সিনেমা ও কাল – সুপ্রতীক চক্রবর্তী
ফ্লবেয়ার একবার বলেছিলেন পৃথিবীর আদিমতম নেশা হল কিছু তৈরি করার নেশা! আজকে এই বিশুদ্ধ বিশ্বায়নের যুগে দাঁড়িয়ে পটেমকিন দেখলে মনে হয় কালানুক্রমিক ইতিবৃত্তের বেশি আর কিছুই নয়। পটেমকিন হল ধ্রুপদী ট্র্যাজেডির প্রথম সিনেম্যাটিক নিদর্শন। মনে করুন ওদেসা বন্দরে শোকস্তব্ধ মানুষের ভিড়ে লাল পতাকা পতপত উড়ছে! শ্রমিক সাম্য আর বুর্জোয়াতন্ত্রের লাথালাথি! একজন আবার বলেছিলেন “পতাকা আবার লাল না সবুজ বুইলে কীভাবে? সাদা কালো ছবিতে ওসব রঙ বোঝা যায় না।” মোদ্দা কথা হল সম্ভাবনা আর বাস্তবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তফাত সিনেমাতে হয়।
বন্ধুগণ, আমি গত বইমেলায় একখানা বই কিনেছিলাম। বইটিতে বেশ কিছু নামজাদা চিত্র পরিচালক নিজেদের কথা বলেছেন। নিজেদের কথা মানে ব্যক্তিগত ভাষ্য (উপভাষ্য নয় তো?)! কেউ কথা কয়েচেন পারমার্থিক বিষয় নিয়ে! বার্গম্যান নামের লোকটা চার্চ থেকে বেরোতেই পারেননি নাকি! কেউ আবার বলেছেন ওদেসা বন্দরে কুয়াশা-টুয়াশা তৈরি করে আইজেনস্টাইন ব্যাপারটা ডার্ক করতে চেয়েছেন! বুনুয়েল মাঝ রাত্তিরে মদ খেয়ে সারা ঘরে গর্ত খুঁজতেন! এইসব আর কি! প্রাচ্যের কোনো কথা নাই সে বইয়ে! কৌমচেতনার বাড়াবাড়ি আর কলোনিয়াল এথিকসের মাতব্বরির কথা জোয়ারের জলের মতো উপচে পড়েছে সে বইয়ে। এনরিকো রোদা আন্তনিওনিকে প্রশ্ন করেছেন, “সিনেমা হীন জায়গায় আপনাকে পাঠিয়ে দিলে কি করবেন?” উত্তর এসেছে, “সিনেমা বানাব।” পরের প্রশ্ন, “আপনি কি নিওরিয়ালিস্টিক?” উত্তরে লা নত্তের পরিচালক যা বললেন সেটা এখানে লেখার লোভ সংবরণ করলে জিওভানি আমাকে ক্ষমা করবেন না। উনি বলছেন—
“অত শত জানি না! নিওরিয়ালিজম ফুরিয়ে যায়নি। কোনো ইজম ফুরিয়ে যায় না, বিবর্তিত হয়। কোনো আন্দোলন, যতক্ষণ না পরবর্তী কোনো আন্দোলন এসে তার স্থান নিচ্ছে ততক্ষণ শেষ হতে পারে না। যুদ্ধের সময়কার একজন মানুষ আর যুদ্ধোত্তর একটা মানুষ এক নয়! পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার পর চরিত্রটির ভেতর পুরনো অভিজ্ঞতার ফলে কী চেঞ্জ এসেছে সেটা খতিয়ে দেখাটা মজার বিষয়। সেই জন্যই যার বাইসাইকেল চুরি গেছে সেই লোকটাকে নিয়ে আবার একটা ছবি করা বোকামো। এমন একটা লোক যার একমাত্র গুরুত্ব হচ্ছে—সে তার বাইসাইকেল চুরি হয়ে যেতে দিয়েছে। আমরা এই ঘটনার অভিঘাতে খুঁজতেই চাইনি যে লোকটা কি লাজুক নাকি হিংসুটে ইত্যাদি!আমাদের কাছে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ হল সাইকেল চুরি, ফলে আমরাও খোঁজাখুজিতে নেমে পড়ি। এখন যখন সে সাইকেলের সমস্যা মিটেছে তখন আমাদের দেখতে হবে সেই লোকটার মনে ও হৃদয়ে কী পরিবর্তন এসেছে।”
আন্তনিওনির একটা আলাদা ভাইব আছে! বুনুয়েল স্ক্রিপ্ট লিখতেন গুছিয়ে! বার্গম্যান সবটাই করতেন ভীষণ গোপনে, অন্ধকারে, অগোচরে! দ্য সিকা অ্যাডাপ্ট করতেন দস্যুর মতন। আন্তনিয়োনি বাতাস থেকে জীবাণুর মতো গল্প টেনে শরীরে মেখে নিতেন। এ কথা উনি নিজে বলেছেন! কামু যতোই বলুন “বাস্তবের সাথে বিদ্রোহ শিল্পের কাজ”, এদের কাজ দেখে মনে হয় বাস্তবটাকে মাইক্রোস্কোপের তলায় রেখে গল্পের “কালচার” করাটাই মুখ্য! এটা সবাই করতেন সেসময়! জাভাত্তিনি থেকে মিজোগুচি, সত্যজিৎ থেকে ব্রেসন! এখন সময় পাালটেছে৷ এখন হাইপোথেটিকাল হয়ে গেছে সবটাই! বেশিরভাগটাই বায়নারি বিদ্ধ! হয় আলো, নয় অন্ধকার! তার মাঝে শূন্য মাথার খুলি ছাড়া আর কিসসু নেই।
City Lights-য়ের শেষ দৃশ্যটা মনে আছে? গোলাপের ডাঁটি মুখে নিয়ে হাসি মুখে চ্যাপলিনের স্টিল ছবিটা! সারা পৃথিবীর চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক এবং অদ্বিতীয় সেই এক্সপ্রেশন! এক্সপ্রেশন আসে কোথা থেকে? ব্যক্তিগত অনুভব বা প্রত্যয় কিংবা বিষণ্ণতাকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে চলচ্চিত্র। সাহিত্যের থেকেও সার্থকতর ভাবে৷ সে জয়েস যাই বলুন!
বার্গম্যান সারাজীবনে একটাই ছবি করতে পেরেছিলেন আমার মতে যেটাকে টেক্সট অফ জার্নি বলা যায়। সেটা হল ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ। মৃত্যুর আগের দিন অবধি এ ছবি ভুলব না। এক বৃদ্ধ তন্নতন্ন করে খুঁজছেন নিজের হারানো প্রতিবিম্ব! তছনছ হয়ে যাচ্ছে অহংকার! এ তো জীবনের ছবি৷ যেমনটা মৃণাল সেন জীবনের এত কাছে যেতে পেরেছেন খন্ডহর বানিয়ে! চলচ্চিত্র এই জীবন খুঁজতে শুরু করল কবে থেকে?
অ্যাঁলা রেনে গার্ণিকা বানিয়েছেন, আইজেনস্টাইন ব্যাটলশিপ পোটেমকিন বানিয়েছেন, কার্ল ড্রেয়ার প্যাসন অফ জোয়ান আর্ক বানিয়েছেন! কিন্তু চলে যাই সেই আদি যুগে। পোর্টার বানালেন “The Great Train Robbery”। ক্যামেরা নড়েনি। চিত্রগত কোনো উদ্ভাবন নেই। অন্তর্বর্তী কোনো সংঘাত নেই। কেবল নিছক একটা গল্প আছে৷ কিন্তু তাতে মজা কই? এগিয়ে এলেন গ্রিফিথ! চলচ্চিত্র জগতের ব্রহ্মা উনি। ছবি জুড়তে দেখালেন, কাটতে দেখালেন, ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ বদলাতে শেখালেন, এডিটিং শেখালেন, আর কি! আমরা পেলাম বার্থ অফ আ নেশন, প্রথম সুস্থ ছবি এটাই।
কিন্তু আদতে জীবন থেকে কতটা আলাদা চলচ্চিত্র? আন্তনিয়োনি বলেছিলেন গোটাটাই আলাদা। একটা ক্যানভাসে একটা রাতের আকাশ আঁকলে যেমন নক্ষত্রের আলোটা গায়ে এসে পড়ে না, তার জন্য সত্যি সত্যি খোলা আকাশে দাঁড়াতে হয়, ততটাই আলাদা। আমার ব্যক্তিগত ভাবে আজকাল মনে হয় ক্যামেরা একটা ভীষণ বস্তু। ওটা যত নড়তে থাকে তত বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে সিনেমা। ধরুন ওজুর কোনো ছবি। একেবারে সনাতন জাপানি চিত্রপরিচালক! বৈশিষ্ট্য ছিল উনি ক্যামেরা নড়াতেন না। নো মুভমেন্ট অ্যাট অল! ইচ্ছাকৃত ভাবে ক্যামেরা একই জায়গায় রেখে অভিনেতাদের ব্যবহার করতেন। এর ফলে ওদের চোখ মুখ গলা ফ্রেম থেকে কাটা পড়ে যেত! এটাই স্টাইল! অর্থাৎ ক্যামেরা এখানে একটা হিউম্যান আইস হিসেবে কাজ করছে। সম্পূর্ণ ঘটনাটা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে দেখছে আবার দেখছে না! যদিও এসব অনেক আগেকার কথা। এখন আর রিলেট করা যায় না।
চলচ্চিত্রের উদ্দেশ্য বহুদর্শিতা! সম্পূর্ণ অন্যধারার একটা ছবির কথা বলি। ভারতীয় নৃত্যকে ভিত্তি করে উদয়শঙ্কর ১৯৪৮ সালে একটি ছবি করেছিলেন, নাম “কল্পনা”। নৃত্যই এখানে মূল চরিত্র। এ ছবিতে চিত্র প্রতিমা রুপান্তরিত হয় ছায়াপ্রতিমায়! উদয়শঙ্কর শুনেছি মঞ্চেও তা করতেন। সত্যজিৎ রায় স্বীকার করেছিলেন যে ছবিটি তিনি নিজে বহুবার দেখেছেন। মজার ব্যাপার হল যে এই রূপান্তরের কৌশলটি উদয়শঙ্করের মাথা থেকে নয়, বেরিয়েছিল তাঁরই বন্ধু জাদুসম্রাট পি সি সরকারের মাথা থেকে!
উপরোক্ত গল্পটি এটা বোঝাতেই বললাম যে Film is a magical art form… সবচেয়ে শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম! আত্মখনন এবং তার বহির্মুখী এক্সপ্রেশনকে প্যারালালি দেখাতে সাহিত্য কিছুটা পারে, কিন্তু সিনেমা পোটেনশিয়ালি এটা করে। ভবিষ্যতেও করবে।