চাবি – মহেশ্বর মাজি
শিল্পীকে ডেকে একদিন তার শাশুড়ী বললেন।
—-তুমি এ বাড়ির বড় বউ।এই চাবির গোছাটা আজ থেকে তুমিই সামলাও।
শিল্পী প্রথমটাই একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল।চোখ,মুখ দেখে সেটা তার শাশুড়ী খুব ভালো করেই টের পেলেন।তাই তিনি ধীর পায়ে শিল্পীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।তারপর নরম হাতটা শিল্পীর মাথার উপর একটুখানি বুলিয়ে বলে উঠলেন।
—-এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই মা।আমি তো আছি।আমার সাথে এসো চাবিগুলো একটু চিনে নেবে।অসুবিধে হলে আমায় ডেকো।
আজ একমাস হল শিল্পী এ বাড়িতে এসেছে।প্রকাশ একজন ইঞ্জিনিয়ার।দেখেশুনেই বিয়েটা হয়েছে।তাছাড়া এদের একটা পারিবারিক ব্যবসাও আছে।এখন সেটা ধুকছে বলা চলে।শিল্পীর শ্বশুরমশাই সেটা দেখাশুনো করেন।প্রেসের ব্যবসা।এখন সে রকম হয় না।বাড়িটা অনেক পুরাতন।শুধুমাত্র রিপেয়ারিং- এর জোরে টিকে আছে।এটা পুরনো কোলকাতার একটা জমাটি জায়গা।আহিরিটোলা।টেরিস থেকে গঙ্গা নদীকে দেখা যায়।
সন্ধ্যের কিছুটা সময় শিল্পী একা হয়ে পড়ে।প্রকাশ রাত করে বাড়ি ফেরে।শ্বশুরমশাই-এর আসতে সেই রাত আটটা।একমাত্র ননদ চাঁদনী।চেন্নাই-এ ডক্টরেট করছে।ও একটা ছেলের সাথে লিভ ইন রিলেশনসিপে আছে।বাড়ির তাতে কারু আপত্তি নেই।শুধু মা বাদে।ও দিন কয়েকের ছুটিতে বাড়ি এসেছে।শিল্পীর সঙ্গে তার খুব বেশি কথা হয়নি।ও নিজের জগৎ নিয়ে মেতে আছে।আগামী কাল ভোরে ফ্ল্যাইট আছে।গতকাল কয়েক মিনিট তার সাথে এ সময়টাই তবু ছিল।আর দেওরটি তো সিনেমা পাড়াতেই রাত-দিন পড়ে রয়েছে।যেটুকু সময় বাড়িতে থাকে নদীর জলের মত কল কল করে বয়ে যায়।তার শাশুড়ী মা এই ছেলেটিকে এখনও কোলের ভাবে।কোন আঁচ লাগতে দেবেন না। শিল্পী টেরিসে উঠে এসেছে।এখান থেকে কোলকাতার অনেকটা জায়গা দেখা যায়।হাতে স্মার্ট ফোনটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে করতে হঠাৎ সুমনের কথা মনে পড়ে গেল।এখন কী করছে কী জানি?তাকে কী ফোন করা ঠিক হবে?..যদি কিছু ভাবে? সাত,পাঁচ ভাবতে ভাবতে নাম্বারটা একবার ডায়াল করেই ফেলল।
— হ্যালো
—আমি বলছি।
কিছুক্ষন নিস্তঃব্ধতা।তার পর সুমন বলে উঠল।
—আসলে কী জানো তো ..এই কন্ঠস্বরটা কোনদিন শুনতে পাব বলে আশা করিনি।তাই কী উত্তর দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না।.. ভাল আছো তো?
— তোমার কী মনে হয়?
—- মনে আমার যায় হোক না কেন..আমি কিন্তু সবসময় তোমাকে সুখেই দেখতে চাই ।
— জানি।
—-কী নামটা যেন?
— প্রকাশ।
— ও হ্যাঁ ।সেই একবারই তো তোমার মুখ থেকে শুনেছিলাম।…তা তুমি ওভাবে হঠাৎ করে সবকিছু ছেড়ে দিলে কেন?
—বাড়ির সকলে চাপ দিচ্ছিল।..আর যতই হোক ওটা তো আমার একটা শখ ছিল।ক্যারিয়র তো ছিল না। তাই মেনে নিতেই হল।..তা এখন কাজকর্ম ঠিক ঠাক চলছে তো?
—তুমি চলে যাওয়ার পর আমিও যাওয়া- আসা কমিয়ে দিয়েছি।..জানি না এখন কী খবর?
শাশুড়ীর ডাক শুনে শিল্পী কলটা কেটে দিল।কখন আধ ঘন্টা পার হয়ে গেছে তার খেয়াল নেই। রান্না ঘরে ভাতটা চাপিয়ে এসেছিল।রুটির শেষে এঘরের সবার এক বাটি করে ভাত খাওয়ার চল আছে।রান্নার মাসি রাতের রান্নার জিনিসগুলো সামনে গুছিয়ে আর চলে যায়।রান্নাটা এই কদিন শিল্পীই করছে।এখন শাশুড়ীমা সেই সময়টুকু সিরিয়েল দেখেন।
নেমে এসে দেখল তার শাশুড়ীমা ভাতের ফ্যান ঝাড়ছে।শিল্পী খুব লজ্জা পেয়ে গেল।
—- আবার নেমে এলে কেন?…আমাকে বলে গেলেই হত।…যাও একটু বোস।বাকিটুকু আমি সেরে নিচ্ছি।
শিল্পী প্রভাদেবীর উপর কথা বলে না। উনার কথা মতই চলে।তবু ছেড়ে কী আর যাওয়া যায়?
—মা আমি শব্জিটা কুটব?
–ইচ্ছে যখন হচ্ছে করো।..তবে সাবধান।মনটা তোমার এখন একটু চঞ্চল রয়েছে…ওসব ধারাল জিনিস নিয়ে সাবধানে বসো।শিল্পী আবার সেই অবাক করা চাউনি নিয়ে প্রভাদেবীকে আর একবার দেখল।মনের কথাগুলো কী সুন্দর করে পড়ে নেন।সত্যি সত্যিই তার মনটা এখন চঞ্চল।বিশেষ করে সুমনের সঙ্গে কথা বলার পর থেকে।কলেজে ভর্তি হওয়ার পরই সুমনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।থিয়েটার পাগল ছেলে।একটা গ্রুপও তৈরি করেছিল।সবাই কলেজের ছেলে, মেয়ে।শিল্পীকে ওই তার গ্রুপে টেনেছিল।কিছুদিন যাওয়ার পর শিল্পী বুঝতে পারে এটা কখন তার নেশা হয়ে গেছে।অনেক দুরেও কবার গিয়েছিল থিয়েটার করতে।সেই ফাঁকে সুমনকেও কখন মন দিয়ে বসে।আসলে ওর ছোয়াটা বড় বেয়াড়া।আর সবকটা নাটকে ওই হত তার নায়ক।
তারপর বাড়ি থেকে একদিন চাপ এল।সোজা একমাসের জন্য পাঠিয়ে দিল মুম্বইএ মাসির বাড়ি।এরপরের কথা চিন্তা করেই শিল্পী আর কখনও সুমনের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।শুধু শুধু মনটাকে কাঁদিয়ে কী লাভ?বিয়ের কথা তার আগে থেকেই চলছিল।সে কথা সুমনকে বলেওছিল।ও তার উত্তরে শুধু চুপ করে থাকত।শিল্পী ওর নীরবতার কারণ বুঝেই বিয়ের আগে আর কখনই ফোন করেনি।
রাতে শুতে গিয়ে দেখে প্রকাশ ল্যাপটপ নিয়ে পড়ে রয়েছে।চোখে চশ্মাটা ও সবসময় পরে না। আর যখন পরে ওকে অন্য জগতের মানুষ বলে মনে হয়।শিল্পী এই অবস্থায় ওর ধারে,কাছেও যেতে চাই না। মুখে জোর করে বলাও যায় না সে কথা।তাই উপায়হীন হয়ে বিছানার এক কোনে নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়।প্রকাশ কাজকে খুব ভালবাসে।সে বাসুক গে তা বলে…এত রাত অব্দি!..এ সময়টা তো শিল্পীর প্রাপ্য।কাজ শেষে নিয়ম করে একটু খুনসুটি তারপর সেই একঘেয়েমী যান্ত্রিক হিসেব কষা।এর মধ্যে শিল্পী কোথাও কোন প্রাণ খুঁজে পায় না।…তবে কী এটা সুমনের স্পর্শশুন্যতার জন্য এরকম তার মনে হচ্ছে?..প্রকাশ এক ঘন্টা পর চশ্মাটা যখন খুলে খাপে রাখল শিল্পী তার পরই মুখ ঘুরে চাইল।মানুষটা মোটেও খারাপ নয়।তবে বড় গম্ভীর স্বভাবের।এ সব মানুষের ভেতরে সহযে প্রবেশ করা যায় না।.. আর তখনি কোথা থেকে সুমনের মুখটাই মনে পড়ে যায়।এক দেখাতেই শিল্পী ওর মনের সমস্ত প্রাচীর টপকে ভেতরটা চষে ফেলতে পারত।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে শিল্পীর ঘুমটা ভেঙে গেল।সকাল পাচটা বাজে।প্রভাদেবীর আওয়াজ শুনে তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে ফেলল।
—-নিচের আলমারির চাবিটা একটু খুলে দিয়ে এসো তো মা।..ওখানে নাকি চাঁদনী ওর পাসপোর্টটা আগের বার রেখে গেছিল।
শিল্পীর মাথাটা আচমকা যেন এক পাক ঘুরে গেল।প্রভাদেবী কথাটা শেষ করে চলে গেলেন।আর শিল্পী পাগলের মত ঘরের সবকটা জিনিস লন্ডভন্ড করে চাবির গোছাটা খুঁজতে লাগল।কোথাও পেল না। বুকটা ভয় আর লজ্জায় কাঁপছে।খোঁজাখুজির শব্দে প্রকাশের ঘুম ভেঙে গেল।
—- কী হল শিল্পী ওভাবে কী খুঁজছো?
শিল্পী সত্য কথাটা বলতে গিয়ে একটু সাবধান হয়ে পড়ল।
— খুঁজিনি তো।..এই একটু ঝাড়াঝাড়ি করছিলাম।কত ধুলো জমে আছে?
—আর সময় পেলে না?..এত সকালে উঠে এ সব করতে তোমায় কে বলেছে?..ভ্যাকুম ক্লিনারটা চালিয়ে দেবে।কাজের মাসি সব জানে।তুমি শুধু বলে দেবে ।
শিল্পী এবার রান্না ঘরের দিকে ছুটে গেল।ওখানে যদি রেখে এসেছে? আর তখনি প্রভাদেবী বলে উঠলেন।
— সাত সকালে তুমি চা করতে চললে নাকি?…ও হ্যাঁ চাঁদনী পাসপোর্টটা ওর লাগেজের মধ্যেই পেয়েছে।..তুমি বরং একটু আরাম করো গিয়ে ।
শিল্পীর আপাতত বুকের বাদ্যযন্ত্রটা একটু থামল।বিপদ তবু কাটেনি।শিল্পী এই মা সমান মহিলাটিকে শ্রদ্ধা,ভয় এবং ভক্তি সব করে।তাই চোখের জল আর বেধে রাখতে পারল না।
—আহা বলবে তো কী হয়েছে।..এভাবে বাচ্চার মত কেউ কাঁদে?
—আমি আমার দায়িত্ব্য পালন করতে পারিনি মা ।..আপনার দেওয়া চাবির গোছাটা কোথায় রেখেছি।মনে পড়ছে না।
প্রভাদেবী শিল্পীকে আদর করে বুকের মধ্যে ভরে নিলেন।স্বভাবসিদ্ধ হাতটা শিল্পীর মাথায় বুলিয়ে দিলেন।স্পর্শটা তার অন্তরের ভিতর অব্দি ছুয়ে গেল।
—এইটুকু জিনিসে এত ভেঙে পড়তে নেই মা।..তোমার ভয়ের কোন কারণ নেই।আমার কাছে দ্বিতীয় চাবিগোছা আছে।
কথাটা শোনামাত্রই শিল্পী অবাকভাবে শাশুড়ির দিকে চাইল।প্রভাদেবী চিবুকটা ছুয়ে বলে উঠল।
—–এবার একটু হাসো দেখি।
শিল্পী আনন্দে কেদে ফেলল।
—যাও এবার গিয়ে স্নানটা সেরে আমার সাথে ঠাকুর ঘরে এসো।
পুজো পাঠ শেষ হয়ে যাওয়ার পর প্রসাদের প্লেটটা শিল্পীর হাতে ধরিয়ে বললেন
—সবাইকে দিয়ে এস গিয়ে।
কিছুটা প্রসাদ বাড়ির টেরিসে একটা পাতায় করে রেখে আসার রেওয়াজ আছে।আর তখনি শিল্পী আবিস্কার করে ফেলল কালকের ভুলে যাওয়া চাবিগোছাটা।জল টাঙ্কির উচু দাওয়াটার একপাশে চাবিগোছাটা রেখে সন্ধ্যের সময় সুমনকে ফোন করছিল।তারপর নিচে নামার সময় সঙ্গে নিয়ে যেতে ভুলে যায়।মনটা আনন্দে নেচে উঠল।নেমে এসেই খবরটা প্রভাদেবীকে জানাল।
— আমি জানতাম পাবে..শুধু.. শুধু মন খারাপ করছিলে তো?
—আপনাকে বলে ঠিক বোঝাতে পারব না।আমি কতটা ভয় পেয়ে গেছিলাম।..আপনি যখন দ্বিতীয় চাবির কথা বললেন তখন কিছুটা শান্তি পেয়েছিলাম।
—-আমার কাছে দ্বিতীয় কোন চাবি নেই মা।একমাত্র এই ঠাকুর ঘরটা ছাড়া।
—আপনি তাহলে..
— ঠিক তাই।তোমার মনটাকে শান্ত করার জন্য ওইটুকু মিথ্যে আমি বলেছিলাম।দেখো মা পরিস্থিতি যায় আসুক না কেন মনটাকে বিচলিত হতে দাও না। তাতে কোন কাজটাই আর ভালভাবে হয় না।…সবই মায়ের ইচ্ছা।মায়ের উপর ভরসাটা হারাও না কখনও।
শিল্পী এই সময় একটা ভক্তিভরে প্রণাম করে নিল প্রভাদেবীকে।উনি এবার মুখোমুখি একটা কথা শুরু করলেন।
—-এ তো হল গিয়ে বিষয়-আসয়ের চাবি।..এছাড়া আর একটা অদৃশ্য চাবি আছে।সেটা হল মনের।কখনো কখনো একদম আপন কাউকেও মনে হয় অচেনা।কারণ আমরা তার মনের দরজাটার তালাটা খুলে সেখানে প্রবেশ করতে পারিনি।… সংসারে বউ হয়ে এসেছ..এখন থেকে সেই চাবিটা তোমাকেই যে খুঁজতে হবে মা।
প্রভাদেবীর আর দাড়াবার সময় নেই। ওদিকে স্বামী আর পুত্রের ডাক পাড়া শুরু হয়ে গেছে।
আজ একটু তাড়াতাড়ি প্রকাশ কাজ থেকে ফিরেছে।এসেই চান করে একটু ফ্রেস হয়ে দু কাপ কফি খেয়ে নিল।তারপর আবার সেই সাধের ল্যাপটপটা নিয়ে বসে পড়ল।শিল্পী পায়ে পায়ে এগিয়ে এল।তারপর প্রকাশের পাশে শান্তভাবে বসে পড়ল।প্রকাশ স্ক্রীনে চোখ রেখে বলে উঠল।
—-মা বলেছে তোমাকে নিয়ে দিন কয়েক কোথাও ঘুরে আসতে।..এ্যপ্লিকেসেনটা পাস হয়ে গেছে।পরশু আমরা গোয়া যাচ্ছি।ফিরব নেক্সট উইক।..তুমি খুশি তো?
—একদম না।
— হয়াট?
এইবার প্রকাশ শিল্পীর দিকে ভাল করে চাইল।ও এতক্ষন ধরে তাহলে তার কাজ দেখছিল?শিল্পী শান্তভাবেই বলে উঠল।
—- এসব গ্রাফিক্স আমিও আঁকতে পারি।..তারজন্য তোমাকে এভাবে রাতের ঘুম ত্যাগ করতে হবে না।
—ও রিয়েলি?
— ইয়েশ বস।..আমি একজন বি.এস.সির ছাত্রী সেটা ভুলে যাওনি নিশ্চই?
— সত্যি তুমি পারবে শিল্পী?
— কেন.. তোমাদের অফিসে কী কেউ মেয়েরা এ সব কাজ করে না?
তারপর অনেকক্ষন ওরা কাজ নিয়ে আলোচনা করল।প্রভাদেবী ঠাকুর ঘরটা বন্ধ করে চাবির গোছাটা ভাবল শিল্পীকে দিয়ে আসে।দরজার কাছে গিয়েই শুনতে পেলেন ছেলে আর বউ- এর হাসাহাসির শব্দ।প্রভাদেবী মনে মনে ভাবলেন শিল্পী এ বাড়ির সবথেকে কঠিন তালাটাই সবার আগে খুলে দেখাল।এই চাবিগোছাটা কাল সকালে দিলেও চলবে।