বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘ সঙ্গ ও নিঃসঙ্গতা ‘ প্রবন্ধে বয়সজনিত উপলব্ধি প্রসঙ্গে এক চমৎকার কথা বলেছেন,
“… এরই মধ্যে চোখদুটো এমন অভদ্র হয়ে উঠলো যে চশমা ছাড়া বিশ্বসাহিত্য অদৃশ্য, এবং চশমা সহ বিশ্বপ্রকৃতি ঝাপসা “।
বাস্তবিকই এই চশমা আমার আর কিছুতেই ঠিকঠাক হয়ে উঠলো না। কিছুতেই বুঝে ওঠা গেল না আমি আসলে কী চাই। চশমা ছাড়া যাকে পূর্ণ বলে দেখি চশমা সহ সেই হয়ে ওঠে বিপুল শূণ্যতা। পূর্ণ এবং শূণ্যের নিত্য হাহাকার চিন্তারহিত কর্মপথের দিকে অগ্রসর হওয়ার বাধা স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। নিজের ভিতরকার সত্যিকার চরিত্র খুইয়ে কাচের ভিতর দিয়ে পৃথিবীটাকেই ঝাপসা দেখি। চারপাশটা যেন সদা চঞ্চল থাকার পণ করেছে, কিছুতেই দু’দন্ড স্হির থাকবার উপায় যেন নেই তার। আর এ অপরিহার্য ঘূর্ণিতে ঘুরে মরার জন্যই যেন জন্ম। কিন্তু ঘুরে মরার এ দাবিকে কিছুতেই ন্যায়সঙ্গত মনে করতে পারি না। নিজের ভিতরেই তাই নিজের একটা ঘর তৈরি করি, নিঃসঙ্গতার যেখানে কোনো জায়গা নেই
। মনের মতো সঙ্গী শুধু নিজেই। বিকল্প বলে কিছু হয় না। শীতের ভোরে খেজুরের রসের মিষ্টতা কি প্রখর গ্রীষ্মের আমপান্নায় গলা ভেজানোর আরামের বিকল্প হতে পারে? কিংবা পর্বতের রৌপ্যচূড়ায় স্বর্ণবিভা ছড়িয়ে সূর্যোদয় দেখার যে সুখ তার বিকল্প কি অসীম পারাবারের পারে বসে টুপ করে ডুবে যাওয়া সূর্যাস্ত দেখা হতে পারে? অথচ দুটিই তো মনোরম। বৈচিত্র্যের সম্ভাবনাতেই আলোছায়ার খেলা, বিকল্পের সম্ভাবনায় নয় এ কথাটা অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়ে মনে রাখার চেষ্টা করি। এর ফল হয় দ্বিবিধ। এক তো পরিস্হিতি জনিত অপঘাতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া আর দু নম্বর হলো চিত্তবিক্ষেপকারি নিছক আবেগ সর্বস্বতার বিশেষ নিরীক্ষা। কৌতুহল এবং প্রয়াসের অভাবমোচন। প্রাত্যহিক বৈকালিক ভ্রমণের মতো কিছুটা সময় যখন মানুষের সাথে কাটিয়ে ঘরের ফেরার মতোই নিজের ভিতরে ডুব দিই তখন ভুস করে মাথা ভেসে ওঠে ছোটবেলার সরল দিনগুলোয়। অপরিণত বয়সের চোখ দিয়ে জগতটাকে দেখার মস্ত সুবিধে হল জগতের অনেক অসঙ্গতিই চোখ এড়িয়ে যায় নিশ্চিন্তে এবং বকাবকি করারও কেউ থাকে না।মনের উৎসুক ভাবের কাছে সমস্ত কিছুই সজীব মনে হয়। কোনো অপ্রয়োজনীয়তা ঘর বাধে না। সে দেখায় পূর্ণতা হয়তো থাকে না কিন্তু তীব্রতা থাকে, নিবিষ্টতা থাকে।আকস্মিকের আনন্দ থাকে ষোলোআনা। শিশুর প্রসন্ন মন প্রসারিত হওয়ার আনন্দে জগতের ভাব সত্তাকে গ্রহণ করে অতি দরদী চিত্তে — এ নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না।
শুনেছি অতীতচারণ নাকি বার্ধক্যের লক্ষণ। তা কালে কালে ঝড় বৃষ্টি বজ্রপাত তো কম দেখলাম না। একলা চুপচাপ জীবন্ত নির্জনতার মধ্যে কিছু কিছু মূল্যবান সময় তাই মাথা চাড়া তো দেবেই। আজ আমার খুব বলতে ইচ্ছে করছে ‘পথের পাঁচালী ‘র সাথে আমার প্রথম আলাপের দিনটির কথা। বেশ বড়রকমের একটা গর্হিত কাজ সে সময়ে করে ফেলেছিলাম সন্দেহ নেই। কিন্তু আজ সে ঘটনার অন্যরকম ব্যাখ্যা আমি দিতে পারি। যদিও সে রাস্তায় না হাঁটাই ভালো। ছেলেবেলার কথা ছেলেমানুষের চোখে দেখাই ঠিক, তাতে নির্ভেজাল পবিত্রতা বজায় থাকে। পাঠ্যবই পড়ার বাইরে পড়াশোনার নেশার বীজ পিতৃসূত্রে পেয়েছিলাম। শিশুপাঠ্যের বাইরে অনেক বই লুকিয়ে পড়ে ফেলেছিলাম সে বয়সেই যে বয়সে ওগুলো পড়া রীতিমতো অপরাধ হিসেবে দেখা হত। ‘রাত ভর বৃষ্টি’, ‘বিবর’,’কালপুরুষ’,’পূর্ব পশ্চিম ‘,’দৃষ্টিকোণ ‘ এমনই সামান্য কিছু উদাহরণ। এসব বই সে সময়ে পড়ার ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ হওয়ার কারন সম্ভবত পড়ার বইয়ের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া, এমন কোনো আশঙ্কা বাবা মায়ের হয়ে থাকবে। কিন্তু তাতে বই পড়ার সুখ কিছুমাত্র কমে নি। কিছু বুঝি না বুঝি পড়ার আনন্দে পড়ে যেতাম। সত্যি বলতে কী বঙ্কিম বা শরৎচন্দ্র পড়তে গিয়ে কখনো কোনো তুল্যমূল্য বিচার করিনি, সে বয়সে সেটা সম্ভবও নয়। তখন শুধু গোগ্রাসে পড়ার সময়। যেখানে যা পেতাম কুড়িয়েবাড়িয়ে নিয়ে এসে পড়ে ফেলতাম। মজার ব্যাপার হল বাবার বইয়ের আলমারী খুললেই কী করে যেন টের পেয়ে যেতেন বাবা। অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি বাবাকে কী সেই রহস্য কিন্তু মৃদু হাসি ছাড়া আর কোনো উত্তর আমি পাইনি। তাই বলে আলমারীতে কখনো তালা ঝোলাতেও দেখিনি। আজ তো বাবা নেই, কোনো ভাবেই সে রহস্য উদ্ঘাটনের রাস্তা আর নেই। থাকুক কিছু কিছু রহস্য, রহস্য হয়েই। তাতে জীবনের মাধুর্য কমে না। দ্রষ্টব্যটুকু নিয়েই আমাদের যাবতীয় সুখ আমরা ভেবে থাকি অথচ তার আড়ালের সদর্থকতা গ্রহণে যারা পারঙ্গম তাদের চেয়ে সুখী আর কে আছে? এক নতুন আনন্দের সন্ধান হয়তো সেখানেই আছে। একটি মাত্র চিন্তা, একটি মাত্র ধারনাই তো আর লক্ষ্য হতে পারে না। যদি তাকেই চরম সত্য বলে মেনে নেওয়া যায় তাহলে নিঃসংশয়ে বলা যায় সংকটকাল উপস্হিত। এ অবস্হা স্বাভাবিকও নয়, কাম্য তো নয়ই। যাক গে কোথা থেকে কোথায় যে গড়িয়ে যায় কথা। শিবের গীতে আমাদের কাজ কী? যেটা বলছিলাম সেটাই বলি। এরকমই যখন অবস্হা তখন মাসির বাড়ি বেড়াতে গিয়ে ( এখানে আমি প্রায়ই যেতাম, তুতো বোনটি এবং আমি সমবয়সী ছিলাম বলে আলাদা একটা আকর্ষণ তো ছিলই ) হাতে পেয়ে যাই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালীর ছোটদের সংস্করণ ‘ছোটদের পথের পাঁচালী ‘। এখানে কিঞ্চিৎ আমার মেসোর কথা বলে নেওয়াটা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। মেসো দীর্ঘ পনেরো বছর দুর্গাপুরের মেয়র ছিলেন। প্রচন্ড রাশভারী পুরুষ। রাজনীতি সমর্পিত প্রাণ অথচ সময় পেলেই পড়াশোনায় ডুবে থাকেন। বাড়িতে এমন কোনো বই নেই যা নেই। আমিও সেখান থেকেই চিনের রূপকথা, রাশিয়ার রূপকথা এবং অন্যান্য আরো বিশ্বসাহিত্যের স্বাদ পাই। আজকাল তো সবই অনলাইন পাওয়া যায় তখন ব্যবস্থা এত সহজ ছিল না, অনেক অপেক্ষা করতে হত। যাইহোক, পথের পাঁচালী তো হাতের কাছে পাওয়া গেল। ছোটদের আঁকা ছবিতে সে বই অলঙ্কৃত। কিছুটা পড়াও হল। আর ব্যস। বই হাতে করে সোজা বাড়ি। মেসো মাসির সস্নেহ প্রশ্রয়ও ছিল এ ব্যাপারে। তবে আগে আগে যা হয়েছে এবার আর তা হল না। বই কিছুতেই আর প্রাণে ধরে ফেরৎ দিতে পারলাম না। তারপর থেকে মাসির বাড়ি গেলেই একটা চাপা ভয় কাজ করতো এই বুঝি সে বই কেউ ফেরত চেয়ে বসলো। কিন্তু অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। কত বসন্ত এসে চলে গেছে। ভাইবোনেরা জীবিকার সন্ধানে ছড়িয়ে পড়েছে কতদিকে। কেউ বই ফেরত চায় নি। আমিও দিইনি। ভরসা আছে কেউ আর কোনোদিন চাইবেও না। স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই তারা উজ্বল জায়গায় রয়েছে। অমন বই ইচ্ছে করলেই তারা শতাধিক কিনে ফেলতে পারে। কিন্তু বইটি আজও আমার কাছে সেই প্রথম দিনের মতোই সযত্নে আছে। পাতাগুলো খানিক বিবর্ণ হয়ে গেছে, ছবিগুলি খানিক ম্লান কিন্তু অপু-দূর্গার ঘ্রাণ অবিকল রয়ে গেছে। পরে নিবিড় ভাবে বিভূতিভূষণের সাহিত্যকৃতির সাথে আমার পরিচয় হয়েছে, পথের পাঁচালীও পড়েছি গোটাটাই কিন্তু ছোটদের জন্য নির্বাচিত অংশ নিয়ে যে ছোটদের পথের পাঁচালী তার সৌরভ প্রথমদিনটির মতোই আজও জীবন্ত। বই ফেরত না দেওয়ার ঘটনার পর অবশ্য আর কোনোদিনই কোনো বই আমি বাড়িতে নিয়ে আসিনি, যতটুকু পড়ার ওখানেই পড়েছি শুয়েবসে আরামে।
“বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে ” আজও আমার নিকোনো উঠোনে ঝরে মিষ্টি মোলায়েম সোনা রোদ্দুর। চাঁদের বর্ণময় আলোকচ্ছটায় ভাসতে থাকে জীবনের যাবতীয় ঋণ। পুরাতন, নিরীহ, গৃহাশ্রয়ী আমার ভাষা বহন করে চলে তুচ্ছতম স্মৃতিগুলি। কত উত্থান -পতনের সাক্ষী আমার বাংলা ভাষা।না জানি কত ভেদনীতির শিকার। কত অন্ধ আঘাত সইতে হয়েছে তাকে। তবু মূঢ়তা, বর্বরতার বিরুদ্ধে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর আমার ভাষাই এনে দিয়েছে গভীর প্রশান্তি। গ্রাম্য জীবনের সাথে আমার প্রত্যক্ষ কোনো যোগ নেই অথচ এই দুটি সরল স্বভাবা বালক-বালিকার সাথে যেন জন্মজন্মান্তরের নিবিড় ঐক্য গড়ে উঠেছে। বাংলা ভাষার সাথে আমার আত্মীয়তা এবং ঘনিষ্ঠতার নিবিড় বোধের মাধ্যম তো সজল শ্যামল বাংলাদেশের এই দুটি মানবশিশুই। মাতৃভাষার সূত্রে পাওয়া বাংলা ভাষা যতদিন আমার অস্তিত্বের অংশ থাকবে ততদিনই মনের চাকাটা ঘুরবে সহজে। জং ধরবে না। শুধু একদিন নয় সারা বছর ধরেই চলবে তার সাথে আমার আনন্দ উদযাপন।
” শুধু সে দিনের একখানি সুর
চিরদিন ধরে বহু বহু দূর
কাঁদিয়া হৃদয় করিছে বিধুর
মধুর করুণ তানে ;
সে মহাপ্রাণের মাঝখানটিতে
যে মহারাগিনী আছিল ধ্বনিতে
আজিও সে গীত মহাসংগীতে
বাজে মানবের কানে। “