|

জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী) – অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ( পর্ব ১ )

শেয়ার করুন

জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল

(গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী)

মূল স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

আমার মা বাড়ি বিক্রির জন্য আমাকে তাঁর সঙ্গে যেতে বললেন। দূরের এক শহর, যেখানে পরিবারের সবাই থাকত, সেখান থেকে সেই সকালে বাররানকিয়ায় এসেছেন। কিন্তু আমাকে কোথায় পাওয়া যাবে সে ব্যাপারে তাঁর বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। এখানে-ওখানে পরিচিত মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করেছেন, তাঁরাই বলে দিয়েছেন ‘মুন্দো’ বইয়ের দোকানে বা তার ধারেকাছের কফিশপগুলোয় খোঁজ নিতে। দিনে অন্তত দুবার আমি সেখানে যেতাম, লেখক-বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। যিনি এই ঠিকানা দিয়েছিলেন তিনি আবার মাকে সতর্কও করে দিয়েছিলেন: ‘সাবধানে যাবেন, ওরা সবকটাই কিন্তু বদ্ধ পাগল।’ কাঁটায় কাঁটায় বারোটার সময় তিনি এলেন। সাজিয়ে রাখা বইয়ের টেবিলের মধ্যে দিয়ে পথ তৈরি করে, হালকা পদক্ষেপে এগিয়ে এলেন ঠিক আমার সামনে, তাকালেন আমার চোখের দিকে, অতীতের সুখের দিনগুলোর উজ্জ্বলতামাখা দুষ্টু হাসি তাঁর চোখে, আমি কিছু বলার আগেই তিনি বলে উঠলেন:

—আমি তোমার মা।

এমন একটা কিছু পরিবর্তন ঘটেছিল তাঁর মধ্যে যে প্রথম নজরে ঠিক চিনতে পারিনি। তাঁর বয়স তখন ৪৫। যে জীবনের প্রায় দশ বছর কাটিয়েছেন গর্ভাবস্থায়, এগারোটি সন্তানের জন্ম দিতে এবং অন্ততপক্ষে আরও অতগুলি বছর পার করেছেন তাদের মানুষ করতে। তাই সময়ের অনেক আগেই বার্ধক্য তাঁকে ছেয়ে ফেলেছে। বাই-ফোকাল চশমার পেছনে চোখদুটো যেন আরও বড়ো, আরও জ্বলজ্বলে। পরনে তাঁর মায়ের মৃত্যুর জন্য শোকের কালো পোশাক। তবুও কী আশ্চর্যভাবে বজায় রয়েছে তাঁর বিয়ের সময়ে তোলা সেই রোমান সৌন্দর্য; এখন প্রৌঢ়ত্বের আবহ তাকে আরও মহীয়ান করেছে। সবার আগে, এমনকি আমাকে আলিঙ্গন করারও আগে, যেমন ঘটা করে কথা বলা তাঁর স্বভাব, ঠিক তেমন ভাবেই বললেন:

—তোমার কাছে এসেছি এই কারণে যে বাড়িটা বিক্রির জন্য যদি আমার সঙ্গে একটু যেতে পারো।

কোন্ বাড়ি বা কোথাকার বাড়ি, তা উল্লেখের প্রয়োজন ছিল না। কেন-না বাড়ি বলতে গোটা পৃথিবীতে আমাদের কাছে একটি বাড়িরই অস্তিত্ব ছিল—আরাকাতাকায় দাদামশাইয়ের সেই পুরোনো বাড়ি, যেখানে জন্ম নেওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল এবং আট বছর বয়সের পর আর কখনও সেখানে গিয়ে থাকিনি। ল-এর ছ’টা সেমিস্টার শেষ করার পরে তখন সবেমাত্র কলেজ ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণ ডুবে আছি বইয়ের জগতে। হাতে যা আসে তাই পড়ি আর স্পেনের স্বর্ণযুগের অবিস্মরণীয় সব কবিতা মুখস্ত আওড়াই। উপন্যাসের কলাকৌশল শেখার জন্য যত বই দরকার ছিল তার সবই বোধহয় পড়া হয়ে গিয়েছিল, অনুবাদে আর অন্যের কাছ থেকে চেয়ে এনে। ইতিমধ্যে খবরের কাগজের ক্রোড়পত্রে আমার ছ’টি গল্প ছাপা হয়েছিল। বন্ধুরা প্রচুর উৎসাহ দিত, এমনকি কয়েকজন সমালোচকেরও নজর কেড়েছিল। ঠিক তার পরের মাসে আমার তেইশ বছর পূর্ণ হবে, ফলে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার বয়স আর নেই। তাছাড়া এর মধ্যেই দুবার গণোরিয়ার অভিজ্ঞতা ঘটে গেছে শরীরে। সারা দিনে সিগারেট খেতাম ৬০ খানা, খুব বাজে কড়া তামাকের সিগারেট। আর অবসর কাটত কলোম্বিয়ার ক্যারিবীয় উপকূলে বাররানকিয়া ও কার্তাহেনা দে ইন্দিয়াসের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়ে। ‘এল এরালদো’ কাগজে প্রতিদিনই কিছু না কিছু লিখতাম, তাতে যা রোজগার হত, যাকে প্রায় কিছু নয় বললেই হয়, তাই দিয়ে কাটত আমার রাজার জীবন। রাতের বেলা যেখানে এসে পৌঁছোতাম, শ্রেষ্ঠ সঙ্গিনীটিকে খুঁজে নিয়ে কাটিয়ে দিতাম সেই রাত, সেখানেই। কিন্তু আমার সেই অনিশ্চিত ভবিষ্যত বা ব্যক্তিজীবনের অবিন্যস্ততা যেন যথেষ্ঠ ছিল না, তাই একদল অন্তরঙ্গ বন্ধু মিলে টাকা-পয়সার কোনও উৎস ছাড়াই একটা ব্যতিক্রমী পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা করলাম। আসলে তার আগের তিন বছর ধরে আলফোনসো ফুয়েনমাইয়োর এর স্বপ্ন দেখে চলেছিল। এর বেশি আর কী-ই বা চাওয়ার থাকতে পারে?

পছন্দের জন্য নয়, টাকা-পয়সার অভাবেই ঠিক করে নিয়েছিলাম কী হবে আমার আগামী কুড়ি বছরের স্টাইল: না-ছাঁটা গোঁফ, এলোমেলো চুল, জিন্সের প্যান্ট, ফুলছাপ শার্ট আর সস্তার চটি। একদিন এক সিনেমা হলে, পাশে আমি বসে আছি সেটা না জেনেই, সেই সময়ের এক বান্ধবী আরেকজনকে বলেছিল: ‘বেচারা গাবিতোটা১ একেবারে গোল্লায় গেছে।’ তাই মা যখন বাড়ি বিক্রির জন্য তাঁর সঙ্গে যেতে বললেন, তখন রাজি না হওয়ার মতো কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু মা জানালেন যে তাঁর কাছে খুব একটা বেশি টাকা নেই আর আমিও গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করে দিলাম, নিজের খরচ নিজেই করতে পারব।

কিন্তু সমস্যা হল, যে কাগজে কাজ করতাম সেখান থেকে কোনো টাকার ব্যবস্থা করা সম্ভব হল না। ওই কাগজে প্রতিদিনের লেখার জন্য আমাকে তিন পেসো করে দিত আর সম্পাদকীয় লেখার জন্য চার পেসো, অবশ্য যদি সম্পাদকদের মধ্যে কেউ লেখা দিতে না পারতেন তবেই এবং সে সৌভাগ্য খুব কমই ঘটত। ধার চাইতে ম্যানেজার পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন আমার আগের দেনাই পঞ্চাশ পেসো ছাড়িয়ে গেছে। সেই সন্ধ্যায় নিরুপায় আমি শেষ পর্যন্ত যে ভয়ংকর কাজটা করেছিলাম তা আমার আর কোনো বন্ধুই করতে সাহস পেত না। বইয়ের দোকানের পাশে ‘কলোম্বিয়া কাফে’ থেকে বেরনোর মুখে দেখা হল বৃদ্ধ কাতালান বই বিক্রেতা দোন রামোন বিনিয়েসের সঙ্গে। চাইলাম দশ পেসো, কিন্তু ওঁর কাছে ছিলই মাত্র ছ’ পেসো।

আমি বা আমার মা কেউই সেদিন ভাবতে পারিনি, পরের ওই দু’দিনের অতি সাধারণ এক যাত্রাপথ আমার জীবনের এত বড়ো নির্ধারক হয়ে উঠবে যে, অতি দীর্ঘ ও কঠোর পরিশ্রমের লেখক জীবনেও তার কথা বলে শেষ করে উঠতে পারব না। এখন, ৭৫ বছরেরও বেশি সময় পেছনে ফেলে এসে বুঝতে পারি, লেখাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। মানে বলতে চাইছি, আমার সমগ্র জীবনে।

কৈশোরের আগে পর্যন্ত স্মৃতির আগ্রহ থাকে অতীতে নয়, বরং ভবিষ্যতের কল্পনায়। তাই আমার সেই ছোট্ট শহরের স্মৃতিতে স্মৃতিকাতরতার স্থান ছিল না। তাকে মনে করতাম ঠিক যেমনটা সে ছিল: এক স্ফটিক জলের নদী, তলায় বিছানো প্রাগৈতিহাসিক ডিমের মতো বড়ো বড়ো, ঝকঝকে সাদা পাথর আর তার ধারে জীবন কাটানোর জন্য চমৎকার এক জায়গা, যেখানে সবাই সবাইকে চেনে। সন্ধেবেলায়, বিশেষত ডিসেম্বর মাসে, যখন বর্ষা শেষ হয় আর বাতাস ফিরে আসে হীরকদ্যুতির উজ্জ্বলতায়, সান্তা মার্তার নেবাদা পাহাড় তার বরফসাদা চুড়োগুলো নিয়ে যেন নেমে আসে নদীর ওই পারের কলাখেতের প্রান্তে। সেখান থেকে দেখা যায় পাহাড়ের খাড়াই বেয়ে পিঁপড়ের সারির মতো এগিয়ে চলেছে আরুয়াকো২ আদিবাসীর দল, পিঠে তাদের আদার বস্তা আর একমনে চিবোচ্ছে কোকো গাছের পাতা—তাদের জীবনানন্দের উৎস। তখন আমরা ছোটোরা কল্পনা করতাম ওই অবিরাম ঝরে পড়া বরফ দিয়ে গোলা বানিয়ে তাপদগ্ধ রাস্তায় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলব। কেন-না গরমটা এতই অস্বাভাবিক ছিল, বিশেষত সিয়েস্তার৩ সময়, যে বড়োরা সারাক্ষণ বিরক্ত হত, যেন বা সেটা ছিল প্রতিদিনের একটা চমক। জন্মাবধি লোককে বলতে শুনেছি, রেলের লাইন আর ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির ছাউনিগুলো তৈরি হয়েছিল রাতের বেলায়। কেন-না দিনের বেলায় রোদে তেতে ওঠা যন্ত্রপাতি হাত দিয়ে ধরাই যেত না।

বাররানকিয়া থেকে আরাকাতাকা যাওয়ার তখন একটাই উপায়—লজ্‌ঝড়ে এক মোটর লঞ্চ। তাতে করে প্রথমে যেতে হবে একটা সরু খালের মধ্যে দিয়ে। সেই কলোনির আমলে দাস শ্রমিকেরা তৈরি করেছিল এই খাল। তারপর নোংরা ও পাঁকে ভর্তি এক বিরাট বড়ো বিল পেরিয়ে পৌঁছোতে হবে রহস্যময় জনপদ সিয়েনাগায়। সেখান থেকে লোকাল ট্রেন। একসময় সেটাই ছিল দেশের শ্রেষ্ঠ রেলপথ। যাত্রার শেষাংশ পেরোতে হবে সেই ট্রেনে চেপে, যেতে যেতে পার হতে হবে অসংখ্য বিশালাকায় কলার খেত, কতবার যে অকারণে থামবে সেই ট্রেন, ধুলোময়, পরিত্যক্ত জনপদের পাশে, কিংবা জনহীন প্ল্যাটফর্মে। সেই পথেই সন্ধে সাতটার সময় শুরু হয়েছিল আমাদের যাত্রা, আমি আর মা, ১৯৫০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, শনিবারে–কার্নিভালের আগের দিন–অসময়ের তুমুল ঝড়বৃষ্টি আর বত্রিশ পেসো সঙ্গে নিয়ে। নির্ধারিত শর্ত অনুযায়ী যদি বাড়ি বিক্রি না হয়, তাহলে ফিরে আসা পর্যন্ত ওইকটা পেসোই সম্বল।

সে রাতের ঝোড়ো হাওয়া ছিল বড়োই উত্তাল। লঞ্চঘাটে দাঁড়িয়ে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তবে মাকে লঞ্চে ওঠাতে পেরেছিলাম। তাঁর ভয় অবশ্য অমূলক ছিল না। লঞ্চগুলো নিউ ওরলেয়ান্সের বাষ্পীয় পোতের ছোটো সংস্করণ। কিন্তু পেট্রোলের মোটরে চালানোর জন্য এমন ঝাঁকুনি দিত যেন মনে হত লঞ্চের সবকিছু প্রবল জ্বরে কাঁপছে। লঞ্চের মধ্যে একটা ছোট্ট ঘরের মতো জায়গায় বিভিন্ন উচ্চতায় হুক লাগানো ছিল হ্যামক টাঙানোর জন্য। আর কিছু কাঠের বেঞ্চ, তার উপরে গায়ে গায়ে ঠেসে কোনোমতে সবাই বসে আর তার সঙ্গে রয়েছে তাদের লটবহর, বেচা-কেনার জিনিস, মুরগির খাঁচা থেকে শুরু করে জ্যান্ত শুয়োর পর্যন্ত। কয়েকটা কেবিনও অবশ্য ছিল। খুপরির মতো দমবন্ধ করা সেই ঘরে দুটো করে সেনাবাহিনীর খাট পাতা। তবে সেগুলো প্রায় সবসময়ই একদল সস্তার বেশ্যা দখল করে রয়েছে, ওই দীর্ঘ যাত্রাপথে জরুরি পরিষেবার প্রয়োজনে। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত কোনো কেবিন খালি পেলাম না, আর হ্যামকও সঙ্গে নিয়ে যাইনি, তখন মাঝখানের বারান্দায় দুটো লোহার চেয়ার প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে দখল করলাম। তারপর আমি আর মা সেখানেই রাত কাটানোর প্রস্তুতি নিলাম।

মাগদালেনা নদী দিয়ে যাওয়ার সময় সত্যি হল মায়ের আশঙ্কা। নদী তখন মোহনার কাছে, তাই সমুদ্রের রূপ নিয়েছে। ঝড়ের ভয়ংকর ঝাপটা এসে পড়ছে আমাদের নড়বড়ে লঞ্চের গায়ে। লঞ্চঘাটেই আমি কিনে নিয়েছি বেশ খানিকটা কমদামি কালো তামাক আর অতি সস্তার সিগারেটের কাগজ, যা দিয়ে জিনিসপত্র মোড়ালেই ভালো হয় আর কী। সিগারেট খেতে শুরু করলাম, সেই সময়ের আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে, একটার আগুন থেকে পরেরটা ধরিয়ে। আর পড়ছিলাম উইলিয়াম ফকনারের ‘আগস্টের আলো’। ফকনারই তখন আমার মাথা বিগড়ে দেওয়া অভিভাবকদের মধ্যমণি। ওদিকে মা তাঁর জপের মালা আঁকড়ে বসে আছেন, যেন সেটা একটা লাটাই, ওটা দিয়ে আটকে রাখতে পারবেন একটা ট্র্যাক্টর কিংবা আকাশে ধরে রাখবেন একটা উড়োজাহাজ। আর প্রার্থনা করছেন, যেমনটা সবসময় করেন, তবে নিজের জন্য কিছু নয়, সবটাই তাঁর এগারোটি অপোগণ্ডের সুখ-সমৃদ্ধি ও দীর্ঘ জীবনের জন্য। নিশ্চয়ই তাঁর প্রার্থনা পৌঁছে গিয়েছিল যথাস্থানে। কেন-না খালে ঢোকার পর বৃষ্টি কমে এল, বাতাসও বিশেষ বইছিল না, তাই মশাও তাড়ানো যাচ্ছিল না। জপের মালা সরিয়ে রাখলেন মা। তারপর অনেকক্ষণ ধরে, সম্পূর্ণ নিশ্চুপভাবে, দেখে গেলেন তাঁর চারপাশে আবর্তিত জীবনের কোলাহল।

মা জন্মেছিলেন গরিবের ঘরে, কিন্তু বড়ো হয়েছিলেন কলা কোম্পানির জাঁকজমকের সময়। ফলত সান্তা মার্তার প্রেসেনতাসিয়োন দে লা সান্তিসিমা বিরহেন স্কুলে উন্নত লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। বড়োদিনের ছুটি কাটাতেন বন্ধুদের সঙ্গে এমব্রয়ডারিতে ফুল তুলে, চ্যারিটি বাজারে ক্ল্যাভিকর্ড বাজিয়ে অথবা মাঝে মাঝে যেতেন এলাকার অভিজাতদের ভদ্রসভ্য নাচের আসরে, সঙ্গে অবশ্য অভিভাবিকা হিসাবে থাকতেন এক পিসি। কিন্তু কেউই জানতে পারেনি তাঁর প্রেমিকের কথা, যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি বিয়ে করলেন ওই শহরেরই এক টেলিগ্রাফ কর্মীকে। এমনকি তাঁর বাবা-মায়েরও এ বিয়েতে মত ছিল না। সেই মুহূর্ত থেকে যে বৈশিষ্ট্য তাঁর মধ্যে প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছিল তা হল তাঁর রসবোধ এবং লোহার মতো মজবুত স্বাস্থ্য, দীর্ঘ জীবনের বহু প্রতিকূলতাও যাকে কখনও পরাভূত করতে পারেনি। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর আর অভাবনীয় ছিল নিজের প্রভূত শক্তিকে ঢেকে রাখবার বিশেষ দক্ষতা–সিংহ রাশির এক উৎকৃষ্ট জাতক। এই ক্ষমতা দিয়েই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এক মাতৃতান্ত্রিক শাসনের ব্যূহ, যা দিয়ে দূরতম আত্মীয়টিকেও প্রভাবিত করবার সামর্থ্য ছিল তাঁর। রান্নাঘর থেকেই তিনি পরিচালনা করতেন তাঁর এই সৌরজগত, বিনস সেদ্ধ করতে করতে, একেবারে মৃদুস্বরে, প্রায় চোখের পলক না ফেলেই।

সেদিনের সেই ভয়ংকর যাত্রায় তাঁর অবিচল মূর্তি দেখে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করেছিলাম, কী করে তিনি দারিদ্র্যের নিষ্ঠুরতাকে এত দ্রুত ও এমন দক্ষতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলেন। সেই সুকঠিন রাতের মতো আর কিছুই তাঁর এই সহ্য শক্তির পরীক্ষা নিতে পারত না। ঝাঁক ঝাঁক রক্তখেকো মশা, গুমোট গরম, লঞ্চের আঘাতে খালের গুলিয়ে ওঠা পাঁকের গা-বমি করা দুর্গন্ধ, বসার জায়গা না পাওয়া আর ঘুমোতে না পারা মানুষদের হৈ-হট্টগোল–এই সবকিছু মিলিয়ে একজন চূড়ান্ত স্থির মানুষেরও ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যেতে পারত। অথচ মা তাঁর চেয়ারে নিশ্চল হয়ে বসে সমস্তই সহ্য করে যাচ্ছেন। পাশের কেবিনগুলোয় তখন চলছে বেশ্যাদের কার্নিভাল, কেউ পরেছে ছেলেদের সাজ, কেউ বা মাদ্রিদের মেয়েদের সাজ। ওদের মধ্যে একজন তার কেবিন থেকে বার বার বেরোচ্ছে আর ঢুকছে, প্রতিবারই বদল হচ্ছে সঙ্গী। এই কেবিনটা আমার মায়ের চেয়ারের ঠিক পাশে। ভেবেছিলাম মা বোধহয় ব্যাপারটা ঠিক লক্ষ করেননি। কিন্তু একঘণ্টার মধ্যে মেয়েটি যখন বার পাঁচ-ছয় ঢুকলো আর বেরলো, মায়ের করুণ দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করল বারান্দার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত।

‘আহা, বেচারি!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা বললেন, ‘শুধু টিকে থাকার জন্য ওদের যা করতে হচ্ছে তা হাড়-ভাঙা খাটুনির চেয়েও বেশি কষ্টকর।’

এভাবেই পেরিয়ে গেল মাঝরাত। অসহ্য ঝাঁকুনি আর বারান্দার নিবু নিবু আলোয় পড়তে পড়তে আমি যখন ক্লান্ত, মায়ের পাশে বসে সিগারেট ধরালাম আর চেষ্টা করতে লাগলাম ইয়োকনোপাতোফার৪ চোরাবালি থেকে বেরিয়ে আসার। ঠিক তার আগের বছর বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছি। ভাবতাম সাংবাদিকতা আর সাহিত্য নিয়েই কাটিয়ে দেব জীবন। এমনকি সেগুলো শেখার প্রয়োজন আছে বলেও মনে করতাম না। তখন একটা কথায় খুব উদ্ধুদ্ধ হয়েছিলাম, মনে হয় বার্নাড শ-এর লেখাতেই পড়েছিলাম: ‘ছোটোবেলায় স্কুলে যাওয়ার জন্য আমার পড়াশুনায় বাধা পড়েছিল।’ যদিও কাউকে একথা বলতে পারিনি। কেন জানিনা, আমার মনে হত যে, আমার এই যুক্তির মূল্য আছে শুধু আমারই কাছে।


টীকা

১। গাবিতো: গার্সিয়া মার্কেসকে তাঁর বন্ধুরা ভালোবেসে গাবো বা গাবিতো বলে ডাকতেন।

১। আরুয়াকো: উত্তর কলোম্বিয়ার সিয়েররা নেবাদা পাহাড়ে বসবাসকারী আদিবাসী সম্প্রদায়; তাঁদের ভাষা চিবচান এবং তাঁরা কলম্বাস-পূর্ব সময়ের কলোম্বিয়ার তাইরোনা সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী।

২। সিয়েস্তা: দুপুরের ভাতঘুম

৩। ইয়োকনোপাতোফা: আমেরিকার লেখক উইলিয়াম ফকনারের উপন্যাসের একটি কল্পিত জনপদ, যার অবস্থান মিসিসিপি অঞ্চলে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

2 Comments

  1. পড়ছি। এর আগে ইংরাজি থেকে অনুবাদ পড়েছি। এবার স্প্যানিশ থেকে সরাসরি পড়ার সুযোগ। তা ছাড়া অসংখ্যবার পড়া যায় এই বই।

  2. কি চমৎকার সাবলীল এই অনুবাদ।তরতরিয়ে পড়া যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *