ফলসা রঙের বউ – অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী

ফলসা রঙের বউ – অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী

শেয়ার করুন
আমাদের বন্ধু জহরলাল ধাড়া খুব যাত্রা ভালোবাসে। কলেজে পড়ার সময় আমরা বইমেলাতে গিটার নিয়ে গান করেছি। কিন্তু জহর সে সবে কোন মজা খুঁজে পায় না। সে বইমেলাতেই যাত্রাপালা করতে চায়। কলেজ শেষ করে জহর প্রাইমারি ইস্কুলে মাস্টারি পেল। ইস্কুলের গ্রামে সে কিছু যাত্রা অনুগত মানুষ খুঁজে পেয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম ইস্কুলের হেডমাস্টার নলিনীবাবু। জহরকে পেয়ে তাঁর উৎসাহ দ্বিগুন। তিনি একটি স্বরচিত পালা নামাতে চান‘ডাকাতে বউয়ের মেনিমুখো স্বামী’। আমাদের জহর দেখতে ভালো। ফর্সা, মাঝারি হাইট। কেবল চেহারা একটু মোটার দিকে। কিন্তু তাতে কী এসে যায়! গ্রামদেশের আমেচার পালায় জহর নায়ক হিসেবে যথেষ্ট দড়। আমরা বললাম, তুই নিশ্চয় নায়ক হবি। আমাদের গ্রামের যাত্রাতেও তুই নায়ক হয়েছিলি। তোর হেডু তোকে এত্ত ভালোবাসে। জহর বলল, নারে, গোলমাল সেখানেই। হেডস্যার নিজেই নায়ক হতে চান। মানে? আমরা পাঁচজন একযোগে বলে উঠি। প্রদীপ, নির্মল, নিমাই, শৈলেন আর আমি। বলি, তোর হেডু তো বললি, বছর পঞ্চাশ বয়স। মাথায় টাক, মোটা ভূঁড়ি। কালো গোলগাল চেহারা। সে হবে নায়ক?আর তুই? স্যার আমাকে নায়কের বাবার পার্ট করতে বলেছেন। অ্যাঁ? মানে হেডুর বাবা! আমি পাকা চুলের উইগ পড়ব, তিনি কাঁচা চুলে টাক ঢাকবেন। বোঝো কাণ্ড! এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। এরপরও আছে? বাব্বা! তা কি সেটা? কথা ছিল, হেড স্যারের মেয়ে মালবিকা আমার স্ত্রীর রোলে অভিনয় করবে। মেয়েটাও যাত্রা ভালোবাসে। একদিন আমরা মহলা দিচ্ছি। একটা জড়াজড়ির সিন ছিল। স্যারের মনে হয়েছে এমনটা ঠিক নয়। তাহলে আমরা পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ব। নির্মল মাথা নেড়ে বলল, উঁ… তা মালুর বয়স কত? কে মালু? আরে মালবিকা। এত বড় নাম সবসময় বলা যায় নাকি? এই ষোলো। নাইনে পড়ে। বয়সটা কিন্তু… আসলে আমাদের তো পঁচিশ-ছাব্বিশ হয়ে গেল— জহর রেগে বলল, তাতে কী? এটাই তো মেয়েদের প্রেমে পড়ার বয়স। এখন যদি বাপকে লুকিয়ে প্রেম না করে তো করবে কবে? যে বয়সে যা। নিমাই বলল, তা এখন কী অবস্থা? তার বাবার ফতোয়া শুনে সে রেগে কাঁই। বলেছে, বাবা যদি এমন করে আমায় আটকায় তাহলে বাবার লেখা সখের যাত্রাপালা আমি লণ্ডভণ্ড করে দেব। লে হালুয়া! প্রদীপ বলল। তোরা কি সত্যি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলি নাকি? জহর মুখ নিচু করে বলে, আসলে মহলা দিতে দিতে—কখন যে, বুঝতে পারিনি আর কি। এখন কি করি? কি আর করবি, নিয়ে পালা। তার কোনো উপায় নেই রে ভাই। আন্ডার আঠারো মেয়েকে বিয়ে করলে চাকরি চলে যাবে। ঘানি টানাও অসম্ভব নয়। স্যার এমনিতে ভালো হলে কি হবে, মহা তেড়েল লোক। একবার গোঁ ধরলে আর ছাড়ান নেই। শৈলেন সকলকে থামিয়ে বলে, মনে হয় তোদের ব্যাপারটা তোর হেডু বুঝে ফেলেছে। তাই অমন কায়দা করে তোদের সরিয়ে দিতে চাইছে। বুড়োর এটা একটা চাল। অসম্ভব নয়। নির্মল বলে। সামনের অঘ্রাণে মালবিকার বিয়ে দেবে কেলেবুড়োটা। মালুকে ছাড়া আমি বাঁচব না। এই বলে জহর হো হো করে ছাদের এক কোনে পা ছড়িয়ে বসে কাঁদতে লেগে গেল। কীভাবে জহরকে এই অবস্থা থেকে রক্ষা করা যায় আর মালুকে ওর হাতে সুস্থ সবল ভাবে তুলে দেওয়া যায়, আমরা তারই পরিকল্পনা করতে লাগলুম। জহর এর আগেও দুমদাম প্রেমে পড়েছে। সেই ছেলেবেলা থেকে সে প্রেমে পড়ে আসছে। উঁচু ক্লাসে উঠে নিচু ক্লাসের মেয়ের প্রেমে পড়তে দেখেছি ঝপাঝপ। অন্য ইস্কুলে তিনবার ফেল করে টিসি নিয়ে কোনো মেয়ে আমাদের ইস্কুলে ভর্তি হলে জহর তার সঙ্গে পনের কুড়ি দিনের ‘টিফিন প্রেম’ সেরে নিত। সেই সব ভেবে আমরা রায় দিলাম, মালবিকাকে ভুলে যাওয়াই জহরের পক্ষে মঙ্গল। এরপর আমরা যে যার মতো কর্মস্থলে চলে গেলাম। মালবিকার কথা ভুলেও গেলাম। নির্মল থাকে মোমিনপুরের যাদব হোস্টেলে। প্রদীপ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। নিমাই কলকাতায়। আমিও বাইরে। কেবল শৈলেন মশাটে জুয়েলারি দোকান দিয়েছে। একদিন মধ্যরাতে সে-ই সকলকে ফোনে অতি উত্তেজিত হয়ে জানাল, জহর বিয়ে করেছে। যে যেভাবে পারিস, চলে আয়। আমরা পড়িমড়ি করে পরদিন সকালেই জহরের বাড়ি চলে এলাম। জহর বলল, আয়। তোদের জন্যই বসে আছি। কোন খবরই দিলি না, সোজা বিয়ে?আমরা ঘাম মুছতে মুছতে বললাম। জহর বলল, আমিও কি জানি যাচ্ছি মাস্টার হয়ে, ফিরব বউ নিয়ে। বুঝতে পারলাম না কোথা থেকে বিয়েটা হয়ে গেল। আমি বলি, ওরে প্রেমে বয়স বলে কিছু হয় না। না হয় চাকরি যাবে, তাতে কি? এবার আদাজল খেয়ে বড় ইস্কুলের জন্য তৈরি হ। নির্মল বলল, তোর হেডু কি বললে? জহর বললে, আরে তিনিই তো নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়েটা দিলেন। আমরা হাঁ। মানে? তিনি একদম সোজা ব্যাটে খেলে দিলেন। এই যে বললি মহা ঘাঘু লোক? সব বলব। আগে আয়, বউ দেখে যা। খুব উদাস গলায় জহর কথাগুলো বলল। আমরা গেলাম। নতুন বউ লাল হলুদ তাঁত পরে বিছানার মাঝে মাথা নিচু করে বসে। জহর আলাপ করিয়ে দিল। সে ঘোমটার ভেতর দিয়ে আমাদের দিকে চাইলে। আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, এ মেয়ে মালবিকা নয়! জহরের মোবাইলে তিনমাস আগে আমরা মালবিকার এত ছবি দেখেছি যে তাকে চিনতে ভুল হবার কথা নয়। আমরা এত অবাক হলাম যে কথা বলতে ভুলে গেলাম। মালবিকাকে এত সুন্দর দেখতে ছিল না। জহর কার পুকুর থেকে কোন ছিপে একে তুলল? জহর আমাদের বাইরে নিয়ে এল। আমরা অবাক হয়ে বলি, ব্যাপারটা কিরকম হল? এ তো মালু নয়! এ হল শালিনী। বলে আমাদের হাতে নেভিকাট সিগারেট ধরিয়ে দিল। আমরা বললাম, সে কে? জহর বলল, মালুর ছোটমাসি। মানে??!! হ্যাঁরে , ওর নিজের মাসি। অবাক হোস না। মালুকে ছেড়ে ওর মাসিকে বিয়ে করলি? কেন? কি করব। শালুর প্রেমে পড়ে গেলাম যে। শালু? আরে শালিনীর ভালো নাম। এরপর জহর যা বলল তা হল এইরকম– জহর যাতে মালুকে না বিয়ে করে সেটা নিয়ে তাকে বোঝাতে নিজের ছোটো শালীকে ডেকে এনেছিল হেডমাস্টার। ছোটো শালীকে নিয়ে হেডুর মনে কোনো ভয় ছিল না। কারণ সে নারীবাদী। সে কখনও বিয়ে করবে না বলে পন করেছে। স্থানীয় কাগজে পুরুষ বিদ্বেষ নিয়ে মাঝেমধ্যেই জ্বালাময়ী কবিতা লেখে। তাছাড়া সে জহরের চেয়ে চার বছরের বড়ো। শালিনী বলেছিল, কিছু ভাববেন না জামাইবাবু, ঐ ফচকে মাস্টারের এমন মগজ ধোলাই করব যে, সাত জন্মেও বিয়ের ধার মাড়াবে না। আমার ভাগ্নী সহজ সরল বলে তার কচি মন নিয়ে ছেলেখেলা করবে একজন, আর আমি মাসী হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখব? কভি নেহি! সামনে ভাইফোঁটায় মালুকে দিয়ে ওকে ফোঁটা দেওয়াব। কিন্তু হল উলটো। দুজনে দুজনকে প্রথম দেখাতেই ভালবেসে ফেলে। চোখের পলক আর পড়তেই পায় না। তখনি জহর অনুভব করে এটাই হল আসল ভালবাসা। আগেরটা ছিল মুগ্ধতা। সে বলে, কীভাবে হলো জানতে চাইছিস ত? ওকে দেখার পর থেকেই মালুকে বোন বলে মনে হতে থাকল। কী লজ্জার কথা! কিন্তু ওর ওই টান আমি আটকাতে পারলুম কই? ওর গায়ের রঙ দেখছিস? কেমন সুন্দর ফলসা রঙের গা না? সেটা দেখে আর থাকতে পারিনি। ওর গায়ে বসা মশা-মাছিকে আমি পিছলে পড়তে দেখেছি। অবাক হচ্ছিস? বাসরে কি বললে জানিস? আমাকে স্বপ্নে দেখেছে। কিন্তু ওর নারীবাদী সত্তা সেই স্বপ্নকে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু সামনাসামনি হয়ে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। আর বয়েস? শচীনের বউও ওর চেয়ে বড়ো। বউ বয়সে বড়ো হলে বেশি ম্যাচিওর হয়। আর সংসার ঠিক করে চালাতে গেলে ম্যাচিওর মেয়েকেই বিয়ে করা দরকার। কিন্তু এরকম ধরে বিয়ে করতে গেলি কেন? কিছু করার ছিল না রে। সেদিন শালু আমাকে বললে, তুমি যদি আমাকে আজই না বিয়ে কর, আমার আর বিয়ে হবে না। আমি বলি, কেন? সে বললে, অন্য নারীবাদীরা; যারা বিয়ে করেনি, তারা এ বিয়ে হতে দেবে না। তাই তুমি আমাকে নিয়ে পালাও। পালালি? ক্ষেপেছিস? আমি শালুকে বললাম, তা অসম্ভব! তোমার জামাইবাবু আমার চাকরি খেয়ে নেবে। তখন সে সোজা গটগট করে হেডুর ঘরে ঢুকে গেল। সব শুনে হেডু টাকে হাত রেখে বললেন, তুমি তো আশ্চর্য ছেলে হে! রোজ রোজ তুমি যা পালা লিখছ, সেখানে আমি আর কলম চালিয়ে কী করব। আমার অমন শালীকে কোনো বীরপুরুষ যখন ঘায়েল করতে পারল না, সেখানে তুমি একঘণ্টার মধ্যেই দাঁও মেরেছ মানে ধরে নিতেই হবে যে, নারী-বিষয়ে তুমি অধিক পটু! দিন কয়েক পর আমার বাড়িতে আমার বড় শালার মেয়ে আসবে। তোমারই বয়সী। তার আমেরিকায় রির্সাচ করতে যাবার কথা। সে রির্সাচের আগের ভাত খেতে আসছে। এখন সে যদি তোমার মুখোমুখি হয়; তাহলে, আমি বেশ বুঝতে পারছি; তার আমেরিকার স্বপ্ন ভণ্ডুল হয়ে যাবে। তোমরা এক কাজ কর। আজই বিয়েটা সেরে নাও। তোমাদের বিয়ে আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দেব। এ তো পুরো সিনেমা রে— প্রদীপ বলল। মালু কিছু বলেনি? কি বলবে? শালু এমনি তার মগজ ধোলাই করেছে যে সে নিতকনে হতে চেয়েছিল। নেহাত বয়েসে আটকে গেল তাই। আমরা বললাম, যাঃ শালা! এখানেও বয়স!! জহর সবার সিগারেটে আগুন দিয়ে বলল, যা বলেছিস। যে বয়সে যা।
শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২