বিবর্ণ হ্যাটের নিচে লুকিয়ে ছিল হর্সরাইডারদের ছায়ারং – উদয় শংকর দুর্জয়

বিবর্ণ হ্যাটের নিচে লুকিয়ে ছিল হর্সরাইডারদের ছায়ারং – উদয় শংকর দুর্জয়

শেয়ার করুন

প্রিয় দেবীদক্ষিণ

মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল থেকে লিখছি।

 

এর আগে তোমাকে এমন অবিশ্রান্তভাবে লিখিনি, এমন করে তোমাকে পোড়াইনি আগুনে। আমারও কি পুড়তে ইচ্ছে করে বলো! কিন্তু সেই আক্রান্ত কবিতাগুলো আর কিছুতেই পালিয়ে গেলো না, ঘাপটি মেরে বসে রইল আমার অজানা কোষের ঘরে। তোমাকে বলেছিলাম মনে আছে, চলো অন্ধ হয়ে যাই, অন্ধ হয়ে যাওয়ার আনন্দই আলাদা!

 

নদী-প্রবাহের বিবর্তন স্মৃতিতে, তোমার ফেলে যাওয়া পায়ের চিহ্ন ধরে হেঁটে গেছি, নিশিভ্রমণ থেকে গিরি খাদের অধিবিহ্বল-শোক-সংসার ছুঁতে চেয়েছি। পত্রচ্যুত ধ্বনি অবলম্বন করে একদল অতিথি জিরাফ যেদিন হরিদ্রাভ আলোয় দেখেছিল দ্রাঘিমা ভাঙা রঙের সমীকরণ, সেই থেকে কোমল শিলাচুর্ণের ধ্রুপদী লহরী হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘিরে ফিরতে ছেয়েছি , তা আর হয়ে উঠলো কই?  ফেলে আসা সেইসব মৃত্যুসংগীত রোজ বেজে ওঠে, আমার পাশে পড়ে থাকা নিঃসঙ্গ টেবিলের উপর। হারিয়ে ফেলা ক্রন্দিত দুপুর, সূর্যগ্রহণকালে আবার যেন উঠে আসে আমার শিয়রে; অনুভব করি এক খণ্ড শীতল নিঃশ্বাস আমার কপালে ঢেলে দিয়ে পালিয়ে গেলো সন্তর্পণে। সংবিৎ ফিরে এলে তোমার শ্রীমুখখানি আমি আজলা ভ’রে পান করি। তুমি তো জানো! একাকীত্বে কতবার আমি শিউরে উঠেছি, কতবার ঘুমন্ত গুলি থেকে বেরিয়ে গেছে আমার নিঃশ্বাসের মতো তপ্ত বাতাস; আমি শ্রান্ত-অবসন্ন-ধীর হয়ে পড়ে রয়েছি হিমালয়ের স্টেশনে। আমার কোনো নিজস্ব ছায়াপথ নেই, কোনো দুঃখ উৎপাদনের কারখানা নেই, তবু শীত উঠে পড়লে চলন্ত ট্রামে আমি মোম এবং বৃক্ষের ছায়া পোহানোর জন্য তোমাকে চিঠি লিখি। তোমার-আমার বিভেদের অনিঃশেষ সংজ্ঞা কেউ জানে না, আমিতো জানি যেখানে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স হরিণের শিং কুড়িয়ে নিয়ে যায়। আমি ছুটছি প্রাণপণ, বহু পথ পাড়ি দিয়ে দেখেছি আমি যেন জীর্ণ বৃক্ষ, পড়ে থাকা বাকলের দিকে চেয়ে আছি। দেবী দক্ষিণ তুমি তো সবই জানো, আমার ক্ষমতা-অক্ষমতা আর মনষা পুজোর নৈবেদ্য।

 

প্রিয় দক্ষিণ, তোমাকে সেসব আর কোনোদিন বলা হয়ে উঠলো না, আর কোনও দিন রঙের  ব্রাশটা সিক্ত উজ্জ্বল রাখতে পারলাম না। যতবার তোমার অগ্নিচোখ পুড়িয়ে আমি একটি প্রাসাদ বানাবো বার্মিংহামে, ততবার পরিচর্যাকারীরা কোনো না কোনো অজুহাতে ভেঙে দিয়ে গেছে আমার গৃহদ্বার।

দেবীদক্ষিণ, তোমাকে দেওয়ার আমার কীইবা ছিল, কীইবা করতে পারতাম তোমার জন্য। এখন আমি নির্জন হাসপাতালের জীবন্ত মর্গে মানুষ খুন করার চাকরি পেয়েছি।

আমি রোজ আমাকে একটু একটু করে খুন করে আসি, কী বীভৎস নির্জন নিস্তব্ধতা আমাকে শুইয়ে রেখেছে তা আমি বোঝাতে পারবো না। আমার বিছানার পাশে, এক আস্ত হেলিকপ্টার ডানা খুলে পড়ে আছে, অথচ কত সহজে আমি আমার ক্লান্ত বহু দিয়ে তা সরিয়ে দিচ্ছি।

 

তুমি তো জানো দেবীদক্ষিণ, সেই যে বুকের গহীন বনে এক খণ্ড তারা ভেঙে পড়েছিল, তা থেকে একটা অস্পষ্ট ব্যথা রোজ আমাকে কুয়াশা-বিচ্ছেদের গান শুনিয়ে যেত, সে কী অদ্ভুত ভয়ংকর সুর! যা আমি জীবনে কখনও কোনোদিনও শুনিনি। কুয়াশা-দেয়ালের পাশ ঘেঁসে সমুদ্র-বক্ষ চোখ মেলে তাকিয়ে আছে, দেবী তুমি কি দেখেছ

কখনও ইস্পাতের মাছগুলো বিষাদের চিহ্ন চোখের কোনায় মেখে নির্দিধায় ঝাপিয়ে পড়ে? আমারও ইচ্ছে হয় দেহের উড়ন্ত কোষগুলোকে বেঁধে রাখি আষ্টেপৃষ্টে, কারণ আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই। এই ম্রিয়মাণ জোছনা, এই বিহ্বলের ঘোড়া, এই রং করা জলহস্তীরা আমাকে আরও নিঃস্ব করে ছাড়বে বলে জানালার ওপারে

অপেক্ষা জড়ো করেছে।

 

খণ্ডিত আপেলের কথা মনে আছে তোমার? নিরানব্বই স্তনের আড়ালে এই কুয়াশাগ্রাম ধুলোবালি মেখে কবিতা শুনতে বসতো। আমার কবিতা ভীষণ একা এবং একাই।

যে ঘরে থাকি, পাঁচ জন প্রাণী আমরা- একটা টিকটিকি, একটা মাকড়সা, এক জোড়া প্রজাপতি আর একটা ঢোঁড়াসাপ। তাদের সঙ্গে বাতাস ভাগাভাগি হয় আমার। আমার এই নির্বাসন যেন আত্মবোধের কাছে নিজেকে দাঁড় করানো, তুমি ছাড়া আর কে জানবে বলো। আমার সৃষ্টির জংশনে আবিষ্কার করেছি তোমার রোদভরা কাল্ভার্টের সেলাই জল। বিপন্ন নতুন গিরিপথ বসে থাকে আমাকে অন্ধকারে স্নান করাবে বলে, আমি সে পথে শুধু হেঁটে যাই অনাদিকাল। আঁকাবাকা সড়কপথেও মসৃন-সাপ-রাত্রী নেমে আসে, আমি চুপচাপ মন্ত্র থেকে জেনে নিই তোমার অবেলার ব্যথিত সংলাপ।

 

‘আজ নগর-বার্মিংহামে রোদ উঠেছে আমি বলছি না- আজই  প্রিয়জনের রক্তে রোদ লাগবে’–মনে পড়ছে?  দেবীদক্ষিণ, এই বিছানায় শুয়ে রোদের আঁচ পাচ্ছি।

চারপাশ থেকে ছুটে আসছে রোদের মিছিল। প্রাসাদ, ভবন, জংশন উড়িয়ে দিয়ে রোদ্দুরের সুনামি নেমেছে। কিন্তু সে রোদ আমার হাসপাতালে না ঢুকে ওরা পালিয়ে গেলো জানালায় উঁকি দিয়ে। পরে বুঝলাম ওরাও চায়নি এমন উন্মাদ কোষের শরীর ঘেঁসতে। আমারই এমন ভাগ্য বলো! তুমিতো জানো আমার রক্তের বেহাল বিড়ম্বনার কথা, আমার শরীরের অক্টোপাসের কথা। ওরা তো আমার কবিতা,

আমার অণুপরমানুতে মিশে থাকা লোহিতকণিকা। কবিতার নগরে ওরা আমার জলন্ত জাহাজ।

 

কবিকে লেখা আমার চিঠি

 

শৈশবের ছায়া কেটে কেটে হরিণের জন্য যে আবাস গড়তে চেয়েছিলে তার দরজা-জানলা হাহাকার করছে এখনও। ঘোড়াদের ক্ষুরের গানেই ছিল তোমার অদম্য টান, তুমি হেঁটে এসে অগ্নিদগ্ধভূমি, থেমে যেতে কোনো ধ্যানমগ্ন মানবীর কাছে, তার কাছেই ছিল হর্স রেইসিংয়ের গোপন সূত্রাবলী। মাথায় তোমার  সূর্যরাগের হ্যাট, চোখের বিহবলতা ঢেকে যেত সেইসব হর্সরাইডারদের বাদামী ছায়ায়। কেউ কোনকদিন টের পায়নি কী এক বিষন্ন ভারীমেঘ লুকিয়ে রেখেছিলে ক্যান্সারাক্রান্ত শব্দপুঞ্জের মাঝে! সেই যে দেবীদক্ষিণ একদিন পদ্মঝুড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরবে বলে, তুমিও শাপলার বিল ভেঙে ঘুড়ির সুতোয় তাড়িয়ে নিয়েছিলে বিকেল। কী পেলে বলতো? হয়তো পেয়েছো ঢের, কিছুই জানা হলো না। তোমার জন্য আর কারো কিছু না হোক, দেবীদক্ষিণ সত্যি-সত্যি তোমার বিবর্ণ হ্যাটের নিচে লুকিয়ে নেবে মায়াসিক্ত রুপ।

 

পুনশ্চ

চূড়ান্ত মৃত্যুর আগেই তুমি দিয়ে গ্যাছো কবিতার কেমোথেরাপি, তার জলকল্লোল ভেঙে তোমার কবিতারা রোজ দেবীদক্ষিণের সবুজ ছায়ায় আদর মেখে ছুটে যায় গ্যালাক্সির পথে। তুমি ভালো থেকো।

 

৩৩ সেন্ট্রাল পার্ক রোড
২৮/০১/২০১৯
১২ টা রাত

 

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

One Comment

  1. অপূর্ব।
    শেষ করার পরে একরাশ মুগ্ধতা ছাড়া বলার কিছুই নেই।

Leave a Reply to Surajit Mandal Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২