ভোজ কয় যাহারে (ষষ্ঠ পর্ব) : ফুলকলি রে ফুলকলি – সত্যম ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

ফুলকলি রে ফুলকলি

সেই যে ওয়ার্ডসওয়ার্থের সলিটারি রিপার শস্য কাটছিল আর গুনগুন করে গান করছিল কোনো একটা অজানা ভাষায় এক পাহাড়ি উপত্যকার ঢালে, দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠলেই কেন জানি মনে হয় সেই ঢালে তখন বয়ে যাচ্ছিল এক মনোরম বাতাস, যার সাথে মাথা দোলাচ্ছিল সেই শস্যক্ষেতের শস্যরাও। তাছাড়া আমাদের এদিকেও হেমন্তের শেষে যখন শীত ধীরে ধীরে ডানা মেলে, অঘ্রাণ মাসের সেই দিনগুলিতে হলুদ হয়ে থাকা ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে যখন বাতাস বয়ে যায় যেন ঢেউ খেলিয়ে, কী অপরূপই না লাগে। আচ্ছা, ঠিক তেমনটাই কি লাগে না যখন শীতের শুরুতে বাজারে হঠাৎ করে একদিন মাথা দোলাতে দোলাতে দেখা দেয় পেঁয়াজকলিরা। যখন তারা ক্ষেতে থাকে তখনও কি তারা এভাবেই মাথা দোলায়? বাজারে তখন তারা মহার্ঘ। হাজারো সবজির ভিড় থেকে অল্প একটু তাদের সাদা মাথাগুলো দেখা যায়। কিন্তু ছোঁয়া যায় না।

আস্তে আস্তে দিন যায়। যেমন কোনো এককালের ডাকসাইটে সুন্দরী মহিলা সম্পর্কে পাড়ার চায়ের দোকানের বৃদ্ধ বলেন—‘উনাকে তো দেখিস নাই তোরা সময়কালে, দেখলে বলতি, যা দেমাক!’ যেমন শহরের ডাকসাইটে সুন্দরীরা দিন যাবার সাথে সাথে অল্প স্থূলাঙ্গী হন, গার্ডার দিয়ে বাঁধা পেঁয়াজকলির আঁটিরাও তেমন সময়ের সাথে সাথে স্থূল হতে থাকে, আর বাকি সকল সবজির মতোই একসময় বাজারে সহজলভ্য হয়ে যায়। কিন্তু একটু দেখে কিনতে পারলে স্বাদ, আহা! সেই প্রথমদিনটির মতোই।

এবারে প্রশ্ন হচ্ছে বাজারে পেঁয়াজকলি আগে আসে না পেঁয়াজশাক। পক্ষপাতিত্ব না থাকলে বলতেই হয় যে আগে আসে পেঁয়াজশাক। কিন্তু ওই অনেকেরই যেমন হয়, সবকিছু থেকেও নাম হয় না, পেঁয়াজশাকেরও ঠিক তেমনিই। গড়পড়তা বাঙালি পেঁয়াজশাকের থেকে পেঁয়াজকলিকেই বেশি পছন্দ করেন বলেই মনে হয়।
তো যাক এইসব কথা। আপাতত আসি সেই কথায় যেখানে হাজার ভালো বাজার করলেও সেটি মাটি হয়ে যেতে পারে, মানে রান্না। সাধারণভাবে পেঁয়াজকলি মানেই কালোজিরা, কাঁচালঙ্কা সহযোগে তাতে লম্বা লম্বা আলু আর বেগুন। এবারে রান্না তো পুরোটাই হাতের ব্যাপার। কারুর কারুর হাতে এই সামান্য পদটিই এমন স্বাদ পায় যে গরম ভাতের সাথে মনে হয় আর কিচ্ছুর দরকার নেই। সাদা ধবধবে ধোঁয়া ওঠা ভাতের চূড়ার ওপরে দেওয়া তরকারি থেকে অল্প অল্প করে গড়াচ্ছে তার ক্কাথ বা তেল আর তার এককোণা থেকে তা দিয়ে একটু একটু করে ভাত মেখে খাওয়া। জীবনে এর থেকে সুখের আর কী হতে পারে?

আর প্রকৃতিও অদ্ভুত। যেমন মানুষ সৃষ্টি হয়েছে তার অসাধারণ টেকনিক্যাল সুপিরিওরিটি নিয়ে, বাজারও ঠিক এই পলিসিতেই চলে। যার সাথে যেটার স্বাদ সব থেকে ভালো খোলে, সঠিক সময়েই বাজারে সেটা এসে উপস্থিত হয়। কেন বলছি এই কথা সেটা একটু খোলসা করে এবারে বলা যাক।

যে সময়ে তরকারি বাজারে এই পেঁয়াজকলিরা বেশ চওড়া হাসি মেলতে শুরু করেছে, তখনই যেন কীভাবে খবর পেয়ে মাছ বাজারে দেখা দেয় কালোর মধ্যে হলুদ ডোরাকাটা ট্যাংরা মাছেরা। আর ঠিক ওই সময়ই তাদের পেট ভরা ডিম। কী অদ্ভুত সমাপতন।

এবারে এই প্রসঙ্গেই আরেক কথায় আসি। আমাদের কৈশোর যৌবনে আত্মীস্বজনের বিয়েবাড়ি এখনকার মতো ওয়ানডে আউট ব্যাপার ছিল না। বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে কদিনের জন্য সেই বাড়িতে গিয়ে তাদের অন্নধ্বংস করাটাই ছিল দস্তুর। হৈ-হল্লা-ঝগড়াঝাটি-গোঁসা ইত্যাদি সবই হত। বললাম বটে অন্নধ্বংস কিন্তু কেউই তা মনে করতো না। ওটা নিন্দুকের কথা।

সবাই জানেন, বিয়েবাড়ির আসল খাওয়াটা পাওয়া যায় বাসি বিয়ের দিন। ইউনিক সব পদ রান্না করে ওই দিনই রান্নার ঠাকুররা তাদের হাতের খেল দেখিয়ে থাকেন। তো এরকমই এক তুতোদিদির বিয়েতে ক’দিন ধরে আছি। বিয়ের দিন রাতে প্রচুর খাওয়া হয়েছে। কিন্তু বয়স কম। বাসি বিয়ের খাওয়াতেও সময় নষ্ট না করে যথারীতি সময়মতো উপস্থিত হয়ে গিয়েছি। প্রথমবার পাতে পড়ল ট্যাংরা মাছ দিয়ে পেঁয়াজকলি। খেয়ে মনে হল, ‘আহা! কী খেলাম এই স্বর্গীয় পদ।’ সেটাও ছিল এক শীতকাল। তারপর থেকে শীতকাল আসলেই আমার শুধু পেঁয়াজকলি বা ট্যাংরা মাছ দেওয়া পেঁয়াজকলির জন্য মনটা আনচান করতে থাকে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *