জোঁক – অমিতাভ গুপ্ত
প্রশ্ন উঠতেই পারে, কেন সারাজীবনের কবিতাপ্রয়াসে বারবার সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতা প্রসঙ্গ ঘুরে ঘুরে এসেছে। প্রশ্নটি অনিবার্য হলেও উত্তর অত্যন্ত সহজ। মার্কসবাদী চেতনাসম্পন্ন যে-কোনো ব্যক্তি স্বভাবত বিরোধিতা করেন সাম্প্রদায়িকতার। এবং তার সাহিত্য-শিল্পের উদ্যোগে ও জীবনচর্চায় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বারবার উচ্চারিত হওয়াই প্রত্যাশিত। একজন মার্কসবাদী শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেন। এই স্বপ্নটি যে সত্য, এই স্বপ্ন যে বাস্তবসম্মত তা শ্রেণী সমাজের আবির্ভাবের আগে—ঐতিহাসিক বিচারে কুড়ি হাজার বছর আগে এবং অন্তত অর্ধ লক্ষ বছর ধরে মানুষের যৌথ জীবনযাপনের কালে—প্রমাণিত হয়েছিল। দাসযুগ, পুরোহিততন্ত্র, রাজতন্ত্র, সামন্ত যুগ ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণী সমাজের সমস্ত বিষ সমন্বিত করে এই যে–বুর্জোয়া যুগ, তারও বিদায়লগ্নে বিশ শতকে সোভিয়েতে, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, চীনে, কিউবায় সাম্যবাদ স্ফুরিত হয়েছে। পূর্ণ বিকশিত হয়নি কেননা বিশ্ববিপ্লবের উদ্যোগ এখনও আগামীদিনের চেতনায় স্পন্দিত হয়ে চলেছে। তবে এইটুকু প্রমাণিত হয়েছে যে সম্প্রদায়বিভাজনহীন ভাবে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে এবং সে বাঁচাটাই সুস্থভাবে বাঁচা। দেহে-মনে-চিন্তায়-ভাবনায় অসুস্থ ভাবে, বিকল ভাবে যারা বেঁচে থাকতে চায়, শ্রেণী সমাজকে আঁকড়ে ধরে স্থিতাবস্থাকে আঁকড়ে ধরেই তাদের বেঁচে থাকতে হয়, অবশ্য সেটাকে যদি ‘বেঁচে থাকা’ বলে।
এই ক্লিন্ন জীবনের সংকীর্ণতা পার হয়ে সত্যসুন্দর সাম্যজীবনের স্বপ্ন ভারতবর্ষও দেখেছে বারবার। বারবার তার স্বপ্ন দলিত হয়েছে, পিষ্ট হয়েছে চতুর চক্রান্তের পায়ের নীচে। চক্রান্তের একটি প্রকাশ সাম্প্রদায়িকতা। বহুজাতিক, বহু ধর্মবোধক মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন করা খুব কঠিন নয়, কিন্তু এই বিভাজন নিতান্ত কৃত্রিম। সমগ্র মানুষ, একটিই জাতি। বিজ্ঞানের প্রত্যেক শাখা সেকথা প্রমাণ করে। অন্যদিকে, ধর্মকে যদি অধ্যাত্মচিন্তার পথ বলে মান্য করা হয় তাহলে বোঝা যায় ধর্মীয় বিভাজন বলে কিছু হতে পারে না।
তবু বিভিন্ন কুযুক্তি ও মূর্খতার দ্বারা এই বিভাজনবাদের সৃষ্টি করেছে শ্রেণী সমাজের স্বার্থান্বেষীরা। এই বিভাজনবাদের অন্যতম বিস্তার ঘটেছে সাম্প্রদায়িকতায়। বিশ শতকের শেষার্ধ থেকে একুশ শতকের প্রথম দুটি দশক দেখে চলেছে এই সাম্প্রদায়িকতার পোস্টমডার্ন চেহারা। মডার্নিস্ট সাম্প্রদায়িকতাবাদ, যা তাত্ত্বিক চেহারা পেয়েছিল ১৯০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, হাই অ্যাথলিকান চার্চের প্রচারে, মোটামুটি তৎপর ছিল সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে সক্রিয় হওয়ার জন্যই। নব্য উপনিবেশবিস্তারে সত্তানির্ভর এই তৎপরতা কার্যকর হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে লেনিনের বক্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। কিন্তু পোস্টমডার্ন সাম্প্রদায়িকতাবাদ বুর্জোয়া শ্রেণীর অধিকতর স্বার্থরক্ষার কাজে ব্যবহৃত হতে শুরু করল। ধর্মীয় বিভাজনবাদের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ মাত্রায় ফিরে এল জাতপাতের বিচার, নিম্নবর্গের ও দলিতদের উপর অত্যাচার, কৃষিজীবি এবং সর্বপ্রকার শ্রমিকদের সর্বনাশসাধনের বিভিন্ন বিচিত্র কূটপন্থা আবিষ্কার, হিংসার, সন্ত্রাসের, অসহিষ্ণুতার রাজনীতি। এই জোঁক যখন রক্ত শোষণ করতে শুরু করে, তখন হয়তো টের পাওয়া যায় না। ধীরে ধীরে এই জোঁক সবটুকু রক্তই শুষে নিতে চায়।
‘জোঁক’ কথাটির তৎসম প্রতিশব্দ ‘জলৌকা’। ভাবা গিয়েছিল, ওই দর্পিত তবু অতিগোপন শোষককে একটি সুসজ্জিত নাম দেওয়াই ভালো। সেইসঙ্গে, একথা নিশ্চয়ই মনে হয়, জোঁক যতই শোষণ করুক, আমাদের আছে কবিতা, আমাদের কাছে ভালোবাসা:
“বুনো বেনো জলে হেঁটেছি অনেক। রক্ত শুনেছে জোঁক
তবু সেইসব ভ্রমণও ছিল উৎসাহব্যঞ্জকদিনের স্রোতে ও রাতের উজানে এখন মিথ্যাচারে
দোলে চোরাবালি ডানাভাঙা পাড়ে সন্ন্যাসে সংসারেরাঢ়ে সমতটে গৌড়ে বঙ্গে সূর্যাস্তের কাছে
প্রাণে অপ্রাণে মহাযাপনের রক্তে রাঙানো কাচেঝলসে উঠছে সাতের দশক। স্মৃতির প্রবঞ্চনা
আমার উপরে ধার্য যে করে সে আজ নিরঞ্জনাসোনালী দিনের কোরক প্রতিটি মেঘ এনেছিল ব’লে
রাতের বুকের দ্রুত অঙ্কুর, ভেবেছি, উঠবে জ্বলেসারাজীবনের মন্দির ভেঙে মস্জিদ ভেঙে ওরা
ছায়াবৃতার মিথ্যাচারিতা করেছে বর্ণচোরাফুটেছি ঝরেছি দেওয়ায় নেওয়ায় হিসেবে নিকেশে নিকষে
কখনো সোনায় স্ফটিকবোনায় অপরাবশ্যবশেকেবল একটি অম্লমধুর সত্য আত্মজারকে
লুকিয়েছি, তাকে ভালোবাসা বলে। নইলে সইবে আর কে?ভালোবাসা সব সহ্য করেছে। সব ক্ষয়ক্ষতিশোক
মিথ্যাচারের এপারে ওপারে জড়ানো জটিল জোঁকতুচ্ছ ক’রে সে ছুঁয়ে যেতে পারে সব অসীমের প্রান্ত
জলৌকা
থাক ডানাভাঙা চোরাবালি বুকে আঁকড়ে অবাক প্রান্তর”
নির্বাচিত কবিতাপ্রয়াস
আপনপাঠ