এই আকাঙ্খিত রূপ – শুভজিৎ ভাদুড়ী
সন্ধে নেমে এল প্রায়। বেশ কিছুক্ষণ হল যানজটে আটকে রয়েছি। ট্যাক্সির জানালার কাঁচ ঘেঁষে চলেছে বিক্ষিপ্ত চলমান জনতার স্রোত। তাদের যে টুকরো কথাবার্তা কানে আসছে তাতে বোঝা যাচ্ছে সামনে কোনও একটা ওভার লোডেড ডাম্পার উলটে গিয়েছে আর সেই কারণেই বিপত্তি। এমনিতে বাড়ি থেকে শ্মশানের দুরত্ব বেশি নয়। সর্বসাকুল্যে কুড়ি মিনিট মতো লাগে। সেই কারণেই আরও বিরক্তি লাগছে আমার। গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে যে অন্য রাস্তা ধরব এখন আর সে উপায়ও নেই। সামনে বা পেছনে কোথাওই আর একচুল নড়ার জায়গা নেই। যে গাড়িটাকে অনুসরণ করে আমি শ্মশানের দিকে যাচ্ছিলাম সেই গাড়িটা এখনও আমার ঠিক সামনে।ট্যাক্সির হেডলাইটের আলো সেই গাড়িটার পেছন দিকটাকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। তীব্র হলুদ আলোয় ঝকমক করছে টিনের রথ। হ্যাঁ, আমার সামনে একটা শববাহী শকট। দুটো কাঁচের আস্তরণ পার করে আমি দেখতে পাচ্ছি একজোড়া পা আকাশের দিকে উঁচু হয়ে আছে। একজন আটাত্তর বছর বয়স্ক মানুষের পা। জীবনের শেষ তিনটে দিন নার্সিংহোমের ঠাণ্ডা ভেন্টিলেশনে কাটিয়ে দেওয়া একজন মানুষের পা। আমার বাবার পা। আমি উদাসীন ভাবে তাকিয়ে রয়েছি। গত বিয়াল্লিশ বছরে কতবার এই পায়ে হাত ছুঁইয়েছি আমি।
এই মৃত্যু মেনে নিতে আমার যে অসুবিধে হচ্ছে তেমনটা নয়। মোটামুটি হিসেব করে দেখেছি গত চারদিনে আমি প্রায় একলাখ ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করেছি। পরিমাণটা নেহাত কম নয়। কিন্তু আমি একজন স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত। স্বামী- স্ত্রী দুজনেই চাকুরিরত।
গোটা বাড়ি প্রয়োজনীয় আর প্রয়োজনের অতিরিক্ত সামগ্রীতে ঠাসাঠাসি। আমার কাছেও এই পরিমাণ অর্থটা অনেক, তবে বিরাট অসুবিধা জনক কিছু একটা নয়। বরং আমি এই খরচটুকুর জন্য মনে মনে একটা প্রসাদ অনুভব করছি। তৃপ্ত লাগছে।
সাধারনত এইরকম দিনে অনেক ফোন আসে। এই মুহূর্তে আমার এক আত্মীয়।
হ্যালো। স্থির হয়ে থাকা গাড়ির মধ্যে প্রথামাফিক কথাবার্তা এগিয়ে চলেছে, যেতে তো সবাইকেই হয় একদিন! তুমি তোমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলে। এটাই সব। ভালো নার্সিং হোমে ভর্তি করেছিলে। ভালো ডাক্তার দেখিয়েছিলে। তোমার বাবা তো তবু চিকিৎসার সুযোগ দিয়েছিল…
কথা শেষ হয় না। আমি হারিয়ে যেতে থাকি। বাবা চিকিৎসার সুযোগ দিতে চায় নি। দীর্ঘ বছর ধরে রোগভোগের পর চারদিন আগে যখন বাবার শরীর যখন বিছানায় ছটফট করছিল তখন আমি এসে দাঁড়িয়েছিলাম মাথার পাশে। বাবা বলেছিল, আর ডাক্তার বদ্যি করিস না। এবার আমাকে যেতে দে। শুনিনি। একটা এ্যাম্বুলেন্স-এ বাবাকে চড়িয়ে সাইরেন বাজাতে বাজাতে ছুটে গিয়েছিলাম। বাবা যেতে যেতেও বলছিল, কথা শোন। আর টানা হ্যাচড়া করিস না। এবার যেতে দে।
বাবা সেই চলেই গেল।
বাবা যে আর ফিরবে না আমিও কি তা জানতাম না?
হয়তো জানতাম। তবু টানা হ্যাচড়া করলাম কেন?
কেমন হত যদি না করতাম?
দুই
বাবার খারাপ শরীর যে হঠাৎ করেই আরও খারাপ হয়ে গিয়েছে এ কথাটা আমি ফোনে শুনলাম। তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরে এসে বাবার মাথার কাছে দাঁড়ালাম। বাবা বলল, আর ডাক্তার বদ্যি করিস না। এবারে আমাকে যেতে দে।
আমরা বাবার ঘরের দরজা জানালা গুলো হাট করে খুলে দিলাম। দুপুরের রোদ এসে ধুয়ে দিল ঘর। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। বাবা শুয়ে শুয়েই আমার মেয়ের আঙুলগুলো ধরল। ওর এখন আট বছর বয়েস। আমরা সারাদিনে এখন আর বাবার সঙ্গে কটা কথা বলি! যেটুকু কথা তা আমার এই মেয়েই বলে। বাবা ওর আঙুলগুলো নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে বলল, ওই যে নিমগাছটা দেখছিস দিদিভাই, ওটা আমার লাগানো। কখনও আমার কথা মনে হলে তুই ওর ছায়ায় গিয়ে বসিস।
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এই বাড়ি ঘরদোর সব তোর জন্মের আগেকার।
আমি মাথা নাড়লাম।
আমাকে একটু উঠোনে নিয়ে গিয়ে খাটিয়া পেতে শুইয়ে দিবি।
দিলাম।
আহ! এই অনন্ত আকাশ! এই অফুরান বাতাস! দিদিভাই! বাবা আমার মেয়ের আঙ্গুলগুলো ছুঁয়েছে আবার। সে মেয়েটি বিস্ময়াবিষ্ট চোখ নিয়ে তার দাদাই এর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এমন অভিজ্ঞতা তার জীবনে প্রথম। বাবা আর পারছে না। শ্বাস উঠে যাচ্ছে। বুকটা ধরফর করছে। কেউ বলছে, এবার বাবার মুখে একটু জল দে।
এখন বড় হয়েছি। নিজের ক্ষুদ্র সংসার হয়েছে। ব্যস্ততা বেড়েছে। বহুদিন বাবার দুঃখ গুলোর সঙ্গে একাত্মতা বোধ করিনি। তবু এই দৃশ্যের সামনে যেন বিহ্বল হয়ে গেলাম। চোখ ভিজে গেল কি! বললাম, এই এত বছর পর পৃথিবী থেকে কি নিয়ে যাচ্ছ বাবা?
বাবা কিছু বলতে পারল না। একবার আমার হাতটা সামান্য ছুঁয়ে ওর দিদিভাই-এর আঙুল গুলো শক্ত করে ধরার চেষ্টা করল। বুঝলাম স্পর্শ নিয়ে যাবে। আরও বেশি করে স্পর্শ দিলাম। বাবার কপালে, গালে, বুকের মাঝখানটায়। বাবা আর নড়ছে না। বুঝলাম, বাবা স্পর্শ গুলো ভরে নিয়েছে তার ঝোলায়।
তিন
একটা ক্রেন দিয়ে বোধহয় উল্টে যাওয়া ডাম্পারটাকে সরানো হল। গাড়িগুলো একটু একটু করে এগোচ্ছে আবার। কে জানে সব কোথায় যাচ্ছে। একই সরলরেখা ধরে যেতে যেতে কেউ ডানদিকে কেউ বামদিকে বেঁকে যাবে। কত অসংখ্য গন্তব্য মানুষের। কত অসংখ্য ঠিকানা। যে পথ ধরে যাচ্ছি তার দুই ধারে নতুন গজিয়ে উঠা অগণিত নার্সিং হোম। শপিংমল গুলোর মতো ঝাঁ চকচক করছে। মানুষ ওখান থেকে জীবনের আরও অতিরিক্ত আটচল্লিশ ঘণ্টা কিনে নেয়। বাহাত্তর ঘণ্টা কিনে নেয়। কেউ আরও বেশি। কি হত যদি বাবাকে আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম। আমি কি পারতাম তার নিঃসঙ্গতার বার্ধক্যজনিত দুর্ভেদ্য প্রাচীরটাকে ভেদ করতে!
এখন আর যানজট নেই। সব গাড়িগুলো ছুটছে। আকাশের দিকে উঁচু হয়ে থাকা বাবার দুই খানি পা ছুটছে। একটু পরেই পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যাবে। বাবা নিজে বোধহয় এতক্ষণে বহুদূর চলে গিয়েছে। কি জানি কেমন সেই রাস্তা! ছোট থেকে এতটা বড় হয়েছি, কোনোদিন খোঁজ নিইনি বাবার রাস্তা কেমন ছিল। মা টুকিটাকি সব গুছিয়ে দিত। এখন তো মা নেই। চলে গিয়েছে আগেই। থাকলে হয়তো বাবার এই যাত্রার আগে ব্যাগ গুছিয়ে দিত। ব্যাগে অনেকটা করে স্পর্শ ভরে দিত, যাতে পথে কোনও অসুবিধে না হয়।
আমি কি আদৌ বাবার কথা ভেবেছি! বাবার জীবনের এই অতিরিক্ত কটা দিন আসলেই কি আমার অনন্ত নিজস্ব চাহিদার অংশ নয়! ছুটছি। সর্বক্ষণ পড়ে যাওয়ার ভয় হয়। বাবার সঙ্গে বহুদিন ভালো করে কথা হয় নি। তাই এখন কথা বলতে নিয়েও কথা খুঁজে পাচ্ছি না। মুখ তো দেখতে পাচ্ছি না। আকাশের দিকে উঁচু হয়ে থাকা দুটো পায়ের দিকে তাকিয়ে ডাকলাম, বাবা
পাথরের মতো কঠিন অপেক্ষার গভীর থেকে বাবা বলল, ডাকছিস?
হ্যাঁ, বলছি, তোমার যখন খুব তোমার দিদিভাইকে দেখতে ইচ্ছে করছিল, তখন ওরা তোমাকে একটা ইঞ্জেকশন দিয়েছিল, না?