ভোজ কয় যাহারে (নবম পর্ব) : কচু – সত্যম ভট্টাচার্য
নবম পর্ব
কচু
আপাতভাবে যে কোনো জিনিসের আসল ব্যাপারটাই হল তার এফেক্টিভনেস। শিক্ষাগত দিক থেকে দেখলে যদিও নম্বর কখনোই মেধার পরিচায়ক নয়, কিন্তু সেই মেধাও কোনো কাজেরই নয় যদি তা থেকে আপনি দু-চার কথা লিখতে বা বলতে না পারেন। মনে করুন, আপনি অনেক কিছু জানেন কোনো বিষয়ের ওপর, কিন্তু যখন আপনাকে সেই বিষয়ের ওপর কিছু লিখতে বা বলতে বলা হল তখন আপনি কিছুই বলতে বা লিখতে পারলেন না। হ্যাঁ, এরকম কখনও হতেই পারে যে আপনি মনে করতে পারলেন না সেই বিষয়টিকে বা বলতে ইচ্ছে করছে না, তা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়, কিন্তু সবসময়ই যদি এমনটাই হতে থাকে তাহলে তো মুশকিল।
যাই হোক, অনেক ভনিতা হল। মোদ্দা যে বিষয়টি বা সবজিটি নিয়ে আজ কথা বলতে ইচ্ছে করছে তা হল কচু। আরও নির্দিষ্ট করে বললে শোলাকচু। আমাদের এদিকে বর্ষাকালের এই সবজিটিকে এই নামে ডাকা হলেও দক্ষিণবঙ্গেও কি এই নামেই ডাকা হয়? ঠিক জানা নেই। অনেকটা দেখতে শোলাকচুর কাছাকাছি আরেকটি কচু আছে। তার নাম বাক্সকচু। অনেক সময় বাজারের কোনো কোনো ব্যবসায়ী এই বাক্সকচুকে শোলাকচু বলে চালানোর চেষ্টা করেন বটে, কিন্তু তুখোড় বাজারুদের ঠকাতে পারেন না। যদিও এই কলমচির কাছে বাক্সকচু আর শোলাকচুর স্বাদে তেমন পার্থক্য অনুভব হয়নি, কিন্তু রসিকজনে বলেন যে আলবাত স্বাদে ফারাক আছে।
এবারে আসি সেই কথায় যে কেন এই লেখা এফেক্টিভনেসের কথা দিয়ে শুরু হল। সময়টা মোটামুটি দু হাজার কুড়ি সালের গ্রীষ্ম-বর্ষা। দুটো ব্যাপারের জন্য আমরা অনেকেই এই সময়টাকে ভুলতে পারব না। প্রথম কারণ হচ্ছে, কঠিন লকডাউন চলছিল সে সময়। চারিদিকে করোনার জুজুতে লোকে ঘরের খিড়কি আটকে বসে আছে। শুনশান রাস্তাঘাট, মাঝেমধ্যে পুলিশ ভ্যানের টহল। কোথাও কোথাও গলির ভেতরে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কয়েকজনের জটলা, ফিসফিস, কোনো বাড়ির কেউ ফিরল কি না। চারিদিকে অবিশ্বাস আর অনিশ্চয়তার বাতাবরণ। আর আরেকটি কারণ মনে রাখার সে বছর গরম প্রায় পড়েইনি। মার্চ-এপ্রিল মাস অর্থাৎ বসন্ত পেরিয়েই আমরা ঢুকে গিয়েছিলাম বর্ষায়। দক্ষিণবঙ্গের কথা বলতে পারব না তবে আমাদের এদিকে উত্তরবঙ্গে এমনটাই হয়েছিল। দক্ষিণবঙ্গে খুব সম্ভবত সে সময়ই ধাক্কা দিয়েছিল আমফান ঝড়।
সেই সময় আমার কর্মক্ষেত্র এমন এক জায়গায় যে জায়গা চাষবাসের ক্ষেত্রে খুব নামকরা। আর সেই ঘোর বর্ষায় তখন জমি থেকে তোলা হচ্ছে শোলাকচু। আর তখন এমন একটা সময় যে কাজ থেকে ঘরে ফেরার সময়ই কিছু বাজার করে ফিরতে হবে। না হলে পরে বেরুতে নিজেরও ভয় আবার পুলিশেরও ভয়। তো সেই যাত্রায় একটা দীর্ঘ সময় আমাকে উদ্ধার করেছিল কচু। একখানা কচু নিয়ে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের গাওয়া সেই গানখানা (কিছুতেই কথা মনে পড়ছে না, যাদবপুরে গাওয়া ক্যাসেটে গানটা ছিল) গাইতে গাইতে ঘরে ফিরতাম।
কারণ কুড়ি-পঁচিশ বা তিরিশ টাকায় কেনা একটি কচু অনেক ভাবে খাওয়া যায় আর তাতেই তার এফেক্টিভনেস। কচুর যে অংশটি মাটির ওপরে থাকে তা দিয়ে হতে পারে চমৎকার শাক। তাতে নিরামিষ হলে মিশবে ছোলা আর আমিষে লাগবে ইলিশ মাছের মাথা। সেখান থেকে আরেকটু নেমে এলেই যে অংশটি তা দিয়ে হয় খুব সুন্দর ডালনা। ঘি-গরমমশলা সহযোগে সেই পদের তুলনা নেই। আবার পাঁচমিশেলি তরকারি বা ঘ্যাট, খিচুড়ির সাথে যার বিকল্প নেই সেখানেও কচুর এই জায়গাটি ব্যবহার করা যেতে পারে। এবারে সেখান থেকে খানিক নামলে থাকে কচুর গোড়া। এবারে তাকে আপনি বেটে খেতে পারেন। পোস্ত-নারকেল কোঁড়া-কাঁচা লঙ্কা আর কাঁচা তেল দিয়ে এই কচুবাটা আর গরমভাত আপনাকে স্বর্গসুখের মতো সুখ দিতে পারে। আর ফাঁকিবাজি করতে চাইলে কচুগোড়ার বড়া। যেভাবে খুশি খান ।
আচ্ছা সুধী পাঠক, এই যে কচুর বর্ণনা দিলাম ওপর থেকে নিচ অব্দি একে কি আপনার সুবিধা হচ্ছে অন্য কোনো বিষয়ের সাথে রিলেট করতে? চাইলে করুন। সেখানেও তো আপনি যেভাবে খুশি সেভাবে ওপর-নিচ করতেই পারেন।