ভোজ কয় যাহারে (তৃতীয় পর্ব) : ফুলকপি – সত্যম ভট্টাচার্য
ও মাসি, কি রান্না হয়েছে গো আজ-
ডাইল আর কফির ডাট্টার চচ্চড়ি-
মুখটা একটু ব্যাজার হতেই ওদিক থেকে আবার ঝনঝন করে আওয়াজ ভেসে এলো-
বাজার নাই তো করুম কি, এগুলাই খায়ে থাকো-
মাসের শেষের দিক। যে কোনো কারণেই হোক মেসের বেশীরভাগ ছেলেপুলেই বাড়ি চলে গিয়েছে। ছুটি আছে হয়তো দু তিন দিন। আমাদের যাদের বাড়ি একটু দূরে তারাই এক দুজন হয়তো মেসে রয়ে গিয়েছি। শীতকাল বা তার শেষের দিক যাচ্ছে। তখন আড়মোড়া ভেঙে দরজা খুলে রান্নার মাসির সাথে এই কথোপকথনে মনটা তাৎক্ষণিক ভাবে খারাপ হয়ে গেলেও যেভাবেই হোক খাওয়াটা কিন্তু হয়ে যেতো। আসলে মেসের ফান্ডে তো টান। তাই বাজার করাও নেই। অগত্যা মাসিকেও আগের দিনের রেখে দেওয়া ফুলকপির ডাঁটা দিয়েই কাজ চালাতে হয়েছে।
তাই ফুলকপি বা তার ডাঁটার কাছে আমরা যারা ঐ জীবনটা কাটিয়েছি তাদের আজীবনের ঋণ। আর ঋণ সেই সমস্ত পূর্ববঙ্গীয় মহিলাদের হাতের কাছে কাছে যারা ঐ ফেলে দেবার মতো বিষয়গুলোকেও এমনভাবে কাজে লাগাতেন যে তাতে একথালা ভাত দিব্যি খাওয়া হয়ে যেতো।
তাই সে কারণেই দুর্গাপুজো নাগাদ সবুজের মধ্যে থেকে সাদা সাদা হাসিমুখে অল্প একটু মুখ বের করা ফুলকপি যখন বাজারে আসে তখন মনে একটু হলেও আনন্দ লাগে বৈকি। ঐ তো আবার সে এসেছে ফিরিয়া। আবার বেশ কিছু দিন তার ওপর নির্ভর করেই দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যাবে। একা হোক বা মাছের সাথে, পাঁচমিশেলী তরকারিতে হোক বা আলু পেঁয়াজ দিয়ে রোস্ট- কোনোটাতেই আসর জমাতে তার জুড়ি মেলা ভার। আর দুর্গাপুজোর সময় দামের কারণে তাতে হাত দিতে না পারলেও লক্ষীপুজোর ভোগে কিন্তু তাকে চাইই চাই। সে যেন তখন সদ্য কিশোরীবেলায় পা দেওয়া উচ্ছল ফুটফুটে। দুষ্টুমি করে মাঝে মাঝেই তখন সে হারিয়ে যায় ব্যাগের মধ্যে আর কান মলে দেবার মতো করে তাকে তখন তুলে আনতে হয় তার গার্ডার লাগানো বিনুনি ধরে।
আচ্ছা এমন কি হয় বা হতে পারে যে বয়সের সাথে সাথে মানুষের ঘ্রাণশক্তি কমে যায়? না হলে সে ফুলকপি যখন মরসুমে প্রথম বাড়িতে আসতো, কড়াইতে পড়ার সাথে সাথে তার গন্ধে কিস্তিমাত হয়ে আমরা দৌড়ে যেতাম রান্না ঘরে। আর ঐ অল্প ভাজা হাল্কা সোনালী ফুলকপি থেকে একটু ভেঙে যখন হাতে পেতাম, আহা! জীবনে এর থেকে মধুময় আর কিই বা হতে পারে বলেই মনে হত। কিন্তু এখন? সে রামও আর সেই অযোধ্যাও নেই। বাজারে এখন প্রায় সারবছরই সবকিছুই পাওয়া যায়। তাই আলাদা করে গন্ধ পাওয়ার আশা করাও বৃথা।
দিন যায়। শীতকাল যায়। কোনোদিন তাকে দেখা যায় সকালে সাদা সাদা লুচির সাথে কালোজিরে কাঁচালঙ্কা আর মুক্তোর মতো সবুজ মটরশুঁটির সাথে। বারান্দায় বসে রোদে পিঠ দিয়ে তখন তাকে জাস্ট উপভোগ করতে হয়। সেই আবার কখোনো ফিরে আসে দুপুরে জ্যান্ত রুই মাছের পাতলা আদা জিরে বাটা ঝোলের সাথে আলুর সাথে সঙ্গত করে। সেই সোনালী ঝোলের থেকে যেন সে মাথা উঁচু করে জানান দেয় আমি আছি এখোনো। অথবা নিরামিষের দিনেও। সে আলু ফুলকপির ডালনা যেন এনএইচ এক দিয়ে ছুটে চলা দুরন্ত ফেরারি।
আবার সন্ধে নাগাদ তার খোঁজেই বেরিয়ে পড়তে হয় একটা চাদর মুড়ি দিয়ে। পাড়ার মোড়ের দোকানে ছোট্ট শিশুর মতো সিঙ্গাড়ার ভেতর থেকে সে তখন উঁকি দিচ্ছে লুকোচুরি খেলবে বলে। ভিড় টপকে কোনোরকমে তাকে ধরে একখানা মুখে পুড়তে পারলে, প্রথমেই একটা হাল্কা আওয়াজ বের হবে,আহ! তারপর দোকানের ওই আলোয় দেখা যায় মুখ থেকে আর শিঙ্গাড়ার ভাঙা প্রান্ত থেকে এক ঝলক ধোঁয়া। মনে হবে যেন এই সব। আবার শুধু ফুলকপির পকোড়ারও জবাব নেই। একটু স্পেস পেলেই অফস্ট্যাম্পের দিকে তার স্কোয়ারকাটে খাদ্যরসিক কাত হতে বাধ্য।
তবে এই গোলমেলে সময়ে লোকজন বলছে না কি জিনিসটি বড় গ্যাসালো পদার্থ। তাই সাবধানে খাওয়াই ভালো। যৌবন চলে গিয়েছে বলে দাম কমে গেলেও তাকে বেশী আত্মসাৎ না করাই ভালো।