লেখকমাত্রই বিপুল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ : আহমাদ মোস্তফা কামাল

লেখকমাত্রই বিপুল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ : আহমাদ মোস্তফা কামাল

শেয়ার করুন

আহমাদ মোস্তফা কামাল। ঔপন্যাসিক। ১৯৬৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশোনার বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে ভীষণ জনপ্রিয়। কথাসাহিত্যে-প্রথম আলো বর্ষসেরা বই, এইচএসবিসি কালি ও কলম এবং জেমকন সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। একলা থাকার গল্প, অন্ধ জাদুকর, ঘরভরতি মানুষ অথবা নৈঃশব্দ্য, কান্নাপর্ব, পরম্পরা, শিল্পের শক্তি শিল্পীর দায় উল্লেখযোগ্য বই। কথাসাহিত্যিক হামিম কামালকে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে বাংলা উপন্যাসের সংকট ও সম্ভাবনার দিকগুলো নিয়ে কথা বলেছেন।
হামিম কামাল : যার অস্তিত্ব আছে, তার অস্তিত্বসংকটও আছে। বাংলা উপন্যাস অস্তিত্বমান। সুতরাং এর সংকটটাও নিশ্চয়ই লক্ষণীয়। আমাদের উপন্যাসের সবচেয়ে বড় সংকট কোনটি বলে আপনি মনে করেন?
আহমাদ মোস্তফা কামাল : বাংলা উপন্যাস তো বেশ বড় প্রেক্ষাপট হয়ে গেল। সেই প্যারিচাঁদ মিত্র থেকে শুরু, বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ পেরিয়ে প্রায় দেড়শো বছরের পথ পরিক্রমা মাথায় রেখেই যদি বলি, তাহলে বোধ হয় বলা যায়, সংকট অতীতে যা ছিল, বর্তমানেও তাই আছে। আত্মপরিচয়ের সংকট। এই একটাই। বাঙালি মুসলমান যেমন আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগে যে সে বাঙালি নাকি মুসলমান, আমাদের উপন্যাসও তেমনই একটা সংকটে ভুগছে। তা হল, আমাদের উপন্যাসের ধারা কী হবে, বা কোন্ ধারা অনুসরণ করব? উপন্যাস বা ছোটগল্প বাঙালির আবিষ্কার নয়, ফলে এই শিল্পমাধ্যমগুলোর ফর্মের ব্যাপারে আমরা সবসময় বাইরের দিকে তাকিয়েছি। বিশ্বসাহিত্যে উপন্যাস হচ্ছে নবীনতম শাখা, কবিতার মতো প্রাচীন শাখা নয়। তো বিশ্বউপন্যাসের মোটা দাগে কয়েকটি ধারা আছে। যেমন ইউরোপীয় ধারা, রুশ ধারা, লাতিন আমেরিকান ধারা ইত্যাদি। এই ধারাগুলো খুব শক্তিশালী। আমাদের সাহিত্যে রুশ উপন্যাসের প্রভাব কিন্তু মারাত্মক। লাতিন আমেরিকার উপন্যাস আমাদের এখানে এসে পৌঁছেছে অনেক পরে, এর আগে এসেছে রুশ উপন্যাস, তারও আগে ইউরোপীয় উপন্যাস। এই যে একেক সময় একেক ধরনের উপন্যাস এল, আমরা পড়তে গিয়ে নতুন নতুন স্বাদ পেলাম, এর ফলে আমাদের উপন্যাসের ফর্ম কী হবে এটা নিয়ে লেখকদের মধ্যে একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা দিল। এটা নিয়ে বেশ বিতর্কও হয়। যেমন দেবেশ রায় একটা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আমি নিজ কানে শুনেছি, যে, একটা উপন্যাস নাকি শুরুই হয় দেড়শো পৃষ্ঠার পর, আর আমাদের উপন্যাস শেষ হয়ে যায় দেড়শো পৃষ্ঠায়; আমরা তো উপন্যাস লেখাই শিখলাম না। তাঁর এ ধারণা হল কেন? কেন উপন্যাস দেড়শো পৃষ্ঠায় শেষ হতে পারে না? এর কারণ হচ্ছে, তিনি রুশ উপন্যাস প্রভাবিত লেখক। তিনি মনে করেন পৃথিবীর আদর্শ উপন্যাস হচ্ছে রুশ উপন্যাস। পরিসর অনেক বড় হবে, বিপুল বিস্তার থাকবে, ডিটেইলিঙের প্রচুর কাজ থাকবে ইত্যাদি। এটিই বোধহয় উপন্যাসের আদর্শ। এরকম ধারণা আমাদের বহু লেখকের মধ্যেই বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছে। যখন আবার লাতিন আমেরিকান ঘরানার উপন্যাস এল, বলা হল উপন্যাস এমন ধারার হওয়া উচিৎ। ইউরোপকে বা ওয়েস্টার্ন ধারাকে আমরা সবসময় অ্যাভয়েড করতে চাই, যদিও আমরা প্রথমে শুরু করেছিলাম ওই ধারাতেই। বঙ্কিম শুরু করেছিলেন ওয়েস্টার্ন উপন্যাসের ধারা থেকে প্রভাবিত হয়ে। ওখান থেকে আমরা বের হয়ে আসতে চাই। এ কারণেই আমরা কখনো রুশের মতো হতে চাই, কখনো লাতিন আমেরিকার মতো হতে চাই, মানে, আমরা কারো না কারো মতো হতে চাই, কিন্তু কখনোই নিজের মতো হতে চাই না। আমরা কখনো ভাবিনি, বাংলা উপন্যাসের একটা নিজস্ব চরিত্র দাঁড়াতে পারে বা দাঁড়িয়ে গেছে। যদি আফ্রিকার উপন্যাসের একটা আলাদা চরিত্র থাকতে পারে, যদি লাতিন উপন্যাসের একটা আলাদা চরিত্র থাকতে পারে, যদি রুশ উপন্যাসের একটা নিজস্ব চরিত্র থাকতে পারে, তাহলে বাংলা উপন্যাসের একেবারে নিজস্ব এবং ইউনিক একটা চরিত্র থাকতে পারবে না কেন? কেউ কেউ বলে থাকেন বাঙালি নাকি দীর্ঘ গদ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, এজন্যে একসময় থেমে যায় এবং এ কারণেই তাদের উপন্যাস হয় ছোট। আমরা যদি অল্প কথায় গল্পটা বলতে পারি, আমাদের বেশি কথার দরকার কী? মূল কথাটা হল লেখক যে গল্পটা বলতে চান, তা কোন্ ধরনের গদ্য ডিমান্ড করবে, কোন ধরনের ফর্ম ডিমান্ড করবে, কতটুকু পরিসর দাবি করবে, এটা তো ওই গল্পই বলে দেবে। এর তো কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা নাই। যদি লেখকরা ভাবতেন যে উপন্যাসের কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা থাকতে পারে না, অন্য যে কোনো শিল্পের মতোই উপন্যাস তার আপন গতিতে চলে এবং কোনো একটা সময় শেষ হয়, বেশ হত। উপন্যাস পঞ্চাশ পৃষ্ঠারও হতে পারে হাজার পৃষ্ঠাও হতে পারে, কিছু যায় আসে না। মূল ব্যাপারটা হচ্ছে, ওটা শিল্পসম্মত উপন্যাস হল কিনা। আমরা যেহেতু এখনও খুব কনফিউজড, পুরনো থেকে নতুনরা, এ বিতর্ক আমরা করেই চলেছি। আমার মনে হয় এতকাল পরে আমাদের অন্তত এই জায়গায় এসে দাঁড়ানো দরকার যে, বাংলা উপন্যাস, বাংলা উপন্যাসের মতোই। এ পর্যন্ত যত কাজ হয়েছে সব নিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে পর্যালোচনা করে দেখুন, দেখবেন বাংলা উপন্যাসের একটা নিজস্ব চরিত্র দাঁড়িয়ে গেছে, এটা আর কারো মতো নয়, আমাদের মতো। এইভাবে চিন্তা যদি করেন, দেখবেন আপনার উপন্যাস দাঁড়িয়েছে, আপনার উপন্যাস আপনার পরিচয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু যদি তা না করেন, আপনার উপন্যাস কখনো লাতিন আমেরিকার উপন্যাস হবে, কখনো ইউরোপীয় উপন্যাস হবে, কখনো রুশ উপন্যাস, আফ্রিকান উপন্যাস হবে, কোনোদিনই আপনার বাংলা উপন্যাস হবে না।

হামিম কামাল : এটা আশার কথা কামাল ভাই, নিজস্ব একটা চরিত্র দাঁড়িয়ে গেছে আপনি বলছেন। বোধহয় এবার এটাকে আরো রসিয়ে তোলা দরকার। আরেক দিক থেকে আরো স্থিত করা দরকার। বেশ। উপন্যাসকে হাতে নিয়ে বর্তমান সমাজ-রাজনৈতিকতার দিকে চোখ রাখতে চাই। জানতে চাই, উপন্যাস ও রাজনীতি কতটা ঘনিষ্ঠ। এ ব্যাপারে বলুন। 
আহমাদ মোস্তফা কামাল : সত্যি কথা বলতে কী, উপন্যাস আর রাজনীতির সরাসরি কোনো সম্পর্ক আমি দেখতে পাই না, বরং উপন্যাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখতে পাই নন্দনতত্ত্বের, নান্দনিকতার, শিল্পের, সৌন্দর্যের। তার মানে এই নয় যে উপন্যাসে রাজনীতি আসে না। উপন্যাস এমন শিল্প যেখানে জীবনের সব কিছুই আসে। এই ‘সবকিছু’ বলতে যা যা মনে আসে তা এবং যা আসে না তাও। বলাই বাহুল্য, আমরা কেউ রাজনীতির বাইরে নই। এই যে বসে দুজন কথা বলছি, দু’জনের এই কথা বলাটাকেও যদি অন্য কোনো একজন লেখক তুলে আনেন উপন্যাসে, তবে এটাও হবে রাজনীতিগত ব্যাপার। কারণ একটা কোনো রাজনীতি আমাদের এক করেছে এবং অজান্তেই আমরা এর দ্বারা পরিচালিত হচ্ছি। কোনো জায়গায় যদি আমাদের মতের মিল না হতো, আমরা এক জায়গায় বসতে পারতাম না। এসবের পেছনে রাজনীতির একটা যোগসূত্র আছে। উপন্যাস জীবন নিয়ে কাজ করে। ওই অর্থে রাজনীতির সঙ্গে তা জড়িত। তবে রাজনীতি বলতে আমরা যে উচ্চকিত ব্যাপারটা বুঝে থাকি, প্রত্যক্ষ রাজনীতি, তার বিষয়ে বলি। যে সমস্ত উপন্যাস ওই ধরনের প্রত্যক্ষ রাজনীতি নিয়ে কাজ করেছে, দেখেছি ওগুলো একটা সময় হারিয়ে গেছে। কিংবা ওগুলোর আবেদন, তীব্রতা হারিয়ে গেছে। কেন এমন হয়? একটা কথা কি জানেন? কথাসাহিত্যের একটা সংকট বা সমস্যা আছে। এটা কবিতা বা গানের মতো না। কবিতা বা গান একেবারেই একটা বিমূর্ত ব্যাপার নিয়ে লেখা হতে পারে, গাওয়া হতে পারে। কিন্তু উপন্যাস সাধারণত সমসাময়িক বাস্তবতা, রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে লেখা হয়। আপনি বলতে পারেন উপন্যাস হচ্ছে, লেখকের জন্য সমসাময়িক বাস্তবতা টুকে রাখার ডায়রি। এখন উপন্যাস লেখার পরে ২০/৩০/৫০ বছর পর ওই বাস্তবতা তো আর থাকবে না। মানিকের যে বাস্তবতা ছিল সেটা তো এখন নেই, বিভূতির যে বাস্তবতা ছিল, বঙ্কিমের, রবীন্দ্রনাথের যে বাস্তবতা ছিল সেটা তো এখন নেই। তাহলে তাদের উপন্যাস কি মরে যাবে? প্রশ্নটা সেখানে। মরবে সে-সমস্ত উপন্যাস যেগুলো সময়কে অতিক্রম করতে পারে না। ওই যে বললাম, এটা একটা সমস্যা। উপন্যাস সাধারণত সমসাময়িক জীবন, বাস্তবতা নিয়ে লেখা হয় বলে এমন একটা চ্যালেঞ্জ নিতে হয় যেন তা সময়কে অতিক্রম করে যায় এবং শুধু তাই না, দেশকালের যে বাস্তবতা, স্থানের যে বাস্তবতা, সেটাকেও অতিক্রম করে যায়। আক্ষরিক অর্থে যে কোনো উপন্যাস, যে কোনো গল্প তো আসলে আঞ্চলিক গল্প। উপন্যাসে আপনি কোনো একটা অঞ্চলকে ধরেন। একটা অঞ্চলের মানুষ, ভাষা, জীবনযাপনের পদ্ধতিকে আপনি ধারণ করেন। এরপরও কোনো কোনো উপন্যাস আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে, তাই না? আমরা তো লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, রাশিয়া, ইউরোপের উপন্যাস পড়ছি। এর মানে বাংলা উপন্যাসও ওখানে পড়া হতে পারে। কোনো কোনো উপন্যাস আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে, আগেই বলেছি। কোন গুণে তা হয়ে ওঠে? কোনো কোনো উপন্যাস সমসাময়িক বাস্তবতাকে ধারণ করেও ১০০ বছর পরে মনে হয়, এটাই এখনকার সমসাময়িক বাস্তবতা। কোন গুণে তা হয়? এখানে লেখকের যে শক্তিমত্তা কাজ করে তা কিন্তু নান্দনিকতা। নন্দনতাত্ত্বিক শক্তিমত্তা, রাজনৈতিক শক্তিমত্তা নয়। তিনি জানেন, এই সমস্ত কিছু একসঙ্গে ধারণ করলে কী হবে, এই উপন্যাসটিকে কালোত্তীর্ণ করা যাবে। একইসঙ্গে তার স্থানিক যে চরিত্র, সেটাকে আন্তর্জাতিক চরিত্রে নিয়ে যাওয়া যাবে। একজন ঔপন্যাসিকের চ্যালেঞ্জ ওটাই, সমকালীন বিষয়কে চিরকালীন করে তোলা আর স্থানিক বাস্তবতাকে আন্তর্জাতিক বা বিশ্বজনীন বাস্তবতায় রূপ দেওয়া। যে লেখক এটা পারেন, যে ঔপন্যাসিক এটা পারেন, তিনিই আসল শক্তিমান ঔপন্যাসিক। তাই না? রাজনীতির সঙ্গে উপন্যাসের সম্পর্ক সরাসরি নয়, উচ্চকিত নয়। নান্দনিকতার সঙ্গেই উপন্যাসের মূল সম্বন্ধ।

হামিম কামাল : নান্দনিকতা সই। উপন্যাসে নান্দনিকতার একটা ফল প্রসঙ্গে আসি। উপন্যাস কি সংকট উত্তরণে মানুষকে আদৌ উদগ্রীব করতে পারে? যদি পেরে থাকে, ওসব কেমন উপন্যাস? যদি না পেরে থাকে, ওসবও বা কেমন?
আহমাদ মোস্তফা কামাল : উপন্যাস পারে বটে, তবে সরাসরি নয়। একটা বিষয় আগে পরিষ্কার করে নিই। ভালো উপন্যাস আমি কাকে বলি? উপন্যাস তো অনেক লেখা হয়। কোনটা ভালো উপন্যাস? এটার সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেকরকম, বোঝাপড়া একেকরকম। আমার বোঝাপড়া হচ্ছে এই, একটা ভালো উপন্যাস পড়ার আগে আমি যেই মানুষটি ছিলাম, উপন্যাসটি পড়ার পর আমি সেই মানুষটি থাকি না। অন্যরকম একটা কিছু ঘটে যায়। এর অর্থ, একটা অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়। এ কাজ যে শুধু উপন্যাস করে তা না, অন্য শিল্পগুলোও করে। গান, কবিতা, গল্প, সিনেমা, নাটকও এ কাজগুলো করে। বলাই বাহুল্য, উপন্যাস সবচেয়ে ভালোভাবে কাজটি করতে পারে। উপন্যাস একটা দীর্ঘ পরিসর নেয়। উপন্যাসের আখ্যানভাগ একটা গল্প বলতে বলতে পাঠককে একটা গন্তব্যে নিয়ে যায়। এর ফলে পরিবর্তন হওয়ার যে ব্যাপারটা, মনের নতুন আকার নেওয়ার যে ব্যাপারটা, সেটা খুব ভালোভাবে করতে পারে একটা উপন্যাস। উপন্যাস বা কোনো শিল্প আসলে যা তৈরি করে, তা কিন্তু সরাসরি কোনো উদ্দীপনা নয়। মনের কিংবা হৃদয়ের একটা আকার দেয় বরং। একটা শিশুর মন যেমন কাদামাটির মতো থাকে, আপনি একটা কাদামাটিকে যে-কোনোভাবে গড়ে তুলতে পারেন, একজন পাঠকের মনও কিন্তু তাই, আকারবিহীন। যখন সে একটা নান্দনিক ব্যাপারের মধ্য দিয়ে যায়, একটা গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গান, নাটক, চলচ্চিত্র অর্থাৎ শিল্পের একটা কোনো প্রকাশমাধ্যমের সঙ্গে যায়, তখন তার মনটা নতুন আকার নেয়, রূপ নেয়। সুতরাং তার পরবর্তী কর্মকান্ডগুলো হয়ে দাঁড়ায় ওই শিল্প দ্বারাই প্রভাবিত। আমি এটা বলতে চাই, আজকের যে পৃথিবী, আজকের যে সভ্যতা, সে সভ্যতা ভালো হোক বা খারাপ, তা এতকাল শিল্পচর্চার ফলে মানুষের মনের যে আকার তৈরি হয়েছে তারই ফল। মানুষ এত কিছু তৈরি করতে পারত না যদি না মানুষ কবিতা লিখত, সুর করত, কিংবা গল্প বলতে না জানত। বিজ্ঞানীরাও এত কিছু আবিষ্কার করতে পারতেন না। বিজ্ঞানীদের মনের যে গড়ন সেটাও কিন্তু শিল্প আস্বাদনের ফল। আইনস্টাইন তার শেষ জীবনে একটা কাজ শুরু করেছিলেন, গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশস থিওরি বা গাট নামে। প্রকৃতির যে চারটি মৌলিক বল, এগুলোর একটা ঐক্যসূত্র আছে, তা দেখাবার জন্যে একটি কাজ শুরু করেছিলেন। আইনস্টাইন কোনো কাজ শুরু করলেই সাংবাদিকরা নানারকম প্রশ্ন করতেন, বলতেন, অল্প কথায় বুঝিয়ে বলুন। গাট-এর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হল। উত্তরে আইনস্টাইন বললেন, ‘আমি যে কাজটা করতে যাচ্ছি তা আমার অনেক আগে দস্তয়েভস্কি করে গেছেন।’ সাংবাদিকরা বলে, ‘দস্তয়েভস্কি তো লেখক, আপনি হচ্ছেন বিজ্ঞানী। উনি আগে করে গেছেন এটা কীভাবে সম্ভব!’ আইনস্টাইনের উত্তরটা ব্যাখ্যা করলে যা দাঁড়ায়, তা হল, মানুষ যেমনই হোক, যে ভাষারই হোক, যে জাতিরই হোক, কোথাও না কোথাও একটা ঐক্যসূত্র আছে, অনুভূতিতে, ভাবনায়, আছে না? প্রকৃতিরও ব্যাপার তাই। যে রূপই সে প্রকাশ করুক, কোথাও না কোথাও একটা যোগসূত্র আছে। আইনস্টাই এই এই ধারণাটা পেয়েছিলেন দস্তয়েভস্কির কাছ থেকে, তিনি নিজেই বলে গেছেন। তো, আমি যেটা বলতে চাইছি যে, মানুষ আসলে উদ্দীপনা কীভাবে নেয়, আপনি চট করে তা বুঝতে পারবেন না। এটা  দীর্ঘমেয়াদী একটা প্রক্রিয়া। সেই অর্থে, একটা উপন্যাস আজ আমি লিখলাম, কালকের মধ্যে একটা বিপ্লব হয়ে গেল, তা কখনো ঘটবে না। একটা ভালো গল্প, ভালো উপন্যাস, ভালো সিনেমা দীর্ঘ মেয়াদে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত করে, তাদের মনের আকার দেয়। একসময় তাদের একটা সম্মিলিত প্রতিক্রিয়া, সম্মিলিত প্রকাশ ঘটে। একে ঘিরে সমাজে, রাষ্ট্রে, দেশে একটা পরিবর্তন ঘটতে পারে। আপনি সরাসরি বলতে পারবেন না যে এটার পরে ওটা ঘটেছে। এটা প্রত্যক্ষ না, বরং পরোক্ষ এবং এই পরোক্ষ কাজটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি দেখবেন, যাদের মনের আকারটা এভাবে নিয়েছে, তারাই সমাজকে নেতৃত্ব দেয়, রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেয়, পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেয়। নেতৃত্ব বলতে শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্ব না, সব ধরনের নেতৃত্বর কথা আমি বলছি। শিল্পের কাজ আসলে অনেক বড়, শুধুমাত্র একটা রাজনৈতিক আন্দোলনকে উজ্জীবিত করে তোলার জন্য নয়। একটা উপন্যাসের কাজ শুধু এটুকুই নয়, বরং আরো বড়। দীর্ঘকাল ধরে পাঠকের মনকে তৈরি করার জন্য উপন্যাস। তৈরি করবে সে নিজেই, লেখককে চেষ্টা করে তৈরি করতে হবে না। লেখকের কাজ হচ্ছে একটা ভালো উপন্যাস লেখা, শুধু এই। তার উপন্যাসই তার হয়ে কাজ করে দেবে। আলাদা কোনো চেষ্টা তাকে আর করতে হবে না। তাকে বলে দিতে হবে না যে, আমি এজন্যে এটা লিখেছি, অতএব তোমরা এটা করো। এ কথা বলা হলে বাকিরা শুনবে না। বহু গল্প লেখা হয়েছে, বহু উপন্যাস লেখা হয়েছে এমন যে গল্পের শেষে, উপন্যাসের শেষে, লাল সূর্য উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে তো আসলে লাল সূর্য ওঠেনি। বিপ্লবটা ঘটেনি। বিপ্লব তো গল্পে হয় না, মাঠে গিয়ে করতে হয়। ওসব গল্প উপন্যাস পড়লে একটা অসুবিধা হয়। মনে হয়, বিপ্লব তো গল্পে হয়েই গেছে, আমার আর কোনো দায় নেই। বিপ্লবটা যে হয়নি, লেখায় ওই অবস্থাটা রাখাই ভালো যেন পাঠকের মনে একটা দায় জন্মায়। দায়টা এই যে, এ সমাজ, এ রাষ্ট্র, এ পৃথিবী শোচনীয় অবস্থায় আছে। এটা বদলানো দরকার এবং আমার কিছু করণীয় আছে। অনেকে মিলে যখন এ কথাটা ভাবে, তখনই তো বিপ্লব হয়, তখনই তো পরিবর্তন আসে। আর নাহলে অন্তত একা চেষ্টা করে। গল্পে, উপন্যাসে সব সমাধান দিয়ে দিলে এর প্রভাব শেষ হয়ে যায়। মানুষকে দীর্ঘ মেয়াদে উজ্জীবিত করার মতো উপন্যাসের ধরনটা হতে পারে এই। 
হামিম কামাল : একটা বিষয়ে কৌতূহল আমার। নিজেকে এমন প্রশ্ন সচেতনে বা অবচেতনে হয়ত প্রায়ই করেছেন, কেন লিখছেন। কী উত্তর পেয়েছেন। কেন লিখছেন? আহমাদ মোস্তফা কামাল : জীবনকে তো নানাভাবে দেখা যায়। আপনি হালকা করেও দেখতে পারেন, উল্টোটাও পারেন। যেভাবেই দেখা যাক না কেন, আপনার অভিজ্ঞতা যত বাড়বে, জীবন তত ভারি হয়ে উঠবে, ততবেশি বহনের অযোগ্য হয়ে পড়বে। আপনি যত সংবেদনশীল হবেন আপনার বিপদ তত বাড়বে। ছোটখাটো ঘটনা, চারপাশের সবাই যেসব এড়িয়ে যাচ্ছে, সেগুলোতে আপনি আহত হবেন। আপনার রক্তক্ষরণ হবে। ফলে আপনার জীবন দুর্বহ হয়ে উঠবে, দুঃসহ হয়ে পড়বে, দুর্বিষহ হয়ে দাঁড়াবে। আমি মনে করি লেখকমাত্রই সংবেদনশীল মানুষ, লেখকমাত্রই বিপুল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ। এই অভিজ্ঞতার মানেটা কী? আপনি রাস্তায় আসতে আসতে লেখক হিসেবে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, আপনার সঙ্গে এসেও পাশের একজন মানুষ একই অভিজ্ঞতা অর্জন করেননি। অর্থাৎ একই পথে হেঁটে গেলেও দুজন মানুষ যে একই অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন, তা নয়। মূল ব্যাপার হল দেখার চোখ। কে কীভাবে দেখছে, কে কীভাবে গ্রহণ করছে। লেখকরা হচ্ছে সেই দলের মানুষ যাঁদের দেখার চোখ খুব তীক্ষ্ণ। এঁরা অন্ধকারেও দেখতে পান, দেখতে পান সবই। চারপাশের কোনো কিছুই তার চোখ এড়ায় না এবং সেখানে প্রচুর অসংগতি থাকতে পারে যেগুলো থাকা উচিৎ নয়, যেগুলো গ্রহণযোগ্য নয়, কিন্তু তার কিছুই করার নেই বেদনায় ভোগা ছাড়া, গ্লানিতে ভোগা ছাড়া। এবং তিনি, ওই যে বললাম, সংবেদনশীল মানুষ। স্পর্শকাতরতা এবং সংবেদনশীলতা কিন্তু এক জিনিস নয়। সেনসিটিভিটি আর সেনসিবলিটি এক নয়। স্পর্শকাতরতা হচ্ছে সেই অনুভূতি, আপনার একান্ত কিছুতে একটু ছোঁয়া লাগলেই আপনি টং করে ওঠেন। মানে আপনি খুবই সেল্ফ সেন্টার্ড মানুষ। এর মানে আপনি স্পর্শকাতর, সেনসিটিভ। কিন্তু আপনি যখন অন্য অনেক মানুষের দিকে তাকিয়ে আছেন, তাদের কষ্ট যে আপনাকে বেদনাহত করছে তারা জানেও না, এই যখন মনোভাব তখন আপনি সংবেদনশীল, সেনসিবল মানুষ। আমি লেখকদের বলি সংবেদনশীল মানুষ এবং যেহেতু তাঁরা সংবেদনশীল, তাঁর দেখার চোখ তীব্র, অতএব তাঁর অভিজ্ঞতা হয় অনেক বেশি এবং তা অনেক বেশি বেদনা আর গ্লানির জন্ম দেয়। ফলে তাঁর জীবন সাধারণ জীবন যাপনের চেয়ে অন্যরকম হয় এবং সেটা বহন করা হয়ে ওঠে কঠিন। এত কঠিন যে তা যদি কোনোক্রমে তিনি ভুলে থাকতে না পারেন, কিংবা প্রকাশ করতে না পারেন, তাহলে পাগল হয়ে যান। বহু লেখক এ কারণেই পাগল হন। সত্যি  কথা বলতে কী, আমি লিখি আমার সংবেদনশীলতার যন্ত্রণাগুলো ভুলে থাকার জন্য। বিরাট কোনো বিপ্লব করে ফেলার সাধ্য আমার নাই। আমি চারপাশে যা দেখি, জীবনের যত অসুন্দর দেখি, অসংগতি দেখি, যত দুঃখ দেখি, যত বেদনা দেখি, একইসঙ্গে যত মায়া দেখি, ভালোবাসা, আনন্দ দেখি সবকিছু মিলিয়ে আমার ভেতর যে ক্যাথারসিস তৈরি হয়, যে অনুভূতি তৈরি হয়, মিশ্র অনুভূতি, সেটাকে আমি বহন করতে পারি না। সেটা আমাকে প্রকাশ করতে হয়। প্রকাশ না করলে আমি পাগল হয়ে যাব। এই যন্ত্রণাদায়ক সময়টিকে ভুলে থাকার জন্যেই আমি লিখতে চাই। কারণ লেখার সময় আমি ঘোরগ্রস্ত হয়ে যাই। আমি ওই জীবনের মধ্যে প্রবেশ করি। একটা নতুন জগৎ, নতুন জীবন। যে জীবনটাকে আমি নানাভাবে দেখতে পারছি, তাকে আমার কলমেই আবার নির্মাণ করছি। এর মধ্যে একটা রিলিজ আছে, একটা আনন্দ আছে। এ অর্থে বলতে পারেন এটা এক ধরনের স্বার্থপরতা। লেখকরা স্বার্থপরই হয়। লেখক নানা অর্থে স্বার্থপর। তিনি যখন লেখেন তার চারপাশের সমস্ত প্রয়োজনকে অস্বীকার করেন। লেখাটাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর লেখা তাঁকে স্বস্তি দেয়, শান্তি দেয়। কেন স্বস্তি দেয়? লেখা তাকে স্বস্তি দেবে কেন? কারণ তাঁর যন্ত্রণার ধরন অন্যদের মতো না। একেবারেই তাঁর নিজের মতো। সে অর্থে আমি এটুকু বলি, আমার দুঃসময় ভুলে থাকার জন্য, দুর্যোগ ভুলে থাকার জন্য বা আমি আমার দুর্বহ অভিজ্ঞতা ভুলে থাকার জন্য, কিংবা সেগুলো প্রকাশের জন্য শুধুমাত্র এই একটি উপায় আমার আছে, লেখা। আমি কলম তুলে নিই এবং কিছু একটা লিখে যাই। নিজেকে প্রকাশের অন্য কোনো উপায় যে আমার নেই।

কৃতজ্ঞতায় : ভাটিয়াল

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২