করোনাকালে গ্রামই বদল জীবনের আশ্রয় – দীপক সাহা
লোকাল ট্রেন চলাচলের দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। নিত্যযাত্রীদের দাবি রাজ্য সরকার ও রেল দপ্তর স্বাস্থ্যবিধিমালাকে মান্যতা দিয়ে অতি দ্রুত লোকাল ট্রেন চালু করুক। এ ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত সোশ্যাল মিডিয়ায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিদিন শিয়ালদহ ডিভিশনে প্রায় ১২ লক্ষ ও হাওড়া ডিভিশনে প্রায় ১০ লক্ষ নিত্যযাত্রী যাতায়াত করেন। বাস্তবিকই দীর্ঘদিন লোকাল ট্রেন বন্ধ হবার জন্য বহু মানুষ নানাবিধ অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। তাদের রুজিরোজগারের পথ হুমকির মুখে। সেক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে লোকাল ট্রেন চালুর পক্ষে জনমত গড়ে ওঠা স্বাভাবিক।
গ্রাম থেকে শহরমুখি জীবনযাপনের প্রতীক হচ্ছে লোকাল ট্রেন। লোকাল ট্রেনে নিত্যদিন নাকেমুখে কোনরকমে কিছু গুঁজে দিয়ে বাদুড় ঝোলা হয়ে যাতায়াত–প্রতিদিনের চিত্র। নিত্যকার রোজনামচায় বেঁচে থাকার জন্য অদম্য লড়াই, সকাল থেকে রাত্রি। এখন এই লড়াইয়ের অভিমুখ যদি ঘুরিয়ে দেওয়া যায়, অর্থাৎ রুজিরোজগার বা উন্নত পরিষেবা বা উন্নত জীবনযাপন যদি গ্রামকেন্দ্রিক হয় তাহলে এই বিপুল জনস্রোতের কিছু অংশ শহরমুখি হবে না। লোকাল ট্রেনেও ভিড়ে ঠাসাঠাসি হয়ে জন্তু-জানোয়ারের মতো চলাচলও করতে হবে না। তখন লোকাল ট্রেনেও সোশ্যাল ডিস্টান্সিং মানা সম্ভব হবে। গ্রামের অর্থনৈতিক ভিত্তি আরও মজবুত করলে আপামর জনগণের সার্বিক জীবন ব্যবস্থাই পালটে যাবে। লোকাল ট্রেনে যাতায়াত সহ অন্যান্য অনেক সমস্যার সমাধানের সূত্রলেখা গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতা সংস্কৃতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে।
শহরে ভোগ-বিলাসী জীবনযাপনের প্রধান উপাদানগুলো থেকে শুরু করে জীবনধারণের অন্যতম উপাদানগুলোর উৎসই হচ্ছে আমাদের গ্রাম। সেই গ্রামকে অবহেলা করে, গ্রামের উন্নয়নকে উপেক্ষা করে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমরা কথায় কথায় গ্রামকে ভালোবাসার কথা বললেও সত্যিকার অর্থে কতখানি ভালোবাসি? মুখে মুখে গ্রামীণ বা কৃষকের উন্নয়নের কথা বলা হলেও প্রকৃত অর্থে কতখানি উন্নয়ন চাই কৃষকের তার প্রমাণ মেলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর আচরণে। বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, ডিশ বিল, ইন্টারনেট বিল, মোবাইল ফোনের বিল, নিত্য ব্যবহার্য পণ্য, চায়নিজ খাবার, বিলাসদ্রব্য, শিক্ষা আর চিকিৎসা খরচ বাড়লে সবই যেন আমাদের সয়ে যায়। শুধু কৃষকের উৎপাদিত পণ্য ধান, চাল, সবজি, মাছ, মাংস, ফলমূলের দাম বাড়লে বাজারে, ঘরে আর আমাদের বিলাসী শহুরে মানসিকতায় আগুন জ্বলে! কৃষকের সমস্যার প্রতিবাদী কণ্ঠ গ্রামের খেতে খামারে উঠলেও খালি পায়ে মাইলের পর মাইল পথ অতিক্রম করে শহরের রাজপথে কংক্রিটের জঙ্গলে এসে প্রদর্শন করতে হয় মিডিয়া ও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য।
প্রজাদরদি জমিদার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বাস করতেন, গ্রামীণ উন্নয়নের ওপর সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভরশীল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুঝতে পেরেছিলেন, বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্য কৃষিকে বহুমুখী করার কোনো বিকল্প নেই। তাই তিনি কীভাবে কৃষককে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করা যায়, উৎপাদন বাড়াতে কীভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো যায়, কৃষকদের সন্তানকে কী করে শিক্ষা দেওয়া যায়–এসব নিয়ে ভেবেছেন এবং কাজ করেছেন। তিনি নোবেল পুরস্কারের অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন কৃষি ব্যাংক। কৃষির উন্নয়নের জন্য তিনি নিজের সন্তান, জামাতা এবং বন্ধুপুত্রকে অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজে না পাঠিয়ে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঠান। তার মানে, উচ্চশিক্ষায় উন্নত ভদ্রলোক হওয়ার চেয়ে উন্নত কৃষক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা তিনি বহু আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
কৃষিভিত্তিক শিক্ষা বা উচ্চশিক্ষাকে খাটো করে দেখার দিন শেষ হয়ে গেছে আগেই। এখন কৃষি বলতে শুধু ধান বা ফসল ফলানোকে বোঝায় না; কৃষি এখন বহুমাত্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্র। এখনই সময় গ্রামীণ উন্নয়নকে জোরদার করে কৃষি এবং কৃষকদেরকে সামগ্রিক উন্নয়নের মূল স্রোতে নিয়ে আসা। কেন-না, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গ্রামীণ বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আরো প্রাণচঞ্চল করার জন্য বিনিয়োগের বিকল্প নেই। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের গ্রাম্য এলাকায় নিয়ে যেতে হবে। তাদের বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। গ্রামের মানুষকে উপেক্ষা করে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। ক্রমাগত উপেক্ষার কারণে কৃষকদের মাঝে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। কৃষকরা যথাসময়ে ভর্তুকি, সার, বিষ, তেল, উন্নত বীজ, সেচ সুবিধা, ফসল ঘরে তোলার গ্যারান্টি এবং ন্যায্য মূল্য পায় না। নদীর ভাঙনের ফলে ঘরবাড়ি বিলীন হয়। কৃষক এবং দেশের খাদ্যের জন্য বিরাট হুমকি এটা জেনেও যথাসময়ে এবং স্থায়ী পরিকল্পনায় বাঁধ নির্মাণ করা হয় না। এসব সমস্যার সমাধানে দ্রুত, স্থায়ী এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
গ্রামের উন্নয়নের জন্য দরকার গ্রামের মানুষের কর্মসংস্থান। আমাদের একেকটি গ্রাম একেকটি সম্ভাবনার ক্ষেত্র। এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩১ শতাংশ শহরবাসী। অবশিষ্ট ৬৯ শতাংশ এখনও গ্রামে বাস করে। কিন্তু জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখার ক্ষেত্রে বৈষম্য অনেক। আমাদের দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় শহরকে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেভাবে গ্রামকে কখনোই গুরুত্ব দেওয়া হয় না। গ্রামকে উপেক্ষা করে কখনোই দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়—এই চিরন্তন সত্যকে এড়িয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে না।
আশার কথা হচ্ছে, গ্রামেও এখন অর্থপ্রবাহ বেড়েছে। গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, সৌরবিদ্যুৎ, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট প্রভৃতি সুবিধা ক্রমেই বদলে দিচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতির চেহারা। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এখন গ্রামীণ অর্থনীতিতে পেশা বাছাইয়ে বহুমুখিতা সৃষ্টি হয়েছে।
আমাদের শহুরে জীবনের অধিকাংশ উপভোগ্যই গ্রাম থেকে আসে। তাহলে গ্রামের কৃষকদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারলেই সার্বিকভাবে দেশের উন্নয়ন ঘটবে। সেক্ষেত্রে গ্রামীণ অর্থপ্রবাহ ও উন্নয়ন অগ্রসরে সরকারের আরো সুনজর প্রয়োজন। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পাশাপাশি বিনামূল্যে প্রদানকৃত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার দিকে আরও বেশি নজর দেওয়া প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিপুল সংখ্যক যুবক থাকা উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি বিরাট সুযোগ। যুব সমাজই উন্নয়নের চাবিকাঠি। আমাদের যুব সমাজের অধিকাংশের অবস্থান গ্রামাঞ্চলে। সেই যুব সম্প্রদায়ের একটা বৃহৎ অংশ অর্থাৎ পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যাকে সমাধান করতে হলে তাদের মেধা ও শ্রমকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলেই খুলে যাবে উন্নয়নের দুয়ার। এখন প্রয়োজন, গ্রামের যুবসমাজ যেন কাজের খোঁজে শহরমুখি না হয়ে, জমি বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে বিদেশে না গিয়ে নিজের গ্রামে থেকে কৃষি এবং কৃষিভিত্তিক উৎপাদন তৎপরতায় জড়িত হয়। আর এজন্য তাদের সামনে এসব ক্ষেত্রের সাফল্যের সম্ভাবনাগুলোর তথ্য তুলে ধরতে হবে। তরুণদের উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজে লাগাতে হবে। তাহলে তরুণরা চাকরিনির্ভর না হয়ে আত্মকর্মসংস্থান-মূলক প্রকল্প স্থাপনে আগ্রহী হয়ে উঠবে।
আধুনিক সভ্যতার সামগ্রিক রক্ত সঞ্চালন একমুখী শহরকেন্দ্রিক করে গ্রামকে অবহেলার খাতায় নথিভুক্ত করলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যহত হবেই। কারণ ভারতীয় সভ্যতার প্রাণভোমরা হচ্ছে কৃষিভিত্তিক গ্রাম। গ্রাম্য এলাকায়, অন্তত জেলা পর্যায়ে শিল্প-কারখানা-গার্মেন্ট-কুটিরশিল্প স্থাপনে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। বেসরকারি উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে জমি, ব্যাংক লোন, পরামর্শ এবং প্রশাসনিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামীণ বিনিয়োগ বাড়লেই ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এলাকায় কাজ পেলে মানুষ আর শহরমুখি হবে না। শহরে মানুষের অযাচিত চাপ কমবে।
গান্ধিজী কৃষিপ্রধান ভারতের উন্নয়নের স্বার্থে গ্রামকে নতুনভাবে গঠন করার উপর জোর দিয়েছিলেন। গান্ধিজীর আদর্শ গ্রামগুলি হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। করোনা আবহে গান্ধিজীর আদর্শকে নতুন আঙ্গিকে বাস্তবায়িত করার সময় এসেছে। শুধু নগরকেন্দ্রিক নয় গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতা-সংস্কৃতির দিকে আমাদের এবার আন্তরিকভাবে নজর দিতে হবে। করোনাকালে এই শিক্ষা ও তার বাস্তবমুখী প্রয়োগ আমাদের মর্মে মর্মে গ্রহণ করার সময় এসেছে। আগামী ভোরে নগরায়ন নয় গ্রামই হোক বদল জীবনের আশ্রয়।