জন্মশতবর্ষে এক সুরের জাদুকর, ভি. বালসারা – প্রবীর মিত্র
গান যখন শেষ হোল পরিপূর্ণ অডিটোরিয়াম-এ তখন যেন পিন পড়ার শব্দ শোনা যাবে। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিজের চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে, হাতদুটো কখন যে নিজের অজান্তে নমস্কারের ভঙ্গীতে চলে এসেছে সেটা তাঁরা নিজেরাই জানেন না। মঞ্চের স্পটলাইটে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একপ্রান্তে সুমন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ হাতে গিটার নিয়ে গান শেষ করে শ্রদ্ধামিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন এক অশীতিপর বৃদ্ধের দিকে। একটু আগে তিনি যে গানটি শেষ করলেন সেটি সেই প্রবীণ ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে লেখা। গান শুনে বৃদ্ধের চোখে জল, দর্শকের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন কারও মুখে কোন কথা নেই। অবশেষে নীরবতা ভাঙলেন কবীর সুমন। তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি সম্মান জানালেন মঞ্চে অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা ভারতীয় সঙ্গীতের সেই প্রবাদপ্রতিম দেবতাকে। তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন ভারতীয় সঙ্গীতের প্রবাদ পুরুষ ভিয়েস্তাপ আর্দেশির বালসারা,সংক্ষেপে ভি. বালসারা।
১৯২২-র ২২শে জুন মুম্বাইতে একটি পার্শি জোরাস্ট্রিয়ান পরিবারে সুরের নাবিক ভিয়েস্তাপ আর্দেশির বালসারার জন্ম এবং মা নাজাময়ির মুখে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সব ধরনের গান শুনে তার বড় হয়ে উঠা। খুব ছোটবেলায় থেকেই মায়ের কাছে তাঁর সঙ্গীতের হাতেখড়ি। বাবার একটি টিউটোরিয়াল হোম ছিল যেখানে ভাষা ও বিজ্ঞানের পাশাপাশি শেখানো হত মিউজিক, আর এর দায়িত্বে ছিলেন নাজাময়ি। মা নিজে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাইতেন। ভিয়েস্তাপের মাত্র ছয় বছর বয়েসে মুম্বাই-এর সি.জে. প্রেক্ষাগৃহে মায়ের সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে ছোট্ট ভিয়েস্তাপ তখনকার দিনের একটি প্যাডেল হারমোনিয়াম বাজিয়ে তৎকালীন বিদ্বজ্জনদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। ওইটুকু একটা বাচ্ছাছেলের পারফরম্যান্স সকলকে মুগ্ধ করেছিল এবং করতালি দিয়ে আশীর্বাদ করেছিল ভারতীয় সঙ্গীতের একটি ভাবী নক্ষত্রকে। জীবনের সেই প্রথম মঞ্চানুষ্ঠানে ছোট্ট ভিয়েস্তাপ এতটুকু নার্ভাস হন নি। বিভিন্ন গানের মধ্যে মা তাকে একটি গান শিখিয়েছিলেন যেটির কথা বালসারাজির পরবর্তী জীবনে একটা আদর্শের মতো কাজ করেছিল, ‘সব দিন হতে না এক সমান,/সুখ আউর দুখ কো সমানই সমজে,/ও হি হতে হ্যায় সাচ্চা ইনসান’। এই গানের প্রত্যেকটি কথা তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মানতেন। জার্মান সঙ্গীতকার হিদাফিল্ডের তত্ত্বাবধানে তিনি পিয়ানো শেখেন এবং তিনি বালসারাকে পিয়ানো ছাড়াও আরও চারটি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শেখান। নিজে সেইসময় বাংলা না জানলেও পঙ্কজ মল্লিক, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, রাইচাঁদ বড়াল, কানন দেবী, পাহাড়ি সান্যাল, অসিতবরন, কমল দাশগুপ্ত প্রমুখ শিল্পীদের গানের সুর তাঁকে ছুঁয়ে যেত।
এই ভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাজাতে বাজাতে ১৯৪২ সালে যুবক বালসারা উস্তাদ মুস্তাক হোসেনের নজরে এলেন এবং ‘বাদল’ছবিতে তাঁকে সহকারী মিউজিক ডিরেক্টর হিসাবে প্রথম ব্রেক দিলেন এবং ছবিতে অনেকগুলি গানের সাথে পিয়ানো বাজিয়েছিলেন তিনি। পঙ্কজ মল্লিক প্রথম ব্যক্তি যিনি ফিল্মে পিয়ানোর ব্যবহার করেছিলেন এবং তৎকালীন বোম্বাই-এর বহু মিউজিক ডিরেক্টরের সুরে পঙ্কজ মল্লিকের একটা ছায়া থাকত।‘বাদল’ ছবিতে কাজ করার সুবাদে বালসারা মুম্বাই-এর অপর দুই মিউজিক ডিরেক্টর গোলাম হায়দার ও খেমচান্দ প্রকাশের সঙ্গে কিছুদিন কাজ করার সুযোগ পান। কিন্তু মনের খিদেটা কিছুতেই যেন মিটছিল না। সহকারী সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে বেশ কয়েকটি হিন্দি ছায়াছবিতে কাজ করার পর নিজে স্বাধীনভাবে কিছু একটা করতে হবে এই ভূতটা তাঁর মাথায় চেপে বসেছিল। বিভিন্ন রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে সময়-সুযোগ পেলেই ঢুঁ মারতেন পঙ্কজ মল্লিকের কাজ দেখার জন্য, উপরি পাওনা হিসাবে মিলত তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত, পিয়ানো সহযোগে। তখনও বাংলাভাষাটা ঠিক সুবিধা করে উঠতে পারেননি বালসারা কিন্তু পঙ্কজবাবুর গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর তাঁকে যেন সম্মোহিত করে ফেলত, আর সেই জন্যই হয়ত কলকাতা ও বাংলা সংস্কৃতির প্রতি একটা টান জন্মে গিয়েছিল।
অবশেষে ১৯৪৩ সালে বসন্তকুমার নাইডু তাঁর নিজের ছবি ‘সার্কাস গার্ল’-এ বালসারাকে একজন স্বতন্ত্র মিউজিক ডিরেক্টর হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবার সুযোগ করে দিলেন। এরপর তাঁকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৫০ পর্যন্ত প্রায় দশ বারোটি হিন্দি ছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালনার ভার নিয়েছিলেন। তাঁর সুরারোপিত হিন্দি ছবিগুলি ছিল ‘তলাশ’, ‘মদমস্ত’, ‘চারদোস্ত’, ‘কুরবানী’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘প্যার’ ইত্যাদি আরও বেশ কিছু ছবি। ১৯৪৭-এ এইচ.এম.ভি.-তে মুম্বাই এর খ্যাতনামা মিউজিক ডিরেক্টর নৌশাদ সাহেবের সহযোগিতায় বালসারা অর্কেস্ট্রা ডিরেক্টর হিসাবে যোগ দেন। এইসুত্রে রাজ কাপুরের আর.কে. স্টুডিও-র ব্যানারের কিছু ছবিতে শঙ্কর জয়কিশান এবং নৌশাদের সঙ্গে কাজ কারার সুযোগ মেলে। নৌশাদজীর সুরে ‘দুলারী (১৯৪৯)’ ছবিতে মহম্মদ রফির গাওয়া বিখ্যাত গান ‘সুহানি রাত ঢাল চুকি, না জানে তুম কব আওগে’ গানটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে ভারতীয় চলচ্চিত্রে এবং তাঁর সাথে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে এই গানে বালসারাজীর অসাধারণ ম্যান্ডোলিনবাদন। আবার অপরদিকে শঙ্কর জয়কিশনের সুরে ‘আওয়ারা’ ছবিতে মুকেশের গাওয়া ‘আওয়ারা হুঁ’ গানের শুরুতে পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ন কিংবা তালাত মাহমুদের গাওয়া ‘দাগ’ ছবির সেই বিখ্যাত গান ‘অ্যায় মেরে দিল কহিঁ আউর চল’, অথবা হেমন্তকুমার-লতাজীর গাওয়া পতিতা ছবির ‘ইয়াদ কিয়া দিল নে কাঁহা হো তুম’ গানের শুরুতে যে প্রিলিউডটি বাজে ভি বালসারা ওটা একটা হারমোনিয়ামকে অসাধারণ স্কেলে বাজিয়েছিলেন যেটা ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। যতদূর জানা যায় এই গানের রেকর্ড হয়ে ছিল বোম্বাইয়ের ফিল্মিস্থান স্টুডিয়োতে এবং পিয়ানোবাদক, বেহালাবাদক, ম্যান্ডোলিনবাদক বালসারা যে এতো ভালো হারমোনিয়াম বাজাতে পারেন সেটা মুগ্ধ করেছিল হেমন্তবাবুকে আর এটাই ছিল সম্ভবত তাঁর সাথে বালসারাজির প্রথম কাজ, আর সেইদিন থেকেই হেমন্তবাবুর সাথে তাঁর সাংগীতিক সম্পর্কের গাঁটছড়া যা হেমন্তবাবুর শেষদিন পর্যন্ত অটুট ছিল, আর এটা পরে বালসারাজী মজা করে বলতেন হেমন্তবাবুর সাথে ‘ঘর করা’কারণ মিউজিক অ্যারেঞ্জার হিসাবে বালসারা সবথেকে বেশী কাজ করেছিলেন হেমন্তবাবুর সাথেই। সত্তরের দশকে ‘যোগী অউর জওয়ানি’ ছবিতে হেমন্তবাবুর জন্য তিনি সুরারোপ করেছিলেন একটি অসাধারণ গান ‘ইনসান সে নফরত করনা’ কিন্তু কোন কারণে সেটি আর মুক্তির আলো দেখেনি। অন্যদিকে বেশ কিছু গানে তিনি ম্যারাকাসও খুব সুন্দর করে বাজাতেন তাতে যেকোন রিদমের গান খুব শ্রুতিমধুর হত। এই ম্যারাকাসকে আমরা বাঙালিরা বলি ঝুমঝুমি, এখন এটিকে শেকারও বলা হয়ে থাকে। এইভাবে কাজ করতে করতে বালসারা লতা, আশা, গীতা দত্ত, মহম্মদ রফি, মুকেশ প্রমুখ সঙ্গীত ব্যক্তিত্বদের সংস্পর্শে আসেন। মুম্বাইতে বাঙালী শিল্পীদের সাথে যতই কাজ করার সুযোগ আসছিল ততই কলকাতা শহর যেন তাঁকে চুম্বকের মতো টানছিল।
অবশেষে এক মহেন্দ্রক্ষণে ১৯৫৩-তে মুম্বাই-এর দুই মিউজিক ডিরেক্টর অনিল বিশ্বাস ও পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ বালসারাকে কলকাতার হিন্দুস্থান পার্কের একটি জলসার অনুষ্ঠানে বাজানোর জন্য নিয়ে আসেন। ইতিমধ্যেই বাংলায় কথা বলাটা তিনি একটু একটু করে রপ্ত করে নিয়েছিলেন মুম্বাইতে, কারণ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে তিনি কলকাতার মাটিতে তিনি একদিন অনুষ্ঠান করবেনই। প্রথম দেখাতেই তাঁর এই স্বপ্নের শহরের প্রেমে পড়ে গেলেন বালসারাজি। অনুষ্ঠানে বাজানোর সময় অনুভব করলেন এখানকার মানুষের সংস্কৃতিপ্রবণ মনোভাব, সেদিন বালাসারাজি মনে মনে উল্লাসে ফেটে গিয়ে বলেছিলেন ‘ইউরেকা ইউরেকা আমি পেয়ে গেছি আমার আসল ঠিকানা’। সেদিনের অনুষ্ঠান তিনি শেষ করেছিলেন পিয়ানোয় একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজিয়ে। গানটি ছিল ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে’। এই গানটি তাঁর অতি প্রিয় গান, তাই পরবর্তীকালে প্রায় সব লাইভ অনুষ্ঠানে তিনি এই গানটি বাজাতেন। পরের দিন একটা গেট-টুগেদার অনুষ্ঠানে দেখা হোল কলকাতার সব বিখ্যাত সঙ্গীতের বটগাছসম ব্যক্তিত্বদের, যাদের গান ও সুরসৃষ্টি শুনে বালসারা পরিণত হয়েছেন, যেমন কানন দেবী, যূথিকা রায়, পঙ্কজ মল্লিক, পাহাড়ি সান্যাল, উৎপলা সেন, সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ প্রমুখ শিল্পী। সবাই উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করলেন গতরাত্রের বালসারার পারফর্মেন্স-এর। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৪ এর ২৬ মে বালসারাজি মুম্বাই-এর ঠিকানা ছেড়ে বঙ্গসংস্কৃতিকে ভালোবেসে, রবীন্দ্রনাথকে ভালোবেসে বরাবরের জন্য কলকাতায় চলে এলেন। সম্বল পকেটে মাত্র তিনটি টাকা ও একটি বাড়তি জামা প্যান্ট খবরের কাগজে মোড়া। আসার সময় বন্ধুরা তাঁকে বারবার নিষেধ করেছিলেন কলকাতায় না যেতে, বলেছিলেন, ‘যাচ্ছ যাও! ওখানে কিন্তু ওখানকার বাঙালিরা তোমাকে টিকতে দেবে না’। স্বতঃস্ফূর্ত উত্তরে বালসারাজি জানিয়েছিলেন, ‘‘ঠিক আছে। টিকতে না দিলে চলে আসব। কিন্তু আমি যাব।’’
কলকাতায় ঠাঁই হোল বৌবাজারের কাছে একটি পার্শি ধর্মশালায় ১৪ নম্বর ঘরে ১২ আনা ভাড়ায়। খ্যাতনামা গায়িকা উৎপলা সেন বালসারাকে ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন। তিনি বিভিন্ন মিউজিক ডিরেক্টরদের সাথে তিনি বালসারার হয়ে সুপারিশ করতেন, তার সাথে নিজের বাড়ীতে বসাতেন সঙ্গীতের আসর আর সেখানে সঙ্গীত জগতের লোকেদের নিমন্ত্রণ করে শোনাতেন বালসারার বাজনা। বিভিন্ন জলসায় উৎপলা সেন ও সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সাথে তিনি বাজাতে লাগলেন। এইভাবেই বালসারার পরিচিতি বাড়তে লাগলো। সবাই জানল সুদূর বোম্বাই থেকে এক পার্শি ভদ্রলোক এসেছেন যিনি বাংলা চমৎকার বলেন ও বোঝেন এবং মিউজিক সেন্সও বেশ ভালো। তাঁদের এই ঋণ বালসারা আমৃত্যু মনে রেখেছিলেন। এছাড়াও পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ রেডিও-তে রম্যগীতি অনুষ্ঠানে যে কয়েকজন যন্ত্রীদের নিয়ে একটা টিম বানিয়েছিলেন এবার সেখানেও নিজগুণে স্থান করে নিলেন বালসারা। এইভাবে তাঁর কাছে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকেও কাজ করার সুযোগ এলো।
বেশ কিছুদিন পর তিনি বৌবাজারের বাসস্থান পাল্টে চলে এলেন সুইনহো স্ট্রিটের একটি বাড়ীতে। সেইসময় ন্যাশনাল অর্কেস্ট্রায় বাজাতে ঢুকেছেন ভি বালসারা। সেখানে তখন পিয়ানো বাজাতেন কুমুদ ভট্টাচার্য। উনি ‘বালসারা বাজাবে’ বলে পিয়ানো ছেড়ে দিয়ে নিজে এসে বসলেন অর্গ্যানে। আর অর্গ্যানে যিনি ছিলেন তিনি গিয়ে বসলেন গিটারে। এ এক মস্ত বড় ‘স্যাক্রিফাইস’। ওঁরা জায়গা না ছেড়ে দিলে বালসারাজি তো ‘ইন্সট্রুমেন্ট’ টাচ করতেই পারতেন না। ইতিমধ্যে উৎপলা সেন ও সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের মারফৎ আলাপ হোল সুরকার অনুপম ঘটকের সঙ্গে। সেই সময় উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘অগ্নিপরীক্ষা’ (১৯৫৪) ছবির গান রেকর্ড চলছে। ছবির একটি গানে পিয়ানো বাজিয়ে সকলের নজরে এলেন বালসারা, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘গানে মোর ইন্দ্রধনু’। সেই সময় মিউজিক অ্যারেঞ্জার বলতে ছিল শচীনদেব বর্মণের ভাগ্নে বীরেন্দ্র নারায়ণদেববর্মণ (চানু), অলোকনাথ দে প্রমুখ। এবার এদের সাথে সংযুক্ত হলেন বালসারা। যেহেতু বালসারাজির একটা সুবিধা ছিল যে, তিনি প্রায় সবধরনের ইন্সট্রুমেন্ট খুব দক্ষতার সাথে বাজাতে পারতেন তাই কলকাতার বিখ্যাত সব মিউজিক ডিরেক্টরদের খুব কাছের লোক হয়ে গিয়ে ছিলেন অচিরেই। সঙ্গীত পরিচালকরা মিউজিক অ্যারেঞ্জারদের উপরও খুব ভরসা করতেন। কোথাও কোন ভুল হলে মিউজিক ডিরেক্টর অ্যারেঞ্জারদের বলে দিতেন আর তার পাশাপাশি অ্যারেঞ্জাররাই খুব নিপুণতার সাথে ফিলার মিউজিক কম্পোজ করে দিতে পারতেন। বাবার টিউটোরিয়াল হোমে বালসারা খুব ভালোভাবে শর্টহ্যান্ডও রপ্ত করেছিলেন যেটি পরবর্তী কালে মিউজিকের নোটেশন তৈরিতে খুব কাজে লাগে। গীতিকার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অপরেশ লাহিড়ীর জন্য লেখেন একটি আধুনিক গান ‘লাইন লাগাও, লাইন লাগাও’ আর সেটির অসাধারণ সুরারোপ করেন ভি বালসারা, এর আগে তিনি শুধুমাত্র একজন মিউজিক অ্যারেঞ্জার হিসাবে পরিচিত ছিলেন, অপরেশ লাহিড়ীর সৌজন্যে লোকে ভি. বালসারাকে একজন সঙ্গীত পরিচালক হিসাবেও চিনলেন। ১৯৫৬ সালে নির্মল ভট্টাচার্যের সাথে জুটি বেঁধে ‘চলাচল’, ‘মা’, ‘পঞ্চতপা’, ‘মমতা’ প্রভৃতি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন এবং ১৯৫৯ সালে অভিনেতা জহর রায় অভিনীত ‘এ জহর সে জহর নয়’ ছবিতে প্রথম একক ভাবে বাংলাছবির সুরকার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলেন বালসারা। আগেই বলেছি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন বালসারার বড় ভাই-এর মতো, আদর করে তাঁকে ‘বালু’ বলে ডাকতেন হেমন্তবাবু। ১৯৬৮ তে ‘পথে হোল দেখা’ গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের কথায়, তাঁর প্রিয় ভাই বালুর সুরে হেমন্তবাবু গাইলেন, ‘চলো চলো মোরা চলে যাই সেই দেশে’ এবং গান খুব হিট হয়। ‘রাতের অন্ধকারে’ ছবির জন্য হেমন্তবাবু গাইলেন ‘আলোতে তুমি মধুর’, ‘আশায় বাঁধিনু ঘর’ ছবির জন্য বালসারার সুরে গাইলেন ‘ওরে মন কোন দেশেতে’। এছাড়াও হেমন্তবাবুর সাথে জুটি বেঁধে তিনি ‘সূর্যতোরণ’, ‘দুইভাই’, ‘পলাতক’, ‘বাদশা’, ‘অজানা শপথ’, ‘মন নিয়ে’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’ –এর মতো প্রায় ৭০ এর বেশী ছবিতে কাজ করেছিলেন। হেমন্ত-বালসারা জুটির অনেক আধুনিক গানের মধ্যে একটি গান মনে পড়ছে ১৯৭৬ সালে পুজোর গান হিসাবে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তী মজুমদারের দ্বৈতকণ্ঠে গাওয়া ‘কাটে না সময় যখন আর কিছুতেই, বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না, জানলায় কখন যে চোখ পড়ে যায় মনে হয় বাবা যেন বলছে আমায়, আয় খুকু আয়’ – এই কালজয়ী গানেরও সুরারোপ করেন ভি. বালসারা যা আজও জনপ্রিয়। অপরদিকে গাছকে ভালোবেসে কবি অমিতাভ চৌধুরীর লেখা একটি কবিতায় সুর করেছিলেন বালসারা, ‘সুন্দরবনে সুন্দরী গাছ, গাছটি সুন্দরবনে, চারদিকে রোদ্দুর যেন ঝিলমিল ঝিলমিল কাঁচ, কচি সবুজ পাতা তার।’গেয়েছিলেন বনশ্রী সেনগুপ্ত। এইভাবে তিনি নতুন শিল্পীদের সাথে কাজ করতে ভালোবাসতেন তাঁর সাথে সাথে চেষ্টা করতেন নতুনদের সুযোগ দেবার। আশা ভোঁসলে, মুকেশ, তালাত মাহমুদকে দিয়ে প্রথম বাংলা গান গাওয়ানো ছাড়াও বাংলায় প্রথম পপগানের স্রষ্টাও কিন্তু বালসারা। হেমন্তকন্যা রানু মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে তিনি গাইয়েছিলেন, ‘বুশিবল বুশিবল’, এছাড়াও শ্রাবন্তী মজুমদারের গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে অধিকাংশ গানই ভি বালসারার সুর ও অর্কেস্ট্রা কম্পোজিশন।
শুধুমাত্র ছবির গান বা আধুনিক গানেই তিনি সুর করে থেমে থাকেননি, করেছেন বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থার হয়ে ছোট ছোট বিজ্ঞাপনী গান বা জিঙ্গলের সুর। যেমন উল্লেখ্য জি. ডি. ফার্মাসিউটিক্যালস-এর বোরোলীনের জিঙ্গল যেটি গেয়েছিলেন শ্রাবন্তী মজুমদার এবং গানের কথা লিখেছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রত্যেক রবিবার বিবিধ ভারতীতে বোরোলীনের সংসার নাটকের অনুষ্ঠানে নাটক শুরু হবার আগে শোনা যেত সেই জিঙ্গল, ‘শুক্ষতার রুক্ষতার অবসান যদি চান, বারোমাস সারা অঙ্গে মেখে নিন, সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম বোরোলীন’। দূরদর্শনের জন্য ‘গৃহদাহ’ ও ‘মুন্সী প্রেমচাঁদের গল্প’ সিরিয়ালে তিনি থিম মিউজিক তৈরি করেছিলেন। মঞ্চসফল নাটক ‘আগন্তুক’ ও ‘কাঁচের পুতুল’-এ তাঁর সুরসৃষ্টি ছিল অতুলনীয়।
রবীন্দ্রনাথের গানের টানে তিনি কলকাতায় আসলেও তাঁর দাদার মত হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁকে একবার সাবধান করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে নিজের বানানো নোটেশন না দিতে তাহলে তার ফল মারাত্মক হতে পারে। এর পিছনে একটা মজার ঘটনা আছে। লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে প্রথম বাংলা গান গাওয়াবেন হেমন্ত এবং সেটি একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত, ‘তোমার হোল শুরু আমার হোল সারা’। তা রেকর্ডিং–এর আগে হেমন্তবাবু বললেন, ‘ভাই বালু, তুমি রবীন্দ্রনাথের কোন একটা গানের সুর বাজাও শুনি’। বালসারাজী পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে শোনা ‘প্রাণ চায় চক্ষু না চায়’ গানটির সুর-ছন্দ মনে রেখে নিজের মতো করে বাজাচ্ছেন। বাজনা শুনেই হেমন্তবাবু ধমকের সুরে বলে উঠলেন, ‘‘কি সব বাজাচ্ছ, নোটেশনে যা লেখা রয়েছে সেই মতো বাজাও। এটা রবীন্দ্রসঙ্গীত। অন্য সুর বাজালে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ তোমায় জেলে ভরে দেবে।”শুনে বেশ ঘাবড়ে গেলেন বালসারা। ‘তোমার হোল শুরু আমার হোল সারা’ গানটির নোটেশন তিনি বিশ্বভারতী অনুযায়ী কম্পোজ করলেন এবং রেকর্ড হল লতা মঙ্গেশকরের প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত হেমন্তবাবুর সাথে। এই গানের মিউজিক অ্যারেঞ্জার ছিলেন ভি.বালসারা এবং গানে পিয়ানো এবং অর্গানও তাঁর বাজানো ছিল। কিন্তু সেদিন বালসারার মনটা খুব ভেঙে গিয়েছিল, রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি বালসারাজির সমস্ত আকর্ষণ যেন চলে গিয়েছিল। ঠিক করেছিলেন আর রবীন্দ্রসঙ্গীতে কাজ করবেন না কোনও দিন। কিন্তু বহুদিন পরেও সেই রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া বালসারা অন্য কিছু ভাবতে পারতেন না, তাঁর কারণ রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর বেঁচে থাকার রসদ যুগিয়েছিল।
১৬, অক্রূর দত্ত লেনে তিনি যখন চলে আসেন এবং সেখানেই একটি ঘরে তিনি গড়ে তোলেন তাঁর মিউজিক রুম। অবশ্য তিনি এটাকে মিউজিক রুম বলতেন না, বলতেন মা সরস্বতীর মন্দির। কারণ এই বাড়ীতে একটা সময় থাকতেন সঙ্গীতের মহান ব্যক্তিত্ব পঙ্কজকুমার মল্লিক। এই মন্দিরে প্রবেশ করে তিনি রবীন্দ্রনাথের ছবির দিকে তাকিয়ে জোড়হাত করে রোজ গাইতেন, ‘বড় আশা করে এসেছি গো কাছে ডেকে লও’। আর রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে গাইতেন ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু’। কার না ছবি ছিল সেই ঘরে?মা সরস্বতী, রামকৃষ্ণ পরমহংস, সারদা মা, বিবেকানন্দ, সাঁই বাবা, আনন্দময়ী মা, ঋষি অরবিন্দের পাশাপাশি বিরাজ করতেন সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখার্জি, লতা মঙ্গেশকর, মহম্মদ রফি, মুকেশ, পঙ্কজ মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, আমীর খান প্রমুখ আরও বিশিষ্ট শিল্পীর ছবি। প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে তিনি প্রত্যেকটি ছবিতে ধূপধুনো দিয়ে দেবতার মতো পুজো করতেন এবং একটি নরম কাপড় নিয়ে পরম যত্নে ছবিগুলিকে মুছে সেই কাপড় নিজের মাথায় নিয়ে তাঁদের উদ্দেশ্যে বলতেন তোমাদের গুণের একটু অংশ আমাকে দাও প্রভু। ঘরে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিল প্রচুর নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র যেমন পিয়ানো, অ্যাকর্ডিয়ন, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নিয়ে বানানো নিজস্ব কিছু বাদ্যযন্ত্র, আর ছিল মেলোডিকা ও ইউনিভক্স। এই মেলোডিকা ছিল বেশ আজব ধরনের একটা যন্ত্র দেখতে বাঁশীর মতো ফুঁ দিয়ে বাজাতে হয় কিন্তু তার সাথে ছিল একটা কী-বোর্ড যেটা দিয়ে নানাধরনের সুর উনি তৈরি করতেন। অন্যদিকে ইউনিভক্স যন্ত্রটিও বালসারাজীকে দেন সুরকার নচিকেতা ঘোষ, এটিও ছিল একটি ছোট্ট পিয়ানোর মতো, সানাই-এর অপূর্ব সুর বেরোত এই যন্ত্র থেকে। ভারতীয় সঙ্গীতে একমাত্র ভি. বালসারা ছাড়া আর কেউ ইউনিভক্স-এর এতো সুন্দর ব্যবহার করেছেন বলে শোনা যায় না। এছাড়াও ট্রান্সজিসটরের সার্কিটগুলোকে একটু অদলবদল করে তৈরি করেছেন অদ্ভুত সব যন্ত্র।
তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল খুব দুঃখে ভরা। বিভিন্ন সময়ে তাঁকে একে একে ছেড়ে চলে গেছে তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলে, দিদি সুগায়িকা ধন্নাবাঈ। কি অসীম একাকীত্ব, কিন্তু কখনো তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েন নি, আরও ডুবে গেছেন সুরের সাগরে, রচনা করেছেন এক একটি কালজয়ী সুর পিয়ানো বা হারমোনিয়াম-এ। দুঃখকে জয় করার অসীম ক্ষমতা ছিল তাঁর। প্রত্যেকদিন বিকেলে তাঁদের ছবির সামনে তিনি ধূপ দিতেন। তাঁর বড়ছেলে মাত্র এগারো বছর বয়েসে মারা যায়। ছেলের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সেরে তিনি একেবারে ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে স্টুডিয়োয় হাজিরা দিয়েছিলেন, তাঁর অন্যান্য সহযোগী যন্ত্রীদের এক মুহূর্তের জন্যও বুঝতে দেন নি কী অমানুষিক ঝড় তাঁর উপর দিয়ে বয়ে গেছে। নিজের স্ত্রী যেদিন মারা যায় সেদিন রাত্রে একটা জলসা ছিল তাঁর। সবকাজ সেরে তিনি ঠিক নির্ধারিত সময়ে হাজির হয়েছিলেন সেই জলসায়, সেদিন তাঁর আঙ্গুল পিয়ানোতে রবি ঠাকুরের একটি গানের সুর তুলেছিল, ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়’। দ্যা শো মাস্ট গো অন।
শুধু দেশীয় সঙ্গীত নয়, পাশ্চাত্য সঙ্গীতের জগত, সে এক অতলান্ত সমুদ্র, এই একটি বিষয় সঙ্গীত যেখানে ভাষা কোন অন্তরায় নয়, সঙ্গীতের কোন সীমারেখা নেই, প্রাচ্য পাশ্চাত্য মিলেমিশে যেখানে একাকার। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের কী অসামান্য দখল ছিল ভি বালসারার। ১৯৬৮ সালে রিলিজ হওয়া ‘বালসারা এন্ড হিজ সিঙ্গিং সেতার’ এলবামটা আজও যখন ইউটিউবে শুনি পিয়ানো এবং সেতারে বাজানো পাশ্চাত্য সুর আমাদের খাঁটি দেশী মনকে উতলা করে সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে সুরের এক অন্য দেশে নিয়ে চলে যান ভি. বালসারা। আসলে তিনি সুর ও বাদ্যযন্ত্র নিয়ে নানাধরনের এক্সপেরিমেন্ট করতেন, ওয়েস্টার্ন ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে তিনি ইন্ডিয়ান সুর বাজাতেন এবং ইন্ডিয়ান ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে ওয়েস্টার্ন সুর বাজাতেন।
বালসারা সঙ্গীত জীবনে বহু সম্মান ও পুরস্কার লাভ করেছেন। উল্লেখযোগ্য পুরস্কারগুলি হল ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কার, রাজীব গান্ধী পুরস্কার, সত্যজিৎ রায় স্মৃতি স্মারক, হিউম্যানিটি মিশন পুরস্কার, কমলা দেবী রাই পুরস্কার, মোহর পুরস্কার ইত্যাদি। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি পশ্চিমবঙ্গের আলাউদ্দিন খাঁ পুরস্কার এবং সৃষ্টিশীল সঙ্গীতের জন্য ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে সঙ্গীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশিকোত্তম উপাধি দ্বারাও সম্মানিত হয়েছেন তিনি। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে প্রায় গোটা চল্লিশেকের বেশী ফিল্মে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন, প্রায় একশোর উপর বাংলা ছবির মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টের পাশাপাশি প্রায় গোটা কুড়ি ছবিতে তিনি আবহসঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ১৯৬৩ সালে রিলিজ হওয়া পরিচালক পার্থপ্রতিম চৌধুরীর ছবি ‘ছায়াসূর্য’, যেখানে অসাধারণ আবহসঙ্গীত প্রয়োগ করেছিলেন ভি.বালসারা এবং ছবিতে হেমন্তবাবুর গাওয়া একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘এসো এসো আমার ঘরে এসো’ এর প্রয়োগ ছিল অতুলনীয়। দেবাশিস ভুঁইয়া পরিচালিত তাপস পাল অভিনীত ‘তিল থেকে তাল’ ছবিটি ছিল তাঁর শেষ সঙ্গীত পরিচালিত ছবি।
বোম্বাইতে থাকাকালীন যেমন তিনি কাজ করেছিলেন সি রামচন্দ্রন, নৌশাদ, শঙ্কর জয়কিশন, অনিল বিশ্বাস, লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল প্রমুখ মিউজিক ডিরেক্টরদের সাথে, ঠিক তেমনি এই বাংলায় তিনি কাজ করেছিলেন নচিকেতা ঘোষ, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ প্রমুখ সঙ্গীত দিকপালদের সাথে। তাঁর মিউজিক সেন্স ও শর্টহ্যান্ড নোটেশন নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতেন মিউজিক ডিরেক্টররা। নচিকেতা ঘোষ সুরারোপিত ছবি ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘সন্ন্যাসী রাজা’, ‘চিরদিনের’, ‘ফরিয়াদ’ ইত্যাদি আরও অনেক ল্যান্ডমার্ক ছবির মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টে ছিলেন বালসারা সাহেব।
কিন্তু দুঃখের বিষয় ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তাঁর অবদান নিয়ে আজ পর্যন্ত তেমন কোন চর্চাও হয় নি। অনেকে দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে জন্মসূত্রে পার্সি হয়েও বাঙালির শ্বাসপ্রশ্বাস ও রক্তে মিশে যাওয়া এবং অনেক বাঙালির থেকেও অধিকতর বাঙালি পণ্ডিত ভিয়েস্তাপ আর্দেশির বালসারা-র নামে একটা রাস্তারও নামকরণ হোল না আজ পর্যন্ত। ২০০৫ সালের ২৪ মার্চ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সদাহাস্যময় বালসারা প্রয়াত হবার পর তৎকালীন শাসকদলের একমন্ত্রী আবেগ তাড়িত হয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছিলেন বালসারাজীর স্মরণে একটি মিউজিয়াম গড়ার কিন্তু আজ ২০২১-এ বালসারাজীর জন্মশতবর্ষে এসে সেটা অধরাই রয়ে গেল।
শেষকথা :- বালসারার সুরে আমার প্রিয় সেরা কয়েকটি বাংলা আধুনিক গান, আপনারা ইচ্ছে করলে ইন্টারনেট-এ সার্চ করে শুনে নিতে পারেন গানগুলি, আশাকরি দীপাবলির সন্ধ্যে আপনাদের খুব একটা খারাপ কাটবে না।
১. আয় খুকু আয় – হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তী মজুমদার, কথা – পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়
২. সুন্দর বনে সুন্দরী গাছ – বনশ্রী সেনগুপ্ত, কথা – অমিতাভ চৌধুরী
৩. ও বিধি আমায় কালো করলে যদি – ড. ভুপেন হাজারিকা, কথা – শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
৪. লাইন লাগাও লাইন লাগাও – অপরেশ লাহিড়ী, কথা – শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
৫. শ্রীচরনেসু মা – রুমা গুহঠাকুরতা, কথা – শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
৬. হৃদয়ের ব্যাথা বিরহের কথা –ড. ভুপেন হাজারিকা, কথা – শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
৭. যদি ঝড় ভাঙ্গে ঘর – শ্যামল মিত্র ও ইলা বসু , কথা – শ্যামল গুপ্ত
৮. তুমি সুন্দর যদি নাহি হও – তালাত মাহমুদ, কথা – শ্যামল গুপ্ত
৯. যেথা রামধনু ওঠে হেসে – তালাত মাহমুদ, কথা – শ্যামল গুপ্ত
১০. মন্দ বলে লোকে বলুক না – মুকেশ, কথা – মিল্টু ঘোষ
১১. মধুপুরে পাশের বাড়ীতে তুমি থাকতে – শ্রাবন্তী মজুমদার, কথা – পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়
১২. আমার চার বছরের বড় দিদির আঁচলে–শ্রাবন্তী মজুমদার, কথা – পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. শতফুল বিকশিত হোক – শ্রাবন্তী মজুমদার, কথা – পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়
১৪. বুশিবল বুশিবল – রানু মুখোপাধ্যায়, কথা – পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়
তথ্যঋণ: – আজকাল, আনন্দবাজার, দেশ বিশেষ বিনোদন সংখ্যা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্মরণ কমিটি, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও ইন্টারনেট –এ প্রকাশিত ভি বালসারার সাক্ষাৎকার, তুমি রবে নীরবে তথ্যচিত্র পরিচালনা রবীন দে।