হিন্দুত্ববাদী পৌরুষের অধিকারবোধ ও মেয়েদের শরীর – অর্ণব সাহা

হিন্দুত্ববাদী পৌরুষের অধিকারবোধ ও মেয়েদের শরীর – অর্ণব সাহা

শেয়ার করুন

‘আক্রমণকারী’/’ধর্ষক’ মুসলিমের নির্মাণ

উনিশ শতকের শেষ দিক থেকেই ‘হিন্দু সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ তার একমাত্রিক কাল্পনিক ‘শত্রু’ হিসেবে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে এবং সেই অনুয়ায়ী একটি সুসংহত ডিসকোর্স নির্মাণের কাজে হাত দেয় । স্বাধীন ভারতের মাটিতে আরএসএস-জনসঙ্ঘ-বিজেপি যে ভাষায় কথা বলে—‘মুসলমানদের বড়ো বাড় বেড়েছে । ওরা পদে পদে অতিরিক্ত সুবিধা পাচ্ছে’—এই যুক্তিক্রম নির্মাণের একটা ধারাবাহিক ইতিহাস আছে । তা হল সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও এজেন্ডা নিয়ে ভারতের মুসলমানদের ‘অপর’ হিসেবে নির্মাণ । উনিশ শতকেই হিন্দু-জাতীয়তাবাদ ইংরেজের বদলে প্রকৃত শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিল মুসলমানকে । বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’-এর প্রথম সংস্করণে যে ইংরেজ বিরোধিতা ছিল তা পরবর্তী সংস্করণে বদলে গিয়ে হল ‘মুসলমান’, ‘যবন’ বা ‘নেড়ে’-র বিরোধিতা । এর পরের ধাপে ইংরেজরা মিত্র এবং মুসলিমরাই চিরশত্রু হিসেবে প্রতিপন্ন হল । একদা জাতীয় কংগ্রেসের নেতা, পরবর্তী কালে আরএসএস-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তাত্ত্বিক বি এস মুঞ্জে, যিনি সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়াড়ের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, তিনিই দক্ষিণপন্থী, চরম রক্ষণশীল আরএসএস-এর লিঙ্গ-রাজনীতির থিয়োরিটিক্যাল ফ্রেমটি গড়ে তুলতে সাহায্য করেন । এমন এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক হিন্দু জাতীয়তাবাদের ভাবনা গড়ে তোলার চেষ্টা হয় যা প্রত্যেক পদে নারীর শরীরকে বিভিন্ন ধরনের পিতৃতন্ত্র, ঔপনিবেশিকতা ও হিন্দু আধিপত্যবাদের খাঁচায় আটকে দেবে । বিশেষ করে শরীর হয়ে উঠবে একটি রণক্ষেত্র যেখানে পিতৃতান্ত্রিক অধিকারলিপ্সা চরিতার্থ হবে । বিশ শতকের গোড়ার দিকে এবং ১৯২৫-এ নাগপুরে আরএসএস গড়ে ওঠার পর হিন্দু সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চিন্তায় হিন্দু পুরুষের ‘মেয়েলিপনা’ বা ‘ইফেমিনেসি’ একটি না-বাচক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে সাব্যস্ত হল । এই ‘মেয়েলি হিন্দু পুরুষ’ আর্কেটাইপ তৈরির পিছনে অবশ্য ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদেরও একটা বিরাট অবদান ছিল । আরএসএস এক ধরনের মিলিটারি হিন্দুত্ববাদের জন্ম দেয় । যাতে বলা হতে থাকে ‘মেয়েলিপনা’-কে অতিক্রম করে হিন্দু ‘পৌরুষ’ জাগ্রত করাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজ । এই ভাবনা অনুযায়ী সংখ্যালঘু মুসলমানরা চিরকাল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণকে অত্যাচার করে গেছে তার কারণ হিন্দু পুরুষ ‘মেয়েলি’ । হিন্দু জাতিকে জাগাতে হলে আগে মেয়েদেরই জাগাতে হবে, নতুন করে গড়ে তুলতে হবে পরিবার, দাম্পত্য, সন্তানপালন বিষয়ক মেয়েদের দায়িত্ব । সবল পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়ে তাদের বলিষ্ঠ হিন্দু জাতি গঠন করতে হবে । কেন মূখ্যত হিন্দু পুত্রসন্তানের জন্মের উপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ? কারণ, পুত্রসন্তান জন্ম দেবার প্রতিযোগিতায় মুসলমানদের টেক্কা দিতে হবে । যেহেতু মুসলমানরা ওই ব্যাপারে অতিমাত্রায় উর্বর । একইসঙ্গে মনে রাখতে হবে মুসলমান পুরুষ মাত্রই বিকৃত যৌন আবেগ দ্বারা তাড়িত । প্রতিটি মুসলমান পুরুষই হিন্দু নারীর এক একজন সম্ভাব্য ধর্ষণকারী । ১৯২০-র দশকের উগ্র হিন্দু মালিকানাধীন বহু খবরের কাগজে মুসলমান পুরুষ দ্বারা হিন্দু মেয়েদের অপহরণ, লাঞ্ছনা ও ধর্ষণের রোমহর্ষক রসালো বিবরণ থাকত । উত্তেজক শিরোনাম ব্যবহৃত হত—‘হিন্দু অওরতোঁ কি লুট’। অক্টোবর, ১৯২৪-এ ‘পেট্রিয়ট’ পত্রিকায় ‘কিডন্যাপিং’ শিরোনামের একটি লেখায় বলা হল—‘এমন একটা দিনও বোধহয় যায় না, যেদিন শুধু মুসলমান গুণ্ডা-বদমায়েশ নয়, উচ্চবিত্ত মুসলমান পুরুষরাও হিন্দু নারী ও শিশুদের অপহরণ করে না…’।

এই ফ্রেমিং থেকে যে ব্যাপারগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেগুলো হল—প্রথমত, মেয়েদের এই লাঞ্ছনাকে নিষ্ক্রিয়ভাবে ভাগ্যের বঞ্চনা বলে বলে মেনে নিলে চলবে না বরং ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ করতে হবে । নিজেদের ‘সতীত্ব’-কে রক্ষা করতে হবে, নইলে গোটা হিন্দু সম্প্রদায়ের মান-মর্যাদা নষ্ট হবে । দ্বিতীয়ত, হিন্দু জাতির বীর্য ও পৌরুষ অক্ষত রাখতে হবে, হিন্দু নারীর অবাধ গতিবিধির উপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে । তৃতীয়ত, যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই ডিসকোর্সের ক্ষেত্রে তা হল, হিন্দু সম্প্রদায় ও নারীর মর্যাদা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে মুসলমান কমিউনিটি বিশেষত মুসলিম মেয়েদের উপর পালটা যৌন আক্রমণ হানতে হবে । তাদেরও পালটা ধর্ষণ করতে হবে । এইভাবেই ম্যানুফাকচারড হল এমন এক আগ্রাসী হিন্দু জাতির ছবি যারা প্রতিনয়ত ‘মুসলিম বর্বরতার’ উচিত জবাব দিতে পারবে । এভাবেই মুসলিম নিধন ও মুসলিম মেয়েদের ধর্ষণ করার মতাদর্শ গড়ে উঠেছিল সেই ১৯২০-র দশকে । আর এই দশকেই ১৯২৫ সালে নাগপুরে আরএসএস-এর জন্ম ।

শত্রু তৈরির এই আখ্যানে, মেয়েদের দুরকম ভূমিকার কথা ভাবা হয়েছে । কখনও তারা মুসলমান আক্রমণের অসহায় শিকার । আবার কখনও তারা বীরাঙ্গণা । তাই আদর্শ হিন্দু নারীকে হতে হবে একাধারে গৃহকর্মে নিপুণা মা ও স্ত্রী; এবং শত্রু আক্রমণকে অনায়াসে মোকাবিলা করার মতো দক্ষ, সাহসী নারী । ১৯২৬ সালে আরএসএস-এর প্রথম যে শাখা সংগঠনটি গড়ে ওঠে তার নাম ‘রাষ্ট্র সেবিকা সমিতি’ । এই প্রতিশোধমূলক হিংসার ধারণা ‘হিন্দু জাতির বীর্যত্ব’ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত । বিনায়ক দামোদর সাভারকর তাঁর ‘ভারতের ইতিহাসের ছয়টি স্বর্ণময় অধ্যায়’ বইতে মুসলমান পুরুষমাত্রই ধর্ষণকারী এই ডিসকোর্স প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে লেখেন—‘মুসলমান মাত্রই অমুসলমান স্ত্রীলোককে অপহরণ করা এবং তাকে নিজের ধর্মে আনা ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করে । এটা তাদের সংখ্যাবৃদ্ধির উপায়ও বটে । এই ধর্মগত ধারণা তাদের কাম-লালসা বাড়িয়ে দিয়েছে এবং তাদের সংখ্যাবৃদ্ধির অভিযানে তথা হিন্দুর সংখ্যা হ্রাসের ক্ষেত্রে বিপুল সহায়তা করেছে…’। এরপর তিনি ইতিহাসের সম্পূর্ণ বিকৃত এক মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন মুসলিম হানাদাররা হিন্দু মেয়েদের লুঠের মাল হিসেবে গণ্য করে তাদের সুলতান থেকে সেপাই পর্যন্ত বন্টন করে দিত । কয়েকশ বছর ধরে এইভাবে নাকি লক্ষ লক্ষ হিন্দু মেয়েকে অপমান করা হয়েছিল । তিনি লিখছে—‘মুসলমান নারীদের মধ্যে এমন ধারণা জন্মানো হত যে হিন্দু নারীদের বলপূর্বক ধর্ম নষ্ট করে ইসলামে দীক্ষিত করার কাজে সহায়তা করা তাদের কর্তব্য’। এর সঙ্গে সাভারকর দাবি করেন যে হিন্দু সমাজের সবচেয়ে বড়ো ত্রুটি হল মুসলিম মেয়েদের সঙ্গে শোভনভাবে ব্যবহার করা । তিনি চান মুসলিম নারীর উপরেও ‘মুসলিম সুলভ পালটা আচরণ করা’। এই নারী ধর্ষণের সঙ্গে যোগ হয় মুসলিম নারী হত্যার উপদেশ—‘শত্রুপক্ষীয় নারী, যারা আমাদের মা-বোনেদের-নারীত্বের চরম অপমান করেছে, তারা নিজেদের আচরণের দ্বারাই নারীত্বের প্রাপ্য অধিকার নষ্ট করেছে । অত্যাচারীর কঠোর দণ্ডই তাদের প্রাপ্য’।

এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে ২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনমাস ব্যাপী গুজরাটে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা যে বিধ্বংসী হত্যাকাণ্ড, মুসলমান নারীর উপর নৃশংস যৌন নির্যাতন ও আগুন জ্বালিয়ে তাদের ঘরবসতি নষ্টের যে ঘটনা ঘটিয়েছিল এবং যেভাবে সমস্ত অপরাধের প্রমাণ লোপাট করা হয়েছিল তার একটা দীর্ঘ মতাদর্শগত পূর্ব ইতিহাসের ভিত্তি আছে । সেই ইতিহাসের ভিতর হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিজমের নিহিত লিঙ্গরাজনীতির দিকটি খুঁটিয়ে দেখা প্রয়োজন । নতুন সহস্রাব্দে এই হিন্দু সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী রাজনীতির প্রথম ল্যাবরেটরি হিসেবে সঙ্ঘ পরিবার বেছে নেয় গুজরাটকে । গুজরাট দাঙ্গার পরিকল্পনা করা হয়েছিল দীর্ঘদিন ধরে । ১৯৯৮ সালে গুজরাটে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সুপরিকল্পিত ভাবে গুজরাটে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে শারীরিক আক্রমণ শুরু হয় । গুজরাট দাঙ্গায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা নিয়েছিল । সেই সংগঠিত দাঙ্গার পিছনেও এই পরিকল্পিত লিঙ্গ-রাজনীতির একটা বিরাট বড়ো ভূমিকা আছে । এক বিশেষ ধরনের সমাজ-মানসিকতার রূপান্তর ঘটানো হয়েছিল প্রত্যেকটা সোশ্যাল লেয়ারে যাতে কেবল গুণ্ডা-লুম্পেনরাই নয়, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত অংশও সক্রিয়ভাবে দাঙ্গায় অংশ নেয় । এর তাত্ত্বিক মতাদর্শগত জায়গাটা হল, যেহেতু হিন্দু সমাজের প্রতিপালন হিন্দু মেয়েদের হাতে, তাই তাদের অরক্ষিত অবস্থায় মুসলিম আক্রমণকারীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না । হিন্দু মেয়েদের প্রতি মুসলিম পুরুষের যৌন লালসার পালটা জবাব দিতে হবে, বিশ শতকের গোড়ার এই মতাদর্শগত আগ্রাসী ক্যাম্পেইনের বাস্তব ফলশ্রুতি এই গুজরাট দাঙ্গা । ১৯৯৮-এ ক্ষমতায় এসেই গুজরাটের বিজেপি স্বরাষ্ট্র দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী হরেন পান্ডিয়া একটি বিশেষ পুলিশ সেল গঠন করেন যাদের কাজ ছিল আন্তঃধর্মীয় বিবাহগুলি তদারক করা । খুবই চতুরভাবে রাষ্ট্রের তরফে এই ধারণার বিকাশ ঘটানো হতে থাকে যে, হিন্দু মেয়ের সঙ্গে মুসলিম পুরুষের বিবাহ কখনোই স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে ঘটে না । বরং এগুলি গূঢ় উদ্দেশ্যে হিন্দু মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় । হিন্দু মেয়ে ও মুসলিম ছেলের বিয়ের বিরোধিতা করে ভিএইচপি ও বজরং দল লাগাতার প্রচার চালাতে থাকে, যাতে এই বিবাহগুলোর বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করা যায় । বরদৌলির ভিএইচপি নেত্রী কলাবেন প্যাটেল বলেন এসব হল হিন্দু মেয়েদের ফুঁসলে নেওয়ার জন্য মুসলিম পুরুষের চক্রান্ত । গুজরাটের আরএসএস দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রচার করতে থাকে মুসলিম মাদ্রাসাগুলো কীভাবে হিন্দু মেয়েদের ‘সতীত্ব’ নাশ করতে হবে এই ব্যাপারে মুসলিম পুরুষদের তালিম দিচ্ছে । ২০০০ সালে প্রচারিত একটি গোপন পুস্তিকায় বলা হয়েছিল—‘হিন্দু সমাজের উপরে প্রধান আক্রমণ হল যে আমাদের অল্পবয়স্ক বোনদের উৎকোচ ও প্রলোভন দেখিয়ে অপহরণ করা হচ্ছে ও তারপর তাদের, জোর করে ধর্মান্তরিত করিয়ে, বিবাহ-রেজিস্টারে সই করতে বাধ্য করা হচ্ছে । শয়ে শয়ে হিন্দু মেয়েদের এইভাবে গুজরাত রাজ্যে মুসলিম করা হচ্ছে’। এরকমভাবেই দীর্ঘসময় ধরে মুসলিমদের ঘৃণা করা ব্যাপক সামাজিক অনুমোদন লাভ করে । ১৯৯৯ সালে, গুজরাতের মুসলিম অধ্যুষিত রণধিকপুর গ্রাম আক্রমণ করে ভিএইচপি, গুজব রটানো হয় ওই গ্রামে দু’জোড়া দম্পতি আশ্রয় নিয়েছে যাদের মধ্যে মেয়েটি হিন্দু এবং ছেলেটি মুসলিম । এই অভিযোগে গোটা গ্রাম তছনছ করা হয় এবং ৩৫০ টি মুসলিম পরিবারের যাবতীয় সম্পত্তি ধ্বংস করা হয় ।

লক্ষণীয়, এই সংগঠিত হিংসায় হিন্দু মেয়েদের ভূমিকা । আরএসএস ও ভিএইচপি হিন্দু মেয়েদের সংগঠিত করে এবং তাদের ভিতর ব্যাপক হিন্দু-পুরুষতান্ত্রিক/পিতৃতান্ত্রিক প্রচার চালায় । এই সক্রিয় ও সশস্ত্র মেয়েরা পুরোদস্তুর সংঘপরিবারের পিতৃতান্ত্রিক এজেন্ডা ও রেটোরিক আত্মস্থ করে এবং ও সেই অনুযায়ী প্রচারে অংশ নেয় । পিইউসিএল-এর প্রতিনিধিদের কাছে এই মেয়েরা বলে—“ওদের (মুসলিমদের) সঙ্গে যা করা হয়েছে ঠিকই করা হয়েছে । ওদের ৪ টে করে বউ আর ২০ টা করে বাচ্চা থাকে । ওরা জন্মনিয়ন্ত্রণ করায় না । একদিন ওরা আমাদের চেয়ে সংখ্যায় বেশি হয়ে যাবে । ওরা আমাদের ব্যবসা আর চাকরি খেয়ে নিচ্ছে বলেই আমরা গরিব হয়ে পড়ছি”। এভাবেই ‘ধর্ষণকারী ও খুনে’ মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণ-হিংসা ক্রমশ বৈধতা পায় । গুজরাট দাঙ্গার লক্ষণীয় দিক হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের এজেন্ডায় মেয়েদের এই সক্রিয় অংশগ্রহণ । সঙ্ঘ পরিবারের তাত্ত্বিকরা একেই ‘মেয়েদের ক্ষমতায়ন’ বলে প্রচার চালাতে থাকেন । এ হল এমন এক ‘ক্ষমতায়ন’ বা প্রতীক যা মুসলিম মেয়েদের নাগরিকত্ব, যৌনতা এমনকী মৌলিক মানবাধিকার ধ্বংসের হিন্দু পুরুষবাদী রেটোরিকের অংশ হয়ে ওঠে । ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় এভাবেই সাভারকর, হেডগেওয়ার, গোলওয়ালকর ও বি এস মুঞ্জের হিন্দু আধিপত্যের পুরুষতান্ত্রিক, রাষ্ট্রবাদী স্বপ্ন সফল রূপ পায়, যাতে ২০০০ মুসলমানকে হত্যা করা হয়, লক্ষ লক্ষ মুসলমানের সম্পত্তি ধ্বংস করা হয় এবং ব্যাপক হারে মুসলিম মেয়েদের উপর অকথ্য যৌন অত্যাচার ঘটানো হয় । ধর্ষণের মতো বর্বর অস্ত্র ব্যবহৃত হয় একটা গোটা কমিউনিটির নারীর অধিকার খর্ব করে হিন্দু পৌরুষের বিজয় প্রতিষ্ঠার জন্য ।

কয়েকটি কেস স্টাডি : ধর্ষণ যখন পালটা অস্ত্র

সেই আগ্রাসী হিংসা, মুসলিমবিদ্বেষী দাঙ্গা আর মুসলিম মেয়েদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘ পরিবারের যৌন আক্রমণের প্রথম সার্থক ল্যাবরেটরি ছিল ২০০২ সালের গুজরাট । এই গুজরাট দাঙ্গার চরিত্র রীতিমতো আলোচনার দাবি রাখে । প্রখ্যাত সমাজকর্মী বোলান গঙ্গোপাধ্যায় দাঙ্গার অব্যবহিত পরে ‘সিটিজেন্স ইনিশিয়েটিভ’ সংস্থার ডাকে গুজরাট যান । তিনি দেখেন সবরমতী নদীর দুই বিপরীত উপকূলে দুই গুজরাটের দুই আলাদা চিত্র । একদিকে দাঙ্গার আগুন তখনও জ্বলছে । অন্যতীরে সুখী উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত হিন্দু গুজরাটি সমাজ নিশ্চিন্ত ও উদাসীন জীবনযাপন করছে । তিনি লিখছেন—‘সবরমতীর এক পারে নিশ্চিন্ত জীবনযাত্রার এই ছবি কলকাতা থেকে ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসা আমাকে, কেবল হতাশ করেনি, বিস্মিত করেছে । এই উদাসীনতা, যা কিনা নিষ্ঠুরতার নামান্তর বা এই নীরব হিংসা (silent violence)—কীভাবে একে মোকাবিলা করা যায়, আমি জানি না । রাষ্ট্র চায়, তার নাগরিকরা পরস্পরের প্রতি উদাসীন হোক—তাহলে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব বজায় রাখার কাজটি অনেক ভালোভাবে সম্পন্ন হতে পারে । আমেদাবাদের দু’পারের মধ্যে এই ব্যবধান রাষ্ট্রের সেই ইচ্ছাকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছে’। (সুত্র : গুজরাতের ক্যাম্পে ক্যাম্পে / বোলান গঙ্গোপাধ্যায়, অবভাস, এপ্রিল-জুন সংখ্যা ২০০৩)। গুজরাট দাঙ্গার প্রাত্যহিক বিবরণ থেকে এটা আজ পরিষ্কার মুসলিম মেয়েদের উপর যে চরম অত্যাচার করা হয়েছে তার খুব সামান্য অংশই নথিবদ্ধ হয়েছে । এই অপরাধগুলিতে রাষ্ট্র আর পুলিশের পূর্ণ মদত ছিল । যে মেয়েরা ভিক্টিম, তারা খুব কম সংখ্যায় নিজেদের অভিযোগ লেখাতে পেরেছে, কারণ থানা এফ.আই.আর নেয়নি । গুজরাটে এমন কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অস্তিত্বই রাখা হয়নি যার মাধ্যমে এই অত্যাচারিত মুসলমান মেয়েরা ন্যায়বিচার চাইতে পারেন । এমনকি গুজরাটি ভাষার আঞ্চলিক নিউজপেপার, পত্রপত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলের এক সংগঠিত ভূমিকা ছিল মুসলিম মেয়েদের বিরুদ্ধে হিংসা উস্কে দেবার কাজে । আমি লেখার এই অংশে এরকম সামান্য কয়েকটি কেস স্টাডির উল্লেখ করছি, যেখানে হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমান মেয়েদের উপর পাশবিক যৌন অত্যাচার করেছে । এই তথ্যগুলি নেওয়া হয়েছে গুজরাট দাঙ্গার উপর কাজ করা ‘সিটিজেন্স ইনিশিয়েটিভ’ সংস্থার সূত্র থেকে ।

মেয়ের ধর্ষণ সম্পর্কে এক মায়ের বর্ণনা :
(মেদিনা মুস্তাফা ইসমাইল শেখ, এরল গ্রাম, পাঁচমহল জেলা, ৩ মার্চ, ২০০২)

অন্য মুসলিম পরিবারেরা যখন ২৮ ফেব্রুয়ারি গ্রাম ছেড়ে কলোলে পালিয়ে যায়, তখন আমার শ্বশুর, একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক, এ কাজ করতে অস্বীকার করেন । তিনি বিশ্বাস করেছিলেন কেউ আমাদের ক্ষতি করবে না । ২৮ তারিখ…আমার পরিবারের বিভিন্ন সদস্য আক্রান্ত হয়ে দয়া ভিক্ষা করছেন, এই চিৎকার আমার কানে আসে । আমি দেখলাম আমার গ্রামেরই দুজন লোক, গনো বারিয়া ও সুনীল আমার মেয়ে শাবানাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে…আমার মেয়েকে যৌন আক্রমণ করে, অত্যাচার করে মারা হল, অথচ আমি তাকে সাহায্য করতে পারলাম না । আমার মেয়ে ছিল ফুলের মতো । তার জীবনের অভিজ্ঞতাই হয়নি…ওই লোকগুলো আমার প্রিয় মেয়েকে টুকরো টুকরো করে ফেলে । কিছুক্ষণ পর দাঙ্গাবাজগুলো বলছিল—“ওদের টুকরো টুকরো করে করে কাটো, কোনও প্রমাণ রেখো না”। আমি দেখলাম আগুন জ্বালানো হচ্ছে…

২৫ বছর বয়স্ক জারিনার গণধর্ষণ : স্বামী নঈমুদ্দিম ইব্রাহিম শেখের বিবরণ:
(হুসেন নগর, নারোদা পাটিয়া, আমেদাবাদ, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০২)

সব শুরু হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯ টায় । তখনই দঙ্গল আসে, চিৎকার করে—“মিঞা ভাই নিকালো”। তারা অনেকে কেশরী চাড্ডি পরে ছিল । তাদের মধ্যে ছিল গঙ্গোত্রী সোসাইটি আর গোপীনাথ সোসাইটির ছেলেরা । আমি আমাদের বাড়ির থেকে গোটা পরিবারকে নিয়ে দৌড়ে পালাই—মা, বাবা, বোনের মেয়ে, আমার স্ত্রী জারিনা, আমার ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী এবং আমার ভাইয়ের মেয়ে—সব মিলিয়ে আমরা এগারো জন ছিলাম । আমরা দৌড়ে যাই পুলিশ চৌকির দিকে । পুলিশ বলে—“গোপীনাথ আর গঙ্গোত্রীর দিকে যাও”। ভিড়ের মধ্যে আমার স্ত্রীর ও আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়…হামলাবাজদের হাত থেকে পালানোর চেষ্টায় ও একটা পাঁচিল টপকানোর চেষ্টা করে । কিন্তু ও আটকে পড়ে একটা কানাগলিতে । ওরা ওকে গণধর্ষণ করে এবং একটা হাত কেটে নেয় । ওকে উলঙ্গ অবস্থায় পাওয়া যায়…

ধর্ষণের পরও বেঁচে আছে, এমন এক সাক্ষী, সুলতানীর কণ্ঠস্বর :
(এরল গ্রাম, কলোল তালুক, পাঁচমহল জেলা, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০২)

২৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে, হিংস্র জনতার হাত থেকে পালাবার জন্য আমরা জনা চল্লিশ একটা টেম্পোতে চেপে বসি…কলোলের ঠিক বাইরে একটা মারুতি গাড়ি রাস্তা আটকে রাখা ছিল । সেখানে অপেক্ষা করছিল একটা দঙ্গল…ওরা আমাদের আক্রমণ করে…আমি আমার ছেলে ফয়জানকে নিয়ে যাচ্ছিলাম…লোকগুলো আমাকে পিছন থেকে ধরে মাটিতে ফেলে দেয় । ফয়জান আমার হাত থেকে পড়ে যায় ও কাঁদতে শুরু করে । লোকগুলো আমার সমস্ত জামাকাপড় খুলে ফেলে । আমাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে দেয় ওরা । তারপর ওরা একের পর এক আমাকে ধর্ষণ করে । পুরোটা সময় আমি আমার ছেলের কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম । ৩-টের পর আমার গোনার হিসেব নেই । তারপর ওরা একটা ধারালো হাতিয়ার দিয়ে আমার পা কাটে এবং ওইভাবে আমাকে ফেলে রেখে যায়…

মেয়েদের বিরুদ্ধে এই যাবতীয় হিংসার ঘটনাকে সঙ্ঘ পরিবারের তরফে গৌরবান্বিত করা হয় । বহু জায়গায় স্বামী প্রকাশ্যে মুসলিম মেয়েকে ধর্ষণ করে ঘরে ফিরেছে এবং স্ত্রী সেই স্বামীর মাথায় তিলক পরিয়ে তাকে বরণ করে নিচ্ছে—এই ঘটনা সেদিন গুজরাটে ঘটেছে । নারোদা পাতিয়ার বিজেপি বিধায়ক মায়া কোদনানিকে যখন এই গণধর্ষণের বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় তিনি আত্মপ্রসাদপূর্ণ হাসি হাসেন ও নির্লিপ্ত ভাবে বলেন—“আচ্ছা, ইয়ে কেয়া সাচ্‌ হ্যায় ? শুনা হ্যায় এক পুলিশওয়ালে নে মুঝে বাতায়া কি আইসে হুয়া হ্যায় পর উসনে কুছ দেখা নেহি”। এভাবেই পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মদতে হিন্দুত্ববাদী ধর্ষণের এজেন্ডাকে বাস্তবায়িত করা হয়েছিল সেইদিন ।

মুসলিম মেয়ের শরীর : যৌন সম্পত্তি/ সাম্প্রদায়িক সম্পত্তি

জন্মলগ্ন থেকে আরএসএস-এর একমাত্রিক লক্ষ্য ভারতের বহুমাত্রিক জাতিরাষ্ট্রের কাঠামোকে ধ্বংস করে একটি কেন্দ্রীভূত একমাত্রিক ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ হিসেবে ভারতকে গড়ে তোলা । সেই কল্পিত ‘হিন্দুরাষ্ট্রে’ মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, পারসিক সকলেই চিহ্নিত ‘অপর’। এমনকি তারা চায় হিন্দুধর্মের নানামাত্রিকতাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে হিন্দুধর্মের ভিতরেই যে বৈচিত্রময় বিভিন্ন কম পরিচিত সেক্ট রয়েছে তাদের মুছে দিতে । ওরা চায় এক ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরাষ্ট্র যেখানে মনুবাদী সমাজকাঠামো ও বর্ণবৈষম্য চিরস্থায়ী হবে । ওদের সরসঙ্ঘচালকেরা সকলেই মুলত মহারাষ্ট্রের চিৎপাবন ব্রাহ্মণ, এমনকি ওদের গোটা সংগঠনে কোথাও কোনও নারী-প্রাধান্য নেই । মূলত হিন্দু পুরুষদেরই এই সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে জায়গা দেওয়া হয় । যদিও জন্মের কিছুদিন পরে ওরা নারী-সংগঠনও তৈরি করে । কিন্তু সেই নারী-সংগঠনগুলোও মূল আরএসএস-এর পিতৃতান্ত্রিক, মনুবাদী, পুরুষতান্ত্রিক আইডিওলজি দ্বারা গভীরভাবেই প্রভাবিত । এবং এই ডিসকোর্স বাখতিনের ভাষায় একধরনের ‘পারফরম্যান্স’। একেবারে গোড়া থেকেই অজস্র আইডিওলজিক্যাল লেখাপত্রের মাধ্যমে এই উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনটি নিজেদের মতাদর্শকে প্রচার করেছে । বিভিন্ন ধরনের প্রচারমূলক সাহিত্য, রিপোর্টাজধর্মী রচনা, স্যাটায়ারমুলক লেখা ছাড়াও এক বিশাল লিটারারি আর্কাইভ ওরা গড়ে তুলেছে যা ওদের মতাদর্শ প্রচারের হাতিয়ার । এই বিপুল আর্কাইভ কিন্তু একেবারেই সমস্বত্ব নয়, তার রয়েছে পরিস্থিতি, সময়মাত্রা ও টার্গেট-গ্রুপ অনুযায়ী বিভিন্নরকম তথ্য-সমাহার ও প্রকাশভঙ্গি । কিন্তু এই সামগ্রিক তাত্ত্বিক ভাণ্ডারটির মধ্য দিয়ে মুসলিম নারীকে একটি বিশেষ ধরনের আর্কেটাইপের ছাঁচে ফেলা হয়েছে ও তাদের এক বিশেষ ধরনের সাম্প্রদায়িক ও যৌন সম্পত্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে হিন্দু পুরুষের মননে । পুরোটাই মুসলিম মেয়েদের অবনমিত ও হিন্দুর তুলনায় নীচু এক ধরনের জীব হিসেবে ।

কিন্তু আরএসএস অনেক বেশি মনোযোগ দিয়েছে হিন্দু পুরুষ সম্পর্কিত একটি স্থির আইডিওলজি তৈরি করতে । এবং এই মডেলের উপর ভিত্তি করেই মুসলিম মেয়েদের মডেলটি তৈরি করা হয়েছে । আরএসএস-এর মতাদর্শ অনুযায়ী হিন্দু পুরুষের মূলত দুটি ভূমিকা—একটি হল, ‘প্রচারক’, অন্যটি হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ‘গৃহস্থ’। ‘প্রচারক’-রা নিজেদের গড়ে তুলবেন প্রায় সন্ন্যাসীর আদলে । তাঁরা হবেন ‘আশ্রমিক’ বা ‘ব্রহ্মচারী’। ‘প্রচারক’ হবেন অবিবাহিত, যৌনতামুক্ত, তাঁর জীবনে নারীর কোনও অস্তিত্ব থাকবে না । ‘হিন্দুরাষ্ট্র’-কে বাস্তবায়িত করার জন্য তাঁর জীবন জনহিতে উৎসর্গীকৃত । তিনি সাহসী, সবল পৌরুষের অধিকারী এবং নিজে ‘হিন্দু’ হিসেবে সচেতন ও গর্বিত । উল্টোদিকে ‘গৃহস্থ’ হিন্দু পুরুষের কার্যক্রম ভাগ করা আছে গার্হস্থ্য এবং জাতীয় কর্তব্য সম্পাদনে । সে যদি চিরকৌমার্য ধারণ করে তবে সেটাই কাঙ্ক্ষিত, তবে বিবাহিত হলেও ক্ষতি নেই । এই আদর্শ হিন্দু পুরুষের কাউন্টারপার্ট আরএসএস-এর মতে পাশ্চাত্যশিক্ষায় শিক্ষিত দেশীয় পুরুষ । আরএসএস মনে করে এরা মেয়েলি, চরিত্রহীন, পার্থিব ধনসম্পদে আসক্ত এবং এরা নারীকে প্রকৃত সম্মান দিতে জানে না । তারা মুসলিম পুরুষকে প্রশ্রয় দেয় এবং এদের জন্যই মুসলিম পুরুষ হিন্দু নারীকে অসম্মান করার সাহস পাচ্ছে । অপরপক্ষে হিন্দু আদর্শ রমণী বলতে আরএসএস বোঝে সেই গৃহস্থ নারীকে যার প্রধান কর্তব্য সন্তানপালন । সুশীলা রমণী যে কেবল মাতা, বধূ, বোন ও স্ত্রী—এই আর্কেটাইপটাই আরএসএস-এর একমাত্রিক আকাঙ্ক্ষা নারীর কাছে । ঠিক এর কাউন্টারপার্ট হল নারীবাদী, অধিকারসচেতন, আধুনিক, কর্মজগতে পা¬-রাখা মেয়েরা, যাদের আরএসএস দাগিয়ে দেয় ‘পাশ্চাত্যের নকলনবিশ’ হিসেবে, যারা কেরিয়ারের জন্য স্বামী, পরিবার এমনকি সন্তানকেও অবহেলা করে । এই আদর্শায়নের আদলেই গোটা মুসলিম সমাজ আরএসএস-এর কাছে হিন্দু সমাজের চিহ্নিত ‘অপর’ এবং ‘শত্রু’। এদের আবার দুটি ভাগ—আক্রমণকারী বহিঃশত্রু মুসলিম এবং ভারতের ধর্মান্তরিত মুসলিম । আরএসএস বিশ্বাস করাতে চায় সমস্ত মুসলিম হল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের শত্রু ও ভারত-বিদ্বেষী । তারা নারীকে সম্মান দিতে জানে না । মোটের উপর আরএসএস একটি যৌনতাবিদ্বেষী সংগঠন যারা যৌনতা জিনিসটাকেই নঞর্থক দৃষ্টিতে দেখে এবং বোঝাতে চায় যাবতীয় যৌনচরিত্রের একমাত্র ধারক মুসলিম পুরুষেরা । তারা সম্ভাব্য বহুগামী এবং ধর্ষক ।

মহাদেব সদাশিব গোলওয়ালকর-এর একাধিক লেখায় মুসলিম নারীর সম্পর্কে স্পষ্ট চরিত্রায়ন করা হয়েছে । এই প্রধান সরসঙ্ঘচালক বলেছিলেন মুসলিম মেয়েরা তিনপ্রকার—পাকিস্তানি মুসলিম মহিলা, ভারতীয় মুসলিম মহিলা এবং এই দুই দেশের বাইরে সাধারণ মুসলিম মহিলা । পাকিস্তানি মুসলিম মহিলাদের কোথাও কোথাও পাকিস্তানি মুসলিম পুরুষের সঙ্গে একসূত্রে গেঁথে দেখানো হয়েছে যে এরাও একইভাবে পাকিস্তানে বসবাসকারী হিন্দু পুরুষের পক্ষে কর্মসংস্থানের অন্তরায় । সাধারণ ভাবে আরএসএস দেখাতে চায় মুসলিম মহিলা মাত্রেই বোরখা-পরিহিত এবং গৃহে আবদ্ধ । কিন্তু পাকিস্তানের শহর ও গ্রামাঞ্চলের কর্মীবাহিনীর একাংশ মহিলা—এটা আরএসএস-এর সূত্রায়ণের বিরোধী । অতএব তারা পাকিস্তানি কর্মী মুসলিম মহিলাদের এই ভাষায় ও যুক্তিতে আক্রমণ করে যে মহিলা মাত্রেই ঘরে থাকাই কর্তব্য, নইলে বাইরের কর্মজগতে তারা হয়ে পড়বে পুরুষের প্রতিবন্ধক এবং আরএসএস-সূত্রায়িত নারীর গার্হস্থ্য-ভূমিকার সম্পূর্ণ বিপরীত । এক্ষেত্রে মুসলিম কর্মী নারী ও কর্মসূত্রে হিন্দু বহির্গামিনী এক ব্র্যাকেটে এসে পড়ে । অন্য একটি ভাষ্যে দাবি করা হয় মুসলিম মহিলারা হিন্দু রমণীর একেবারেই বিপরীত—স্বভাবচরিত্র ও সতীত্বের নিরিখে । মুসলিম মহিলারা অসতী, বহুগামী ও বেশ্যার সমতুল্য—এরকম দাবিও করা হয়েছে আরএসএস-এর লেখায় । আর একটি ছবি আঁকা হয়েছে যেখানে মুসলিম মহিলারা হল সন্তান উৎপাদনের উর্বর যন্ত্র মাত্র—তাদের কারণেই মুসলিম জনঘনত্ব হিন্দু জন্মহারের চেয়ে বেশি হারে বাড়ছে । মুসলমান একটি ওভার-পপুলেটেড জাতি, এবং এর জন্য দায়ী তাদের মেয়েরাই । তারা মুসলিম পুরুষের বহুগামিতার নেপথ্য কারণ । অর্থাৎ মুসলিম নারী হল সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র কিন্তু হিন্দু নারীর তুলনায় তাদের মাতৃত্বের গুণাবলি একেবারেই কম—এটাই আরএসএস-এর সূত্রায়ণ । তাদের মতে মুসলিম নারীর ‘মুক্তি’ ঘটতে পারে একমাত্র তখনই যদি তারা দলে দলে হিন্দু পুরুষদের বিবাহ করে । এখানে ‘নারীমুক্তি’-র এক উলটো ও প্রতিক্রিয়াশীল ব্যাখ্যা চোখে পড়ে যেখানে মুসলিম নারীকে হিন্দু পুরুষের যৌনসম্পত্তিতে পরিণত করার আকাঙ্ক্ষা সুস্পষ্ট । এভাবেই আরএসএস-এর তাত্ত্বিক ভাবনায় মুসলমান নারী পুরোদস্তুর হিন্দু পুরুষের সম্প্রদায়গত সম্পত্তিতে পরিণত হয়, যাকে হিন্দুর উদ্দেশ্যে যেভাবে খুশি ব্যবহার করা যায় ।

কিন্তু এই আগ্রাসী ভাবনা কেবল মুসলমান মেয়েদের সম্পর্কে জঙ্গি হিন্দুত্ববাদে সীমাবদ্ধ নয়। এই লেখা সম্পূর্ণ হবে না, নিজেদের কৌম অর্থাৎ হিন্দু কমিউনিটির ভিতরেই মেয়েদের সম্পর্কে আরএসএস সঙ্ঘ পরিবার কী ভাবে সে সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা না থাকলে। ১৯২৫ সালে আরএসএস প্রতিষ্ঠিত হলেও এই জঙ্গি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনটির ভিতরে মেয়েদের কাজ করার কোনও অধিকার ছিল না। তাই, আরএসএস প্রতিষ্ঠার এগারো বছর বাদে মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধায় ড. হেডগেওয়ারের পরিকল্পনায় প্রতিষ্ঠিত হয় সঙ্ঘ পরিবারের মহিলা শাখা—‘রাষ্ট্র সেবিকা সঙ্ঘ’। এর প্রথম নেত্রী হন লক্ষ্মীবাঈ কেলকার। মূলত সঙ্ঘের নেতা-কর্মীদের স্ত্রী এবং বাড়ির মেয়েদের নিয়ে গড়া হয় এই সংগঠনটি—সঙ্ঘের পুরুষেরা যখন তাঁদের ‘দেশপ্রেমিক’ কর্তব্য করতে বাইরে যাবেন, তখন তাঁদের পরিবারের অন্তঃপুরের দায়দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁদের মেয়েদের এই সংগঠনটিকে নিযুক্ত করা হয়। কোনও অবস্থাতেই সঙ্ঘ পরিবারের কোনও কর্মোদ্যোগেই নারী ও পুরুষের একত্র কর্ম সম্পাদনের কোনও চল কোনওকালেই ছিল না। আরএসএস কর্মীদের স্ত্রী-কন্যাদের কাজ মূলত সঙ্ঘের শিবির ও মিটিং-এ রান্নাবান্না, পরিষ্কার করা ইত্যাদির মধ্যেই সীমিত থাকে। সঙ্ঘের প্রথম ৫০ বছরের ইতিহাসে সাধ্বী ঋতম্ভরা বা উমা ভারতীর মতো ফায়ারব্র্যান্ড নিম্নবর্গ থেকে উঠে আসা নেত্রীদের সেইভাবে কখনওই দেখা যায়নি। গোয়ালিয়রের রাজমাতা বিজয়রাজে সিন্ধিয়া এর আগে সঙ্ঘের বিভিন্ন কোর কমিটির মিটিং-এ থাকতেন বটে, কিন্তু সেটা ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের প্রতিনিধি হিসেবে। আর বিবিধ সামাজিক ইস্যুতে বিজয়রাজে সিন্ধিয়া ছিলেন চরমতম রক্ষণশীল মানসিকতার অধিকারী ও ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার মুক্ত প্রচারক। সঙ্ঘ পরিবার বিশ্বাস করে, সামাজিক কাঠামোয় মেয়েরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। উত্তরপ্রদেশে সামাজিক পরিবর্তন ও বিকাশের উপর লেখা একটি পাঠ্যপুস্তকে বলা হয়েছে—‘আইন মেয়েদের যে অধিকার দিয়েছে সেগুলো পরিবার ভেঙে যাবার কারণ। এইসব আইনগুলো মেয়েদের অবস্থান উঁচু করে দিয়েছে। মেয়েদের স্বপক্ষে সরকার এইসব প্রগতিশীল আইন প্রবর্তনের ফলে পরিবারের উপর চাপ ও বিবাদ-বিসংবাদ বেড়ে গেছে’। ১৯৯৪ সালে বিজেপিওর মহিলা মোর্চার প্রেসিডেন্ট মৃদুলা সিন্‌হা বলেন—‘ভারতীয় জনতা পার্টিতে আমরা নারীমুক্তির বিরোধী, কারণ তা পুরুষদের বিরুদ্ধে যায়। আমরা মেয়েদের আরও মানিয়ে নিতে বলি, কারণ স্বামী ছেড়ে গেলে তাদের যাওয়ার কোনও জায়গা থাকবে না’। সঙ্ঘের কাছে আধুনিকতার অর্থ হল পশ্চিমা পোশাক আর অনৈতিক জীবনযাত্রা। একে যৌন বিকৃতি হিসেবেই দেখে এরা, গ্রহণযোগ্য মনে করে না। বিজেপির নীতি অনুযায়ী মেয়েরা পরিবারে তাঁদের ঐতিহ্যবাহী ও রক্ষণশীল ভূমিকাই পালন করে চলবে। আরএসএস-এর সংগঠন বিবেকানন্দ কেন্দ্রের পূর্বতন প্রেসিডেন্ট ও আরএসএস নেত্রী ড. এম লক্ষ্মী কুমারী বলেন—‘আজকাল মেয়েদের ক্ষমতায়ন নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ও স্বাধীনতা অবশ্যই মেয়েদের জীবনে খানিক আত্মবিশ্বাস, সুস্থিতি ও সান্ত্বনা আনতে পারে, কিন্তু তা মেয়েদের নিজেদের, পরিবারের বা সমাজের ভেতরকার গভীর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সক্ষম করে তোলে না’। তিনি আরও বলেছেন, ভারতীয় নারীকে শিখতে হবে ঘৃণাকে ভালোবাসা দিয়ে, গার্হস্থ্য হিংসাকে অহিংসা ও সহানুভূতি দিয়ে, স্বার্থকে নিঃস্বার্থ ভাবনা দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। অর্থাৎ হিংস্র, স্বার্থপর, কঠিন পুরুষদের অধীনস্থ হয়ে তাদের মেনে চলতে হবে ভারতীয় মেয়েদের, সঙ্ঘের মতে সেটাই ভারতীয় নারীর মুক্তি ও ক্ষমতায়নের লক্ষণ। আরএসএসের কাছে মেয়েদের স্বাভাবিক গার্হস্থ্য ভূমিকা হল মা ও স্ত্রী হয়ে ওঠা। এমনকি মধ্যপন্থী বিজেপি নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী একবার বলেছিলেন—“যেসব মেয়েরা পুরুষ হতে চায়, আর অন্য মেয়েদেরও পুরুষের মতো তৈরি করতে চায়, তারা উপহাসের পাত্র”। এই ক্ষুদ্র আলোচনায় মুসলিম মেয়েদের ভোগ্যবস্তু হিসেবে দেখা সঙ্ঘ পরিবার যে নিজেদের কৌমের মেয়েদেরও কমিউনিটির সম্পত্তির চেয়ে বেশি কিছু হিসেবে দেখে না, সেটাই বলা হল। এর সবচেয়ে হিংদস্র এবং মূর্ত রূপ দেখা গিয়েছিল ১৯৮৭ সালে রাজস্থানের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে রূপ কানোয়ার ‘সতী’ হবার পর। মৃত স্বামীর চিতায় তাঁকে জোর করে পোড়ানো হয়েছিল। রাজমাতা বিজয়রাজে সিন্ধিয়া ভারতীয় বিধবাদের স্বেচ্ছায় তাদের স্বামীর চিতায় আত্মাহুতি দেবার পক্ষে দাঁড়ান। উল্টোদিকে উমা ভারতী সমস্ত ধরনের ‘সতী’ প্রথার বিরোধিতা করেন। তিনি পরিষ্কার বলেন, এর সঙ্গে ধর্মের যতো না সম্বন্ধ, তার চেয়ে বেশি সম্পর্ক মহিলাদের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার। এরা দুজনেই ক্রমশ বদলে যেতে থাকা সঙ্ঘ পরিবারের দুই ভিন্ন কৌশলী মুখকে প্রকাশ করেন, যেখানে সিন্ধিয়া হিন্দু রক্ষণশীলদের ভাষায় কথা বলবেন আর উমা ভারতী সামান্য নমনীয় ভাষায় নারীর অধিকারের পক্ষে দাঁড়াবেন। সাধ্বী ঋতম্ভরা ও উমা ভারতী বিজেপির এলিট চরিত্র লুকিয়ে রাখার দুই হাতিয়ার। এঁরা দুজনেই উঠে এসেছেন নিম্নবর্ণ ও গরিব পরিবার থেকে। বিজেপি এদের ব্যবহার করে চলেছে তৃণমূল স্তরে অর্থাৎ সাবঅল্টার্ন স্তরে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে নেবার কৌশল হিসেবে।

গ্রন্থঋণ :
গর্ভঘাতী গুজরাট: গুজরাতে নারী নিধনের দলিল সংকলন; সম্পা. সোমা মারিক, মৈত্রেয়ী চট্টোপাধায়। পিপলস বুক সোসাইটি, কলকাতা, সেপ্টেম্বর, ২০০৪
Gender in the Hindu Nation :RSS Women as Ideologues. Paola Bacchetta, Kali for Women, New Delhi, 2004
In The Belly of The Beast: The Hindu Suprimacist RSS and BJP of India: an Insoder’s Story/ Partha Banerjee, Ajanta Books International, New Delhi, 1998

রচনাকাল : ২০২০

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২