ভোজ কয় যাহারে (পঞ্চদশ পর্ব) : এঁচোড় – সত্যম ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

দুনিয়া তো এক আজব ভোজবাজি। কখন কোথায় কী কেন কীভাবে হচ্ছে ভেবে দেখতে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যায় প্রায়। যে জিনিস এত সুন্দর সে-ই কোনো এক সময় ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে প্রচণ্ড তাণ্ডবলীলা চালিয়ে মানবজাতিকে গ্রাস করতে উদগ্রীব হয়। যাই হোক, এসব জিনিস ভাবতে গেলে যেহেতু মাথা খারাপ হতে পারে তাই অন্য কিছুতে মনোনিবেশ করি।

কাঁচা কিছু পাকলে তা আমাদের কতক্ষণ বা কতদূর ভালো লাগে। যেমন একদম ছোটো বাচ্চার পাকা পাকা কথা শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু সেই বাচ্চাই যখন আরেকটু বড়ো হয়ে উঠে আরেকটু পাকা পাকা কথা বলতে থাকে তখন কিন্তু আমাদের তাকে আর ভালো লাগে না। তখন তাকে আমরা বলি এঁচোড়ে পাকা। এবারে এই এঁচোড়ে পাকা শব্দটি তো সাধারণ ভাবে আমরা ব্যবহার করি নেগেটিভ সেন্সে কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এঁচোড় পাকলে যে এমন সুমধুর হতে পারে তার সাথে কিন্তু এর মিল নেই।

যাই হোক, আমাদের ছোটোকালে বাজারে কিন্তু সেভাবে এঁচোড় পাওয়া যেত না। অন্তত, আমাদের মফঃস্বলে তো পাওয়া যেতোই না। মা করিতকর্মা কাউকে বলে রাখতেন এঁচোড়ের জন্য। আর সেটা লাগবেই লাগবে কোনদিন? চৈত্র সংক্রান্তির দিন। আসলে একটা উৎসবের দিন। আর সে সময় তো পনীর আসেনি বাজারে। শীতকালে তবু ফুলকপি বা আর অন্য কিছু দিয়ে চলে যেত কিন্তু গরমে ওই দিন ভালো কিছুর বন্দোবস্ত করা ছিল রীতিমতো কঠিন। অতএব এঁচোড়।

এবারে সে এঁচোড় যখন চৈত্র সংক্রান্তির দিন হবে তা হবে কিন্তু নিরামিষ। আর এখন চারিদিকে একটা ধারণা দেখি যে নিরামিষ রান্না মানেই তা পাতলা হবে বা সুস্বাদু হবে না এমন একটা ব্যাপার। কিন্তু আমাদের মায়েদের রান্না নিরামিষ পদ দেখেছি যথেষ্ট গড়গড়ে বা আরো সোজা করে বললে রিচই হত। যাই হোক, খাওয়াদাওয়ার সে সব জাদুমাখা দিন গিয়েছে। এখন লোকে ভালো খাওয়াদাওয়া বললে শুধু চিকেনই বোঝে। সবেতেই খাপে খাপ, পঞ্চার বাপ।

এবারে আর এক ব্যাপারে আসি। এঁচোড় তো শুধু বাড়িতে আনলে হবে না। রান্নার আগে তাকে নিয়ে এক মস্ত হার্ডেল পেরুতে হবে যার নাম কাটা। ব্যাপারটা পাতি এমন নয় যে ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ করে কাটা গেলো আর ধুয়ে কড়াইতে দিয়ে রান্না শুরু করা গেল। সেজন্য সময় হাতে থাকলে ছুটির দিনই হবে এইসব পদ, তাই ছিল বাড়িতে নিয়ম। আর তা একদিন হবে পেঁয়াজ দিয়ে, আরেকদিন হবে নিরামিষ।

এই যে শুরুতে বলেছিলাম দুনিয়া এক আজব ভোজবাজি, তা কী রকম এবারে বলি। এবছরই যখন এঁচোড়ের সিজন চলছে একদিন তরকারিওয়ালাকে এঁচোড় কত করে জিজ্ঞেস করাতে বলল কেটে দিলে এত আর না কাটলে এত। জোর কা ঝটকা ধিরেসে লাগে। ব্যাপারটা কী প্রথমে বোধগম্য হল না। ঠিক করলাম পাশে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বুঝি। কি কতখানি দেবো–এই কথা আমাকে বার কয়েক জিজ্ঞেস করতেই আমি না শোনার বা বাড়িতে ফোন করার একটা ভান করছি, তখনই দেখলাম জিনসটপ পরিহিত এক তন্বী এসে কাটা এঁচোড় নিতে চাইলেন এবং তার আদুরে মিষ্টি বা নিন্দুকের ভাষায় ন্যাকা গলায় জানান দিলেন যে তিনি কাটাটাই নেবেন। এবং অবিশ্বাস্য ভাবে দেখলাম দোকানদার মিনিট কয়েকের মধ্যে সে এঁচোড়কে বাড়ির মতোই বেশ ছক্কা ছক্কা পিস করে ফেলল। মনে মনে ভাবলাম এই হচ্ছে প্রগতি বা অগ্রগতি।

এই প্রসঙ্গে একটি গল্প বলে শেষ করা যাক। গত শীতে কবিতা পড়তে কলকাতা গিয়েছি। আর আমি কলকাতা গেলেই আমার লক্ষ্য থাকে নামী দোকানে বেশ করে খাওয়া। কবিতা পড়া বিকেলে আর আমি কলেজ স্ট্রীট চত্বরে সকাল থেকে সেদিন খেয়ে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হল স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলে দুপুরের খাওয়াটা খাই। খাসীর মাংসের আগে খেলাম বটে সেখানে এঁচোড় একখানা বহুদিন পর। আর তারপর কবিতা পড়তে বাংলা একাডেমি পর্যন্ত পৌঁছুতে কী যে কষ্টই না করতে হয়েছিল তা বলাই বাহুল্য।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *