অত্রি ভট্টাচার্য-এর কবিতা
মার্জারসুন্দরী
১.
দরজায় দাঁড়িয়ে দেখি,
রাতের ঘড়ি বারোটা ছুঁলেও, বাইরে যথেচ্ছ আলো
সানাইয়ের সিডিটা বার করে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগাচ্ছে পাড়ার সাউন্ডম্যান
দু- একটা ক্লান্ত সাইকেল হাওয়া চিড়ে চলে যাচ্ছে
এসময়ে, তোমার ভ্রূ ও পল্লবের মাঝে সাদা বেড়ালছানা হাঁটে
যে জানে কার্নিভাল সততই জাগরুক, তার কোনো ইনসোমনিয়া নেই
২.
আয়ুর্বেদ মতে, বিড়ালের বিষ্ঠা, ছাগলোম, মেষশৃঙ্গ, বচ ও মধু দিয়ে বানানো ধূপ–বাচ্চাদের জ্বর সারায়।
ঠাকুরবাড়ির নীল রক্ত ঋতেন্দ্রনাথের মতে, প্লেগের পর থেকে হিন্দুরা ষষ্ঠীবাহন বিড়ালকে তাদের কুলুঙ্গিতে ঠাঁই দিয়েছিল।
কারণ, সে প্লেগবাহক ইঁদুরের, বঙ্গদেশের কৃষকের ধান্যাদি, শস্যের অনিষ্টকারী ইঁদুরের প্রধানতম এনিমি।
তার আগে, এমনকি রামায়ণে বলা হয়েছে রাম যখন বনবাসে গেলেন, ভরত অযোধ্যার শূন্যপূরীতে দেখেছিলেন, কয়েকটি অলক্ষুণে ছায়া, কয়েকটি বিড়াল
রাশভারী কমেন্ট্রিতে ঋতেন্দ্রনাথ, লিখছেন ‘আমরা দেখাইলাম যে হিন্দুর দেবতার বাহনকল্পনা নিরর্থক নহে–’
এইসব অ্যানালজি, মিথিক ও অকাল্টের ফান্ডা ছেড়ে, প্রসঙ্গে আসি, আজ কটা ক্যাটভিডিও দেখলে বিড়ালী আমার?
ফার্নান্দ ব্রদেলের প্রতি
১.
জীবন যা দেবে, মৃত্যু তাকে কেড়েই নেবে—এই অমোঘ বাক্য কোন্ পাঠশালায় শিখেছ তুমি? ১৪৫১-এর কোলোন শহরে, আমরা জেনেছিলাম–প্লেগাক্রান্ত হয়ে, নিভে গেছিল ২১,০০০ লোক, তার কিছু বছরের মধ্যেই শহরে বেজেছিল ৪০০০ বিবাহের সানাই,
১৬৩৭–গ্যারিসনের সৈন্যেরা যারা পালিয়েছিল প্লেগের সময়, ফিরে ফিরে আসছে তারা, জীবনের দিক থেকে পিঠ ফিরিয়ে রাখা, জরা ও দুঃখের ফসল, বিধবারা বৈধব্য ছেড়ে তাদেরই ভালোবাসছে, ভেরোনা শহর আবার সেজে উঠছে ম্যারেজ সেরেমনিতে, গির্জার পাদ্রীদের সময়ে কুলোচ্ছে না, কয়দিন পর হয়তো আবার, কোনো পর্যটক তার ডায়েরিতে টুকে রাখবে–‘এখানে, এই জনমানবশূন্য, খাঁ খাঁ প্রদেশে কোনো পুরুষমানুষ নেই অস্ত্র তুলবে বলে, অথচ চারদিকে কিলবিল করছে একগাদা বাচ্চাকাচ্চা’, হয়ত মনে পড়বে, ১৪৩৮–এই তো কদিন আগে, সেনলিসের কাছে ক্রেপি শহরে, শহরের এক-তৃতীয়াংশ ভিক্ষে করছিল, গাঁয়ে ফেরবার চেষ্টা করছিল অনেকে, আর বুড়োলোকগুলো নিভৃতে মরছিল।
এই এতকাল পর, আরেক প্যান্ডেমিকের দর্শক আমি, বিলক্ষণ বুঝি, মহামারী কেটে গেলে ক্ষুধার কথা কেউ বলে না।
সকলেই ডুবে যায় বিয়ে ও শাদির হুল্লোড়ে।
২.
যে কোনও পরিসংখ্যানে দেখবে দুঃখ ও বিষণ্ণতা লেগে থাকে
১৩০৮ থেকে ১৩১৮ যখন ব্ল্যাক ডেথ আর খাবারের কমতি মড়কের মতো ছড়িয়ে পড়ছে, প্রথমে জার্মানিতে, তারপর গোটা ইউরোপে, রাইনল্যান্ডে ও লিভোনিয়ায়– সর্বত্র স্থানে স্থানে মন্বন্তর, কজনের কথা জানি আমরা, কজনের মৃতদেহ দেখেছি ভেনিস বা অ্যামিনেসের স্বর্গের মতো রাস্তায়, পাবলিক স্কোয়ারে পড়ে থাকতে
মানুষকে সংখ্যা বলে, দেখতে শেখায় যে গণিত,
সে গণিত আমি শিখতে চাই না।
বরঞ্চ দেখে নিই মুরিলোর আঁকা ছবি, সন্ত দিয়েগো নিরন্নকে অন্ন দিচ্ছেন, এক ভিখারি এগিয়ে দিচ্ছে মাধুকরীর বাটি।
আমি মা অন্নপূর্ণার দেশের লোক, নিবৃত্তি বুঝি, গণিত বুঝি না।
রন্ধনপ্রণালী
রাত্রি, যত বাড়তে থাকবে, জুকবক্সে তত ঘন হবে ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে’—ঝিনচ্যাক গোলাপি আলোতে, অটোকাকু দেখে নেবে, নিজের মুখ সেইখানে, যেখানে লেখা থাকে, অবজেক্টস ইন মিরর আর ক্লোজার দ্যান দে অ্যাপিয়ার।
সেই আয়নার ভিতরের কালো জল ঠেলে, সে সাঁতরাতে থাকবে, আর বলতে থাকবে—আমরা প্রোলেতারিয়েত—কুলশ্রেষ্ঠ, আমরা কর্মকার,
আমরা হাতুড়ির মুখে গান, আমরা স্রষ্টার ও
ব্রহ্মার চেয়েও বেশি কিছু, আমাদের ধর্ম শ্রম, আমাদের নেতি মানে, নেতি ধোপানি।
আরে নাহ্, প্রতিটি ডায়লগে প্রবল সিটি পড়বে, পড়তেই থাকবে।
যাই হোক, আপাতত কালকের কথা ভেবে, একটি লাজিজ্ কুইজিন হিসাবে পান্তা ও শুকনো ডালের প্রক্রিয়াটি শিখে নেওয়া যাক।