বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় -এর দশটি কবিতা
নিরাপদ মাননীয় মানব সমাজ
‘I smell dark police in the trees’.
দীর্ঘ দেবদারু বীথি আজ কোনো আকাশ দেখে না
এখন আকাশ জুড়ে নষ্ট চাঁদ, শুরু হবে পিশাচের নাচ; এখন বাতাস দগ্ধ দুধকলা দিয়ে পোষা সাপের নিঃশ্বাসে… ভাল আছে—নিরাপদ—আমাদের মাননীয় মানব সমাজ॥
[রাস্তায় যে হেঁটে যায় / প্রথম প্রকাশ: ১৩৭৯]
কবিতা পরিষদের ‘বইমেলায়’
আমরা সবাই চাঁদের আলোয় বামন
ব’সে আছি অনন্ত ইথারের
একটি বিন্দু কোটিতে ভাগ ক’রে
এই পৃথিবীর কয়েক কোটি মানুষ;
এবং ক’জন মার্কাস স্কোয়ারে।
আমরা সবাই ক্ষুদ্র ইতর বামন
চাঁদের আলোয় যে যার মুখ দেখে
অন্য সময় মাথার চুল ছিঁড়ি
আয়না ভাঙি; তবু এখন অবাক
ঘাসের ওপর মার্কাস স্কোয়ারে!
কবিতা শুধু কবিতা চারদিকে
যেন জীবন এখন কালপুরুষ
সপ্তর্ষির চেতনা : যেন চুমা
ইতর মুখে চোখে, ইতর বুকে;
আধফোটা এই মার্কাস স্কোয়ারে।
আমরা ক’জন সৌরলোকের বামন
কয়েকটি রাত বাঁশির মতো বাজি।
[সভা ভেঙে গেলে/ প্রথম প্রকাশ: ১৩৭১]
বর্ষা
কালো মেঘের ফিটন চ’ড়ে
কালীঘাটের বস্তিটাতেও আষাঢ় এলো।
সেখানে যত ছন্নছাড়া গলিরা ভিড় ক’রে
খিদের জ্বালায় হুগলি-গঙ্গাকেই
রোগা মায়ের স্তনের মতো কামড়ে ধ’রে
বেহুঁশ প’ড়ে আছে।
আষাঢ় এসে ভীষণ জোরে দুয়ারে দিল নাড়া—
শীর্ণ হাতে শিশুরা খোলে খিল॥
[লখিন্দর/ প্রথম প্রকাশ: ১৩৬৩]
এ শহর
এ শহরে ঈশ্বরের সভা হবে, তাই
ছেঁড়া কাঁথা ছুঁড়ে ফেলে পরেছে সে
নকশাপাড় শাড়ি
খোঁপায় গুঁজেছে লাল-নীল ফুল।
রাত ভোর না হতেই ফুটপাতের উলঙ্গ ছেলেরা বিদেশ গিয়েছে…
[শীতবসন্তের গল্প/ প্রথম প্রকাশ: ১৩৮৩]
‘আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে’
একটি পুরনো রূপকথা
একটি মেয়ে উপুড় হয়ে কাঁদছে যন্ত্রণায়
বিবর্ণ তার নয়ন দুটি, কিন্তু বড় মিঠে।
একটি ছেলে জানে না, তাই অঘোরে নিদ্রা যায়
জানলে পরে থাকতো এখন পঙ্খীরাজের পিঠে।
[দিবস রজনীর কবিতা/ প্রথম প্রকাশ: ১৩৮৫]
মুঠো খালি রাখতে নেই
মুঠো খালি রাখতে নেই।
ফুল-বেলপাতার কাজ শেষ হয়ে গেলে
হাতের কাছে যা পাওয়া যায়
পাথর, ধুলো, একটা মরা ইঁদুর—
তাই আমরা আমাদের জাগ্রত শালগ্রাম-শিলাদের জন্যে দু-হাত ভর্তি ক’রে নিয়ে আসি।
তাঁরা প্রসন্ন হন।
[গ্ৰন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতা]
রানি, আমার রানি
ভালবাসার দিনগুলিকে
ফিরিয়ে দেবে কোন্ নবান্ন।
অন্ন কি শ্মশানের মানিক
জ্যোছনা আনবে শুকনো কাঠে!
‘রানি আমার রানি’ ব’লে
কণ্ঠ চিরে যতই ডাকো;
কেউ দেবে না সাড়া, সবাই
হৃৎপিণ্ড ছুঁড়ে দিয়েছে।
[হাওয়া দেয়/ প্রথম প্রকাশ: ১৩৭৫]
তোর বুকের মধ্যখানে
ঈশ্বরের দয়া কাঁপছে; ঊর্ধ্বে অধেঃ যেদিকে তাকাই
গানের অনন্ত আলো; আলো তোর বুকের ভিতর।
শিশুর মতোন আমি জেগে উঠছি, গান শুনছি, আলো চেতনায় নিচ্ছি; আর সারা অঙ্গ আমারো ঈশ্বর।
সারা অঙ্গ মন্ত্র হচ্ছে; তোর বুকের মধ্যখানে আমি
দেখতে পাচ্ছি নবজন্ম, শুনতে পাচ্ছি, শিবের নিশ্বাস। কোথাও সধবা নাচছে, নেচে উঠছে মৃত লখিন্দর;
চন্দন নিমের গন্ধে ছেয়ে যাচ্ছে সমস্ত বাতাস।
ঈশ্বরের দয়া কাঁপছে; তোর বুকের মধ্যখানে আমি
চোখ রেখে, গাল রেখে, ঠোঁট রেখে একটি জীবন মেষশাবকের মতো হয়ে যাব। কিশোর যিশুকে
দেখব আমি, জানবো বেহুলাকে; যুগ্ম করুণার স্তন অনুভব করবো আমি, গঙ্গা নামছে, দুই কূলে তার
শাখা নাড়ছে বোধিবৃক্ষ, মিলে যাচ্ছে এপার ওপার।
[সভা ভেঙে গেলে/ প্রথম প্রকাশ: ১৩৭১]
ফুল ফুটুক, তবেই বসন্ত
প্রেমের ফুল ফুটুক, আগুনের
মতন রং ভালবাসার রক্তজবা
আগুন ছাড়া মিথ্যে ভালবাসা
এসো, আমরা আগুনে হাত রেখে
প্রেমের গান গাই।
আলো আসুক, আলো আসুক, আলো
বুকের মধ্যে মন্ত্র হোক : রক্তজবা।
এসো, আমরা আগুনে হাত রেখে
মন্ত্র করি উচ্চারণ : ‘রক্তজবা!’
এসো, আমরা প্রেমের গান গাই॥
[মুখে যদি রক্ত ওঠে/ প্রথম প্রকাশ: ১৩৭১]
এই অন্ধকার
নিঃশ্বাস নিতেও মানা
কেন না মানুষ এই অন্ধকারে নিজের মুখ-কে
লুকিয়ে রাখার জন্য
চারিদিকে কশাইখানার মধ্যে
ছ’ফুট মাটির নিচে চুপচাপ স্থির ব’সে আছে।
কোথাও জানলা নেই
দরজার কথা ভাবা অসম্ভব,
কেন না বাতাস ঢুকলে কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান,
হতে হবে। কেন না ঘরের মধ্যে, ঘরের বাইরে
অন্তহীন দ্বেষের আগুন।
[ভিসা অফিসের সামনে/ প্রথম প্রকাশ: ১৩৭৪]