|

বেল গাছ – ইস্টারিন কিরে অনুবাদ : তপন মহন্ত

শেয়ার করুন

[ইস্টারিন কিরে (নাগাল্যান্ড ১৯৫৯) উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক কণ্ঠ হিসেবে পরিচিত, তিনি কবিতা, উপন্যাস এবং ছোটোগল্পের সংকলন সহ ইংরেজিতে বিভিন্ন বই লিখেছেন। পুনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বর্তমানে উত্তর নরওয়েতে বসবাস করেন। তার লেখার অধিকাংশই উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগাল্যান্ডের মানুষের জীবন বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে। লেখার পাশাপাশি, তিনি তার ব্যান্ড জ্যাজপোয়েসির সাথে জ্যাজ কবিতাও পরিবেশন করেন।]

২০১০ সালে গ্রীষ্মকালের এক উষ্ণ দিনে, আমি ৩০০ জন শ্রোতার সমাবেশে ‘নীল সিংহ ও জিপসি রাজা এবং স্বাধীনতার রামধনু’ সম্পর্কে একটি কবিতা পাঠ করেছিলাম। পাঠ শেষে একজন যুবক আমার দিকে এগিয়ে এল। তাঁর মাথায় ছিল অবিন্যস্ত বাদামি চুল আর গায়ে একটি স্টাইলিশ কালো জ্যাকেট। আর তাঁর চোখে ছিল জল। “ওই কবিতাটি… আমারই কবিতা!” সে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। তার দু-গাল বেয়ে অবিরত ধারায় নেমে এসেছিল নীরব অশ্রু। “প্রতিটি শব্দ আমি বসে বসে শুনলাম। আপনি কীভাবে জানলেন যে আমাদের সংস্কৃতিতে নীল সিংহ আছে? আপনি জিপসি রাজা রামধনু এবং স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। আমি একজন জিপসি এবং আমি আমার স্বাধীনতার রামধনু রং খুঁজছি!”

তাঁর নাম আমার মনে নেই। আমি হয়তো আর কখনও তাঁর মুখটাও স্মরণে আনতে পারব না। কিন্তু আমি সবসময় তার অশ্রুর কথা মনে রাখব। কৃতজ্ঞতার অশ্রু। এটাকে আনন্দাশ্রু বলা একটু বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। অপরিচিত মানুষে ভরা ঘরে আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসেছিলাম। তারপর আমরা কিছু না বলেই বিদায় নিয়েছিলাম। কিন্তু সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য পরস্পরের মিলিত হওয়ার মধুর অনুভূতির রেশটুকু লেগে রইল আমার মনে।

কয়েক বছর আগে আমি দুই জন লোককবির কবিগানের সময় একই ধরনের সংযোগ দেখেছি। তাঁরা যখন আমাকে একটি লোককবিতার ব্যাখ্যা শোনাচ্ছিলেন তখন একটি শ্লোকে থেমে এটিকে পুরোপুরি অন্যভাবে নিয়ে, তাঁরা উভয়েই কবিতার অর্থ নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেছিল। তাঁরা কবিতাটির মূল অর্থ নিয়ে সহমত ছিল। কিন্তু লোককবিতার প্রাচীন ভাষাটির এতগুলি স্তর ছিল যে তাঁরা স্তরগুলির খোসা ছাড়াতে ডুবে গিয়েছিল, এটা নিশ্চিত করতে যাতে আমি এর সবটুকু বুঝতে পারি। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায়, তাঁরা কীভাবে সেই শব্দগুলির অপরিহার্য অন্তর্নিহিত অর্থ উন্মোচন করবে এবং তাদের ব্যুৎপত্তিগত শিকড় খুঁজে বের করবে! আহ্, শব্দের কী চৌম্বক জাদু!

কখনও কখনও তাঁদের একই কবিতা বিভিন্ন রূপে দেখা যায় যা আমাকে দ্বিধার মধ্যে ফেলে দেয় যে কোন্ লেখাটি সরকারিভাবে ব্যবহার করা উচিত হবে। শেষ পর্যন্ত, আমি একই কবিতার প্রথম এবং দ্বিতীয় সংস্করণ দুটি পেয়ে সেই দ্বিধার সমাধান করেছি। যদিও তাঁরা আমাকে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কিন্তু কবিতার উপসংহার সবসময় একটি ধারণায় রূপান্তরিত হয়।

সেটাই শব্দের সৌন্দর্য, কবিতা এবং গল্পের সৌন্দর্য। ভাবনা ও স্বপ্ন এবং প্রজ্ঞার একত্রে মিলিত হওয়া। প্রতিটি কবিতায় একটি অন্তর্নিহিত গল্প থাকে। প্রাচীনকালে প্রতিটি লোককাহিনি এক একটি কবিতা ছিল। আর তাই কাব্যগাথায় সবচেয়ে সুন্দরভাবে গল্পের প্রকাশ ঘটত। সেই সমস্ত গল্পগুলি সম্ভবত একটি মাতৃবৃক্ষ থেকে সময়ে সময়ে ঘুরে ফিরে এসেছে।

এটা ভাবুন। আমাদের পাহাড়ে একটি শীতকালীন বনের মাঝখানে একটি বেল গাছের কথা কল্পনা করুন। হলদেটে আর লালচে পাকা ফলে গাছটিকে ঢেকে রাখে আর তার শাখা প্রশাখাগুলোকে ফলের ভারে অবনত করে। একটি বেল গাছে মরশুমে প্রচুর ফল ধরে। গ্রামবাসীরা বলেন যে বেল গাছে দু-বছর পর পর ফলন আসে। সেই গাছটিকে গল্পের মাতৃবৃক্ষ হিসেবে চিত্রিত করুন। আমাদের গল্পের জন্ম দিন। সেগুলোকে ফলপ্রসূ করে তুলুন যাতে যে কেউ ইচ্ছে করলে গাছ থেকে তুলে নিতে পারেন। বনের সমস্ত বেল গাছকে মাতৃবৃক্ষ হিসাবে চিত্রিত করুন। আর সব বেলকে এক একটি গল্প ভাবুন। সব কোটি কোটি কোটি গল্প।

আমি গল্পের মিলে বিশ্বাস করি। একজন সামি গায়িকা একবার আমাকে বলেছিলেন যে তিনি আমার সমস্ত গল্প জানেন এবং প্রতিটি গল্প যা আমি বলতে পারি, তাঁর কাছেও মজুদ থাকে, যা আমার ভাবনার সাথেও মিলে যায়। এবং সত্যি তাই। আমার ভাল্লুকের গল্পের জন্য তাঁর একটি ভাল্লুকের গল্প ছিল এবং তাঁর অনেক পাথরের গল্প ছিল যা আমার মনে পড়া গল্পের চেয়েও বেশি। একই ঘটনা ঘটেছিল একজন নাপিত মহিলার সাথে যিনি আমার গল্পের সাথে গলা মিলিয়ে গেয়েছিলেন। গল্প হল সবচেয়ে সুন্দর গণসংযোগকারী মাধ্যম। আদি থেকেই গল্প ছিল এবং প্রতিটি মানুষ গল্পের মাঝে বিনিময়ের উপাদান খুঁজে পেতে পারেন। সুতোর মতো চলমান মানব জীবনকে একসাথে বেঁধে রাখে গল্প। গল্প বেল গাছের মতো যেখান থেকে প্রতিটি প্রজন্ম ফল তুলে খায়। সেই আত্মিক সংযোগ ছাড়া আমরা শুকিয়ে যাই, আমরা ধীরে ধীরে নগণ্য হয়ে যাই।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *