একুশে আইন আর গণেশ পাইন – প্রদীপ চক্রবর্তী

শেয়ার করুন
এক/
ভাষা হারানোর অন্ধ মাঠে বাঙালি কবির দেশ ছাড়ার দীর্ঘশ্বাস এখনো আমরা আহত আর্তনাদের মতো টের পাই। এ বঙ্গের বাঙালি আমি। আত্মপরিচিতিহীন হয়েও কতো নির্লিপ্ত! মাঝে মাঝে মধ্য নিশীথের অন্ধকারে খণ্ডহীন নীরবতার ভেতর, আকাশের নীচে এসে নিজের মুখোমুখি দাঁড়াই। মুখ তুলে দেখি, মাথার ওপর জ্বলজ্বল করছে বৃহস্পতি, কালপুরুষ, মৃগশিরা নক্ষত্রমন্ডল, সিংহ রাশি আর বাংলার আকাশ …, ভাবি, আজ আমার মতো, আমার অজানিত ভাবী বংশধররা, কি চিনে নিতে পারবে, এই নক্ষত্র গুলোকে ? না, সাতটি তারার তিমির ঢেকে দেবে, চৈতন্যের আদিগন্ত আকাশ ? এই ভূখণ্ডে একদিন বাঙালি বলে একজনও থাকবে না , বাংলা ভাষা বলে কোনো ভাষার অস্তিত্ব থাকবে না , আমাদের বিদ্যালয় পাঠ্য ভুগোল বইয়ে লেখা হবে, বাংলাদেশ নামে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কথা। যে রাষ্ট্রের স্বীকৃত রাষ্ট্র ভাষা, বাংলা । যে রাষ্ট্রে শুধুমাত্র বাংলা ভাষার জন্য, আন্দোলন করে, গুলির সামনে , বুক চিতিয়ে শহীদ হন, আবদুল জব্বার, আবুল বরকত, রফিক আহমদ নামক তিন তাজা তরুণ। উনিশশো বাহান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারী সকাল দশটায়। যে রাষ্ট্রে বাঙালি রা বাস করে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা । সে দেশ ই আমাদের কাছে নিজের ছায়ার চেয়েও বহুদূরের বিদেশ …
সীমান্তের কাঁটা তার যেখানে আমাদের সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। যে  ভাষার  জন্য রক্তের ফেরারি গোলাপ উপহার দিয়েছে , আমার সহোদর । কিন্তু আমি ?… থেকেও নেই …! ভিসা অফিসের সামনে যে দেশ আমায় খুঁজে নিতে হয়, আমার ছোঁয়া ও উষ্ণতা পেতে আমার ভাইকেও টপকাতে হয় কাঁটাতারের দুরূহ নিয়ম, আর শেষে, মানসিক অনাহারক্লিষ্ট অথচ , অন্তঃসারশূন্য অহমিকার কঙ্কালসার এক নটরাজের শরীরে, দেখি, আমাদের গাঙুরের জলে আর ঘোলাটে গঙ্গার আকাশে ভ্রাম্যমাণ এক পাল চিল শকুনের ভিড়ে হারানো একটি ক্লান্ত কথার অনুতাপ ….. ” ভারতবর্ষের একটি বিশেষ অঞ্চলের কিছুমানুষ এই ভাষায় এখনো কথা বলে। যদিও তাদের কোনো পরিচয় নেই , তবু অনেক বছর আগে তাদের বাঙালি বলে চিহ্নিত করা হতো …..
দুই/
ভাবি….আর ভাবি …
আর এই দ্বন্দ্বে সংকটে নিজের মুখের তিমির ছায়া পিন্ড বেনোজলে ভেসে যেতে যেতে ভাবে , ধরা যাক দু একটা ইঁদুর এবার ….!
ভাবি….আর ভাবি ….
এই শত সহস্র কবিতাকারী , এই মুখ পুস্তিকায় নকল ব্যাঘ্র শাবকের হালুম , হুম হুম হুমনা হুম চিল চিৎকার , এই দল উপদল গোষ্ঠী প্রমুখ পুস্তক মেলা , ফি বছরে রাশি রাশি শব্দের জঞ্জাল ও পুস্তিকা ,কাব্য কুসুমকার পাহাড় ও সরকারি বেসরকারি পুরস্কারের হুড়ো যুদ্ধ , এই গণসংস্কৃতির কবি ভূষণ ও আনুপূর্ব অতি আঁতেলবাজি ,বৎসর ব্যাপী মত্ত বহুরূপী সে , বহুমুখী …. এই অদৃশ্য পোস্টার বুকে নিকিয়ে যে কদম কদম চলা ও লাফ , তার কি কোনো দিক দিশা , সীমা শেষ হারা ভবিষৎ আছে ?… যখন আজ , হাফ এংলো,বাঙালি শিশু , সুদূরতম অস্ফুট অবাক দৃষ্টিতে পাগলা দাশুর আ মরি মোদের গরব মোদের আশা শুনে , হিক্কা টানে …., যখন হাফ চকোলেট শিশুর বাঙালি মাম্মি , তার না ছোঁয়া , শিশুকে না পান করানো নকল স্তন্য সুধায় বিদেশি শব্দের আরক মিশিয়ে , সন্তানের বিদেশি চাকরির মায়াময় চক্রব্যূহ নিজেই তৈরি করে , মাতৃভাষার সলিল সমাধির ওপর দাঁড়িয়ে , তখনও ভাবি … আর ভাবি ….
যখন বাংলা ভাষা , প্রান্তিক অসবর্ণ ভাগচাষীর মতো সরতে সরতে সরে যায় মধ্যদিনের আহার সহ ,এক গুচ্ছ সাম্প্রতিক প্রকল্পের লোভ দেখিয়ে , বাংলা মিডিয়ামের ছেলে ধরা স্কুলে , তখনো ভাবি আর ভাবি …..
তিন/
ভাবি,শিকড় চ্যুত কবি …. তোমার ভাষা না বাঁচলে ,তোমার কবিতা পড়বে কে ?…
ভাবি , শিকড়চ্যুত বাঙালি , হে , এ বঙ্গের কুলভূষণ , তুমি নিজের ভাষাকে ইগনোর করে , রাষ্ট্র ভাষায় কথা বলে গর্বিত হও ,অথচ , তোমার পুরান তোমার লোককথা তোমার পরণ কথার ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী , তেপান্তরের রূপকথা , তোমার ময়মনসিংহের গীতিকা, মলুয়া পালা , আলাওলের কাব্য, বিষাদ সিন্ধু , টুনটুির গল্প, আবোল তাবোলের কবিতা ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা , তোমার পুরাতনী রবীন্দ্র টপ্পা ঠুংরি সারি ভাওয়াইয়া ভাটিয়ালি আলকাপ জারি গাজীর গান আউল বাউল সহজিয়া সুফী ….. তোমার রামনিধি গুপ্ত ,নিধু বাবু গেয়ে ওঠেন ….
নানান দেশে নানান ভাষা
বিনে স্বদেশীয় ভাষা পূরে কি আশা
কতো নদী সরোবর
কী বা ফল চাতকীর
ধারাজল বিনে কভু ঘুচে কি তৃষা …
তবু বাঙালি কবির দেশ ভাগের দীর্ঘশ্বাস এখনো আমরা নির্জন ক্ষতর মতো বয়ে যাচ্ছি একা একা….
এ বঙ্গের বাঙালি কবি , একুশে কেবল একটা দিন নয় , নতুন সমাজ সংকটের ঘোরতর বর্তমানে নিজের অস্ত্বিত্ব রক্ষার কাল সন্ধিক্ষণ ….
যেন কোনো দিন ভবিষ্যতের ইতিহাস না লেখে ……… ” ভারতবর্ষের একটি বিশেষ অঞ্চলের কিছু মানুষ এই ভাষায় এখনো কথা বলে | যদিও তাদের কোনো পরিচয় নেই , তবু অনেক অনেক বছর আগে তাদের ” বাঙালি ” , বলে চিহ্নিত করা হতো ……”,
জীবনানন্দ…. সুতীর্থ …. একা একা পথ হাঁটতে হাঁটতে আজো মৃদু শব্দে বলছে …..
” আমি চলে যাবো বলে
চালতা ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরেরজলে
নরম গন্ধের ঢেউয়ে ?
লক্ষ্মীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্মী টির তরে ?
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে ?
আমার সর্বশেষ অস্তিত্ব আমার বাংলা ভাষা ….
আমার অন্তিম নিয়তি আমার ভাষা ….
একুশে আইন ….. আর আবহমান রক্তে বয়ে আসা আলোয় ক্যানভাসে তুলি হাতে মগ্ন অনাসক্ত শিল্পী , গণেশ পাইন ….আরোগ্যের জন্য … নতজানু স্তাবকেরা বুঝবে কি ?
প্রদীপ চক্রবর্তী
শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২