অন্ধ তিমির – এণাক্ষী রায়
স্পষ্ট একটি মুখ। থুতনির ডানদিকে একটা উঁচু মতো তিল। সাদা মলিন শাড়ি পরে, এলোমেলো রুক্ষ কাঁচা-পাকা চুলে মাথায় আধ-ঘোমটা দিয়ে স্বপ্নে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন করুণা মাসিমা। করুণা মাসিমা বলছিলেন নিজের কথা। বলতে বলতে ইস্কুলবেলায় খেলাধুলার কথাও বলছিলেন। উদাস স্বরে করুণামাসিমা বলছিলেন – অন্ধ তো সবাই। অন্ধকারের ভেতর আলোর আসা-যাওয়ার একটা পাতলা প্রলেপ লেগে থাকে। লালচে একটা আভা ফুটলে বুঝি, রোদ্দুরে খুব বেশি ঝাঁজ সেদিন। তোমরা বোঝ না? এই যে স্বপ্নের ভেতর আমি তাকায় আছি তোমার দিকে, সেইরকম করেই তো ইস্কুলে হাডুডু খেলতাম। মেঘের মধ্যে জড়াজড়ি করে উলটে পড়তাম এ ওর গায়ে। হাডুডুতে কেউ হারাতে পারত না আমাকে। আমার তখন সব দিক সমান। কোনো দিকে কেউ নাই। বুঝলা? কেউ এসে জড়ায় ধরল তো তাকে টানতে টানতে নিয়ে আসতাম আমার অন্ধকারের মধ্যে। – মেঘের মধ্যে খেলতা কীরকম!– তোমরা যাকে কাদা বল, আমি তাকে বলি মেঘ। কেন, বললেই বা দোষ কী? তাই তো দোষ আবার কী। অন্ধের কী বা দিন কীই বা রাত! – আর মেঘকে?– মেঘ একটা রং। আর দার্জিলিং পাহাড়ের বৃষ্টি। আমি মেঘকে সবুজ বলি।– সবুজ রং কী করে চেনো? তাছাড়া সবুজ তো গাছপালা।– গাছপালা তো সত্যি সত্যি। ছুঁয়ে দেখলেই বোঝা যায়। তার আবার রং কী! ছোটবেলায় আমাদের চানঘরের চারদিকে পুদিনা পাতা লাগায়ছিল মা। ওই গন্ধটাই তো গাছপালা। তারপর ধর গিয়ে ধনে পাতার গন্ধ। লতানে গোলাপের কাঁটা। আর বিছুটি পাতার চুলকানি। তখন বয়স বারো কি তেরো, বন্ধুরা বিছুটির জঙ্গলে গিয়ে ছেড়ে দিসিল আমাকে। কী চুলকানি! কী চুলকানি!– বন্ধুরা! তাদেরও তুমি বন্ধু বলবে? – বন্ধুই তো। না হলে গোলাপের কাঁটা আর বিছুটি গাছ চিনতাম কী করে?করুণামাসিমা মলিন শাড়িটা আর একটু গুছিয়ে নেন। নীল পাড় সাদা শাড়িটা। – গাছপালা আসলে একটা গন্ধ। তোমরা যাকে রং দিয়ে চেন।
দাওয়াইপানির চেতন বলেছিল, বছরে একবার আমাদের এখানে সংসারী পূজা হয়। সংসারী মানে জগৎ- সংসারের পূজা। সে-পূজার দেবতা মানে পাথর কিছু। সারা গ্রামের লোক সেদিন পূজায় যে যেমন পারে, ছাগল মুরগি ডিম নিয়ে আসে। দেবতাকে নিবেদন করে। তারপর সেই সব ডিম মাংস একসাথে রান্না-খাওয়া হয়। কবে হয় সেই পূজা? হাতে সরু বাঁশের কঞ্চিটা একটা গাছের দিকে তাক করে চেতন বলল, এই গাছের ফুল যখন টাইগার হিল থেকে নামতে নামতে এই গ্রাম অব্দি চলে আসে, তখন আমরা বুঝতে পারি পূজার সময় চলে এসেছে। গাছেদেরও পাড়া থাকে। এক পাড়ার গাছ ভুল করেও অন্য পাড়ায় যায় না। একেকটি পাড়ায় শুধু গাছ নয়, গজায় একেক রকম গুল্মও। চেতন অন্ধ নয়, সাল তারিখ মাস দেখতে পারে ক্যালেন্ডারের পাতায়। তবু বিশেষ কোনো ফুল ওকে সময় চেনায় । ক্যালেন্ডার দেখতে হয় না।
পাহাড়ি পথ বেয়ে হেঁটে যাই, আমি আর চেতন। দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার আভাস কল্পনা করি। সেখানে জমাট মেঘের আড়াল। আমার ডানদিক দিয়ে সূর্য উঠে মিলিয়ে যায় বলে আমি উত্তর ঠিক করে নি সামনে, সোজাসুজি। আমার দেখা পুরনো-হয়ে-যাওয়া একটা হলদেটে কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি সেখানে মনে মনে বসাই। লাল রঙের একটা পাখি ডাকে। একটানা কিছুক্ষণ ডেকে উঠে থেমে থেমে যায় তক্ষক। কোথায় যেন শুনেছিলাম তক্ষক নিজের বয়স অনুযায়ী ডাকে। সেই ডাক থেকে বয়স আন্দাজ করতে করতে পাহাড় বেয়ে উঠি। আগে আগে চেতন ওঠে দা-দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করতে করতে। অন্যান্য সরীসৃপ নিদ্রাহীন ডেকে যায়, সেই ছোটবেলায় মেলায় কেনা কটকটি ব্যাঙের মতো। পথের দুপাশে ফুলের মতো ফুটে থাকা জংলি স্ট্রবেরির পাড়া চেতন চিনিয়ে দেয়। ওই পাড়ায় ঘাসের ওপর অন্য কোনো ফুল নেই। ইতস্তত ব্যাঙের ছাতা পাহাড়ি মাটি ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে। বন্যফুলের পাড়া থেকে এ-পাড়ার দূরত্ব বেশি নয়। গুরাস, বন্য চাঁপা, শাল বৃক্ষ পার হয়ে পাইনের পাড়ায় চলে আসা যায়, মাত্র চার কিলোমিটার হেঁটেই। এখানের ঘাসেই বন্য স্ট্রবেরির পাড়া। শুনশান রাস্তায় আমি করুণা মাসিমা হতে চাই। গন্ধ অনুসরণ করে হাঁটি, মাত্র কয়েক পা। তারপরই খাদের ভয়ানক ভয় আমাকে তাড়া করে।
আমার কয়েকটা ছবি আছে। চোখ বন্ধ করলেও আমি সেই পরিচিত ছবিই দেখতে পাই। করুণা মাসিমা নিজেই ছবি তৈরি করেন প্রতি মুহূর্তে। তাঁর মতো হতে পারি না। গন্ধ দিয়ে, স্পর্শ দিয়ে, ছবি আঁকলে কেমন হয় সে ছবি? করুণামাসিমার হাতে তুলি এনে দিই। এনে দিই আমার কল্পনার রংগুলি। করুণামাসিমা সাদা কাগজে শুকনো তুলি বুলিয়ে যান একমনে। আমার গোলানো রং শুকিয়ে যায়। তাঁর তুলিতে খেলা করে আমার কল্পনার চেয়ে বেশি রং। তিনি সাদাকে সাদা রেখে উঠে পড়েন, মাঠের দিকে, যেখানে ঘেঁটুফুলে ছেয়ে থাকে এখনও। তিনি হাস্নুহানা ফুলের গন্ধের খোঁজ করেন। আমারও মনে পড়ে যায়, কোনো একদিন হাস্নুহানা বলে একটা ফুলকে চিনতাম।
চেতনের
দাদু, সুরেশ রাই গল্প বলেন, বলে যান অনবরত। বিরক্তিকর একঘেয়ে তাঁর কথকতায়
ঝাঁপ খোলে দাওয়াইপানি নামের রহস্য। জল খাওয়া নিয়ে ইতস্তত করলে শুনিয়ে দেন
আরেকটা গল্প। কেউ শুনুক না শুনুক, কথা বলে যান, টিপ টিপ করে সারাদিন ঝরে
পড়া বৃষ্টির মতো।— ইস পাহাড়কে নিচে সে পানি নিকালতা।
হর বখত পানি নিকালতা হ্যায়। ইংরেজলোগোনে দেখা কি, ওহ মিনারেল ওয়াটার
স্প্রিং। ইসিলিয়ে লোকাল লোগোনে নাম দিয়া দাওয়াই পানি। এ পানি বহত আচ্ছা।
দার্জিলিংমে নেহি মিলেগা।
চোখ
বেঁধে দেওয়া কানামাছি খেলার মতো অন্ধকারে সুরেশ রাই শহর দেখেন। কালেভদ্রে
দার্জিলিং গেলে, সেই তাঁর শহর দেখা। সেই ধারণায় কলকাতার গল্প সাজান সুরেশ
রাই। গল্প করেন সাবিত্রীকে। ফার্নের পাতার মুকুট পরে বাঁশের কঞ্চি হাতে
তিনি রাজার মতো হেঁটে যান গিরিপথে। তাঁর বাঁশের কঞ্চি, জাদুকরের ছড়ির মতো
কলকাতার গলিপথ সবুজে সবুজে ঢেকে দিতে দিতে যায়। অজস্র বলিরেখাময় তাঁর মুখের
খাঁজে খাঁজে আলো জমে পাহাড়ে খাদের মতো খাদ তৈরি করে। আদিম গল্পের থেকে
উঠে-আসা তাঁর একঘেয়ে বকবকানিতে, গুরাসের গাছকে ছাতিমগাছগুলোর মতো লাগে।
ছাতিমের তীব্র ফুলের গন্ধে করুণা মাসিমার স্পর্শ-গন্ধময় জীবন এক হয়ে যায়।
গাছের পাতায় বৃষ্টি নামলে যেমন টপ টপ করে জল নামে। এক পাতা থেকে অন্যপাতায়
এসে, দ্রুততর হয়ে গড়িয়ে যেতে থাকে নিচে। তেমনি, মিশে যায়, সুরেশ রাইএর
কল্পনার শহরে, করুণামাসিমার মেঘ।
মাছের
পেট টিপে টিপে পরীক্ষা করেন করুণামাসিমা। গন্ধ নেন। টাকাও গুনে দেন হাতের
আন্দাজে। লাঠিটা বাড়িয়ে দিয়ে ছোট্ট লাফ দিয়ে তিনি পার হয়ে যান জল-জমে-থাকা
খন্দটা। বাজারের পথে দেখা হয়ে যায়। লাঠি ঠুকে পথ হাঁটেন। তাঁর
গন্ধ-স্পর্শ-শব্দের জগতে কখন ঢুকে পড়ি আমিও। আমাকে চিনে নেন তিনি। বাড়ি
ফিরে সবজি কাটতে বসলে তাঁর ভাস্তা ভাস্তিরা মশকরা করে বলে – বেগুনে পোকা
আছে পিসি!হাসেন করুণা মাসিমা। তিনি নিশ্চিত জানেন, ভালো জিনিসটা থেকে পোকাগুলো চিনে নিয়ে বের করে দিতে পারে তাঁর অন্ধ হাত।
পেশক
রোডের মাঝামাঝি থেকে খাড়া উঠে গেছে রাস্তাটা। ভাড়া-করা গাড়ি ছাড়া এখানে
যাওয়ার কোনো উপায় নেই। এই রাস্তা ধরে তরতর করে ওঠে-নামে চেতনরা। অথবা কোনো
গাড়ি, গেস্টদের নামিয়ে ফেরার পথে তুলে নেয় কখনও।উচ্চমাধ্যমিক
পরীক্ষা দিয়ে বসে আছে চেতন। এইফাঁকে আমাদের চেনা-শোনা। কাকা বিরেন রাই-এর
গেস্ট হাউসের গেস্টদের গাইড হয়ে পথ দেখানোর কাজ করে স্বেচ্ছায় । এতদিন
ওকে রোজ ছয়-ছয় বারো কিলোমিটার পাহাড়ি পথে পাড়ি দিয়ে যেতে হতো স্কুলে। অসুখ
বিসুখ হলে ছোট্ট হেলথ সেন্টার, পাহাড়ি পথের ঘুরপাক খেয়ে অনেকটা নিচে নেমে
গেলে। হাসপাতাল! সেই দার্জিলিং। নিচে গ্রামের মুদি দোকানে প্রেসক্রিপশন
ছাড়াই মিলে যায় কয়েকটা দরকারি ওষুধ। — আর কলেজ?— কলেজভি ও হি দার্জিলিং মে । বহত দূর দূর সে উধার পড়নেকে লিয়ে আতে হ্যায় স্টুডেন্টলোগ। কলকাত্তাসে ভি আতে হ্যায়।— চান্স না পেলে! – কিঁউ? হ্যায় না ড্রাইভারি!
অনাবিল
হাসে চেতন। কুড়ি বছর বয়সের হাসি। ইংরেজি অনার্স পড়তে চায় ও। গুরুতর
অসুখ-বিসুখ হলে যেমন দার্জিলিং যাবার পথেই মারা যায় অনেকে, তেমনিভাবেই হয়তো
এই সব প্রান্তিক স্বপ্নগুলোও ভেঙ্গে যায়। তিনমাইলের দিকে জনমানবশূন্য খাঁ
খাঁ ট্রেকিং পথে, পাহাড়ের দুপাশে ছোট-বড় গর্ত দেখায় চেতন। বন্যপ্রাণীদের
আস্তানা। হাতের বাঁশের কঞ্চি দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে দেখায় একটা গর্তে কোনো এক
সরীসৃপের ডিম। একটা ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়েছে সবে। আরেকটা ডিম পড়ে আছে
পাশে, খোলস ভাঙ্গার অপেক্ষায়। হাতের কঞ্চিটা দিয়ে আবার পাতায় ঢেকে দেয়
চেতন, গর্তের মুখটি। ওদের সংরক্ষণ দরকার, চেতন জানে। পাহাড়ি পথে হাঁটাচলার
সময় লাঠি দা ছোট্ট কুড়ুল ব্যাগে ভরে নেয়।
কলকাতার
রাস্তায় ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিল। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে,এককাট্টা হয়ে গর্জে
উঠছে তারা। পৃথিবী উত্তপ্ত হচ্ছে। জল শেষ হয়ে যাচ্ছে ভূগর্ভে। আমাজন পুড়ে
যাচ্ছে নীরবে। কলকাতার বড় বড় গাছ সব নিশ্চিহ্ন। আলো দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছে
রাজপথ।
চেতন এসবের খবর
রাখে না। কলেজে ভর্তি হতে না পারলে, ও শিখবে ড্রাইভিং। পাহাড়ের সর্পিল
রাস্তা দিয়ে ছুটে যাবে এঁকেবেঁকে। খাদের পাশ কাটিয়ে মেঘের মধ্যে হারিয়ে
যাবে ওর সরল হাসিটা। শহরের কোলাহলে আমারও স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে চেতন।
করুণামাসিমা জেব্রাক্রসিং ছাড়াই রাস্তা পার হচ্ছেন, থেমে-থাকা বাস টোটো
রিক্সার মধ্য দিয়ে, লাঠি ঠুকে ঠুকে।
করুণামাসিমার মতো আমিও গন্ধের ভেতর চলে যাই। ভরা বর্ষায়, জানলার নিচে কামিনী ফুল থোকা থোকা আলো হয়ে ফোটে। কামিনীর গন্ধের ভেতর আমি বর্ষার সন্ধেবেলা খুঁজে যাই আঁতিপাঁতি করে। কী যেন একটা হারিয়ে যাচ্ছে মনে হয়। আমার বর্ষার গন্ধের ওপর, পথের পাশে, কদমের গন্ধ এসে ঝাপটা দেয়। বকুল ঝরে পড়ে। সেই গন্ধ খুঁজে পাই না তবু। বর্ষার গন্ধ মানে অন্য কিছু খুঁজি। করুণামাসিমার মতো, এবারই প্রথম, আমার ভেতরে কোনো ছবি খুঁজে পাই না। দোলনচাঁপা বলে একটা ফুলের নামটুকু পড়ে থাকে শুধু স্মৃতির ভেতরে। তার কোনো আকার নেই, রঙ নেই। কেবল গন্ধটুকু ধাক্কা মারে স্মৃতির জানলায়। এই প্রথম নিজেকে আবিষ্কার করি অন্ধ বলে।