যে-বছর চের্নোবিল ( পর্ব ১১ ) – কুশাণ গুপ্ত

শেয়ার করুন

১১

মানিকপাড়া

প্রেক্ষাপট ও পরিপ্রেক্ষিত অনুধাবনের সুবিধার্থে খানিক স্বদেশভূমির পানে ফিরিয়া দেখি, হে পাঠক। দ্বিতীয় বামফ্রন্টের যে-বৎসর লইয়া এই আখ্যান লিখিত হইতেছে সেই বৎসরেই সুপ্রিম কোর্টে ঐতিহাসিক শাহ বানু মামলার নিষ্পত্তি হইয়া ভারতবর্ষের রাজনীতি তোলপাড় হইয়াছিল। এ ব্যতীত, অনেকের অগোচরে আরেকটি ঘটনা ঘটে যাহার গুরুত্ব তখনও কেউ সেভাবে উপলব্ধি করে নাই। পরের দশকেই ইহা লইয়া ভারতবর্ষের ভাগ্যাকাশে যুগান্তকারী উথালপাতাল ঘটিয়া যাইবে। ঘটনাটি হইল, একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ফৈজাবাদ জিলা-আদালতের নির্দেশে বাবরি মসজিদ নামক প্রাচীন একটি নির্মাণের ফটকের তালা দীর্ঘকাল পর খুলিয়া গিয়াছিল। বস্তুত, শাহ বানু মামলা এবং দ্বিতীয় ঘটনার মধ্যে ব্যবধান ছিল দুই সপ্তাহের।

পূজার ছুটি পড়িয়া গিয়াছিল। রবিবারের নাগাদ সাড়ে দশটায় হাসু ও নবা অধ্যাপক তমোনাশ চক্রবর্তীর বাসন্তীতলার বসার ঘরে বসিয়া ছিল। সেখানে মধ্যবয়সি আরেক ব্যক্তি বসিয়া ছিলেন। শার্ট-প্যান্ট পরিহিত কৃশকায় ব্যক্তির চোখে পুরু লেন্সের চশমা; তিনি, এবং সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির তমোনাশ কথা বলিতেছিলেন, হাসু ও নবা একটি অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের বই লইয়া পাতা উলটাইয়া রঙিন ছবিগুলি দেখিতেছিল।

বছর সাঁইত্রিশের তমোনাশ চক্রবর্তী সম্পর্কে দুই-এক কথা বলি। এই জিলাশহরের সকল পার্বণ ও লোক-কোলাহলের আড়ালে এক নম্র, পরিশীলিত ব্যক্তিত্ব বাস করিতেন, ছায়া-পড়া একটি শান্ত, শীর্ণ গলির লাগোয়া একটি একান্নবর্তী বাড়িতে। বাসন্তীতলা নামের এই রোগা গলিটি বড়বাজার হইতে ছোটবাজার এই দুই সমান্তরাল জনবহুল দুই রাস্তার বস্তুত লম্ব-দ্বিখন্ডক। তমোনাশ স্থানীয় কলেজের স্বনামধন্য অধ্যাপক, সাতের দশকের পরিচিত কবি ও প্রাবন্ধিক। এই কথা বলিলেই তমোনাশ সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না। তিনি একাধারে দেশীয় তথা স্থানিক লোকসংস্কৃতি ও অন্যদিকে পাশ্চাত্য সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির স্বীকৃত বোদ্ধা। কোনো কোনো ব্যক্তির কাছে তাঁহার নাম জিলা অতিক্রম করিয়া কলিকাতা অবধি প্রসারিত ছিল। তিনি ধীমান, সহৃদয় বুদ্ধিমত্তার চর্চায় নিবেদিতপ্রাণ। এছাড়াও আশ্চর্য তাঁহার বাসন্তীতলার বসার ঘরখানি। সেই ঘরে আসিয়া পড়িতেন লিটল ম্যাগের সম্পাদক, তরুণ লেখক, সংস্কৃতিকর্মী ও সর্বোপরি অজস্র তরুণ-তরুণী, যাহারা কলেজের ছাত্রছাত্রী। তমোনাশ নিজে পিএইচডি করেন নাই, অথচ পিএইচডির জটিল বিষয়ে ফাঁপরে পড়া কোনো কোনো গবেষক পরিত্রাণহেতু তাঁহার শরণাপন্ন হইতেন। এককথায় তমোনাশ স্থানিক ও কালিক অবস্থানে অগ্রসরমান এক দিকপুরুষ। অথচ তিনি আক্ষরিক অর্থেই প্রচারবিমুখ, প্ৰকৃত প্রতিষ্ঠানবিরোধী, নম্র এক মানুষ। তাঁহার ব্যক্তিত্বের দীপ্তিতে অন্যরকম স্বকীয়তা ছিল।

প্রশ্ন উঠিবে, জীবন সম্পর্কে কার্যত অসচেতন দুই প্রগলভ নবম শ্রেণীর কিশোর কীরূপে তমোনাশের নিকট বসিয়া থাকিবে? এক্ষণে নবা সম্পর্কে প্রাথমিক দুই-চার কথা বলিতে হয়।

নবা ওরফে নবদ্বীপ বাল্য হইতে নানাবিধ গ্রন্থ পড়িতে ভালোবাসিত। তাহার শৈশবের একাংশ মাতুলালয়ে কাটিত। গোপ টিলার রাস্তায় কাঁসাইয়ের কঙ্কাবতী ও নেপুরার ঘাট অতিক্রম করিয়া খালশিউলিগামী রাস্তার রাউতরাপুরে ছিল তাহার মামার বাড়ি। শৈশব হইতেই সে মাতুলালয়ের নির্জন কক্ষে বসিয়া নানাবিধ গ্রন্থে আসক্ত হয়। ক্রমশ বঙ্গভান্ডারের নানান পত্রপত্রিকা পড়িতে পড়িতে এই গ্রন্থকীট পাশাপাশি রুশ কিতাবের প্রতি সমাসক্ত হয়। পিতা উমাপদ বাড়িতে নানান রুশ বই ও পত্রপত্রিকা রাখিতেন। সেই সকল পড়িতে পড়িতে সে বাল্য হইতে নানাবিধ বালখিল্য ফ্যান্টাসি রচিতে অভ্যস্ত হয়। অস্ত্রভস্কি ও গোর্কি পড়িতে পড়িতে তাহার হৃদয় উদ্বেলিত হইয়া উঠিত। আর্কাদি গাইদারের লেখা ‘ইশকুল’ গ্রন্থটি দেবেন দাস তাহার দিদিকে কোনো এককালে জন্মদিনে উপহার দিয়াছিলেন। সেই চওড়া গ্রন্থটি পড়িতে পড়িতে বিপ্লব-স্পন্দিত বুকে সে নিজেকেই বরিস মনে করিত। নিরন্তর কল্পনার খামখেয়ালে নিজের শহরই ভুলবশত তাহার নিকট মনে হইত সুদূর সোভিয়েত ভূখণ্ডের আরজামাস।

একই ভাবে মাকারেঙ্কোর বুরুজে নিশান পড়িতে পড়িতে ইগর চরিত্রের সহিত তাহার হৃদয়ের ঘনিষ্ঠতা স্থাপিত হয়। সে সহপাঠী টোটনকে মনে করিত ‘ইশকুল’ গ্রন্থের ফেদকা, হাসুকে তিমকা এবং বুরুজে নিশানের আপেল খেতের মজুরানি অক্সানাকে খুঁজিয়া ফিরিত সমবয়সি কিশোরীর সৌন্দর্য-মধ্যে। এই পরিক্রমা চলিত বুকের ভিতরে, মনে হইত সেও বরিসের ন্যায় যুদ্ধে চলিয়া যাইবে একদিন, একদিন সে-ও মাকে সুদূরের স্টেশন হইতে চিঠি লিখিবে। সেদিন সে-ও কাঁদিবে না, এই মর্মে স্বরচিত ফ্যান্টাসি-আইল্যান্ডে অভিমানের কুয়াশায় তাহার দুই শপথ-আকুল চোখ একাকী দ্বিপ্রহরের চিলেকোঠায় সজল হইয়া উঠিত।

তমোনাশ একাধারে উমাপদর প্রথম প্রজন্মের স্কুলের ছাত্র, অপরপক্ষে উমাপদর স্ত্রী মানসীর কলেজের একদা ঘনিষ্ঠ সহপাঠী। এই দুই যোগাযোগের মধ্যে দ্বিতীয় কারণটিই সম্ভবত তমোনাশকে কখনও-কখনও তাহাদের বাড়িতে টানিয়া আনিত। বাল্য হইতেই নবা এবং তাহার দিদি রাণী মানসীর সূত্রেই তমোনাশকে চিনিত। নবা যখন সপ্তম শ্রেণীতে, একদিন তমোনাশ তাহাদের চিলেকোঠায় টেবিলে ডাঁই করা বই উলটাইতে উলটাইতে নবার সঙ্গে কথা বলিতেছিলেন।

কথাপ্রসঙ্গে তমোনাশ একটি বই দেখাইয়া বলিলেন, তুমি এই বইটা পড়েছ?

