কল সেন্টার – মাধব ঘোষ

শেয়ার করুন

হঠাৎ করে কল ফ্লো বেড়ে যাওয়ায় ম্যানেজার লগ-ইন টাইম এক ঘণ্টা বাড়িয়ে দিল। বেতনও কিছুটা বাড়ল তবে সেটা অতি সামান্য। বিশেষ করে টানা আট ঘণ্টা কাস্টোমারের সঙ্গে কথা বলার পর এমনিতেই গলা শুকিয়ে আসে, এয়ার কন্ডিশনের ঠান্ডা আবহের মধ্যেও শরীরে জ্বালাপোড়া শুরু হয়, তারপর অতিরিক্ত আরও এক ঘণ্টা কথা বলার চাপ—এটা জাস্ট নেওয়া যায় না। ম্যানেজারের এই সিদ্ধান্তে কেউই খুশি হয়নি। ব্রেক টাইমে এই নিয়ে এমপ্লয়িদের মধ্যে নানা ধরনের কথাবার্তাও হয়েছে, যার সবটাই ম্যানাজারের বাপ-বাপান্ত বিষয়ক। ডিউটি শেষে মদের দোকানে, গাঁজার আড্ডায় উল্লেখযোগ্যভাবে ভিড় বাড়তে লাগল, সেখানেও আলোচনার বিষয়বস্তু বিশেষ পালটালো না।

এক টানা নয় ঘণ্টা ডিউটির পর, প্রায় দুশো জন কাস্টোমারের সঙ্গে কথা বলে অদ্রিশ যখন ফ্লোর থেকে বেরোয় তখন রাত নয়টা। এই সময়টাতে মুখের ভেতর থুতু পর্যন্ত শুকিয়ে যায়। ক্লান্তি দূর করতে একটা সিগারেট জ্বালায় অদ্রিশ। সামনেই মেইন রোড। ছোটোবড়ো নানা সাইজের গাড়ি তীরের মতো ছুটে চলছে গন্তব্যের দিকে৷ আশেপাশে তখন অদ্রিশের মতো আরও অনেকেই বাড়ি ফিরছে, যাদের নাইট সিফট তারা যাচ্ছে অফিসের দিকে। কারো দিকে না তাকিয়ে অদ্রিশ হাঁটা শুরু করে। শ্রাবণ মাস। বেশ গরম। কয়েকদিন ধরে প্রায় নিয়ম করে বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু গরম এক তিলও কমেনি। সারাদিন এয়ার কন্ডিশনে কাটিয়ে বেরোনোর ফলে এই সময়টাতে এমনিতেই গরম অনুভূত হয় বেশি। কিছুদূর হাঁটার পর একটা অন্ধকার গলির ভেতর এসে দাঁড়ায় অদ্রিশ। চারদিকে তাকিয়ে একটি বন্ধ কাঠের দরজায় কড়া নাড়ে। মুহূর্তের মধ্যে ভেতর থেকে মেয়েলি স্বর ভেসে আসে,
—কী লাগবে?
—বৌদি একটা কোয়াটার দিন।
সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞাত হাতে ভর করে একটা ছোটো বোতল বেরিয়ে আসে, অন্য একটি হাত তড়িঘড়ি সেটিকে ব্যাগে পুরে সেখান থেকে রওনা দেয়। তারাহীন রাতের আকাশে তখন মেঘ ডাকছে, সঙ্গে বিদুৎ-এর ঝলকানি। দ্রুত পা চালায় অদ্রিশ।

২.

নিজের ভাড়া ঘরের দরজা খুলতেই একটা গুমোট গন্ধে শরীরটা ঘিনঘিন করে ওঠে। পুরোনো আমলের ঘর, বড্ড বেশি স্যাঁতসেঁতে। ভেজা মেঝেতে ফাঙ্গাস পড়েছে। কারণ ভারী বৃষ্টিতে ছাদ চুঁইয়ে জল আসে ঘরে। দেওয়াল এবং মেঝেতে জলের দাগ তখনও শুকোয়নি। কিন্তু ভাড়া কিছুটা কম থাকায় অদ্রিশ বাড়ি পালটানোর কথা ভাবে না। চটপট ফ্রেশ হয়ে খাটের উপর গ্লাস, বোতল নিয়ে বসে অদ্রিশ৷ প্রতি চুমুকে ক্লান্তি দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা চলতে থাকে! মায়ের কথা মনে পড়ে। ঘড়ির দিকে তাকায়, রাত ১১টা। হয়তো মা ঘুমিয়ে পড়েছে। হয়তো জেগে আছে! মায়ের নম্বরটা ডায়াল করেও কেটে দেয় অদ্রিশ। খুব খিদে পেয়েছে। মনে করে দেখল শেষবার ভাত খেয়েছিল দুপুর একটায়। তারপর এখনও পর্যন্ত কফি, সিগারেট আর মদ ছাড়া কিছু পেটে পড়েনি। খালিপেটে হুইস্কির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় মাথাটা টলমল করতে থাকে। হেলে দুলে কোনোক্রমে রান্না গিয়ে অদ্রিশ দেখল খাওয়ার কিছু নেই। মনে পড়ল, আজ রান্না করা হয়নি। ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর অতিক্রম করেছে। শরীরের যা অবস্থা এখন রান্না চাপানো সম্ভব নয়৷ অগত্যা এভাববেই শুয়ে পড়া ছাড়া উপায় নেই। নেশায় চোখ বুজে আসে ঠিকই কিন্তু খালি পেটে ঘুম আসে না! একটা তন্দ্রাঘোরে তলিয়ে যেতে থাকে অদ্রিশ!

অদ্রিশের সিস্টেমে ফোন এসেছে, অদ্রিশ কথা বলছে…
Good morning, this is Adrish, How may I help you?
ফোনের ওপ্রান্তে অদ্রিশের মা! বলছেন,
—বাবা রাতে না খেয়ে ঘুমোলে আয়ু কমে! অল্প কিছু খেয়ে নে। কাঠাল বিচি ভাজা আর মুসুর ডাল করেছি। আয় বাবা, খেতে আয়!
অদ্রিশ উত্তর দেয়—“ও আচ্ছা। আপনার অসুবিধার জন্য দুঃখিত। আপনার আয়ু কমার সমস্যাটা এখনই ঠিক হয়ে যাবে। আপনি অনুগ্রহ করে রাইট মেসেজে গিয়ে ক্যাপিটাল লেটারে টাইপ করুন ‘CREDIT ভাত’ এবং এটা পাঠিয়ে দিন আমাদের টোল ফ্রি নম্বর ১১১-এ! সঙ্গে সঙ্গে আপনার আয়ু বেড়ে যাবে! আপনার খিদে মিটে যাবে! কল করার জন্য ধন্যবাদ। আপনার রাত শুভ হোক।” বিড়বিড় করতে থাকে অদ্রিশ।

৩.

অদ্রিশের টিমের নাম কাঞ্চনজঙ্ঘা। কল সেন্টারের ওয়ার্কাররা এরকম নানা টিমে বিভক্ত থাকে। প্রত্যেক টিমে থাকে একজন টিম লিডার। অদ্রিশদের টিম লিডার রজত রায়। আজ ফ্লোরে যাওয়ার আগে রজত মিটিং ডেকেছে! আপাতত অদ্রিশরা সবাই মিটিংয়ের জন্য অপেক্ষারত৷

মিনিট পাঁচেক পরেই রজত প্রবেশ করে মিটিং রুমে। পোডিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে সে প্রথমেই বলে,
“Adrish, External Quality Team has informed us that yesterday, you have taken a Fatal Call. And for the past few days, as per as C-SAT is concerned your earnings have been much lower than others.”

হলের বাকিরা অদ্রিশের দিকে দৃষ্টি ফেরায়। এইরকম পরিস্থিতি এর আগেও অনেকবার হয়েছে। এই কোম্পানির রুলস বুকেই সম্ভবত এটা বলা আছে যে কেউ ভুল করলে মিটিং ডেকে সাবার সামনে বসিয়ে, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তাকে অপমান করো, হেনস্তা করো! আর কল সেন্টারের এমপ্লয়িরা কাজের অতিরিক্ত প্রেশারে এমনিতেই যন্ত্র হয়ে যায়, তাই এদের অপমান-অপদস্ত করলে কোনো প্রতিবাদ আসে না! অদ্রিশও চুপচাপ মাথা নীচু করে বসে থাকে, কিছু বলে না। রজত তখনও অনর্গল কী সব বলে যাচ্ছে, কিন্তু অদ্রিশের কানে তখন ওসব ঢুকছে না। অদ্রিশের মনে তখন একটাই শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছে ‘ফ্যাটাল’! কল সেন্টারে পান থেকে চুন খসলেই ‘ফ্যাটাল’! অর্থাৎ মারাত্মক ভুল যার পরিণাম হতে ভারে ভয়ংকর। যেমন আজ অদ্রিশের হল! গতকাল কোনো একটা কলে সে একটা কিছু ভুল করেছে। তাই শাস্তি স্বরূপ সেন্টার হেডের ঘরে বসে আজ ওকে কল নিতে হবে! অদ্রিশ ভেবে পায় না, কোন্ কলটায় সে ভুল করেছে! কল সেন্টারে ভুল করে পাড় পাওয়া যায় না। কারণ প্রতিটি কল সিস্টেমে রেকর্ডেড থাকে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চাইলে পরে যেকোনো সময় সেই রেকর্ড শুনতে পারেন। তাই একটু অসাবধান হলেই ঘটে বিপত্তি। আর যাবতীয় নিয়ম মেনে কাস্টোমারের সঙ্গে কথা বললেই ঝামেলা মিটে গেল তা কিন্তু নয়, কারণ কাস্টোমারের সাইড থেকে C-SAT অর্থাৎ Customer Satisfactory রিপ্লাই ম্যাসেজ এলো কি না সেই বিষয়টিও এমপ্লয়িদের খেয়াল রাখতে হয়। এখানে আসার আগে অদ্রিশ অনেকবার কারণে-অকারণে কাস্টোমার কেয়ারে ফোন করেছে। প্রতিবার ফোনের শেষে একটা মেসেজ আসত, Hi! You just spoke to Mr. অমুক, If you are satisfied then please reply us with ‘Y’, If not then reply with ‘N’! তখন অদ্রিশ বুঝত না কিন্তু এখন বুঝেছে এই সামান্য ‘Y’ এবং ‘N’-এর কত গুরুত্ব।

মিটিং হল থেকে বেরিয়ে অদ্রিশ সোজা সেন্টার হেডের ঘরের দিকে রওনা হয়। আশেপাশের কাচের চ্যাম্বারগুলোতে এক ঝাঁক তরুণ তরুণী কানে হেডফোন লাগিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসা। সবাই অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। সারা ফ্লোর জুড়ে পেট্রোলিং করছে স্যুট বুট টাই পরা টিম লিডার। এদের দায়িত্ব মনিটরিং করা। কেউ যদি পাঁচ মিনিটের বেশি সময় একটা কলে কথা বলে তাহলেই পেছনে গিয়ে রিমাইন্ডার দেয় ওরা, “Whats wrong with you man! Call is being longer. Try to finish within quickest possible time. Thousands call are in waiting!”

সেন্টার হেডের কেবিনে ঢুকে অদ্রিশ দেখে সেখানে আগে থেকেই কয়েকজন কল নিচ্ছে! সবার মুখ থমথমে! অদ্রিশের মতো এরাও কোনো না কোনো ভুল করে ধরা পড়েছে। গুনগুন শব্দে হলটা মুখর, কিন্তু সবার মধ্যেই একটা চাপা নিস্তব্ধতা। সিস্টেম অন করে প্রথম কলে ভারবেজ দেয় অদ্রিশ, “Good evening, this is Adrish, How may I help you?”
ঘড়িতে তখন সন্ধে ৭টা। ডিউটি চলবে ভোর ৪টে পর্যন্ত।

৪.

রাত ১.১০মিনিট। ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত কতগুলো চোখ কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। অদ্রিশের পাশাপাশি তন্দ্রাচ্ছন্ন আরও কিছু ছেলেমেয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। এত রাতেও আসতে পারে কাস্টোমারের কল! অতএব জাগতে রাহো! যদিও এই সময়টাতে কল ফ্লো অপেক্ষাকৃত কম থাকে! তবে মাঝে মধ্যেই বিপ শব্দে কেঁপে ওঠে রিসিভার। খালি পেট, শুকনো জিভ, মাথা ঝিমঝিম করে অদ্রিশের। খোলা আকাশের নীচে যে মুক্ত বাতাস, বাইরের পৃথিবীর মানুষ যা অত্যন্ত অবহেলায় গ্রহণ এবং বর্জন করে সেটাও এখানে সহজলভ্য নয়। এসির ঠান্ডা বাতাসে চামড়া ঠান্ডা হয় কিন্তু চামড়ার ভেতরটা উত্তপ্তই থেকে যায়। রুম ফ্রেশনারের বীভৎস গন্ধে পেট গুলোতে থাকে। অদ্রিশের পাশের চেয়ারে কল নিচ্ছে রেশমা। আসামের মেয়ে। ওরা পূর্বপরিচিত, কিন্তু ছয় ঘণ্টা পাশাপাশি কল নিলেও কেউ কারও সঙ্গে একটি কথা বলার সুযোগ পায়নি এখনও অবধি। এখন কল ফ্লো সেরকম নেই, টিম লিডারদের আনাগোনাও কম। তাই অদ্রিশ কথা বলে,
—হ্যালো! কেমন আছো?
—ভালো না, চাকরিটা সম্ভবত আর থাকবে না!
—তোমার কী প্রবলেম?
—এবিউসিভ বিহেভিয়ার উইথ কাস্টোমার।
—সেকি! গালাগাল দিয়েছ? অদ্রিশের মুখে চাপা হাসি
—আর বোলো না! মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে গিয়েছিল। রাত বারোটায় এক কাস্টমার ফোন করে আমায় বলে ‘আপ কি আওয়াজ বহুত নাশিলা হ্যায়! মে আপসে মিলনা চাহাতা হু! নম্বর মিলেগা?’

অদ্রিশ অনেক কষ্ট করেও হাসি আটকাতে পারে না। কল সেন্টারের পরিভাষায় এসবকে বলা হয় ‘প্র্যাঙ্ক কল’। কাস্টোমার প্রকৃত সমস্যার বাইরে গিয়ে হাবিজাবি প্রশ্ন করে, গালাগালি করে। এরকম সিচুয়েশনেও মাথা ঠান্ডা রাখতে হয় এমপ্লয়িদের। কাস্টোমার যত নোংরা ভাষা ব্যবহার করুক, তুমি কঠোর প্রফেশনালিজম মেইনটেইন করে যাবে। এই হল নিয়ম। রেশমা সেই নিয়ম ব্রেক করেছে।

অদ্রিশ এবং রেশমার কথপোকথনে যোগ দেয় পাশের চেয়ারের অনিল।

—আরে তুমি তো খিস্তি দিয়ে শাস্তি ভোগ করছ, কিন্তু আমি তো সেরকম কিছু না করেই শাস্তি পেলাম!
রেশমা জিজ্ঞেস করে,
—আপনার কেসটা কী?
অনিল হেসে বলে,
—আমার অপরাধ হল, আমি কাস্টোমারের খিস্তি না শুনে ফোনটা কেটে দিয়েছিলাম।
এই কথা শুনে সবাই একসঙ্গে হেসে ওঠে।
কল সেন্টারের রুল বুকে এটাও অপরাধ। অর্থাৎ কাস্টোমার যতই অপ্রাসঙ্গিক কথা বলুক, যতই তোমার মা, বাবা, বোনকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ কথা বলুক, ফোন না রাখা পর্যন্ত তুমি সেসব শুনে যাবে! ফোন ডিসকানেক্ট করার অধিকার শুধু কাস্টোমারের আছে! ফোন রিসিভ করা, ফোন কেটে দেওয়া—কোনোকিছুই এমপ্লয়ির হাতে থাকে না! এমনকি প্রাকৃতিক কারণে ওয়াশরুমে গেলেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আবার সিস্টেমের সামনে ফিরে আসতে হবে! এটাকে বলা হয় ‘অক্স টাইম’। নয় ঘণ্টার ডিউটিতে এমপ্লয়িদের জন্য এক ঘণ্টা ‘অক্স টাইম’ বরাদ্দ থাকে। এই এক ঘণ্টা সময়সীমা আবার নানা খাতে বিভক্ত। যেমন পেচ্ছাপ করতে গেলে পাঁচ মিনিট, হাগু করতে গেলে সাত মিনিট, কফি ব্রেক নিলে দশ মিনিট, লাঞ্চ বা ডিনারের জন্য কুড়ি মিনিট!

অদ্রিশের সঙ্গে গত সপ্তাহেই এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে। সিস্টেমে পেচ্ছাপের অক্স টাইম সিলেক্ট করে সে ওয়াশরুমে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে ভিড় থাকায় পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসতে পারেনি। ব্যাস! ঘটে যায় বিপত্তি! অর্থাৎ পাঁচ মিনিটের অক্স টাইম শেষ হতেই সিস্টেম অটোমেটিক চালু হয়ে ফোন রিসিভ করতে শুরু করে দেয়৷ এদিকে অদ্রিশ যখন সিস্টেমে ফিরে আসে ততক্ষণে তিনটে কল অটো রিসিভড হয়ে আবার ডিসকানক্টেডও হয়ে গেছে! আর যায় কই! সঙ্গে সঙ্গে ম্যানাজারের ঘরে তলব! এইসব ক্ষেত্রে ম্যানাজার চাইলে ‘ATL’ অর্থাৎ ‘Ask to leave’ লেটার ধরিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু বরাত জোরে অদ্রিশ সে যাত্রায় বেঁচে যায়, শাস্তি স্বরূপ ওর একদিনের বেতন কেটে নেওয়া হয়!

ঘড়ির কাঁটা ৪টা ছুঁতেই ওরা লগ আউট করে। কেবিন থেকে বেরিয়ে সবাই সোজা চলে যায় ডিউটিরত টিম লিডারের ঘরে! সেখানে সিগনেচার করে তারপর বেরোতে হবে! একসঙ্গে সবাই ঢোকার নিয়ম নেই তাই সবার প্রথমে ঢোকে রেশমা। রেশমা বেরিয়ে এলে ভেতরে ঢোকে অদ্রিশ! এক এক করে সবাই সিগনেচার শেষ করে লিফটে করে নেমে আসে নীচে! সেখানে রয়েছে এমপ্লয়িদের জন্য লকার রুম। কল সেন্টারের এমপ্লয়িরা শুধুমাত্র আই কার্ড ছাড়া আর কিছু নিয়ে মূল ফ্লোরে যেতে পারে না। তাই ডিউটিতে জয়েন করার পূর্বে সঙ্গে থাকা যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন মোবাইল, মানিব্যাগ, কলম এসব রেখে যায় লকারে। আবার ডিউটি শেষে সেসব নিয়ে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে আসে! লকার রুমে ব্যাপারটা প্রথমে লক্ষ করে রেশমা। ওদের সঙ্গে থাকা মণিপুরি মেয়েটিকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না! প্রথমে বিষয়টিকে কেউ সেরকম গুরুত্ব দিতে চায় না। অনিল বলে, হয়তো ওয়াশ রুমে গেছে! আর এখন যেহেতু ‘অক্স টাইম’-এর চোখরাঙানি নেই তাই ধীরেসুস্থে সবকিছু করছে!
অদ্রিশ মুচকি হাসে।
রেশমাও হাসিতে যোগ দেয়।
কিন্তু দশ-পনেরো মিনিট কেটে যাওয়ার পরও মেয়েটি ফিরে না আসায় ওরা তিনজন মিলে আবার উপরতলায় আসে। দোতলার উপর একটি ঘরে সিকিউরিটি গার্ডরা থাকে। সেখান থেকে গোটা বিল্ডিংটার সিসিটিভি ফুটেজে নজর রাখে ওরা। ডিউটিরত দুজন গার্ডকে ব্যাপারটা বলে রেশমা। কারণ এখন তাদের পক্ষে পুরো সাততলা বিল্ডিংয়ের সর্বত্র খোঁজা সম্ভব নয়। রেশমাদের কথা শুনে প্রথমে কম্পিউটারের প্রতিটি ক্যামেরার লাইভ ফুটেজ চেক করে সিকিউরিটি গার্ড। কিন্তু সেখানে কোথাও মেয়েটিকে দেখা যায় না। এরপর ওরা নিজেরাই খুঁজতে বেরোয়। অদ্রিশরা বসে থাকে ক্যামেরার সামনে। সকাল পাঁচটা বেজে গেছে, দূরে এনজিপি রেলস্টেশন থেকে ভেসে আসছে রেলগাড়ির শব্দ! অনিল পাশের চেয়ারটায় বসে ঝিমোচ্ছে। হঠাৎ অদ্রিশ উঠে দাঁড়ায়। রেশমাকে বলে,
—এভাবে আর বসে থাকা ঠিক হবে না, চলো আমরাও খুঁজে দেখি।
অনিলও নড়েচড়ে বসে। ওরা বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। চারদিক প্রায় জনমানবহীন। কেবলমাত্র এই সময়টাতেই গোটা বিল্ডিংটা হঠাৎ নীরব হয়ে যায়৷ আশেপাশের কেবিনগুলোতে দুই একজন কম্পিউটার খুলে বসে আছে কিন্তু ওরাও সম্ভবত বসে বসে ঘুমোচ্ছে। ভোর চারটে থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত সময়কালকে কল সেন্টারের পরিভাষায় ‘ডেথ আওয়ার’ বলা হয়। অর্থাৎ কল ফ্লো প্রায় জিরো!
কিছুদূর অগ্রসর হয়ে অদ্রিশরা একটা কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভেতরে একটা হট্টগোলের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তে হুড়মুড় করে ওরা তিনজনই কেবিনের ভেতর ঢুকে পড়ে।
নর্থ ইস্ট ইউনিটের টিম লিডারের কেবিন।
ভেতরে একটি মধ্যবয়স্ক লোক সিকিউরিটি গার্ডদের সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে মণিপুরি মেয়েটি!
লোকটিকে অদ্রিশ চেনে। এন.ই ইউনিটের টিম লিডার, নরেশ সরকার।
অদ্রিশদের দেখে আতঙ্কে নরেশের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। যদিও মুখে সে অন্যকথা বলতে থাকে। মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে সে বলে,
—কাল থেকে ভালো করে কল নেবে। কোম্পানি তোমার মতো স্টুপিডকে বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেবে না। আমি তোমায় ওয়ার্ন করছি, এই পারফরম্যান্সে চাকরি থাকবে না।
আর সিকিউরিটিদের শাসিয়ে বলে,
—ইউ পিপল জাস্ট গেট আউট অফ মাই রুম। কাল তোমাদের দেখে নেবো!
অদ্রিশ, রেশমা এবং অনিলকে দেখা মাত্রই মণিপুরি মেয়েটি ওদের কাছে চলে আসে।
নরেশ সরকার কোম্পানির প্রভাবশালী লোক, কোম্পানিতে চাকরি দেওয়া এবং নেওয়া, দুটো ক্ষমতাই তার আছে।
সুতরাং আসল ব্যাপারটা সবাই বুঝলেও কেউ কিছু বলে না, চুপচাপ সবাই কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।

৫.

আজ রোববার। অদ্রিশের অফ ডে। কল সেন্টারে রোববার মানেই সকলের ছুটির দিন তা কিন্তু নয়! এমপ্লয়িরা সপ্তাহে একদিন ছুটি পায়, কার ভাগ্যে কোন্‌দিন সেই ছুটি ধার্য হবে সেটা ম্যানেজার ঠিক করেন। সেদিন রাতের ঘটনার পর থেকে অদ্রিশের মনটা একেবারেই ভালো নেই। এমনিতেই অনেকদিন ধরে ও চাকরি থেকে রিজাইন করার কথা ভাবছিল, নানা কারণে সেটা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু শেষ ঘটনাটা ওকে নাড়িয়ে দিয়েছে। কয় টাকা আর বেতন? ফাইন, পেনাল্টি, হেনো, তেনো নানা কিছু কেটে মাস গেলে ৮০০০ টাকাও হাতে আসে না! তাহলে কেন করবে কেউ এই চাকরি? কিন্তু এক বছর আগে চাকরিটাতে যখন জয়েন করেছিল তখন এইটুকু টাকাই ওর কাছে বিরাট কিছু ছিল। টাকার প্রয়োজন আজও আছে। অদ্রিশ এও জানে এই চাকরিটা ছেড়ে আরেকটা চাকরি জোগাড় করা সহজ নয়! কিন্তু যাই হোক না কেন, এই চাকরি সে করবে না! সেদিন ভোরবেলায় টিম লিডার নরেশ সরকার একটি অসহায় মেয়ের সঙ্গে যা করেছে তার প্রতিবাদ হয়তো অদ্রিশ করতে পারেনি, কিন্তু ওই লোকটার আন্ডারে সে আর কাজ করবে না। রেশমার সঙ্গে ইদানিং খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে অদ্রিশের। আপার আসামের একটি গ্রামে ওর বাড়ি। খুব সাহসী মেয়ে। জোরহাটের নামি ইংরেজি স্কুলে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা। বাবার অবস্থাও ভালো। কেবলমাত্র বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করবে না বলে সে পালিয়ে এসেছে শিলিগুড়িতে। এখানে এসে কল সেন্টারের চাকরি নিয়েছে৷ এছাড়া আর উপায়ও ছিল না। একমাত্র এই কলসেন্টার গুলোতেই সারা বছর চাকরি পাওয়া যায়। অদ্রিশ দেখেছে প্রায় প্রতিদিনই একগুচ্ছ ছেলেমেয়ে ইন্টারভিউ দিতে আসে, আবার প্রতিদিন একগুচ্ছ ছেলেমেয়ে চাকরি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। তাই কল সেন্টারের ভ্যাকেন্সি কোনোদিনও শেষ হয় না৷ কল সেন্টারে যেকোনো সময়, যেকোনো দিন, চাকরি পাওয়া যায়। শুধুমাত্র ইংরেজি, বাংলা আর হিন্দি ভাষাটা ভালো জানতে হবে। তবে সবক্ষেত্রে ইংরেজির দরকার হয় না। যারা নর্থ ইস্ট ইউনিটে চাকরি করে শুধু তাদের ক্ষেত্রেই ইংরেজি জানাটা বাধ্যতামূলক। নর্থ ইস্ট ছাড়াও রয়েছে আরও দুটি ইউনিট যেমন আসাম ও বেঙ্গল, এগুলোতে বাংলা, অসমীয়া জানলেই হয়। পাশাপাশি টুকটাক হিন্দি জানলে ভালো! অদ্রিশ, রেশমা এবং সেই মণিপুরী মেয়েটি নর্থইস্ট ইউনিটের কল নেয়। নাগাল্যান্ড, মনিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরা, এসব রাজ্য থেকে কল আসে অদ্রিশদের কাছে। অনিল বেঙ্গল ইউনিটের কল নেয়। সারা পশ্চিমবঙ্গের কল আসে বেঙ্গল ইউনিটে।
দুপুর বারোটার দিকে রেশমার ফোন আসে অদ্রিশের মোবাইলে! অদ্রিশ ফোন রিসিভ করে- হ্যালো বলে!
—Where r u now?
—I’m in my room.
—Ok stay there, I’m just on the way to your room.
এইটুকু বলেই ফোন কেটে দেয় রেশমা।

অদ্রিশ চটজলদি বিছানাটা একটু গুছিয়ে নেয়। ঝটপট নোংরা শার্ট-প্যান্ট, আন্ডারওয়্যার সবকিছু একটা বড়ো ঠোঙায় ঢুকিয়ে খাটের নীচে চালান করে দেয়। এরপর পরনের হাফপ্যান্ট খুলে একটা ট্রাউজার্স আর টি-শার্ট পরে নেয়। সঙ্গে হালকা ডিওডোরেন্ট স্প্রে করতেও ভোলে না! অদ্রিশের হৃদস্পন্দন আস্তে আস্তে বাড়ছে! রেশমা ওর ঘরে আগেও এসেছে। তবে তখন ওদের মধ্যে এতটা বন্ধুত্ব ছিল না। গত কদিনে ওদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এর মধ্যেই রেশমার ঘরে অদ্রিশ একদিন দুপুরে নিমন্ত্রণ খেয়ে এসেছে। একদিন দুজনে মিলে অদ্রিশের ঘরেই দরজা বন্ধ করে বিয়ার আর গাঁজাও খেয়েছে! তখন থেকেই অদ্রিশের মনে রেশমা সম্পর্কে অন্যরকম একটা অনুভূতি তৈরি হতে শুরু করে। অদ্রিশের মনে পড়ে সেদিনের কথা, নেশায় টলতে টলতে রেশমা কত কথাই না বলেছে। বাড়ির কথা, প্রথম প্রেম, প্রথম সেক্স সবকিছু। অদ্রিশও কিছু লুকোয়নি। সব বলেছে রেশমাকে। রাতে বাড়িতে ফেরার আগে রেশমা অদ্রিশকে জড়িয়ে ধরেছিল! তারপর যদি অদ্রিশের মনে রেশমাকে নিয়ে একটা কিছু তৈরি হয় তাহলে দোষ কোথায়?
মিনিট পনেরোর মধ্যে রেশমা অদ্রিশের ঘরে এসে পৌঁছায়! কিন্তু এ কী! রেশমা একা নয়, সঙ্গে সেই মণিপুরি মেয়েটি! মেয়েটিকে দেখে রাগ হয় অদ্রিশের। রেশমা অনেক কিছু খাবার নিয়ে এসেছে। চিপস, কোল্ড ড্রিংকস, চকলেট এবং বিয়ার।
অদ্রিশ কিছুটা নির্লিপ্তভাবেই একটা চেয়ারে বসে পড়ে।
রেশমা সম্ভবত অদ্রিশের মনের অবস্থা কিছুটা বুঝতে পেরেছে। মুচকি হেসে অদ্রিশকে জিজ্ঞেস করে,
—Are you ok?
—Ya, I’m fine.
—No, it doesn’t look like you’re in a good mood.
—Nothing like that.
ওদের কথার মাঝখানেই কথা বলে মণিপুরি মেয়েটি। অদ্রিশ দুদিন আগেই মেয়েটির নাম জেনেছে। সারিতা পোখরেল।
ভাঙা বাংলায় সারিতা বলে,
—তুমরা কী শুধু বাতে করবা! খানা-পিনা কিছু হবে না নাকি? হামি তাইলে যাই!
—না না, সেকি! আপনি বসুন! আপনার সাথেও নিশ্চয়ই কথা বলব, জবাব দেয় অদ্রিশ।
—তাইলে চলো শুরু করা যাক! হামার পেটে বহুত খিদা লাগতেছে!
—হ্যাঁ হ্যাঁ! শুরু করা যাক!
রান্নাঘর থেকে অদ্রিশ গ্লাস নিয়ে আসে। ওরা চিপস সহযোগে বিয়ার খেতে শুরু করে।
দুই গ্লাস করে বিয়ার খাওয়া হয়ে গেলে অদ্রিশ সিগারেট জ্বালায়। রেশমা সিগারেট খায় না। কিন্তু সারিতা অদ্রিশের কাছ থেকে একটা সিগারেট চেয়ে নিল।
নাক-মুখ দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে অদ্রিশ শুরু করে,
—বন্ধুরা তোমাদের জানিয়ে রাখি, এই বালের চাকরি আমি আর করব না! আমি ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।
রেশমা, সারিতা চুপ করে তাকিয়ে থাকে অদ্রিশের দিকে।
অদ্রিশ আবার বলতে শুরু করে,
—Now let me tell you something… আমি অদ্রিশ বসু। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। আমি ইংরেজিতে এম.এ এবং বি.এড করে এসে কল সেন্টারে কাজ করছি, কেন জানো?
রেশমা, সারিতা কথা বলে না। ওরা বুঝেছে অদ্রিশের নেশা হয়েছে।
অদ্রিশ আবারও শুরু করে,
—আমি আমার বাবার কথা শুনে এখানে পালিয়ে এসেছি। কারণ হল আমাদের গ্রামের একটি আদিবাসী মেয়েকে আমি ভালোবাসতাম। মেয়েটিও আমায় ভালোবাসে। হঠাৎ একদিন মেয়েটি আমায় জানাল সে প্র্যাগনেন্ট এবং আমি তার পেটের বাচ্চার বাবা! খবরটা শুনে আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। বাড়িতে এসে মা’কে সব খুলে বলি। মা খুব কান্না করেছিল, কিন্তু বাবা যখন বিষয়টি জানল তখন উনি আমায় কিছুই বলেননি, শুধু পরেরদিন ভোরবেলায় আমাকে শিলিগুড়ির ট্রেনে উঠিয়ে দিলেন! আজ আমি এটাও জানি না, সেই মেয়েটি কোথায় আছে, কী করছে! তবে শুনেছি আমার বাবাই ধরে বেঁধে মেয়েটিকে অন্যত্র বিয়ে দিয়েছে। এক বছর হয়ে গেল আমি আমার মা’কে দেখি না, মায়ের হাতের রান্না খাই না। এমনকি কাল যদি আমি চাকরিটা ছেড়ে দিই, তারপর আমি কোথায় যাব জানি না। শুধু এইটুকু জানি, বাড়ি আমি যেতে পারব না।
অদ্রিশের এহেন কথাবার্তায় চারপাশের পরিবেশটা হঠাৎ গুমোট হয়ে ওঠে!
রেশমা পরিস্থিতি পালটানোর চেষ্টা করে,
—Adrish, You are so stingy man… We haven’t had anything to eat since we came to your house! Chi! Man, chi!
অদ্রিশ লজ্জায় পড়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ওমনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সারিতা…
—One minute please… I have something to share… তুমরা জানো, মণিপুর থাকি আমি কেনে ইখানে এসেছি! জানো?
রেশমা চুপ, অদ্রিশ হ্যাবলার মতো চেয়ে থাকে শুধু।
সারিতা ঢুলতে ঢুলতে হাত নেড়ে বলতে শুরু করে।
—আমার বাবা কয়লার খাদানে কাম করতে গিয়া কোমড় ভাঙি ঘরে পড়ে আছে। আমার মা মানুষের বাড়িতে কাম করে, কিন্তু বাবার দাওয়াই আর খানা জোগাড় করতে পারে না! এইদিকে আমার ভাই সে মাল না খেলে ঘুমাইতে পারে না! মাল খাওয়ার জন্য টাকা চায়, মা দিতে না পারলে লাথ মেরে আমার মা’কে মাটিতে ফ্যালায় দেয়! Now you people tell me what can I do? পড়াশোনা বেশি করি নাই! কে চাকরি দিবে? এখন তুমরা বুজতে পারছো কেনো আমি নরেশ সরকারের মুখে সেদিন জুতার বাড়ি দেই নাই! কেনো আমি চুপচাপ চলে এসেছিলাম! কেনো আমি সব সহ্য করলাম! আর অদ্রিশ তুমি তো নখরি ছাড়ার ফ্যায়সলা নিয়েছো, নিতে পেরেছো, সেই স্বাধীনতা তোমার আছে। হামি কিন্তু সেটাও পারবো না। নরেশ সরকার যদি আমার ইজ্জত নিয়ে নেয় তবুও পরের দিন আমাকে তার সামনে বসে ফিরসে কল নিতে হবে! এই হলো আমার অবস্থা!

রেশমা উঠে সারিতাকে জড়িয়ে ধরে,
—তু অভি চুপ কর, নাহি তো এক থাপ্পড় মারুঙ্গি!
সারিতাকে জোর করে চেয়ারে বসিয়ে দেয় রেশমা।
ঘড়িতে তখন সন্ধে সাতটা অতিক্রান্ত হয়েছে। কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ বসে থাকার পর অদ্রিশ গিয়ে ঘরের দরজা, জানালা খুলে দেয়। এক ঝাঁক মুক্ত বাতাস অদ্রিশের নাকে মুখে ধাক্কা খেতে খেতে ঘরে ঢুকে পড়ে। অদ্রিশের চোখ চলে যায় জানালার বাইরে। আলোকিত শিলিগুড়ি শহর। পাশের রাস্তাটি উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত। মানুষজন আসা যাওয়া করছে। শুধুমাত্র সারিতা তখনও মাথা নীচু করে বসা। রেশমা অদ্রিশের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে ওর কাঁধে মাথা রাখে। এই তিনজন তরুণ-তরুণীর সামনে একটু আগে এই দুনিয়ার অনেক রহস্য আজ উন্মোচন হয়ে গেল। রেশমা খুব মোলায়েম ভাবে অদ্রিশকে বলে-
—Nice decision. Go wherever you want, just don’t continue this job. You deserve better one.
অদ্রিশ চোখ বন্ধ করে বসে থাকে।

৪.

সোমবার সকালে একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙে অদ্রিশের। ঘড়ির কাঁটা প্রায় বারোটা স্পর্শ করেছে। মেঘলা আকাশ, সঙ্গে হালকা বৃষ্টিও পড়ছে। সেইজন্যই সম্ভবত এত বেলা হয়ে গেলেও টের পায়নি অদ্রিশ। গতদিনের কথা মনে পড়ে অদ্রিশের। বিশেষ করে সারিতার কথা। মেয়েটি কত কষ্ট করছে, কত কী সহ্য করছে শুধুমাত্র পরিবারের কথা ভেবে। অদ্রিশ মনে মনে স্যালুট জানায় সারিতাকে। রেশমার মুখটা চোখে ভাসে। এত মিষ্টি একটা মুখের ভেতরে কী করে এত প্রখরতা, এত শক্তি, এত সাহস লুকিয়ে থাকে সেটাই ভাবে অদ্রিশ। চোখ বন্ধ করে এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে আরও ঘণ্টাখানেক কেটে যায়। অদ্রিশের মনে পড়ে আজ সোমবার। ডিউটি আছে, সন্ধ্যা সাতটায়। অন্যদিন ডিউটির কথা মনে পড়লে অদ্রিশের মাথাব্যথা শুরু হয়ে যেত, কিন্তু আজ সেরকম মনে হল না। বরং ডিউটিতে গিয়ে রেশমার সঙ্গে দেখা হবে, সারিতার সঙ্গে দেখা হবে, এসব ভেবে ভালোই লাগে ওর।
স্নান, খাওয়া-দাওয়া সব সেরে অদ্রিশ ঠিক সাতটায় অফিসের সামনে গিয়ে পৌঁছোল। প্রতিদিন অফিসের সামনেই একটা দোকানে সিগারেট খেয়ে তারপর সে অফিসে ঢোকে! আজও সেটাই করছিল। এই সময়টাতে অদ্রিশ আর যে কাজটি গত কয়দিন ধরে নিয়মিত করে আসছে তা হল রেশমাকে ফোন করে জানতে চাওয়া যে সে এখন অফিস থেকে কতদূর। তারপর রেশমা এলে ওরা দুজনে মিলে একসঙ্গে অফিসে ঢোকে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফোন করতে যাবে এমন সময়ই রেশমার পাঠানো একটা মেসেজ অদ্রিশের মোবাইলে ঢোকে। রেশমার ইংরেজি ম্যাসেজের বাংলা তর্জমা করলে যা দাঁড়ায় সেটা মোটামুটি এরকম—

“কী বন্ধু! তুমি নিশ্চয়ই এখন স্যুট বুট টাই পরে, অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে সস্তা সিগারেট টানছ আর ভাবছ আমি কেন এত লেট করছি! তাহলে আমি তোমাকে বলতে চাই আমি কখনও লেট করি না। এটা অবশ্য তুমিও জানো। তুমি কাল তোমার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলে, আর আমি আজ সেই সিদ্ধান্তের পরের ধাপ অতিক্রম করে বর্তমানে ট্রেনে বসে আছি! কোনো কিছুতে আমার লেট হোক সেটা আমার পছন্দ নয়। বন্ধু, আমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি। সুতরাং সিগারেট শেষ করার পর আজ তোমাকে একাই অফিসে যেতে হবে। আর শোনো, আমি আমার সঙ্গে সারিতাকেও নিয়ে এসেছি। সারিতাও চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। আমিই ওকে জোর করে চাকরি ছাড়িয়েছি। এখন আমরা এনজিপি টু গুয়াহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনের সেকেন্ড ক্লাসে বসে বসে বাদাম খাচ্ছি। এত কিছু করার আগে তোমাকে জানাইনি বলে দুঃখ পেও না। আর যদি দুঃখ পাও তাহলে আজ ভোরে বাড়িতে ফিরে একটা ফুল জয়েন্ট টেনে নিও। তাহলেই সব দুঃখ উধাও৷ যাইহোক ভবিষ্যতে কী করব সেটা এখনও ঠিক করিনি। আপাতত গুয়াহাটিতে আমার এক মাসতুতো দিদির বাড়িতে উঠব। যাই করি, যেখানেই থাকি সারিতা আমার সাথেই থাকবে। এই ভরসা দিয়েই ওকে রিজাইন করিয়েছি। যাই হোক, তুমি ভালো থেকো। এই জীবনে আর দেখা হবে কি না জানি না, তবে যদি দেখা হয় তাহলে আবার একসঙ্গে বসে বিয়ার খাবো। বিদায় বন্ধু!”

মেসেজটা পড়ে অদ্রিশের চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে! চোখ মুছে ধীর ধীরে সে অফিসে প্রবেশ করে। ঝাঁ চকচকে ফ্লোরে, বাতানুকূল কাচের ঘরে বসে তখনও একঝাঁক তরুণ-তরুণী অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *