৪৮ অব্দি প্রায় বছরের পর বছর ধরে অভিজাতবর্গের সমাজের ওপরে বুর্জোয়া শ্রেণির ক্রমবর্ধমান চাপ— যে সমাজ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিল ১৮১৫ সালের পরে এবং যতদূর তা পেরেছিল আবার তুলে ধরেছিল পুরনো ফরাসি আদব কায়দার মানে। তিনি সেখানে বর্ণনা করেছেন কেমন করে এই আদর্শ (তাঁর কাছে) সমাজের অবশেষগুলি ক্রমে ক্রমে লুপ্ত হয়ে গেল ইতর, টাকাওয়ালা হঠাৎ বড়লোকের প্রাদুরভাবের ফলে কিংবা হল তার দ্বারা দুর্নীতি দুষ্টু।… আর কেন্দ্রীয় চিত্রটিকে ঘিরে তিনি বিন্যস্ত করেছেন ফরাসি সমাজের একটি সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত যা থেকে এমনকি অর্থনীতির বিস্তারিত ক্ষেত্রেও (যেমন ফরাসি বিপ্লবের পরে অস্থাবর ব্যক্তিগত সম্পত্তির পুনরবন্টন) আমি যা শিখেছি তা সেকালের সমস্ত পেশাদার, ঐতিহাসিক, অর্থনীতিবিদ ও পরিসংখ্যানবিদদের কাছ থেকে মোট যা শিখেছি— তার চেয়েও বেশি।
আচ্ছা, বালজাক ছিলেন রাজতন্ত্রের সমর্থক, তাঁর মহান গ্রন্থটি হচ্ছে পুরনো মঙ্গলময় সমাজের অপ্রতিবিধেয় অবক্ষয়ের একটি নিরবিচ্ছিন্ন অন্ত্যষ্ঠী সংগীত। তার সহানুভূতি হচ্ছে সেই শ্রেণীর প্রতি যার অবসান অবধারিত। কিন্তু এসব সত্বেও, যখন তিনি বর্ণনা করেন ঠিক সেই সব নরনারীকেই, অভিজাতবর্গকেই, যাদের প্রতি তিনি গভীর সহানুভূতি সম্পন্ন, তখনকার চেয়ে আর কখনো তার ব্যঙ্গ হয় না এত তীক্ষ্ণ, তাঁর শ্লেষ এত তীব্র… বালজাক যে এইভাবে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁর শ্রেণিগত সহানুভূতি ও রাজনৈতিক সংস্কারের বিরুদ্ধে যেতে, তিনি যে দেখতে পেয়েছিলেন তার প্রীতিভাজন অভিজাতবর্গের পতনের আবশ্যিকতা এবং তাদের বর্ণনা করেছিলেন এমন লোক হিসেবে যারা এর চেয়ে ভালো কোন ভবিতব্যের উপযুক্ত নয়। তিনি যে দেখতে পেয়েছিলেন ভবিষ্যতের আসল মানুষদের যখন, তৎকালীন সময়ের জন্য, কেবলমাত্র তাদেরই দেখা যাবে— একেই আমি বিবেচনা করি বালজাকের বাস্তবতার মহোত্তম বিজয়সমূহের মধ্যে অন্যতম এবং বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে অন্যতম বলে।” (4)

বালজাক প্রসঙ্গে এঙ্গেলসের আগেই এই একই কথা অন্যভাবে বলেছিলেন এমিল জোলা। ১৮৮১ সালে তিনি লিখেছিলেন, এটা খুব আশ্চর্যের যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার সমর্থক হয়েও বালজাকের প্রতিভা ছিল একান্তই গণতান্ত্রিক আর মানুষ সবচেয়ে বিপ্লবী যে রচনা পড়তে পারেন তাই লিখেছিলেন বালজাক। ১৮৭০ সালে জোলা দাবি করেছিলেন,
বালজাক আমাদের: রাজতন্ত্রী ও ক্যাথলিক বালজাক কাজ করেছিলেন সাধারণতন্ত্রের পক্ষে, ভবিষ্যতের স্বাধীন সমাজ ও ধর্মগুলির পক্ষে।“ ১৮৮১-৮২ জোলার অন্যান্য লেখায় একই সুরে বলছেন,
চান বা না চান বালজাক পক্ষ নিয়েছিলেন রাজার বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষে ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের পক্ষে।
প্রকৃতিবাদ (লে নাতুরালিজম) প্রসঙ্গে জোলা লেখেন, প্রকাশ্যে বালজাক ক্যাথলিক ও রাজতন্ত্রী মতামত ঘোষণা করলেও, তাঁর কাজ কিন্তু ‘ব্যাপক অর্থে বৈজ্ঞানিক ও গণতান্ত্রিক’। (5)
দেখার মত বিষয়টি হল, লেখকের, ব্যাপক অর্থে শিল্পীর, ব্যক্তিগত মতামত রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা রচনার পেছনে তার অভিপ্রায়(intention) এগুলি তার সৃষ্টির মধ্যে আয়নার ছবির মত প্রতিফলিত হবেই এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। শিল্পীর মনোগত ভাবনা, বিশেষ করে তিনি যা প্রকাশ করতে চান তার শিল্পকর্মে সেটি ধরা পড়বে এমনটাই তো হওয়া উচিত। কিন্তু এটা হল সম্পূর্ণ যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। বাস্তবে অভিপ্রায়কে ছাড়িয়ে যায় অভিকৃতি(performance) এমনকি বিপরীত দিকেও এর যাত্রা হতে পারে। এখানেই দ্বান্দ্বিকতার গুরুত্ব। এই প্রসঙ্গে এঙ্গেলস যে ব্যাখ্যাটি দিয়েছিলেন জোলার লেখাতে তা কিন্তু পাওয়া যায় না। অভিপ্রায় অভিকৃতির বিরোধ সম্পর্কে তাঁরা সচেতন হলেও এঙ্গেলসই প্রথম এই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। এঙ্গেলসের ব্যাখায়, বাস্তববাদ এমনই জিনিস যার টানে বাস্তব অবস্থার নিখুঁত উপস্থাপনা অনিবার্য হয়ে ওঠে। ফলে লেখক এর অভিপ্রায় পেছনে পড়ে যায়, সামনে এসে দাঁড়ায় যা ঘটে তাই।
এখানে প্রাসঙ্গিক বিষয়টি হল, শিল্পীর শ্রেণিচরিত্র, তাঁর ব্যক্তিগত মতামত বা সচেতন অভিপ্রায় দিয়ে তাঁর সৃষ্টিকে বিচার করার পদ্ধতি একেবারেই অমার্কসীয়। ভাষার মতোই কথা-ছাড়া সংযোগের ক্ষেত্রেও তার মূল উপাদানগুলি যেমন রং, রেখা, সুর ইত্যাদি হল সর্বজনীন, সেগুলির কোন শ্রেণি চরিত্র নেই। বিষয়নিষ্ঠার অবস্থান মার্কসীয় দর্শনের একেবারে কেন্দ্রে। (6)
মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব প্রসঙ্গে এঙ্গেলসের বেশকিছু চিঠিপত্র ছাড়াও লেনিনের একটি রচনাও প্রাসঙ্গিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লেনিন বলছেন,
আজ সাহিত্য যা প্রকাশিত হয়, এমনকি বৈধভাবেও, তা হতে পারে নয়-দশমাংশ পার্টি সাহিত্য একে অবশ্যই হতে হবে পার্টি সাহিত্য। বুর্জোয়া রাজনীতি থেকে, মুনাফা সন্ধানী বাণিজ্যকৃত বুর্জোয়া প্রকাশনা থেকে, বুর্জোয়া সাহিত্যিক সুলভ ক্যারিয়ারবাদ ও ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রবাদ থেকে, ‘ অভিজাতান্ত্রিক নৈরাজ্যবাদ’ এবং মুনাফা অর্জনের তাড়না থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে সমাজতান্ত্রিক প্রলেতারিয়েত শ্রেণিকে অবশ্যই তুলে ধরতে হবে পার্টি সাহিত্যের নীতি, বিকশিত করে তুলতে হবে এই নীতিটিকে এবং যথাসম্ভব সম্পূর্ণ ও সর্বাঙ্গীনভাবে তাকে রূপায়িত করতে হবে প্রয়োগ ক্ষেত্রে।… সাহিত্য হতে পারেনা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে ধনবান করার একটা উপায়, বস্তুতপক্ষে তা হতে পারে না প্রলেতারিয়েত শ্রেণির অভিন্ন আদর্শ থেকে নিরপেক্ষ একটি ব্যক্তিক উদ্যোগ। নিপাত যাক অপক্ষপাতী( non-partisan) লেখকেরা। নিপাত যাক সাহিত্যিক অতি মানবেরা! সাহিত্যকে অবশ্যই হতে হবে প্রলেতারিয়েত শ্রেণির অভিন্ন ভাবাদর্শের অংশ, সমগ্র শ্রমিক শ্রেণির সমগ্র রাজনীতি-সচেতন অগ্রবাহিনীর দ্বারা গতি সঞ্চারিত একটি একক বিরাট সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক যন্ত্রের ‘নাট ও বল্টু’। সাহিত্যকে হতে হবে সংগঠিত, পরিকল্পিত, সুসংহত সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-কর্মসূচির একটি উপাদান। (7)
লেনিনের এই বক্তব্যকে মাথায় রেখে জর্জ স্টাইনার রাশিয়ায় স্টালিনের সময়ে লুকাচের সাহিত্য সমালোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন,

“Joseph Revai, the Hungarian Zhdanov, launched the assault on Lukács in 1950. In a pamphlet entitled Literature and Popular Democracy, he asks: What could Hungarian literature gain from the pass-word given it by Lukács in 1954: “Zola? No, Balzac!”? And what could it gain from the slogan put forward by Lukács in 1948: “Neither Pirandello nor Priestley, but Shakespeare and Molière”? In both instances—nothing.
Lukács’ concentration on Balzac and Goethe, suggests Revai, is dangerously obsolete… It is Lukács’ merit that he has set out to do the whole job. He fully realizes that a Marxist aesthetic must be a cogent, integral part of a total Marxist world-view and analysis of human behavior. Otherwise Marxist criticism will remain an aggregate of partisan or ideological polemic, local insights, and borrowed jargon.” (8)

এখানে স্পষ্ট যে লেলিনের বক্তব্যকে জর্জ স্টাইনার সামগ্রিকভাবে সৃজনমূলক সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে ব্যাখ্যা করেছেন যা বস্তুত পার্টি সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য বলা হয়েছিল। এ কথা লেখার সময় বলশেভিক পাটি ধীরে ধীরে এক জনগণের সংগঠন হয়ে উঠেছিল এবং তখন তার প্রয়োজন ছিল কঠিন অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার। তাই লেনিন উপন্যাসের কথা ভেবে নয়, পার্টির তাত্ত্বিক লেখার কথা ভেবে এ মন্তব্য করেছিলেন।

মোদ্দা কথাটা হলো, সেই সময় মার্কস এঙ্গেলসের হাতে একটি পূর্ণাঙ্গ নন্দনতত্ত্ব গড়ে তোলা ছাড়াও অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও পরিকল্পনা ছিল। সে কারণেই শিল্প সাহিত্যের ওপরে তাঁদের মন্তব্যগুলি ছড়ানো ছেটানো ও আংশিক পরিণত একটি তত্ত্বের বদলে সেগুলি বরং অনুষঙ্গ হিসেবেই এসেছে। ফলত, মার্কসীয় সমালোচনার অর্থ কেবলমাত্র মার্কসবাদের প্রতিষ্ঠাতাদের বক্তব্যকে পুনরাবৃত্তি করাই নয় তার দায়িত্ব স্বভাবতই আরও অনেক বেশি। মার্কসীয় সমালোচনা কেবলমাত্র একটা ‘সাহিত্যের সমাজতত্ত্ব’ নয়, যা কী করে উপন্যাস প্রকাশিত হয় এবং সেগুলিতে শ্রমিক শ্রেণির উল্লেখ আছে কিনা সেসব আলোচনা করে। সাহিত্যকর্মকে আরও পূর্ণাঙ্গভাবে ব্যাখ্যা করাই তার লক্ষ্য, এবং তার জন্যই তো আঙ্গিক, শৈলী এবং টেক্সটের অর্থের প্রতি আরও সচেতন মনোনিবেশ দাবি করে। মার্কস লিখেছিলেন,
তাদের জীবনের সামাজিক উৎপাদনে লোকে কতক নির্দিষ্ট সম্পর্কের মধ্যে ঢোকে যেগুলি অপরিহার্য আর তাদের ইচ্ছা নিরপেক্ষ, ( এগুলি হলো ) উৎপাদনে নানা সম্পর্ক যেগুলি মানুষের বাস্তব উৎপাদক শক্তিগুলির বিকাশের এক নির্দিষ্ট পর্যায়ের সঙ্গে মেলে।… লোকের চেতনা তাদের সত্তাকে নির্ধারণ করে দেয় না বরং উল্টোদিকে তাদের সামাজিক তাদের চেতনাকে নির্ধারণ করে।… ঠিক যেমন কোন ব্যক্তি সম্পর্কে আমাদের ধারণা তিনি নিজের সম্পর্কে কী ভাবেন তার উপর দাঁড়িয়ে থাকে না তেমনি রূপান্তরের কোন পর্বকে তার নিজের চেতনা দিয়ে আমরা বিচার করতে পারি না।“ (9)
মার্কস এঙ্গেলস তাঁদের সাহিত্যিক মন্তব্যে স্পষ্ট রাজনৈতিক মতসম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন, সে কথা কখনোই প্রায় বলেননি। মার্কসের প্রিয় লেখকরা যেমন ইস্কাইলাস শেক্সপিয়ার, গোয়েটে, বালজাক কেউই বিপ্লবী ছিলেন না এবং সমাজ বদলে দেওয়ার লক্ষ্যে তাঁরা সাহিত্য সৃষ্টি করেননি। ‘রাইনিস ৎসাইটুং’ পত্রিকায় প্রেসের স্বাধীনতা সম্পর্কে প্রথম দিকের এক রচনায় মার্কস উদ্দেশ্য সাধনের উপায় হিসেবে সাহিত্যকে দেখার উপযোগিতার সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিকে আক্রমণ করে বলেছিলেন,
একজন লেখক তার রচনাকে কোন উদ্দেশ্য সাধনের উপায় হিসেবে দেখেন না। তারা নিজেরাই চরম উদ্দেশ্য। তারা তার নিজের এবং অন্যদের জন্য উপায় হিসেবে এতই অক্ষম যে তিনি প্রয়োজন হলে বরং তাদের অস্তিত্বের জন্য নিজের অস্তিত্বকে ত্যাগ করতে পারেন। (10)
শিল্প এক অর্থে নিজেই একটি লক্ষ্য এই ভাবনা মার্কসের পরিণত লেখাতেও বেরিয়ে আসে। ‘থিওরিজ অব স্যারপ্লাস ভ্যালু’-তে মার্কস বলছেন,
একটি গুটিপোকা যে কারণে রেশম বনে চলে সেই একই কারণে মিল্টন প্যারাডাইস লস লিখেছিলেন এটা তাঁর পক্ষে একটা স্বাভাবিক কর্ম।(11)
এই ভাবনাই মার্কস এঙ্গেলসকে বালজাকের মত একজন সচেতনভাবে প্রতিক্রিয়াশীল লেখকের লেখাকে প্রশংসা করতে সমর্থ্ করে। প্রকাশ্যে একজন লেজিটিমিস্ট হয়েও বালজাকের রচনার গভীরে রয়েছে তাঁর তিক্ততম রাজনৈতিক শত্রু অর্থাৎ রিপাবলিকানদের প্রতি এক সুস্পষ্ট মুগ্ধতা। একটি রচনার বিষয়ীগত অভিপ্রায় ও বিষয়গত তাৎপর্যের মধ্যের পার্থক্য, এই ‘দ্বন্দ্বের নীতি’-ই পরবর্তীকালে ধ্বনিত হয়েছে তলস্তয়ের ওপর লেনিনের লেখায় এবং লুকাচকৃত ওয়ালটার স্কটের সমালোচনায়।
আমাদের সর্বান্তকরণে বুঝে নিতে হবে, সূক্ষ্ম ও গভীর দৃষ্টিশক্তি ছিল বলেই প্রতিক্রিয়াশীল ভাবনা আগলে রেখে গোষ্পদে বিশাল আকাশ ধরার অতিমানবীয় কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন বালজাক ‘হিউম্যান কমেডি’-র আড়াই হাজার চরিত্রের মধ্যে দিয়ে। শুধু মার্কস এঙ্গেলস নন তাঁদের সমসাময়িক আরও একজন সাহিত্যের অতিমানব প্রভাবিত হয়েছিলেন বালজাকের সাহিত্য প্রতিভায়। পিটর্সবুর্গের রাজপথে একলা ক্লান্ত অবসন্ন চোখে জনতার গতিবিধি দেখার সময় তিনি ভাবতেন বালজাকের কথা, কী নির্মম অভাবের সঙ্গে যুঝেই না বালজাক তাঁর অমর রচনাগুলি সৃষ্টি করেছেন! দেশকাল অতিক্রম করে তাঁর চরিত্রগুলি কী অবলীলায় না বিশ্ব মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে! তিনিও একদিন সেইরকম কিছু লিখবেন। অন্যমনস্ক মনে হাঁটতে হাঁটতে এই কথাই ভেবেছিলেন ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তইয়েভ্‌স্কি।

তথ্যসূত্র:

  1. THE HUMAN COMEDY, Selected Stories, HONORÉ DE BALZAC, Edited and with an introduction by PETER BROOKS, Translated from the French by LINDA ASHER CAROL COSMAN and JORDAN STUMP, NEW YORK REVIEW BOOKS, New York, 2014, Page-1(Introduction)
  2. মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব ১, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা – ৯০
  3. ঐ, পৃষ্ঠা – ১০১
  4. শিল্প ও সাহিত্য প্রসঙ্গে: মার্কস থেকে মাও, পীযূষ দাশগুপ্ত, বাণী প্রকাশ, পৃষ্ঠা – ৫৫
  5. মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব ১, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা- ১০২
  6. ঐ, পৃষ্ঠা- ১০8
  7. শিল্প ও সাহিত্য প্রসঙ্গে: মার্কস থেকে মাও, পীযূষ দাশগুপ্ত, বাণী প্রকাশ, পৃষ্ঠা- ১০০-০১
  8. Language and Silence, Essays on Language, Literature, and the Inhuman George Steiner (chapter 0n ‘Marxism and Literary Critic’, page 14)
  9. On Literature and Art, Karl Marx and Frederick Engels, Moscow Progress Publishers, 1976, page 42-43
  10. মার্কসবাদ ও সাহিত্য সমালোচনা, টেরী ঈগলটন, ভাষান্তর নিরঞ্জন গোস্বামী, দীপায়ন, ২০০১, পৃষ্ঠা ৭১
শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *