জয় – রেহান কৌশিক

শেয়ার করুন

শান্ত সকাল। তার মন-ভালো-করা রোদের আঙুল ছুঁয়ে দিচ্ছে ‘ওটা’ নদীর জল। ‘ওটা’ কি হেসে উঠল মৃদু? রিনরিন শব্দে বেজে উঠল তার জল-নূপুর। ‘ওটা’র তীরে দাঁড়ানো সার-সার মেপল গাছেরা কিন্তু মাথা দোলাচ্ছিল তখন। সামুদ্রিক নীলচে হাওয়ার সমবেত ভাবে ছড় টানছিল তারা।
রূপকথার গল্পে পক্ষীরাজের সন্ধান মেলে। যার মস্ত দু’টো ডানা মেঘ ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে চলে রাজপুত্রকে পিঠে নিয়ে তেপান্তরের দিকে।
এখানে পক্ষীরাজ নয়, একটা বিমান। যার প্রপেলার হাওয়া ভেঙে ভেঙে উড়িয়ে এনেছিল শান্ত এই দ্বীপের আকাশে। যার পিঠে নয়, পেটের ভিতর ছিল ‘লিটল বয়’। ১০ ফুট লম্বা ৪৪০০ কেজি ওজনের ‘ছোট্ট বালক’ ঝাঁপ দিয়েছিল মাটির ওপর, আর…
একটা নিমেষ, একটা মুহূর্ত। একটা পলকমাত্র। সমুদ্রের নীল-জলের বুকে ভেসে থাকা হিরোসিমার অর্কেস্ট্রায় জেগে ওঠা সকালের কনসার্ট স্তব্ধ হয়ে গেল মুহূর্তের ভগ্নাংশে!
নাহ, সেদিন সুনামি আছড়ে পড়েনি মাটিতে। উড়ে আসেনি আগ্নেয়গিরির জলন্ত লাভাও, তবুও ওই একটা নিমেষ। একটা মুহূর্ত। একটা পলক। তছনছ করে দিল শহরের সকাল। মানুষের শ্রম আর স্বপ্নের গড়া ভাস্কর্য, আশি হাজার মানুষের হৃদস্পব্দন!
কে শিশু? কে মহিলা? কে পুরুষ? কে শিল্পী? কে সাহিত্যিক? কে গায়ক? কে কৃষক? কে প্রযুক্তিবিদ? কে সাফাইওয়ালা? কে ডাক্তার? কে ব্যান্ডমাষ্টার? চিহ্ন নেই, আর কোনও আলাদা সংকেত থাকলো না শনাক্ত করার!
হাজার হাজার মানুষের রক্ত-মাংস-হাড় কালো রঙের বাষ্প হয়ে যে মুহূর্তে মিশে যাচ্ছিল এশিয়ার আকাশে, যে-মুহূর্তে পরমাণুর তেজষ্ক্রিয় কণায় নীল হচ্ছিল মাটির অভ্যন্তরে থাকা মেপলের সমস্ত শেকড়, সেই মুহূর্তে কি দক্ষিণের জানালা দিয়ে ঢুকে আসা বিশুদ্ধ বাতাস নিজের ফুসফুসে টেনে নিচ্ছিল সাদা-বাড়ির সেই দৈত্য? গোড়ালি-ডোবানো লাল-কার্পেটের ওপড় দিয়ে হেঁটে এসে নকশাদার সিংহাসনে বসে হোয়াইট হাউসের সেই প্রভু হ্যারি এস. ট্রুম্যান উদযাপন করছিলেন নিজের জয়?
কত দিনের প্রতীক্ষা! কত দিনের অপেক্ষা! কত অর্থ আর শ্রমের সেই ম্যানহাটন প্রকল্পের পরিকল্পনাজাত ফসল দৈত্যের হাতে তুলে দিয়েছিল ওপেনহাইমার। তার পরীক্ষা হয়ে গেল!
পার হল তিন দিন। আবার, আবার.. আবার আকাশ থেকে নেমে এল আরও এক মৃত্যুর দূত। এবার ‘লিটল বয়’ নয়, ‘ফ্যাট ম্যান’। ৪৬৭০ কেজি ওজন, ১২৮ ইঞ্চি লম্বা, ৬০ ইঞ্চি ব্যাসের মোটা মানুষ নেমে এল নাগাসাকির ওপর!
গন-মৃত্যুর স্বরে থমকে গিয়েছিল সমুদ্রের জল। স্থির হয়ে মেঘ আর বাতাসের দেহ। নিশ্চুপ হয়েছিল রৌদ্রছায়ার মুখ…
দৈত্য সেদিন জয়ী। ট্রুম্যানের উদ্ধত আঙুল বলেছিল, ‘আত্মসমর্পণ কর’।
হ্যাঁ, মাথা নিচু করে কুর্নিশ জানাতে বাধ্য হয়েছিল জাপানের মানুষ।
জয়ী চিরকাল চায় শর্তহীন আত্মসমর্পণ। জয়ী চায় চির-আনুগত্য। জয়ী চায় বিরোধী-শূন্য অখন্ড অবসর। এমন জয়ই চেয়েছিল আলেকজান্ডার নেপোলিয়ন হিটলার মুসোলিনী। চেয়েছিল, তাদের জয়ের স্মারক হবে অস্ত্র-শক্তির নির্মম ক্ষমতায় নির্মিত। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস তা অনুমোদন করেনি। তাদের সমস্ত স্বপ্নের স্মারক ঢাকা পড়ে গেছে অন্ধকারে।
প্রকৃত পক্ষে, এইগুলি কোনওটাই জয় ছিল না। ছিল দখল। জয় আর দখলের ফারাক বিস্তর। ভালবাসা দিয়ে হৃদয়ের জয় সম্ভব। মানবিকতাই মানুষের মন জয়ের প্রধান উপাদান। কিন্তু এইগুলি সমস্তই ছিল অস্ত্র-নির্ভর মাটির দখল। আর মাটির দখল কোনওদিন স্থায়ী হয় না। দখলের ব্যুহ ভেঙে দিতে সময় নিজেই রচনা করে আগুনের কণা। প্রতিরোধের সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয় স্বাধীনতাকামী মানুষের অন্তর্গতে। মানুষ ডাক দেয় দ্রোহের। দ্রোহ ফিরিয়ে আনে মুক্তির দিন।
মানবিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কোনও দখল স্থায়িত্ব পায় না। দখলের তখত ভেঙে লুটিয়ে পড়ে ধুলোর ওপর। আর সেই ধ্বংসস্তুপের ওপর শুরু হয় নতুন মুক্তির অঙ্কুরোদ্গম। সময়ের সত্য মিশে যায় বিশ্বসত্যের সঙ্গে। আর বিশ্ব-সত্য কোনওদিন ধ্বংস আর হত্যার উৎসবে বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করে সুস্থিত জীবনের শান্ত উদবোধনে। প্রকৃত জয় জেগে থাকে এই উদবোধনে, মানবিকতার প্রকৃত প্রকাশে।

*ওটা: হিরোশিমা দ্বীপের একটি নদীর নাম।

শেয়ার করুন

Similar Posts

4 Comments

  1. বিশ্বাস করে সুস্থিত জীবনের শান্ত উদবোধনে। প্রকৃত জয় জেগে থাকে এই উদবোধনে, মানবিকতার প্রকৃত প্রকাশে।
    Khub bhalo laglo. I respect you and your ” Rachna” , philosophy for peace in the world…I support peaceful world..best regards.. Rehan Bhalo thakbe

  2. রেহান আমায় বারবার বিস্মিত করে।এবারও সে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটল না। ভালো থেকো,রেহান।
    সন্ধ্যা মাসি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *