হারিয়ে যাওয়া শারদোৎসব – অমিতাভ গুপ্ত ( কবিতার সূত্রে আত্মকথন পর্ব ৪ )

হারিয়ে যাওয়া শারদোৎসব – অমিতাভ গুপ্ত ( কবিতার সূত্রে আত্মকথন পর্ব ৪ )

শেয়ার করুন

এই সিরিজের অন্যান্য লেখা গুলি পড়তে উপরের কবিতার সূত্রে আত্মকথন ট্যাগে ক্লিক করুন।

‘আপনপাঠ ওয়েবজিন’-এ নিজের কবিতাযাপনের যে-কথা বলার সুযোগ পেয়েছি তারই সূত্রে এবার সম্পাদকীয় পরামর্শ এল বাল্যের–কৈশোরের–যৌবনের শারদোৎসবের কিছু স্মৃতি পুনরুদ্ধারের। যে স্মৃতি সর্বদা সহচর নয় তাকে নিশ্চয় পুনর্বার উদ্ধার করতে গেলে অবচেতন থেকে চেতনে একটি স্বেচ্ছামূলক চলাচল প্রয়োজন হয়। ওই চলাচলে আবার দু-একটি কবিতাপ্রয়াসও ধরা পড়ে।

এবার তাহলে শারদ উৎসবের স্মৃতিচারণার অন্তে বা মধ্যভাগে অন্তত দুটি কবিতাপ্রয়াসের কথা বলা যেতে পারে। অর্থাৎ এই সুযোগে ‘আপনপাঠ’-এর প্রাক্তন ও বর্তমান নির্দেশ উভয়কেই শিরোধার্য করা হল। করোনার কলুষে শারদোৎসবের একটি প্রধান অংশ, দুর্গাপূজা, এবার বিঘ্নিত— বিলম্বিতও ছিল তিথিনক্ষত্রযোগে। তথাপি কিছু শারদসংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে এবং আমাদের আপন অন্তর্জালের জন্য অতিবিলম্বিত এ-রচনারও উদ্যোগ গ্রহণ করা গেল।

জানিয়ে রাখি, এটি প্রাথমিকভাবে একটি চিঠি যা আপনারই উদ্দেশে নিবেদিত। কল্যাণীয়াসু, আপনি আমার কন্যাতুল্য নয় শুধুমাত্র, আপনাকে কন্যা হিসেবে মান্য করেই আমি ধন্য। অতএব পরবর্তী প্রজন্মের কাছে, পুত্র-কন্যাদের কাছে বহুবিস্মৃতপ্রায়ই নিরতিমাস অতীতের সুখ-দুঃখের কথায় এবার ছড়িয়ে রইল পথঘাট–মাঠ–পঁয়ষট্টি বছর আগের শারদোৎসবের অনুষঙ্গ। জীবনের প্রথম সাত বছর কেটেছে বর্ধমানে। সেখানে সবচেয়ে পুরোনো যে স্মৃতিটি গাঁথা, তার সঙ্গে শিউলি ফুলের মতো জড়িয়ে আছে একটি শিশু-কিশোর পত্রিকার শারদসংখ্যা। পত্রিকাটির নাম ‘শিশুসাথী’। আপনারা হয়তো এ পত্রিকার নামও শোনেননি কিন্তু সেকালে এটি ছিল এক উল্লেখযোগ্য পত্রিকা, সম্ভবত বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করে, সপ্তম দশকে বন্ধ হয়ে যায়। ‘শিশুসাথী’ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরে অবগত হয়েছি। মুদ্রিত অক্ষরে আশাপূর্ণা দেবীর প্রথম আত্মপ্রকাশ এই পত্রিকাতেই, সম্ভবত বিশ শতকের তিরিশের দশকে তার কয়েকটি লেখা এখানে মুদ্রিত হয়। মূলত ‘শিশুসাথী’ ছিল মাসিক পত্রিকা, মাসিক ‘শিশুসাথী’-র যে সংখ্যাটি প্রথম হাতে পাই সেখানেই শুরু হয় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘চারমূর্তি’। পরে অবশ্য নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সমস্ত কিশোর রচনা পড়েছি, তাঁর প্রতি একান্ত কৃতজ্ঞ এ জন্যেই যে অতি শৈশবেই তিনি আমার মন থেকে গুরুবাদের এবং মহাপুরুষভজনার কুসংস্কার বিলুপ্ত করে দিয়েছিলেন।

‘শিশুসাথী’-র সে ছিল স্বর্ণোজ্জ্বল সময়। যে মধুর স্মৃতিটির উল্লেখ করতে চাইছি তা হল এইরকম, ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠামাত্র বাবা আমার হাতে শারদীয়া শিশুসাথী অর্থাৎ ‘বার্ষিক শিশুসাথী’ তুলে দিয়ে গেলেন। বইটি পৃথুল, ভারী, অতি মৃদুল্য নীল মলাটের শক্ত বাঁধাই। হাতে নিয়ে বর্ধমানের বাসাবাড়ির ছাদে চলে যাই। মায়ের ডাকাডাকিতে কখনও নীচে। আমি বারবার ছাদে যাই, রোদ বাড়লে বারান্দায়, বইটি আমার সঙ্গ ছাড়ে না। সেই আমার শৈশবের শারদোৎসবের সর্বশ্রেষ্ঠ স্মৃতি।

বীরভূমে যখন এলাম তখন বাবার সঙ্গে, সমবয়সি বালক-বালিকাদের সঙ্গে ফুল কুড়োতে এবং ফুল তুলতে যেতাম। শিউলি কুড়িয়েই সাজিগুলি ভরে যেত— টগর, জবা, দোপাটি তুলে রাখতে হত কাপড়ের টুকরোয় বেঁধে। উঁচু ডালে ফুটে থাকা লালকেশর দেখেছি, জলপদ্ম ভরা একটি বিশাল দীঘির কথাও মনে পড়ে। স্থলকমল আর নানা রং-এর করবী ছিল অফুরন্ত। সেই বিশাল বাগানটির কথা ভাবলে আজ বিমূঢ় লাগে। সে কি সত্যিই ছিল, না সে আমার শৈশবকল্পনা মাত্র? সাজিভরা ফুল দিয়ে আসা হত এ-বাড়ি ও-বাড়ি, পাড়ার দুর্গাপুজোয়। এ-ও কি কল্পনা? তখনও তো স্কুলে ভর্তি হইনি, কল্পনাকে অ্যাকাডেমিক নৈপুণ্যে সুশৃঙ্খল করা শিখিনি তখনও। তবু মনে পড়ে, বাড়িতে রেডিও ছিল না তাই মহালয়ার দিন পাড়ার গলির মুখে একটি বাড়ির জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আমার বড়দির হাত ধরে মহালয়া শুনতাম। আমার বড়দি আমার চেয়ে এগারো বছরের বড়ো। আরেকজন দিদি, পাঁচ বছরের বড়ো। আমি তাদের একমাত্র ভাই। আরও অনেক ভাই-বোন রেখে, আমার জন্যে অনেক আত্মীয়স্বজন রেখে তাঁরা দুজনেই অকালপ্রয়াত। দুজনেই স্বভাবত আমার প্রথম জীবনের শারদোৎসবের স্মৃতির সঙ্গে মিশে রয়েছে। বড়দির কথা বিশেষভাবে মনে পড়েছিল ‘মাতা ও মৃত্তিকা’ পুঁথিটি রচনার সময়ে, একটি দুর্গাপ্রতিমা দেখে ফেরার পথে।

“আশ্বিন, ধ্বংসবীজের মতো নীলরং আকাশের। নীচে
চালচিত্র : মুখের গর্জনতেল, মনে পড়ে, দিদিকে মানাত।
আমরা কয়েকজন আনমনে দেখে নিই সবুজ অসুর
সাবর্ণ চৌধুরীর বাড়ি—কলকাতার সবচেয়ে পুরনো প্রতিমা
সবুজরঙের অর্থ ঘৃণা : আমি আমার বন্ধুর কাছে দ্রুত
জেনে নিই, ভারতের নাট্যশাস্ত্রে এরকমই লেখা আছে নাকি।
কেউ কি পেয়েছে টের, সবুজথাবার নীচে রোগাবোকা দিদি
বিবাহের উনিশ বছর ধরে ক্ষয়েঝরে, তারপর শ্মশানে শুয়েছে

২.
যখন রোপণ কর, জাগে প্রতিমার
গায়ের নতুন রং মাঠে মাঠে, মুকুরিত বীজ
ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে অপহরণের বোধে বাণিজ্যে ও পণ্যবীথিকায়

বাংলার কনকদুর্গা, এদেশেই থেকো”

[ ‘শ্রীদুর্গা’- নির্বাচিত কবিতাপ্রয়াস, আপনপাঠ পাবলিশার্স ]

সম্ভবত এভাবেই মাতৃপ্রতিমার রূপে এদেশের নারীপ্রতিমার রূপটি আমার কাছে বারবার ধরা দিয়েছে। একথা স্বীকার্য যে ‘শ্রীদুর্গা’ কবিতার রচনাকাল বড়দির হাত ধরে মহালয়া শোনার অনেক পরে। ইতিমধ্যে নির্যাতিত নারীসত্তা সম্পর্কে কয়েকটি প্রবন্ধ এবং একটি আখ্যানের প্রাথমিক খসরাও রচিত হয়েছে। তীব্রস্বর অকুণ্ঠিত সেইসব গদ্যের সঙ্গে এই কবিতাপ্রয়াসটি হয়তো সর্বতোসুরে মেলে না। তবু শারদোৎসবের প্রসঙ্গ এলেই ‘শ্রীদুর্গা’-র কথা মনে পড়ে যায়।

শৈশবে–কৈশোরে জানতে পেরেছিলাম, দুর্গাপূজার সময়ে প্রায়ই ঈদের উৎসবও হয়। পিতৃদেবের সঙ্গে পথে বেরিয়ে লক্ষ করেছি, তিনি কাউকে বিজয়ার সম্ভাষণ কাউকে আবার ঈদের আলিঙ্গন জানাতেন। সম্ভবত তিনি তাঁর আদিভূমি বিক্রমপুর থেকে এই সৌজন্যটি নিয়ে এসেছিলেন, বানানো কোনো ঔদার্যচর্চায় নয়। তিনি, বীরেন্দ্রকুমার গুপ্ত, ছোটোদের জন্য গল্প লিখতেন, প্রধানত ওই ‘শিশুসাথী’ পত্রিকাতেই।

বার্ষিক ‘শিশুসাথী’-র প্রায় সমসময়েই হাতে আসতে শুরু করেছিল দেব সাহিত্য কুটিরের অনবদ্য পূজাবার্ষিকীগুলি। উভয় পত্রিকার লেখকগোষ্ঠীর মধ্যে আশি–পঁচাশি শতাংশ মিল ছিল, তবে দেব সাহিত্য কুটিরের বার্ষিকীতেই শুধু উপস্থিত থাকতেন প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ঘনাদা’। অন্যদিকে শশীভূষণ দাশগুপ্তের চোখে জল আনা ছোটোগল্পগুলি (‘দুঃখী’, ‘ঝিলিমিলির মৎস্যকন্যা’) বা কাব্যকাহিনি (‘শ্যামলা দীঘির ঈশান কোণে’) মুদ্রিত হত শুধু বার্ষিক ‘শিশুসাথী’ পত্রিকাতেই। উভয় পত্রিকাতেই থাকত অন্তহীন জ্ঞানবিজ্ঞানের কথা, ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে সহজ ভাবে লেখা অতিসমৃদ্ধ নিবন্ধ। আজ বুঝতে পারি আমার ছোটোবেলার শারদোৎসবে প্রায় সবটা জুড়েই ছিল এইসব শারদীয় পত্র-পত্রিকা। আরও বুঝতে পারি, পরবর্তী জীবনের লব্ধ প্রায় সব জানাই ছোটোবেলার ওই জেনে-নেওয়ার উপরে ভরসা করে।

তখন অর্থাৎ গত শতকের পঞ্চাশের দশক পেরিয়ে ষাটের দশকে প্রবেশ করে আমার মতো ছেলেদের একজোড়া হাফপ্যান্ট, দুটি শার্ট ও একজোড়া হাওয়াই চপ্পল হলেই চলত। শারদোৎসবে উপহার পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না তাই সেজন্য দুঃখও ছিল না। হুগলীতে এসে হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলে নাইনে ওঠার পরে বোধহয় একটি পাজামা এল। ফুলপ্যান্ট এসেছিল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে, অবশ্য ততদিনে পাজামা–শার্টের সংখ্যা বেড়েছে নিশ্চয়। বেশভূষার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাঠসূচির পরিবর্তনও হল। হুগলি ফ্রেন্ডস্ লাইব্রেরিতে তথাকথিত ‘অ্যাডাল্ট’ এবং প্রাতিষ্ঠানিক শারদসংখ্যা পড়তে শুরু করি। কলকাতায়, কলেজে পড়ার সূত্রে এসে, প্রত্যক্ষ মিছিল-মিটিংয়ে অধিকতর আবিষ্ট হয়ে উঠি, ওইসব পত্রিকা পড়ার অভ্যাসও বন্ধ হয়ে যায়। বেশ কয়েক বছর পরে, সত্যজিৎ রায়ের আবির্ভাবের পরে, ফেলুদা-কাহিনি পড়ার জন্য আবার শারদ পত্রিকা পড়তে শুরু করি, ‘আনন্দমেলা’ রাখি নিয়ম করে। চেষ্টা করি একালের শারদোৎসবের সঙ্গে নিজেকে মেলাবার।

কল্যাণীয়াসু, বহু ব্যবধান সত্ত্বেও একেবারে যে আপনাদের কালের শারদোৎসবের সঙ্গে আমার কালের আশ্বিনের নির্মেঘ নীল উজ্জ্বল দীপ্রদীপ্ত আকাশকে যে একেবারে মেলাতে পারি না, তা নয়। ভোগতন্ত্র ও বিত্তবাদ সর্বত্রই বিস্তার করে চলেছে তার থাবা। বাঙালির শারোদৎসবই বা বিপন্নতাকে এড়াবে কি করে। দাঙ্গাবিধ্বস্ত সদ্যবিভাজিত বাংলায় সেকালে সাম্প্রদায়িকতা হয়তো এতটা হিংস্র ছিল না, আজ যদি মৌলবাদ অধিকতর বিষাক্ত করে তার নখ, আরও ধারালো হয়ে ওঠে তার দাঁত, তাহলে মেনে নিতে হবে বিত্তবাদ তার সর্বশেষ শক্তি দিয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করে চলেছে এদেশে সাংস্কৃতিক চেতনাকে ধ্বংস করার। আপনি জানেন, আমরাও জানি, এই সাংস্কৃতিক চেতনার অন্তর্দাহে রয়েছে আমাদের নারীপ্রতিমার অজস্র যন্ত্রণা:

“কত ছোটো ছোটো দান দিয়ে এই চৈতন্যের
প্রার্থনা সম্পূর্ণ হয়ে এসেছিল। দূরে
ক্ষুদ্রতর উচ্চতায় কুঙ্কুমেসিঁদুরে
লিপ্ত সিঁথি। মনে হল সপ্তাশ্ব আরোহী
শৈশবে মুকুরে রাখা প্রতিফলনের মতো ওই
চিত্রার্পিত স্মৃতিটিকে ঘিরে আছে অতল অথৈ

অন্য কেউ। এখনও সূর্যাস্ত যদি ফুরালো না। যদি
রুদ্ধশ্বাস দিগন্তের কাছে এসে পুনর্বার ভিক্ষা চায়
শাড়ির আঁচল দিয়ে ফাঁস টেনে নিয়েছে যে নিজের গলায়
সেই মেজদিদি”

[‘সূর্যাস্ত’- নির্বাচিত কবিতাপ্রয়াস, আপনপাঠ পাবলিশার্স ]

লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে অমিতাভ গুপ্ত ট্যাগে ক্লিক করুন।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২