এখন রাজনীতির সময় নয় – সরোজ দরবার – [শেষাংশ]

শেয়ার করুন

প্রথম অংশ : এখন রাজনীতির সময় নয় – সরোজ দরবার


পরিযায়ী বলা হোক কিংবা অতিথি, শ্রমিকদের নিয়ে যে সেভাবে ভাবা হয়নি, এই সত্যিটা স্বীকার করে নেওয়াই ভালো; মর্মন্তুদ সব ছবি দেখতে দেখতে প্রতিটা দিন একটাই দীর্ঘস্থায়ী গাঢ় কালো রাত হয়ে উঠছিল। অথচ ভারতীয় অর্থনীতিতে পরিযায়ী শ্রমিকের অবদান নেই, এ তো অতি বোকা লোকও বলবে না।
তাহলে পরিযায়ীদের জন্য সামান্য ভাবনাটুকুও ভাবা হল না কেন! মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে এ-দেশে লকডাউন নেমে এসেছিল। নিশ্চিতই ধরে নেওয়া যায় যে লকডাউন জরুরি ছিল। কিন্তু এত অল্প সময়ে! যদি বুঝতে হয়, হাতে সময় একদম ছিল না, তাহলে পিছু ফিরে দেখতে হয়, ঠিক কবে থেকে এই বিপদের কথা জানা গিয়েছিল! ঠিক কতদিন বিপদকে বিপদ বলে মনে হয়নি!
যাইহোক, ঘোষণা তো হল; এরপর নিজেকে নিজের মতো যারা গুছিয়ে নিতে পারে বা পেরেছিল, তারা আর যাই হোক শ্রমিক নন। তাদের সম্পর্কে, একটা চমৎকার অভিধা পাওয়া গিয়েছিল, ‘ব্যালকনি ক্লাস’। অর্থাৎ, যারা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তালি বা থালা বাজাতে পারে কি মোমবাতি জ্বালাতে পারে। যেমনটা এই লকডাউন চলাকালীন বিভিন্ন পর্বে দেখা গিয়েছিল। যদিও বারান্দা বা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এইসব করার নির্দেশ যখন আসে, তখন বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়, এ-দেশে এখনও অনেকের ঘরই নেই, তার আবার বারান্দা! ভাবনার গোড়াতেই অনেকগুলো মানুষকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রও দেয়, মানুষও তার পাশের মানুষকে ভুলে যায়। এ একটা অভ্যাস। এই যেমন ক’দিন আগে, এনআরসি প্রসঙ্গে বলা হচ্ছিল, কাগজ দেখাব না। সে তো, যার কাগজ থাকবে, সে এই না-দেখানোর প্রিভিলেজটুকু পাবে। কিন্তু যার কাগজ ভেসে গেছে, তার কাছে না-দেখানোটা কোন অর্থ বয়ে আনবে! যাই হোক, ‘ব্যালকনি ক্লাস’ কথাটার স্রষ্টা যিনি, ভাষাবিদদের নিশ্চয়ই তাঁকে খুঁজে বের করে পুরস্কৃত করা উচিত।
তো সেই ব্যালকনি ক্লাস সামলে নিলেও, শ্রমিকরা পারল না। তাঁরা বাড়ি ফিরতে চাইল। ফিরতে ফিরতে রাস্তায় না-খেয়ে, ক্লান্তিতে, ট্রেনে চাপা পড়ে মরল। সেই বাচ্চা মেয়েটি, বারো বছর মোটে বয়স, জামলো মাকদম, যখন মারা গেল, তখন তার বয়সিরাই বাড়িতে বসে অনলাইন ক্লাস করছিল। এই যে জামলোকে রাষ্ট্র স্বীকার করল না, তার কারণ শুধু এই নয় যে শ্রমিককে রাষ্ট্র গুরুত্ব দেয়নি; বরং কারণ হল, শ্রমিক যে একজন ব্যক্তি, এই সত্যিটাকে অস্বীকার করতে-করতে সে মুছে দিতে চাইছিল। একজন ব্যক্তিরই মহামারীতে আতঙ্কিত-হওয়া আছে, পরিবারের কাছে ফেরার তাগিদ আছে। কিন্তু কারও ব্যক্তিসত্তা অস্বীকার করলে, আর এইগুলো কাজ করে না। তখন বলা যেতে পারে, খাবার দেওয়া হবে, ভবিষ্যতে কাজ দেওয়া হবে – অতএব যেখানে আছ সেখানেই থাকো। কিন্তু কেউ যদি মৃত্যুকেই ভবিতব্য জানে, সে তো অন্তত তার প্রিয়জনের কাছে এসেই মরবে। ব্যক্তির এই সামান্য ইচ্ছেটুকুও রাষ্ট্র স্বীকার করতে চায়নি।
পরমেশ বলে চলেছিল এসব; একটানা; প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে। তার বলার তাগিদ এতটাই ছিল যে, গৌতম বার দুই কথা বলার চেষ্টা করেও বলতে পারেনি। শুধু ‘হ্যাঁ’, ‘ঠিকই তো’ বলে সঙ্গত করছিল। এতটা বলার পর পরমেশ থামল। বোঝা যাচ্ছিল, সে খুবই শক্‌ড। আর, না-হয়েই বা উপায় কী! তত্ত্ব আর বাস্তবের ফারাকটাকে যদি আয়রনি বলতে হয়, তবে এইসব ঘটনা, এই দৃশ্যাবলী- আয়রনির অধিক। কারণ, এখানে বাস্তব আর তত্ত্বের অবস্থানটাই যেন ঘেঁটে গেছে।
সত্যি বলতে এই ব্যালকনি ক্লাসেরই অন্তর্ভুক্ত– গৌতম, অজপা, পরমেশ, তার স্ত্রী শমিতা– সেই শুরুর দিন থেকেই এসব দেখে চলেছে। দুঃখিত হচ্ছে; খারাপ লাগছে। কিন্তু এ-ও বুঝতে পারছে যে, রাষ্ট্র তার চরিত্র বদলাচ্ছে। রাষ্ট্রের ভিতর দেশের স্মৃতিটুকুও আর যেন নেই।
এমনকি নাগরিকও বদলেছে অনেকখানি। সত্যি বলতে, নাগরিকই তো বদলেছে। ইউরোপের সাম্রাজ্যবিস্তারে যেমন উপনিবেশের মানুষের ভূমিকা ছিল অনেকখানি। না জেনে, কিংবা জেনে-বুঝেই তারাও ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভাষাতেই কথা বলতে রপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এক্ষেত্রেও মানুষ রাষ্ট্রের ভাষাতে কথা বলে, রাষ্ট্রীয় অনাচারকে এতখানি স্বীকৃতি দিচ্ছে যে, রাষ্ট্রকে আলাদা করে আর কথা বলতেই হচ্ছে না। নাগরিকরাই তার হয়ে বলে দিচ্ছে, ‘এই অবস্থায় যে যেখানে ছিল, থেকে গেলেই পারত’, ‘গায়ে কীটনাশক ছড়াক, তবু প্রাণে তো বেঁচেছে’, ‘এখন রেল লাইনে কেউ শুয়ে পড়লে সরকার কী করবে!’ – ইত্যাদি বয়ানে ভেসে যাচ্ছে চতুর্দিক। এই ধরনের মন তৈরি হয়ে গেলে, পুঁজিচালিত রাষ্ট্রের আর বিশেষ কিছু করার থাকে না। শুধু মনের এই অবস্থাটা যাতে দীর্ঘস্থায়ী হয়, সেই কল-কবজাগুলোয় তেল দিয়ে গেলেই চলে।
পরমেশ আজ তা ঠেকে বুঝেছে। সকাল-সকাল সে একটা ছবি দেখেছে। এক শ্রমিক কানে ফোন নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছে। আশ্চর্য এই ছবি। এই সময়টা এমনই যে, তা একজন শ্রমিকের হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তাকে তার বাড়ি ফেরানোর বন্দোবস্তটুকু করেনি। এই ছবি বিপর্যস্ত করেছে পরমেশকে। আর তাই সে, ফেসবুকের তরল-লঘু-চপল প্রায় নেই-কাজ-তো-খই-ভাজ মাধ্যমেও দুটো কথা বলার তাগিদ অনুভব করেছে। ফলাফল প্রত্যাশিত; একে ঝড় আসছে; তার উপর আবার সরকারের পক্ষ থেকে মোটা অঙ্কের আর্থিক প্যাকেজ- সে কেউ পাক বা না-পাক, তার মধ্যে যত জল-দুধই থাক না কেন – ঘোষণা করা হয়েছে ইতোমধ্যে। ফলে একদল লোক এসে পরমেশকে যাচ্ছেতাই আক্রমণ করেছে। বলেছে, এখন রাজনীতির সময় নয়। এমনকি বাম মতাদর্শের প্রতি তার ঝোঁক নিয়ে বেশ ব্যঙ্গ-কটূক্তিও করেছে। বয়সের ধার ধারেনি। পরমেশ আশ্চর্য হয়েছে এই ভেবে যে, তার চেনা দেশ, নাগরিক, সময়, চোখের সামনে এত এত বদলে গেল কবে! সরকারের সমালোচনা করা কী এমন অন্যায় কাজ হতে পারে!
এখানেও সেই স্বরক্ষেপ। আক্ষেপ; উত্তেজনার বশে পরমেশ যেভাবে কথা বলছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, তার ভিতটা কতখানি চঞ্চল হয়েছে।
কথা ঘোরাতে, গৌতম বলে, আর ছাড়ো! সোশ্যাল মিডিয়াকে বেশি গুরুত্ব দিও না। তা, সেদিন যে ‘পথের পাঁচালী’ দেখতে বসেছিলে, পুরোটা দেখলে নাকি!
পরমেশের সুর নরম হল। বদলে গেল। ভিতরে ভিতরে সে নিজেকে সামলে নিল; বুঝতে পারল গৌতম। সামলে নিয়েই বলল, তুমি তো জানো ভাই, দুর্গার মৃত্যু-সংবাদ হরিহরের কানে ওঠার আগেই আমি বন্ধ করে দিই। ‘পথের পাঁচালী’ বোধহয় এ-জীবনে আমি আর পুরোটা দেখে উঠতে পারব না।
গৌতম হাসে; বলে, তবু যে প্রতিবার দেখতে বসো, সেই তো অমোঘ জাদু। তোমার মনে আছে, দেবেশ রায়ের সেই লেখাটা? ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে কথা বলতে বসলেই, একটা সময়, আমরা বারংবার যে-কথাগুলো বলতাম।
সে আর ভুলি কী করে! ইউরোপ থেকে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে একদল মানুষ এ-দেশে চলে এল। অথচ, এ-দেশেরই একজন মানুষের কাছে তার মেয়ের মৃত্যু-সংবাদ পৌঁছনো গেল না। যা হওয়ার কথা নয়, তবু সবটাই ঘটে গেল। কী আশ্চর্য নিয়তি! দেবেশবাবুর সেই আশ্চর্য পঙক্তি, ‘ এ কোন হিংস্র অপারাপারযোগ্য কঠিন শূন্য দেশ, যেখানে মেয়ে মরে গেলেও বাপকে সে-খবর পৌঁছুনো যায় না?’, সে তো একেবারে আমাদের বুকে এসে বিঁধেছিল। আর, সর্বজয়া মানে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই নীরব কান্না। কানুবাবুর সেই সর্বস্ব ভেঙে-পড়া অভিব্যক্তি! সবটা মিলিয়ে কী নিষ্ঠুর! নিতে পারি না ভাই।
হ্যাঁ গো। দেবেশবাবুও তো চলে গেলেন।
আনিসুজ্জামানও তো গেলেন। কী মনে হয়, জানো গৌতম… এঁদের মৃত্যু বোধহয় এই সময়টার অবক্ষয়ের চিহ্ন। তুমি বলো, এই সময়টা কি একজন দেবেশ রায় বা আনিসুজ্জামানকে ধারণ করতে, গ্রহণ করার মতো জায়গায় আর আছে? ওঁদের মৃত্যু বা বলতে পারো ওঁরা চলে গিয়ে আমাদের জানিয়ে গেলেন, সে যোগ্যতা আমরা হারিয়েছি।
গৌতম আর কিছু বলে না। ধীরে ধীরে তাদের কথা ফুরিয়ে আসে।


ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। এই বিচ্ছিন্নতা অমোঘ। ওই ছবির লোকটিরও ফোনের সংযোগ নিশ্চিত এভাবেই একটা সময় বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। সেই ক্রন্দনরত মানুষটির ছবি গৌতমও দেখেছে। সে-মুখখানা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
গৌতম জানত, তবু পরমেশকে আর উত্তেজিত করতে চায়নি বলেই বলেনি, যে, মানুষটি ফোন হাতে কাঁদছিলেন, কারণ ততক্ষণে তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, তাঁর মৃত সন্তানকে তিনি শেষবারের মতো আর দেখতে পাবেন না। ফোনের ওপারে তিনি কি তাঁর সন্তানেরই জননীর কান্না শুনছিলেন! পৃথিবী-ভাঙা এক আর্তনাদ!
ভাবতে আশ্চর্য লাগে, এই স্বাধীন দেশ, এই বিশ্বায়নের মায়ামাখা পৃথিবী শুধু মানুষটির হাতে ফোন ধরিয়েই ক্ষান্ত হয়নি; সেই ফোনে সন্তানের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার ব্যবস্থাও করে দিয়েছে; তবু, তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেনি। মাঝরাস্তায় ফেলে রেখেছে; একটা ফ্লাইওভারের মুখে আটকে থেকে-থেকে একসময় মানুষটা বুঝে গিয়েছিলেন, পায়ে হেঁটেও মৃত-সন্তানকে ছোঁয়া আর সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে।
এত বছর পরেও ‘এ কোন হিংস্র অপারাপারযোগ্য কঠিন শূন্য দেশ’!
দুর্গা যে নেই, এ-কথা তো হরিহর তবু দিনের দিন জানতে পারেনি। পরমেশকে বলা হল না, যে, আজকে দাঁড়িয়ে মনে হয়, দূরে বসে ওই সংবাদটুকু জানতে না-পারা বোধহয় একরকম সৌভাগ্যই ছিল হরিহরের; যেহেতু আর এক বাপের দেখা মিলেছে, আরও উন্নত পৃথিবীতে যার কিনা সেই প্রহসনের সৌভাগ্যটুকুও নেই।
গৌতম ঠিক করে, বিকেলেই সে পরমেশকে ফোন করবে। তাকে বলে দেবে শ্রমিকের ছবির তলায় ক্যাপশনে যা যা লেখা নেই, তার সবটুকু। আর বলবে, চাইলে এবার পুরো ‘পথের পাঁচালী’ই সে দেখে ফেলতে পারে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

3 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *