বেন দং – মীনা খেরকটারী অনুবাদ : তপন মহন্ত
[মীনা খেরকটারী বর্তমান প্রজন্মের ছোটগল্প লেখিকা। উনি সর্বশিক্ষা অভিযানে কনসালটেন্ট হিসেবে কর্মরত। তাঁর লেখা বেন দং গল্পটির স্বকৃত অসমিয়া অনুবাদ সম্প্রতি “প্রকাশ” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।]
এক টাকা, দু’টাকা, তিন টাকা – পুরো তিন’শ টাকা ক্রেতা না থাকার সময়ে নির্ভুল ভাবে দু’বার গুণে রুমালে বেঁধে দখনার কোঁচড়ে গুঁজে রাখে মায়দাঙ। মিষ্টি কুমড়ো পাঁচটা, দু’জোড়া নারকেল, শাক-সবজি, কাঁচা লংকা, হলুদের গুড়ো ও অন্যান্য খুচরো সামগ্রী বিক্রির টাকা এগুলো। মায়দাঙের ঠোঁটের কিনারে প্রসন্নতার হাসি ফুটে ওঠে। আরেকটু যদি বাড়ানো যেত ব্যবসাটা? আশ ভরা মনে স্বপ্ন দেখে, ভবিষ্যতের একটি নীলাভ রঙিন স্বপ্ন। এটাই জীবন। বুকটা কেমন যেন ভারী ভারী লাগে। একটি দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখতে পারে না মায়দাঙ। বললে ভুল বলা হবে না, ছোটোখাটো সব জিনিসপত্রই পাওয়া যায় মায়দাঙের দোকানে, কচুর কচি পাতা থেকে শুকনো মাছ, জংলা শাক থেকে গাঁদাল পাতা পর্যন্ত। দোকান মানে গ্রামের প্রান্তে গ্রামেরই নামে বসা চক বাজার। বিকেল বেলা প্লাস্টিকের চাদরে বানানো ঘরে বসা চক বাজার। গুরানমাখা গ্রামের প্রান্তে হওয়ার জন্য নাম গুরানমাখা চক বাজার। গুরানমাখা গ্রামের আশেপাশে অনেকগুলো গ্রাম থাকার জন্য বৈকালিক বাজারটি সবসময় বড় হয়ে থাকে। সকাল-বিকেলে মাছ-মাংসের অভাব নেই। রাস্তার দু’পাশে তিন-চারটে স্থায়ী গালামালের দোকান, চায়ের দোকানও বসেছে সম্প্রতি। বেচা-কেনা আদানপ্রদানের সাথে সাথে অনেকের জীবন-জীবিকা সংস্থান হওয়াসহ দু’চার জনকে অলসও করেনি এমনটা নয়। দু’টোরই জ্বলন্ত উদাহরণ মায়দাঙ ও সন্থলা। মাথায় টুকরি নিয়ে যেদিন প্রথম বাজারে আসে সেদিন লজ্জায় ম্রিয়মাণ হয়েছিল। ম্যাট্রিকের দেনা মেটানো মায়দাঙের অজানা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে গিয়ে কখনো বা নিজের পোড়াকপালের ওপর ধিক্কার জন্মাতো। চার ভায়ের মাঝে আদরে বড় হয়ে ওঠা একমাত্র কন্যা মায়দাঙ। অভাব কী তা অনুভব না করা মায়দাঙের বাজারে আসায় সব মানুষেরা যেন তার দিকেই তাকিয়ে থাকে। কোনও খদ্দের এলে দূর থেকেই মুখে যা আসে এমন একটা সংখ্যা যেন তেন প্রকারে বলে দিত মায়দাঙ। অনভিজ্ঞ মায়দাঙ তাড়াতাড়ি সব বস্তু বিক্রি করে ঘরমুখো হত। এমনটা করার জন্য সে অন্য পাইকারি ব্যবসায়ীর খোটা শোনেনি এমনটা নয়। এখন সে সব বিষয়ে পাকা। মায়দাঙ নিজের ব্যবসায় খুব তাড়াতাড়ি দক।ষতা অর্জন করে ফেলে। তাকে কেউ এখন ঠকাতে পারে না বা তার কাছ থেকে কমদামে বস্তু কিনে নিতে পারে না। সে এখন শুধু গুরানমাখার সান্ধ্য বাজারেই নয়, ধারেকাছের সাপ্তাহিক বাজারে যেমন – চিরাং, মায়ব্রা, খলিল বাড়ি ইত্যাদি বাজারেও নিজের স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছে। তাকে মানুষেরা চিনতে পারে। ক্রেতারা এখন সোজা তার কাছেই আসে। কখনো বা কোনো কারণে বাজারে না যেতে পারলে ক্রেতারা তার খোঁজ করে ফিরে যেত। বলতে গেলে মায়দাঙ এখন এই অঞ্চলের সবারই পরিচিত ব্যবসায়ী। যেখানে সে কৃষকের কাছ থেকে বস্তু কেনে, সেখানেই বিক্রি করে যা পায় সেটাই তার ব্যবসা। প্রতি মরশুমে তার কাছে সবধরনের মরশুমি সব্জি তার দোকান পাওয়া যায়।
“মা গো, টাকার যোগাড় হল?”
কোমরে টাকার থলিটা গোঁজায় ব্যস্ত মায়দাঙ মাথা তুলে দেখে তার বড় ছেলে জায়খ্লং।
“হ্যাঁ, বাবা। তোর কপালটা ভালো। আজ সব জিনিসই বিক্রি করতে পারলাম। ভালো দামও পেলাম। মিষ্টি কুমড়োগুলো কুড়ি টাকা কুড়ি টাকা করে কিনে তিরিশ টাকা করে বিক্রি করলাম।”
“চলো তাহলে। সন্ধ্যাও হয়ে গেছে। ভাই-বোনেরা ভয় পাবে।” শান্তভাবে বলে জয়খ্লং।
“হু, এই টাকা ক’টা নিয়ে মাছ কিনে আনগে যা। তোর বাবা মাছ ছাড়া ভাতই খাবে না। তুই বাজার সেরে আসা অবধি আমি লাফা শাক চার মুঠা বিক্রি করি। যদি কেউ আসে। তোর বাবার বিকেলের টাকা কটা যদিবা পেয়ে যাই!” জিনিস পত্র বাঁধতে বাঁধতে বলে মায়দাঙ।
“ঠিক আছে। মায়ের মুখের দিকে নীরবে তাকায় সে। টাকা কটা হাত পেতে নিয়ে গম্ভীর মুখে মাছ বাজারের দিকে লম্বা লম্বা পা ফেলে জায়খ্লং।
-মা আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করে। বাবা যদি মা-র কষ্টটা বুঝতে পারতো। ছেলের দিকে নিক্ষেপ করা গভীর দৃষ্টি মায়দাঙকে অতীতে টেনে নিয়ে যায়।
জায়খ্লং – আশার সাত রঙে রচিত রামধনু, আলো বিতরণ করা অলংবার আর সবাইর স্নেহের দদেরে। মায়দাঙের জন্য তিন টুকরো সোনা। বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। চোখের জল মুছে মুছে হাসতে শিখে জীবন জয় করার আশা তাদের। দুঃখ দুর্দশা সহ্য করে কিছু একটা করার ভরসা তাদের মায়দাঙের। তাদের প্রতি থাকা দায়িত্ব আর স্নেহে সাপের মতন খোলস পালটে আজকের মায়দাঙের নবজন্ম। আজকের মায়দাঙ ভীত নয়। লতার মতো অন্যের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠে না সে। আজ সে নিজে একটি ডালপালায় ভরা বটবৃক্ষ যাকে ঘিরে অন্য পরাশ্রয়ীরা বেঁচে থাকে। সে একজন দায়িত্বশীল মা ও বাবা দুটোই।
ছেলে-মেয়ে তিনটেকে শিক্ষাদীক্ষা, আচার-আচরণ সবদিক থেকে সুশিক্ষিত করার জন্যই সে দিনরাত কষ্ট সহ্য করে আসছে। সন্তানরা যাতে বাবার বিদ্যেটা না পায় সেজন্য মায়দাঙ সর্বদা ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে। সন্তানের শরীরে বাবার রক্ত প্রবাহিত না হওয়ার ভাবনার জন্য তার কোনো পাপ হয়নি তো – নিরিবিলিতে এমন চিন্তা আসা-যাওয়া করে তার মনে। মনের কোণে একটু ব্যথা অনুভূত হয়। সন্তানের শরীরে এমন রক্তের সঞ্চালন কাম্য নয়, যা সন্তানের সারাটা জীবন বিষময় করে তুলতে পারে, এমনকী সেটা নিজের পিতার কাছ থেকে লাভ করা হোক না কেন। পুনরায় সে ভাবে। একজন মা হিসেবে অন্য দশজন মায়ের মতো সে নিজেও সন্তানের মঙ্গল কামনা করে। তাই পিতা ও মাতা দুজনের স্নেহেই সন্তানদের জড়িয়ে রাখতে চায়।
“দিদি, লাফা শাক দুই আঁটি দিন তো। গভীর কোনো চিন্তায় মগ্ন আছেন দেখছি।”
“ওহ্। মায়দাঙের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে। ক্রেতা তার প্রাপ্যটুকু নিয়ে চলে যায়। মায়দাঙ ছেলের আসার দিকে একবার ঘাড় উঁচু করে দেখে। না, আসছে না। অবিক্রীত শাকটুকু থলেতে ভরে রাখে। থাকুক, ক্রেতাও নেই। ঘরে মাছ দিয়ে রেঁধে খাওয়া যাবে। ছেলের জন্য প্রতীক্ষা করে করে আবার নিজের ফেলে আসা দিনগুলোয় আরেকবার ফিরে যায় মায়দাঙ। মানসপটে দ্রুতগতিতে ভেসে ওঠে কত টুকরো স্মৃতি।
ম্যাট্রিক পাশ করার পর মায়দাঙকে কলেজে পড়তে না দিয়ে গুরানমাখার চন্থলার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। বাড়ির একমাত্র পুত্র, মা-বাবার অগাধ সম্পত্তির মালিক ম্যাট্রিক ফেল চন্থলা ব্যবসায়ী। বাবার অগাধ সম্পত্তি খেয়ে শেষ না করতে পারা চন্থলার নিজেরও একটি ব্যবসা আছে। ভালো ছেলে। এসব শুনে শুনে মায়দাঙের কোনো ওজর আপত্তি টিকলো না ঘরের মানুষের কাছে। ‘হাতে ভালো ছেলে পেলেই মেয়েকে ভালয় ভালয় বিদেয় করতে হয়।’ এভাবেই মায়দাঙের ভাগ্যের চাকা ঘুরলো।
সময় পেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আসল সত্য প্রকাশিত হয়। অষ্টম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণির মুখ দেখতে না পাওয়া চন্থলা কোনও ব্যবসা করে না। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বাসি মুখটাও চক বাজারেই ধোয়। সকালের এক কাপ চা-ও খায় বাজৈর দোকানে। সারাটা দিন চকে বসে থাকে তাসের আড্ডয়। নইলে যার যখন প্রয়োজন, তাকে মদ-মাংসের যোগান দেওয়াই চন্থলার ব্যবসা। এগুলোর বিনিময়ে তার নিজের খাওয়াটাও জুটে যায়। শুধু চন্থলাই নয়, আরও এক ধরনের জীব আছে। কে কোথায় যায়, কী খায়, কী পরিধান করে সবই তাদের জিভের ডগায়। বর্তমানের রক-মুখি সংস্কৃতি যেভাবে একধরনের মানুষকে কাজ তথা বেঁচে থাকার পথ দেখিয়েছে, তেমনি আরো কিছু সংখ্যককে কর্মহীনও করেছে।
চন্থলা যখন ঘরে ঢোকে, তখন পা ফেলার মতো অবস্থায় থাকে না। দরজার মুখ থেকেই তাকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে যাওয়ার উত্তরাধিকারটুকু বিয়ের পরেই মায়দাঙের হাতে এসেছে! এর বিপরীতটা কখনও ঘটলে মায়দাঙের নরম পিঠে চন্থলার হাত কথা বলে আর সাথে থাকে অশ্রাব্য গালি-গালাজ। মায়দাঙ সবই সহ্য করে, সবই করে। এসব দেখে দেখে কখনোবা চন্থলা বলে, পতিই পরম দেবতা, পতির সেবাতেই নারীর স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটে, বুঝেছ মায়দাঙ!
‘দেবতার আসন পেতে হলে দেবগুণও থাকা প্রয়োজন। অসুরত্ব নিয়ে দেবতার সম্মান পাওয়া যায় না। শ্রদ্ধা জোরজুলুম করে পাওয়া যায় না।’ বলার ইচ্ছে থাকলেও সে ভয়ে বলতে পারে না। চন্থলাকে শুধু মায়দাঙই নয়, সভ্য সমাজের সব মানুষই তাকে ভয় পায় তার লাগামহীন মুখের জন্য। হাত-পা, নাক-কান থেকেও চন্থলা একজন অক্ষম ব্যক্তি। লোকের কাছ থেকে টাকা ধার করে মদ-মাংস খায়। টাকা ধার দেওয়া মানুষেরা এসে মা-বাবাকে ধরে। ছেলের ঋণ ভয়েই হোক বা পুত্রস্নেহেই হোক শোধ করতে হয়। ফলে জমানো সম্পত্তি প্রতিদিন ক্রমে ক্রমে শেষ হয়ে আসে।
মায়দাঙের বিয়ে হয়ে ঘরে আসার দু’বছরের মধ্যে আগে-পিছে করে তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি সংসার থেকে পরলোকে বিদেয় নেওয়ার সাথে সাথেই চন্থলাকে মা-বাপের সম্পত্তি শেষ করতে মাত্র তিন বছরই লেগেছিল। ঘরের ছেলে-মেয়েদের খাওয়া-দাওয়ার খোঁজ-খবর কোনোদিন না করা চন্থলা ঘরের কেউ খাক বা না খাক, তার নিজের ভাগটা কিন্তু ঠিকই থাকতে হবে। মদ খাওয়ার জন্য সে বাগানের পান-সুপারি, আম-কাঠালের গাছ-গাছালি সবকিছু একেএকে বিক্রি করা শুরু করে। মায়দাঙ চোখের সামনে অন্ধকার দেখে। সন্তানদের মুখে একমুঠো ভাত তুলে দেওয়ার উপায় খুঁজে সে হাহাকার করে। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অবশেষে মায়দাঙ উপায় একটা খুঁজে পায়। একদিন ছোট কন্যা দদেরেকে পিঠে বেঁধে বাগানের পাকা কলা, মিষ্টিকুমড়োর টুকরিটা মাথায় তুলে নেয় বেঁচে থাকার আর বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে। সেই দিনটি থেকে আজ অবধি মায়দাঙের মাথার টুকরিটা আসা যাওয়া করছে তো করছেই। হেলে পড়া ঘরটা ধরে রাখার চেষ্টা মায়দাঙ অহরহ করে যাচ্ছে। সংসারের লাগামটা হাতে তুলে নিয়ে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে হলে একজন মা যতটুকু করতে পারে ততটুকু করে যাচ্ছে। জায়খ্লং এখন হয়ার সেকেন্ডারির চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্র। তার ফর্ম ফিল আপের জন্য তিনশো টাকা লাগবে কালকে। অলংবারও এইবার ম্যাট্রিক দেবে। দু’টোই পড়াশুনায় ভালো। মেয়ে দদেরে নবম শ্রেণিতে উঠেছে। ওদের বাবা এসব নিয়ে কোনো খবরই রাখে না। বরং সন্তানদেরই রাখতে হয় তাঁর খবর।
ছেলে জায়খ্লংয়ের সাইকেলে জিনিসপত্র তুলে দেওয়ার সময়ই চন্থলা নিজের ভাগের টাকাটুকু নিয়ে যায়। চন্থলাকে সবসময় এক বোতল মদের দাম দিতে হয়। এর অন্যথায় এক টাকা কম হলেই মায়দাঙকে এর উত্তর পেতে হয়! সাইকেলের পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকা মায়াদাঙ ভাবে, নারীদেরই বেন দং অর্থাৎ লতা আখ্যা দেওয়া হয়। অপরের ওপরে নির্ভর করে বেঁচে থাকার জন্য বলা হলে, চন্থলাদের মতো পুরুষেরা যারা স্ত্রীর ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা পুরুষেরা কী নাম পেয়ে থাকে মায়দাঙ তা জানে না। চন্থলার মতো পুরুষেরা মানব জাতির, সমাজের অথবা সংসারের এক একটি লতা নয়কি? চন্থলাও এই নাম না থাকা লতারই একটি নয়কি?
বেন দং – লতা
দখনা – বোড়ো মহিলাদের পোশাক।