বইটির নাম ‘ইতালির রূপকথা’। নবা ইতিবাচক উত্তর দিল।

তমোনাশ পুনরায় শুধাইলেন, কোন্ গল্পটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে?

নবা বিকলাঙ্গ ভাই এবং দিদি ও তাহার প্রেমিকের গল্পের প্রসঙ্গ বলিল।

ইহার পরে আরেকটি বইয়ের দিকে তমোনাশের দৃষ্টি পড়িল। বইটি লুসুনের লেখা ‘আকিউ’। বইটি তাহার দিদি রাণী মাধ্যমিক পাশ করিয়া কোনো এক ছাত্র সংগঠনের হইতে পুরস্কার পাইয়াছিল।

বইটি লইয়া তমোনাশ বলিলেন, এই বইটা পড়েছ?

নবা ‘আকিউ’-এর গল্পও বলিতে লাগিল।

―বাব্বা! তুমি ‘আকিউ’ পড়েছ!

এই বলিয়াই তমোনাশ বলিলেন, তুমি আমাদের বাড়িতে আসবে। আমার কাছে কিছু বই আছে। তোমার পছন্দমতো বই নিয়ে যাবে।

তমোনাশের এই প্রস্তাবে নবা যেন হাতে চাঁদ পাইল। সে বইয়ের জন্য এখানে-সেখানে, যত্রতত্র হানা দিত। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য সহপাঠীদের বাড়ি, দিদির বন্ধু, দুই তিনটি লাইব্রেরি, তারক দাস ও অন্যান্য প্রতিবেশীদের বাড়ি। সে এক্ষণে নিয়মিত তমোনাশের গৃহে যাতায়াত শুরু করিল।

সে বাসন্তীতলায় প্রায় প্রতি মাসে অন্তত দুইবার যাইত। কখনও-কখনও প্রতি সপ্তাহে। তমোনাশের নিজস্ব বইয়ের সম্ভার কার্যত এক দুষ্প্রাপ্য লাইব্রেরির সমতুল। সাহিত্য, শিল্প, ইতিহাস, বিজ্ঞান―প্রায় সমস্ত বিষয়ে তাঁহার সংগ্রহ ছিল দেখিবার মতন। বস্তুত তমোনাশ তাঁহার সঞ্চয়ের প্রায় সমস্তই বইয়ের পিছনে উড়াইয়া দিতেন। নবা এক-একটি বই পড়িয়া ফেরত দেওয়ার সময় তমোনাশ বইটির পাঠ-প্রতিক্রিয়া নবার নিকট হইতে মন দিয়া শুনিতেন। ইহার পরে পুস্তক লইয়া আলোচনা চলিত। তৎসহ নানান প্রসঙ্গ আসিত।

একেক সময় অন্যান্য নানান সাক্ষাৎপ্রার্থী তমোনাশের কাছে আসিতেন। কেউ বিশেষ ঘনিষ্ঠ, কেউ বা নিতান্ত স্বারস্বত প্রয়োজনে। সমাজ, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি বিষয়ক নানাবিধ তাত্ত্বিক আলোচনা বাসন্তীতলার কক্ষে চলিত। এসকলের সামান্য কিছুই নবা বুঝিতে পারিত, মাথার উপর দিয়া বেশ কিছু চলিয়া যাইত। নবা ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকাইয়া থাকিত। তমোনাশের একটি স্বভাব ছিল। আলোচনা চলিতে চলিতে তমোনাশ তাঁহার লাইব্রেরি হইতে প্রয়োজনীয় রেফারেন্স বাহির করিয়া দেখাইতেন। এছাড়াও, তিনি প্রায় সকলকেই কমবেশি গুরুত্ব দিতেন। এমন অযাচিত প্রশ্রয় কিশোর নবাকে তমোনাশের প্রতি আকর্ষণ করিত। নবা অচিরেই তমোনাশের মেধার প্রতি অনুরক্ত হইয়া ওঠে।

হাসুও ইদানীং নবার সহিত তমোনাশের গৃহে হাজির হইত। তাহার মূল আকর্ষণ ছিল ছবি, তমোনাশ তাহার আগ্রহ জানিতে পারিয়া সম্প্রতি নন্দলাল বসুর একটি বই দিয়াছিলেন, যাহা দেখিয়া হাসু আঁকা মকশো করিত। শৌভিক বলিয়া এক তরুণ অবসাদগ্রস্ত শিল্পীর সঙ্গেও হাসুর আলাপ তমোনাশের কক্ষেই হয়। বস্তুত, হাসু ও নবার মাতুলালয় ও গৃহ, উভয়ই একই মিউন্সিপ্যালিটি ওয়ার্ডে, নেতাজি ক্লাবের অনতিদূরে একটি গলিতে। উভয়ের ভৌগোলিক নৈকট্য মানসিক নৈকট্যে ক্লাস সেভেন হইতেই রূপান্তরিত হয়। তাহারা পালবাড়ির মাঠে কিছুকাল বিকেলে খেলিত, কিছুকাল নতুনবাজার নেতাজি ক্লাবের সংলগ্ন মাঠে। ফলে অধুনা নবা তমোনাশের নিকট গেলে হাসুকেও ডাকিয়া লইত।

যেদিনের কথা উঠিল, যেদিন তমোনাশের বাড়িতে তাঁহারই সমবয়সি বন্ধুস্থানীয় সেই আগন্তুক বসিয়াছিলেন, সেদিনকার ঘটনা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, তাই বলিতেছি। কথা চলাকালীন অকস্মাৎ তমোনাশ বলিলেন, তোমাদের সঙ্গে ওর আলাপ করিয়ে দিই।

নবা ও হাসু এতক্ষণ বইয়ের ছবি উলটাইয়া দেখিতেছিল। উভয়েই মুখ তুলিল।

–ওর নাম সৌমিত্র দাস। ও আমার বন্ধু। মস্কোতে থাকে। ও বৈজ্ঞানিক। লেজার নিয়ে কাজ করে। আর এই নবা উমাপদবাবুর ছেলে। উমাপদবাবুকে তোমার নিশ্চয় মনে আছে, সৌমিত্র।

—মস্কো! —বলিয়াই নবা অভিভূত হইয়া ওই ব্যক্তির দিকে সসম্ভ্রম তাকাইল।

ভদ্রলোকের চাহনিতে বা শরীরি ভাষায় তেমন পরিবর্তন দেখা গেল না।

―নবা, সাম্প্রতিক সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে কিছু জানতে চাও তো বলো, এই বলিয়া তমোনাশ সামান্য চোখ তুলিলেন।

নবা বা হাসু কিছু বলিবার পূর্বেই ভদ্রলোক মুখ খুলিলেন―

বিশেষ কিছু বলার নেই। এককথায় সবহারার একনায়কতন্ত্র গোল্লায় গেছে।

নবা বা হাসু এই ঠাট্টার কিছু বুঝিতে পারিল না। ইহার পরে একটু থামিয়া সৌমিত্র মুখ খুলিলেন,

তমো, ক্রাইসিস দিনদিন বেড়ে চলেছে। মস্কোর রাস্তায় ব্ল্যাকার আর বেশ্যা, শুধু এই দুইয়ের ভিড়।

ভদ্রলোক বেশ্যা শব্দটা এত জোর দিয়া বলিলেন যে নবা এবং হাসু দুজনেই স্তম্ভিত হইয়া মুখ নামাইয়া লইল। হাসু একবার মুখ তুলিয়া মিনমিন করিয়া বলিল, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন তো সমাজতান্ত্রিক দেশ।

―সমাজতান্ত্রিক? ঘণ্টা! ―এই বলিয়া ভদ্রলোক দুই হাতে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে কাঁচকলার মুদ্রা আনিয়া নবার দিকে তুলিয়া ধরিলেন। পুরু লেন্সের ফাঁকে তাঁহার চোখদুটি জ্বলজ্বল করিতে লাগিল। নবা থতমত খাইয়া গেল।

―সাত সকালে প্রাভদা দিয়ে যায়। ডাস্টবিনে ফেলে দিই, বুঝলে তমো।

―রিফর্মের কথা শুনছি যে আজকাল, গর্বাচভ রিফর্মস আনছেন বুঝি? ―তমোনাশ বলিলেন।

―আরে ছাড়ো তো। রন্ধ্রে রন্ধ্রে আমলাতন্ত্র। সোভিয়েত ডুবে গেছে। আমি দেশে চাকরি খুঁজছি তমো। পালিয়ে আসতে পারলে বাঁচি।

সেদিন নবা হালকা মনমরা হইয়া ফিরিয়াছিল। হাসুও কম বিস্মিত হয় নাই। সোভিয়েত ইউনিয়ন পত্রিকায় কাস্পিয়ান হ্রদের তীরে সুখী কৃষকের যে ছবি সে দেখিয়াছিল তাহার সঙ্গে সৌমিত্র নামের আগন্তুক বৈজ্ঞানিকের বিবরণ আদৌ মেলে না। যদ্যপি কৈশোর সংশয় ও নৈরাশ্য মানে না, তদুপরি এক ধরনের অবিশ্বাস কিশোর মনে চকিতেই আসিয়াছিল। যদিও নবা ভাবিতেছিল, হয়তো বা ইহা কোনো প্রতিবিপ্লবীর বয়ান।

আনুমানিক দুই সপ্তাহ পরে আপনাদের অন্য এক দৃশ্যের নিকট লইয়া যাই, যেখানে এই কিশোরযুগলকে আবার দেখিতে পাইবেন। একটি রেললাইন পার করিয়া দুই কিশোর ঝোপ-জঙ্গল পরিকীর্ণ উঁচু একটি নির্জন জমির উপর হাঁটিতেছে, রুক্ষ মৃত্তিকায় ল্যাটেরাইটের তীব্র প্রভাব। অকুস্থলে আরও দুইজনকে দেখা যাইবে। প্রথমজন নবার মাসতুতো দাদা নন্তু। দ্বিতীয়জন এক সমবয়সি কিশোরী, যাহাকে দ্বিতীয় পরিচ্ছদে শাড়ি পরিহিতা ও নাকে নোলক পরা অবস্থায় পালবাড়ির মাঠে দেখা গিয়াছিল। এক্ষণে তাহার নাকে নোলক অন্তর্হিত, একটি উজ্জ্বল চুড়িদার পরিয়া টিয়া খানিক আগে আগে হাঁটিতেছিল, কিছু পিছনে হাসু। নন্তু ও নবা খানিক কৌণিক অবস্থানে অগ্রসর ছিল।

অদূরের ঝোপে কিছু ক্ষুদ্র কুলের ন্যায় ফল ফলিয়া আছে দেখিয়া হাসু বাহাদুরি করিল― মনে হয় বৈঁচি।

―ওটা বৈঁচি নয় মশায়। ওর নাম কানকুল। শীতকালে কালো হয়ে গাছ ভরে যায়। আমরা এখানে এসে তুলি। খাই। খুব মিষ্টি হয়।

―তুই কুল খেতে ভালোবাসিস খুব, না?

টিয়া এই কথার উত্তর করিল না। খানিক এগাইয়া একটা গাছের দিকে আঙুল বাড়াইল, এটা কী গাছ বল্ তো ?

―কী জানি? মহুয়া?

―হাঁদা! তার মানে তুই কুর্চিও চিনিস না, মহুয়াও চিনিস না।

অনতিদূরে দাঁড়ানো নন্তুদা একটা উঁচু গাছ দেখাইল, এই যে, এটা মহুয়া।

তাহারা সাইকেল লইয়া লালগেড়িয়া বাঁধ বেড়াতে গিয়াছিল। সেখানে কিছুক্ষণ কাটাইয়া ফিরিবার সময় টিয়া জঙ্গলে ঢুকিবার জন্য বায়না ধরিল। এই রাস্তাটি মানিকপাড়া হইতে বাঁশতলা অভিমুখে বাঁক লইয়া ঝাড়গ্রাম অভিমুখে গিয়াছে।

দুইদিন হইল হাসু নবার সহিত মানিকপাড়া আসিয়াছে। এই প্রথম তাহারা অভিভাবক ছাড়া শুধুমাত্র দুইজনে ট্রেন ধরিয়া কোথাও যাইল। ইহাতে নবা ও হাসু যুগপৎ গর্ববোধ করিয়াছিল। বাড়ির লোকজন প্রথমে আপত্তি জানাইলেও পরে রাজি হইয়া যায়।

ঝাড়গ্রাম-ঘনিষ্ঠ মানিকপাড়া অঞ্চল জিলার মধ্যে আরেকটি গ্রাম হইলেও ইহার এক বিশিষ্টতা ছিল। নবা পূর্বে বহুবার আসিলেও হাসুর নিকট মানিকপাড়া এক নতুন অভিজ্ঞতা। বস্তুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলাইকুন্ডা‌ এয়ার বেস হইতে কিছু দূরে ঝাড়গ্রাম হইতে উনিশ কিলোমিটার দূরে বালিভাসার নিকটবর্তী দুধকুন্ডিতে জঙ্গল কাটিয়া মার্কিন এয়ারফিল্ড তৈরি হয়। এই স্থান হইতে মার্কিন যুদ্ধবিমান জাপান, থাইল্যান্ড ও মায়ানমার অভিমুখে উড়িত। মানিকপাড়ার অনতিদূরে বেলতলায় মার্কিন সেনাব্যারাক তৈরি হয়। সেনাদিগের খাদ্য যোগানে নির্মিত হয় কিছু রাইস মিল। পরবর্তীকালে এই ব্যারাকগুলি পার্টিশনের পর রিফিউজি ক্যাম্পে রূপান্তরিত হয়। ক্যাম্পের প্রাচীন জলের ট্যাংকগুলি হাসু, নবা ও টিয়াকে লইয়া নন্তুদা দেখাইয়াছে। পার্টিশনের পরে পূর্ববঙ্গের কিছু মানুষ এই অঞ্চলে আসিয়া পড়েন ও স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। স্থানীয় মাহাতো সম্প্রদায়ের সহিত পূর্ববঙ্গীয়দের বসবাসহেতু এই অঞ্চলে এক মিশ্র-সংস্কৃতি জন্ম লইয়াছে। পূর্ববঙ্গ হইতে আগত মন্মথ বন্দ্যোপাধ্যায় সহ আরও কিছু শিক্ষকের উদ্যোগে মানিকপাড়ার বিদ্যালয়টি সুনাম অর্জন করে। টিয়ার বাবা এই স্কুলেই শিক্ষকতা করেন।

হাসুকে সর্বাধিক আকর্ষণ করিয়াছে লাল পাথুরে রাস্তার চারিদিকে ছোটো বেড়া ঘেরা ছিমছাম বাড়িগুলি ও অদূরবর্তী জঙ্গল। টিয়াদের বাড়ির সংলগ্ন বাগান, বিপরীতে তাহাদের নিকটতম প্রতিবেশী রাজাদের বাড়িতেও অনুরূপ একটি বেড়া ঘেরা বাগান, লাল মোরামের রাস্তার পাশে চমৎকার একটি ক্রীড়াযোগ্য মাঠ। বিকালে রাজা ডাকিয়া লইয়া যায়। ক্রিকেট খেলা হয়। সকাল হইতে দুপুর চারিপাশ ঘুরিয়া বেড়ায় তিনজন। কখনও-কখনও, বিশেষত অপেক্ষাকৃত দূরের জায়গাগুলিতে নন্তুদা সঙ্গ দেয়।

দুদিন ধরিয়া পাগলের ন্যায় বেড়াইতেছে দুজন। হাসুর উদ্দীপনা নবার চাইতেও বেশি। অধিকন্তু টিয়ার সান্নিধ্য হাসুর মধ্যে এক ধরনের ঘোর আনিয়া দিয়াছিল, যাহা সে সম্যক বুঝিতে অক্ষম। তথাপি মনে হইতেছিল অনিঃশেষ, অভাবিত এই ঋতু, যেন-বা চিরকালীন যাহার খোঁজ ছিল।
ঢাল ধরিয়া ফিরিবার সময় টিয়ার লাল ওড়না একটি ঝোপের ডালে আটকাইয়া গেল। পেছন হইতে হাসু বলিল, দাঁড়া একটু, বলিয়াই তাহার ওড়না দ্রুত ডালমুক্ত করিল।

রেল লাইন ক্রস করিয়া হাসু বলিল, নবা, এতক্ষণ তোকে ক্যারি করছি। তুই চালা একটু এবার।

বস্তুত, যাইবার সময় নন্তুদার সাইকেলে টিয়া বসিয়াছিল। নবা হাসুর সাইকেলের আরোহী হইয়াছিল। ফিরিবার বেশ কিছু পথেও ইহার ব্যত‍্যয় হয় নাই।

কিন্তু, নবা বাঁকিয়া বসিল। নন্তুদা ডাকিল, নবা, আমার সাইকেলে বসবি আয়।

নবা চুপচাপ নন্তুদার সাইকেলে বসিল।

টিয়া বলিল, হাসুদা, তুই সামনে বোস। আমি চালাচ্ছি।

ফোঁস করিয়া উঠিল বছর পনেরোর আহত পৌরুষ। মুহূর্তেই সে বলিয়া উঠিল, তুই সামনে বোস।

―কেন, তোর প্রেস্টিজ যাবে?―টিয়া ঈষৎ হাসিয়া শুধাইল।

―তুই আমার চেয়ে ছোটো।

―কী করে জানলি? তোর জন্মতারিখ বল।

―ও আমি জানি।

টিয়া ওড়নাখানি ভালো করিয়া পেঁচাইল। তাহার পরে নির্লিপ্ত মুখে আসিয়া সামনে বসিল। হাসু সাইকেল চালাইতে লাগিল। মিনিট দুইয়ের মধ্যে সে হাঁফাইতে লাগিল।

―হাঁফাচ্ছিস কেন এত? আস্তে চালা।

হাসু গতি কমাইল। এমন নৈকট্যে টিয়া বসিয়া আছে, অথচ কী স্বাভাবিকতা তাহার সমস্ত ভঙ্গিমায়… কিন্তু তাহার নিজের বুক অনবরত ঢিপঢিপ করিতেছে কেন? হাসু সতর্ক হইয়া চালাইতেছিল, যাহাতে সামান্যতম স্পর্শ, সামান্যতম চাঞ্চল্যও টিয়া টের পাইতে না পারে।

সন্ধ্যায় টিয়াদের বাড়ির দোতলায় বিছানায় হাসু ড্রইংয়ের স্কেচ খাতা বাহির করিয়া একটি ম্যাপ আঁকিতেছিল। অপর একটি তক্তপোষে শুইয়া নবা চারমূর্তি পড়িতেছিল। দুইটি মুড়ির বাটি আনিয়া টিয়া ঢুকিল। হাসু ও নবা কেউ মুখ তুলিল না।

টিয়া আসিয়া বলিল, মুড়ি-তেলেভাজা আছে। খেয়ে নে।

নবা হাত বাড়াইয়া লইল। কিন্তু হাসু মুখ তুলিল না।

টিয়া হাসুর নিকট দাঁড়াইল, কী আঁকছিস রে?

হাসু নিরুত্তর, আঁকিতে লাগিল।

―কীসের ম্যাপ এটা?

―বাংলার, হাসু সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়া আবার পেনসিল চালাইতে লাগিল।

―বললেই হবে! এটা বাংলার ম্যাপ?

―দ্যাখ পুরোটা।

―মুড়িটা খেয়ে নে।

―আর এক মিনিট দাঁড়া।

কার্যত এক মিনিটেরও কম সময়ে হাসু ম্যাপ শেষ করিল। বলিল, দ্যাখ এবার।

―এটা পশ্চিমবঙ্গের ম্যাপ?

―না। অবিভক্ত বাংলার। পার্টিশনের আগে।

―যা!

―বিশ্বাস হচ্ছে না? এবার দ্যাখ তবে।

হাসু ইহার পরে বর্ডার আঁকিতে লাগিল। আঁকিতে আঁকিতেই বাংলা দুই ভাগে বিভক্ত হইল। টিয়া একবার ড্রইং বুক লইল। ভালো করিয়া দেখিল। তাহার দুই চোখে মুগ্ধতা।

―আমাকে খাতাটা একটু দে। মাকে দেখাই।

ইহার পরে খাতাটি লইয়া সে পাতা উলটাইয়া দেখিতে লাগিল। হাসু মুড়িতে বাদাম মিশাইতে লাগিল।

অকস্মাৎ টিয়া খিলখিল করিয়া হাসিতে লাগিল, হাসিতে হাসিতেই বলিল, এটা কী এঁকেছিস রে?

হাসু তাকাইল। নবাও চোখ তুলিল।

এই ছবিটি এই বৎসর নবেন্দু স্যার স্কুলের পত্রিকার জন্য বিশেষ আগ্রহ সহকারে লইয়াছেন। চিত্রটিতে দুর্গা নোলক পরে ভেংচি কাটিতেছে। দুর্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতী প্রত্যেকের মুখের অবয়বে হাসু টিয়ার মুখ কল্পনা সহ মিশাইয়া দেয়। মহিষাসুর বাধ্য ছেলের ন্যায় নিজের কান ধরিয়া নীলডাউন হইয়া আছে। মহিষাসুরের মুখে সরখেলের অবয়ব মেশানো হইয়াছে। মহিষাসুর অপরাধীর ন্যায় কাতর ভঙ্গিমায়। কার্ত্তিক সেইদিকে আঙুল বাড়াইয়া ফিচেল হাসিতেছে। এককথায় চিত্রটি অভিনব, হাল্কা আমোদে ভরপুর।

টিয়া খাতাটি লইয়া দৌড়ে নীচে নামিয়া গেল।

রাতে খাইবার সময় মাসি বলিলেন, হাসু, তোর আঁকা দুর্গার মুখটা তো টিয়ার মতন। চোখদুটো তো অবিকল। তুই কি টিয়াকে আগে দেখেছিস?

হাসু এইরূপ অতর্কিত প্রশ্নের প্রত্যাশা করে নাই। ভাত মাখিতে মাখিতে স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে বলিল, না মানে দূর থেকে… পালবাড়ির মাঠে…

সেই রাতে হাসু কয়েকটি স্কেচ করিল। একটি স্কেচে জঙ্গলের গাছের ডাল ওড়না টানিয়া ধরিয়াছে একটি মেয়ের। মেয়েটি আপ্রাণ ঘুরিয়া দেখিতেছে। অপর স্কেচে লালগেড়িয়া বাঁধের দৃশ্যপট। নীচে মাছ ধরিতেছে একদল লোক। বাঁধের ওপর দাঁড়ানো দর্শক। প্রোফাইল ভিউতে টিয়া।

পরের দিন সকালে ভাইফোঁটার তোড়জোড় লাগিল। টিয়া বাসন্তী রঙের একটা শাড়ি পরিয়াছে। নন্তুর পরে কাচা ধুতি পরিয়া নবা ফোঁটা লইতে বসিল। বস্তুত, এ বৎসর তাহার দিদি রাণী এক সপ্তাহের জন্য বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াইতে গিয়াছে। তাই নবা ফোঁটা লইয়া যাইবে, এরূপ স্থির ছিল।

নবার পরে হাসুকে ফোঁটার জন্য আহ্বান করা হইল। হাসু মিনমিন করিয়া বলিল, কিন্তু, টিয়া তো আমার আপন বোন নয়।

―বোনের আবার আপন পর কী? ―মাসি বলিলেন।

হাসু গাঁইগুঁই করিতে লাগিল। শেষে অনন্যোপায় হইয়া ধুতি পরিয়া আসনে বসিল।

দুই হাঁটু সামনে মুড়িয়া টিয়া বসিয়াছে। হাসুর মুখের সম্মুখে টিয়ার আনত মুখ। কপালে তাহার কড়ে আঙুলের তিনবারের ভেজা, শীতল স্পর্শ পাইল হাসু। টিয়ার ঠোঁট অস্ফুট মন্ত্র-উচ্চারণে বিড়বিড় করিতেছিল। মাসি শাঁখ বাজাইতেছিলেন। ফোঁটা শেষে নীচু হইয়া টিয়া হাসুকে বলিল, পা-দুটো সামনে বাড়া। অতঃপর ধান-দুর্বা তাহার পায়ের উপরে দিয়া দুই পা মৃদু স্পর্শ করিল।

হাসু সামান্য ধান-দুর্বা টিয়ার মাথায় ছড়াইল। অতঃপর নিজের ডান হাত আলতো করিয়া টিয়ার মাথার ওপরে রাখিল। কিন্তু মুহূর্তেই মুখ সরাইয়া টিয়া দ্রুত উঠিয়া পড়িল।

পরক্ষণেই, টিয়া জিভ বাহির করিয়া তাহাকে ভেংচি কাটিল।

ক্রমশ

[ সবকটি পর্ব পড়তে যে-বছর চের্নোবিল ট্যাগে ক্লিক করুন ]

শেয়ার করুন

Similar Posts

4 Comments

  1. পর্ব ১১ তে অনেক চেনা চরিত্র, জানা ঘটনা। সবগুলিকে অপরিসীম দক্ষতার সঙ্গে এক কিশোরের ব্যর্থ প্রেমানুভূতির সূত্রে গাঁথা হয়েছে। চমৎকার এগোচ্ছে। 👌

  2. সোভিয়েত দেশের প্রতি মুগ্ধতার অনুভূতি ফিরে পেলাম

  3. ভাল যে লাগছে তা বলাই বাহুল্য। ভাষাবৈভব আর বিষয় দুই ই মন কাড়া। এবারের তমোনাশ এর চরিত্রটির কথা পড়ে নিজের ছোটবেলা মনে পড়ে গেল। এইরকম বাবার বন্ধু মায়ের বন্ধু আমরাও পেয়েছি। জানি না এখনকার বাচ্চারা পায় কিনা! কত প্রেমও যে সে আমলের টিয়াদের মায়েরা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *