সুবিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর পাঁচটি কবিতা
হৈমন্তিকা
তুমি বললে শরৎ
আসলে হেমন্ত এখন।
বাতাসে কান পাতো।
শুনবে পাতা খসে পড়ার আওয়াজ।
যেমন পুরনো বাড়ির গা থেকে পলেস্তারা যত।
মানুষের চেনা ক্যামোফ্লেজ প্রয়াস।
আয়ু -১
কুয়াশায় ভরে গেল মাঠ
তুমি বললে হাঁটো।
হাঁটতে হাঁটতে গাছ।
নীচ থেকে ওপরে তাকিয়ে দেখলাম গাছ।
আমি ওপর থেকে নীচে দেখলাম গাছ।
চণ্ডী মণ্ডপের মাঠ।
ফেলে আসা ফুরনো বাজির প্যাকেট
উড়ে যাচ্ছে হাওয়ায় হাওয়ায়
ও প্যাকেট যেও না…
বলতে বলতে ধরে নিল মেয়ে।
আমার হারানো দূরবিন খুঁজে পেল মেয়ে।
কুয়াশার মাঠে বসে এবার সে খেলা শুরু করল।
আমি হাসতে হাসতে দেখলাম,
তার মাথায় নরম চুলে হাত রাখলাম
আর একটা খালি প্যাকেট হয়ে গেলাম।
এবার নিজেই উড়তে শুরু করলাম হাওয়ায়।
আয়ু -২
মৃত্যু বলল চল।
আমি ঘড়ি খুলে রাখলাম।
সমস্ত মৃত ঘড়িদের শব সাজিয়ে দিলাম
একে একে তার পায়ের কাছে।
ফেভার লিউবা, অরিস, আংলো সুইস, সিকোসা।
সে বলল কেন?
বললাম যেমন জীবিত মানুষের কব্জিতে মৃত ঘড়ি মানায় না,
তেমনই মৃত মানুষের কব্জিতে জীবিত।
একথা বলতেই আশ্চর্য
সে দৌড়ে গিয়ে কিছু কলম নিয়ে এল।
আমি বললাম এগুলো কার!
সে বলল মৃত কবিদের।
কিন্তু কালি তো দিব্যি পড়ছে এখনও,
কই শুকিয়ে যায়নি তো।
তবে কে লিখছিল এতদিন এতে!
মৃত্যু অধোবদন রইল কিছুক্ষণ
তার পর খুব ধীরে বলল
বড্ড ভুল হয়ে গেছে।
শূন্য
গড়িয়ে গেল শূন্য পাহাড়ের ঢালে
আর পিছু পিছু ছুটলেন আর্যভট্ট!
ভেবেছিলাম এই অব্দি বলে থেমে যাব,
কিন্তু স্বপ্নে সে জায়মান শূন্য
জ্বলে উঠল, তার গা থেকে
ঠিকরে বেরোতে শুরু করল নীল আলো।
সেই আলোর বল ক্রমাগত
লাফাতে লাফাতে গড়িয়ে গড়িয়ে
নামতে শুরু করল।
এ গাছ থেকে সে গাছের ফাঁক গলে।
দেখলাম গাছেরা পুড়ে যাচ্ছে, ধোঁয়া উঠছে
ঘাস পুড়ে যাচ্ছে স্থানে স্থানে কালো হয়ে।
গ্রামের মানুষ নীচ থেকে দেখে ভাবল
পাহাড়ে বুঝি আগুন লেগেছে,
নয়তো কোনো বিরাট তারা
নেমে পড়ছে আকাশ থেকে।
তারা ভয় পেল, তারা আনন্দিত হল,
তারা বুঝে উঠতে পারল না
এ ঈশ্বরের আশীর্বাদ না দানবের অভিশাপ!
শুধু কেউ যা জানতেও পারল না
(আমি স্বপ্নে দেখলাম)
নিজেরই বানানো নীল আগুনকে
যা আদতে শূন্য
জাপটে ধরতে গিয়ে
গণিতজ্ঞ পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন
পাহাড়ের অনেকটা ওপরে।
অস্পষ্ট চকের দাগ
বছরের এ সময় কবিতা লেখার জন্য ভালো।
রোদ নরম থাকে, চামড়ার সূক্ষ্মতম ফুটোও পরিষ্কার ধরা পড়ে।
তাছাড়া নরম আলোয়, ছায়াও নরম হয়।
নরম ছায়া বড় উপকারী।
সে তার ভেতরে তৈরি করে আরও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাঁজ, গতিপথ, হারিয়ে যেতে বসা তিল, ডুবো পাহাড়ের মতো গজ দাঁত, ইগনিয়াস ক্রেটারের টোল।
জাতীয়সড়ক যেমন মেশে রাজ্যসড়ক,
শহরের প্রধান রাস্তা হয়ে পাড়ার গলিতে।
প্রতিটা কানা গলির শেষ বাড়ির খিড়কি দরজার গায়ে হালকা হয়ে আসা সেলস ম্যানের
চকের দাগ পর্যন্ত তুলতে না পারলে
তুমি কী ছবি তুললে প্রিয়ংবদা!