ভোজ কয় যাহারে (সপ্তম পর্ব) : দে দোল দে দোল – সত্যম ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

দে দোল দে দোল

বেশি কোনো কিছুই ভালো নয়। আমাদের যৌবনকালে মেয়েদের সাথে কোনো কিছু বাড়াবাড়ি করলে যা তাদের ভালো লাগছে না, একটু মুখটা বেঁকিয়ে ‘উঁ’ মতো একটা আওয়াজ করে তারা বলত—বেশি বেশি। যাই হোক, এই লাইনে কথা আর বেশি বাড়িয়ে লাভ নেই কারণ সেই যৌবনকালও আর নেই আর ফ্লার্ট করবার মতো বান্ধবীও আজকাল আর জোটে না। এখন শুধু মাথায় টাক আর বুকে দীর্ঘশ্বাস।

যাই হোক, এই বেশি বেশি ব্যাপারটা সমস্ত সবজি ফসলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যে পটলের ছায়ায় বা আশ্রয়ে আমাদের প্রায় গোটা গরমকাল কাটে, পরের দিকে মনে হয় কখন একটু অন্য কিছু আসবে, কবে এই পটলের ঝোলের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। তখন মা-মাসিমারা আর কিঈ করবেন? তারা তো নিরুপায়। এতগুলো লোককে খাওয়াতেও হবে আবার খাওয়াতেও হবে এমন এক পদ দিয়ে যা তারা পছন্দ করছে না। তখন তারা এই পটল দিয়েই বিভিন্ন মডিফিকেশন করতেন যার ঝোল বা গ্রেভি দিয়ে একথালা ভাত নিমেষের মধ্যে বাড়ির লোকের উড়ে যেত। এরকমই একটি পদ ছিল আতপচাল-ঘি-গরমমশলা সহযোগে আলু পটলের ডালনা। মানে মূল ব্যাপারটা সেই পটল থাকলেও আতপচাল-ঘি-গরমমশলার গন্ধে কিন্তু ব্যাপারটা সেই তেলে ঝোলে হয়ে উঠল।

এর অনেক আগে বাজারে যখন সদ্য সদ্য পটল আসা শুরু করেছে, বেশি বেশি ব্যাপারটা তখন একদমই আসেনি, তখন গরম ভাতের সাথে সেই কচি পটল ভাজা। আহা! ভাজার গন্ধেই তো বাজিমাত। আর খাবার সময় সাথে চাই সেই পটলভাজারই তেল আর একটি সবুজ কাঁচালঙ্কা-লবণ। কী যে স্বাদ! খারাপ লাগে যখন বেশি হয়ে যাবার পর সেই পটলেরই ওই রকমের পরিণতি হতে দেখা যায়। তাই মনে হয় মহাপুরুষরা বার বার বলেছেন—অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। রূপের অতিরিক্ত দেমাক ভালো নয়, অর্থের অতিরিক্ত দেমাক ভালো নয়। কারণ একটা সময় আসে যখন সবার ল অফ এভারেজ মেনটেন হয়।

তখন ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের একটা স্কুলে আবাসিক টিচার হিসেবে কাজ করি। চরম নিরামিষ জীবন। সন্ধের পর দারোয়ানের সাথে সাঁট করে বেরিয়ে গ্রামের বাজার থেকে কিনে চপ আর ডিমসেদ্ধ খাই। কখনও ছেলেদের আবদার থাকে সেসব নিয়ে আসার জন্য। রাতে খাবার পর ছাদে গিয়ে সেসবের সদব্যবহার হবে। এবারে নিয়ে এসে লুকিয়ে রাখি আলমারিতে। আর আলমারি একটু খুললেই গন্ধ একদম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ধরা পড়ি সাধু মহারাজদের কাছে। চক্ষুলজ্জার কারণে তারা কিছু বলেন না। শুধু একটা দৃষ্টিতে বুঝিয়ে দেন যে তারা সবটাই বুঝেছেন।

রাঁধতে পারলে তো পটলের প্রিপারেশন অনেক রকমের হয়। পোস্ত-দোলমা, আরও কত কী! এবারে কোন্‌টা কী তাও অনেক সময় ঠিকঠাক জানি না। খাবার হয়, খেয়ে নিই। তো সেই চরম নিরামিষাশী হোস্টেল জীবনে একবার সেখানকার পাচক কী একটা যেন উৎসবে রেঁধে খাইয়েছিল। গোটা গোটা চেরা পটল, তার সাথে পোস্তরই মনে হয় গা মাখা গ্রেভি। খেয়ে-দেয়ে বুঝেছিলাম এই কারণেই সাধু মহারাজরা আমিষ খাবারের দিকে ঝোঁকেন না।

যাই হোক, খাবার মানে তো গল্প। বাজার যখন পটলে পটল, মানে পটলে আছাড় খেয়েই আপনি পটল তুলতে পারেন, তখন কিন্তু বাজারে বেশ কয়েক রকমের পটল পাওয়া যায়। একটা লোকাল চালানির ব্যাপার তো আছেই আমাদের এই উত্তরবঙ্গের উত্তরের বাজারগুলিতে। এছাড়াও আরও আছে—জাংলা পটল, মাটির পটল ইত্যাদি। তবে গরম বেশ খানিকটা পড়ে যাবার পর সাদাটে লম্বা লম্বা পটলটিরই স্বাদ ভালো লাগে।

তো, একবার এক আত্মীয়ের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছি সন্ধে নাগাদ। বাড়ি চা বাগানে। এবারে কী খাওয়াবেন আমাদের রাতে কথা উঠতেই সমস্যা দাঁড়াল যে তখন বাগানের বাজারে আর কিছুই পাওয়া যাবে না হয়তো। আর শহরে যেতে গেলে তো মোটামুটি কিলোমিটার দশেক। সে-পথে হাতির ভয়। তো শেষে ঠিক হল বাগানের বাজারে যা পাওয়া যাবে তা দিয়েই যা হবার হবে।

গৃহকর্তা গেলেন সেখানে এবং ব্যাজার মুখে নিয়ে এলেন কিছু মরা টাকি মাছ। সবাই যখন প্রচণ্ড চিন্তায় যে এই জিনিস দিয়ে কী অতিথি সৎকার করা যায় তখন সেই বাড়ির নিরামিষভোজি দিদিমা বললেন, ‘হইবো, রাখো’।

তারপর সেই মাছের দেহ থেকে মাছ আলাদা করে তার প্রিপারেশন করে লম্বা লম্বা পটলের ভেতরটাকে পরিষ্কার করে নিয়ে তিনি যে পদটি রেঁধেছিলেন এবং খাওয়ানোর সময় বলেছিলেন, ‘তোমাগো দাদু হেইটা খাইতে খুব ভালোবাসতো’, তো তাতে একদম ও-পারের ঘ্রাণ আর আত্মবিশ্বাস প্রতি গ্রাসে গ্রাসে অনুভব করা গিয়েছিল। আজ বছর-পঁচিশেক পেরিয়ে গেলেও সেই দিদিমার বা সেই জায়গার কথা উঠলেই সেই রান্নাটির কথা মনে পড়ে যায়…

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *