ফাটা আয়নার মুখ – ময়ূরী মিত্র

ফাটা আয়নার মুখ – ময়ূরী মিত্র

শেয়ার করুন


ভোকাট্টা হয়ে ইতিউতি লাট খাচ্ছিলেন তাঁরা। সত্যি বলতে কি উনিশ শতকের বাঙালি ভদ্রলােকের গুণপনা ব্যাখ্যায় আর কোন্ উপমাই বা দেওয়া যায়! একদিকে শ্রেণি-পরিস্থিতি ও যুক্তিবাদের হিড়িকে পশ্চিমি সংস্কৃতি ও পরদেশি প্রশাসককে নিয়ে আদেখলাপনা, আরেক দিকে, বিশ্বাস ও আবেগের পীড়াপীড়িতে শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের বিরুদ্ধে নিয়ত চাপা ফুসফুস—দুইয়ের ঝাপটায় তখন বেহাল বাঙালি। স্বদেশচর্চার কচকচি তাই কেবলমাত্র সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার দেখনদারিতে। আর ভদ্রলােকের সংস্কৃতিচর্চা মানেই ছিল ইংরেজদের লগে লগে নিজেদেরকে আরও খানিক মাজাঘষা করে নেওয়া। জাতিগত আত্মপরিচয় এবং বৌদ্ধিক স্বকীয়তা বা অনুকরণধর্মিতা নিয়ে শাসক-শাসিতে লাগাতার সাংস্কৃতিক রাজনীতি চললেও বাঙালি মধ্যবিত্তের এই ইংরেজের কোলঘেঁষা সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদটি কিন্তু বেশ অনায়াসেই তাঁদের ব্রিটিশ আনুগত্যের সঙ্গে মিশ খেয়ে যাচ্ছিল। ভয়টা ছিল বিদ্রোহজাত স্বাধীনতা হয়তাে তাঁদের আর্থ-সামাজিক স্বস্তিতে টাল খাইয়ে দিতে পারে। নিজেদের এইসব অসঙ্গতিকে পাশ কাটাতে চটজলদি ব্রিটিশ প্রশাসন সম্পর্কে কতকগুলাে মিথ বা অতিকথাও তৈরি করে ফেললেন। যার মধ্যে ঔপনিবেশিকতার সবচেয়ে বড়ো জয়ের দ্যোতক ছিল এই মিথটি—‘ব্রিটিশ ভারতকে যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান, সাম্য, স্বাধীনতা, এমনকি জাতীয়তাবােধ শিক্ষা দিয়েছে, তার জ্ঞান ও মূল্যবােধকে উন্নত করেছে এবং বাঙালি ভদ্রজনে আধুনিক সংস্কৃতির ছোঁয়া এনেছে।’ তাে নিজেদেরকে এইভাবে বুঝ দিতে দিতেই বাঙালি ভদ্রলােক তৈরি করে ফেললেন নীলদর্পণ। রাজনৈতিক না হয়েও যেটি রাজনৈতিক প্রসঙ্গের নাটক।

সিপাহি বিদ্রোহ থেকে নীলবিদ্রোহ—ঢিল ছোঁড়া ব্যবধানেই কি তাহলে ঘটে গিয়েছিল ইংরেজ প্রশাসককে নিয়ে তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত ও সমুচিত ধৈর্যচ্যুতি? সন্দেহ নেই, ১৮৫৮-এ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে রানী ভিক্টোরিয়ার হাতে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের পর শাসনতান্ত্রিক পরিকাঠামাে থেকে শিক্ষিত বাঙালিদের দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছিল। তাই ১৮৫৮-তেই হরিশচন্দ্র মুখােপাধ্যায় তাঁর ‘Who Is To Blame’ প্রবন্ধে এইসময়ের দরকারি প্রশ্নগুলা করলেন। প্রশ্নগুলাে ছিল এইরকম—

এক) ইংরেজের প্রতি ভারতবাসীর অন্তরে সংগােপনে সঞ্চিত হচ্ছে ক্ষোভ ও ঘৃণা। এর জন্য দায়ী কে?

দুই) ভারতবর্ষে শাসক ও শাসিতের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ বিস্তৃত হচ্ছে। এর জন্য দায়ী কে?

তিন) ভারতে বর্তমান শাসকরা একদিন নর্ম্যানদের ঘৃণা করলেও এখন নিজেরাই ঘৃণার পাত্র। এর জন্য দায়ী কে?

‘The Future of Indian Government’ প্রবন্ধে হরিশচন্দ্র সােজাসাপটা বলেই দিলেন—

“The time is nearly come when all questions must be solved by the Indian.”

এবারে দেখি, নীলদর্পণ লেখার ঠিক আগে আগে নীলকরদের অত্যাচার নিয়ে কোলকাতায় কী কী ধরনের লেখাপত্র বের হচ্ছিল। নীলদৰ্পণের ঠিক বছর দুই আগে, সম্ভবত ঐ ১৮৫৮-এর শেষ দিকেই, হিন্দু পেট্রিয়ট প্রেস ‘বাপ রে বাপ নীলকরের কি অত্যাচার’ নামে একটি চটি বই বের করে—যেখানে এক শহুরে ভদ্রলােক ও এক কৃষকের আলাপচারিতায় দৃশ্যায়ত হয় কৃষক বিক্ষোভ। ত্রাস। নীলবিদ্রোহ নিয়ে হরিশের নিজস্ব লেখাপত্র তাে চলছিলই। এও দেখি আমরা হিন্দু পেট্রিয়টকে ঘিরে গ্রামবাংলায় সাংবাদিকদের আস্ত একখানা রেজিমেন্ট তখন মজুত হয়েছিল—যাঁদের মধ্যে ছিলেন যশােহরের শিশিরকুমার ঘােষ, মনােমােহন ঘােষ, কৃষ্ণনগরের দারােগা গিরিশচন্দ্র বসু, নদীয়া স্কুলের ডেপুটি ইনস্পেক্টর রাধিকাপ্রসন্ন মুখােপাধ্যায়। এমনকি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, যিনি কিনা ইতিমধ্যেই রাজভক্ত সম্পাদক হিসেবে একটুআধটু নামটাম করেছেন তিনিও মেদিনীপুরে কর্মরত রাজনারায়ণ বসুকে নীলকর ও নীলচাষ সংক্রান্ত যাবতীয় খবরাখবর সংবাদ প্রভাকরে পাঠাতে বললেন। আর ঠিক ১৮৫৯-এর মধ্যভাগে কোথায় না কোথায় ঘুরছেন নীলদর্পণের নাটককার দীনবন্ধু মিত্র। শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন—
“নিজে অনেক নীল প্রপীড়িত স্থান ভ্রমণ করিয়া প্রজাদের দুঃখ স্বচক্ষে দর্শন করিয়াছিলেন। সে সময় হিন্দু পেট্রিয়টের পৃষ্ঠায় হরিশচন্দ্র তাহাদের দুঃখের যে সকল চিত্র অঙ্কিত করিতেছিলেন, সে সকল চিত্রের অধিকাংশই দীনবন্ধুর নিজের পরীক্ষিত ছিল।”

সত্য—নীলবিদ্রোহের হামলায় বাঙালি ভদ্রলােক সমাজের মূল স্রোতের বাইরে থাকা মানুষের টানে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। হয়তাে খানিক থতমত খেয়েই দাঁড়িয়েছিলেন। হয়তাে খুব মনস্ক ছিল না সেই ঘুরে দাঁড়ানাে। কিন্তু দাঁড়িয়েছিলেন। আর এটাই ছিল নীলদর্পণের সবচেয়ে বড়ো জোরের জায়গা। প্রাণের জোর। অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ছিলেন না দীনবন্ধু। তবু তাঁর নীলদর্পণই প্রথমবার দেশের দরিদ্র মানুষের সঙ্গে মধ্যশ্রেণির অর্থনৈতিক স্বার্থের বন্ধন এবং উভয়ের এক সাধারণ অর্থনৈতিক শত্রু সম্বন্ধে ধারণা তৈরি করেছিল। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখানাে হয়েছে, নীলবিদ্রোহের কালে ব্রিটিশ-বাঙালি দুই তরফই জাতিবৈরিতায় প্ররােচিত হয়েছিল। এই জাতিবৈরিতায় তাৎক্ষণিক উত্তেজক নীলদর্পণ। সারা নাটক জুড়ে শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের অত্যাচারের কথা, ব্রিটিশ বিচারব্যবস্থাকে পালটা নাকানিচোবানি খাওয়ানাের জন্য নাটককারের মুখিয়ে থাকা—এই সবকিছুই খুব জুতসইভাবে এক ধরনের জাতিবৈরিতার জন্ম দিয়েছিল। অভিজ্ঞতার তীব্রতায় ভিন্নতা থাকলেও এই জাতিবৈরিতাই যে ভারতীয় রাজনীতিতে প্রথমবার নিম্নবিত্তের সঙ্গে ভদ্রলােকদের মজিয়ে দিয়েছিল নীলদর্পণে তা স্পষ্ট। ব্রিটিশ-ভারতীয়ে পারস্পরিক এই বিরাগ অবশ্যই উপনিবেশ বিরােধিতা নয়। কিন্তু নতুন রাজনৈতিক সময় ও পরিবেশে জাতিগত শত্রুতাই যে উপনিবেশ বিরােধিতায় ক্ষুরধার হয়ে উঠতে পারে, অন্তত ওঠার সম্ভাবনা রাখে তা কে অস্বীকার করতে পারে? কোনাে না কোনাে ভাবে নাটককার বুঝতে বা বােঝাতে পেরেছিলেন, উপনিবেশে জাতিভিত্তিক নিপীড়নে ব্রিটিশ উদারনীতিও অনভিপ্রেত ঠেকতে বাধ্য।

ঠাটেবাটে বাঙালি ভদ্রলােকের দর্পণখানি ঝিকিয়ে উঠল। আক্রমণ এখানে খােদ বিদেশি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতির বিরুদ্ধে—অর্থাৎ ঔপনিবেশিকতার মৌলিক ভিতটারই বিরুদ্ধে। অথচ নীলদর্পণ সামাল দেওয়ার ব্যাপারে ঔপনিবেশিক সরকারের এক অংশের কোনােরকম হেলদোল নেই। নাটকটি নিষিদ্ধ করা তাে দূর অস্ত, উলটে প্রশাসনের একপক্ষের উদ্যোগ ও খরচেই ঘটে গেল ইংরেজি নীলদর্পণের প্রকাশ এবং আন্তর্জাতিক মহলে তার উপস্থাপনা। তাও আবার বঙ্গীয় সরকারের সেক্রেটারির স্বাক্ষর সিলমােহর সহযােগে। নীলদর্পণের প্রতি প্রশাসনিক কর্তাদের একপক্ষের টানটি যে কতদূর টানটান হয়ে উঠেছিল তা ধরতে পারি লন্ডনের পেরেন্ট কমিটিকে লেখা জেমস লঙের একটি চিঠিতে। ১৮৬১-এর ১৫ আগষ্ট পাঠানাে এই চিঠিটায় লঙসাহেব লিখছেন, “বিচারের সময় যা সম্মান এবং সত্যবাদিতার কারণে প্রকাশ করতে পারিনি, এখন তা বলতে পারি—আমি এ বই সম্পাদনার এবং এটা অনুবাদ করার জন্য একজন অনুবাদক নিয়ােগের কাজ করেছিলাম সরকারের সচিবের পক্ষ থেকে।”

নীলকমিশনের সভাপতি ও বাংলার সচিব ডব্লু এস. সিটনকার, স্যার রিচার্ড টেম্পল, রেভারেন্ড জে সেল—প্রশাসক মহলের বহু ইংরেজ কর্মচারী ও জেলাশাসকরা প্রকাশ্যে নীলকুঠিয়ালদের অত্যাচারের কাহিনির নিন্দা করলেন। শুধু তাই নয় বােম্বাইয়ের মতাে শহরে নাটকটির মঞ্চায়নেও কোনো বিধিনিষেধ আনা হল না। ১৮৬১-এর ৫ সেপ্টেম্বরের হিন্দু পেট্রিয়ট থেকে অন্তত এইরকমই তথ্য পাই আমরা। এবার ১৮৬২-এর ১৪ এপ্রিলের সােম প্রকাশ। জানা যাচ্ছে, নীলদর্পণ মামলায় বাঙালিদের প্রতি মরডান্ট সাহেবের কটূক্তির বিষয় কোলকাতার ভদ্রলােকরা স্টেট সেক্রেটারির গােচরে আনলে স্বয়ং চার্লস উড স্বজাতীয় বিচারকটিকে রীতিমতো ধমকেছিলেন। অন্যদিকে ব্রিটিশ প্রশাসকদের বিরুদ্ধে নীলকরদের গজগজানিও আড়ালে থাকেনি আর। সমস্ত ঘটনাটার জবাবদিহি চেয়ে ব্রিটিশ ভারতের জমিদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সেক্রেটারি মি. ফার্গুসন একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠিটির উল্লেখযােগ্য অংশ—

“It has been done without the sanction or knowledge of the Government of Bengal the committee will expect formal and official
disavowal of the proceeding and that the names of the parties who have thus made use of the name and means of the Goverment to circulate a foul and malicious libel on Indigo Planters, tending to excite sedition and breaches of the peace, be given to us in order that they may be prosecuted with the utmost rigour of the law.”

বলাবাহুল্য ফার্গুসনের চিঠিটির যে উত্তর বাংলা সরকারের তরফ থেকে দেওয়া হয়েছিল তা নীলকর বণিকসভার না-পসন্দ ছিল।

কেন এই উলোটপুরাণ? কেনই বা বাঙালির প্রথম রাজনৈতিক নাটক ঘিরে দমকা লড়াই শুরু হল ব্রিটিশ জাতির অভ্যন্তরে? আসলে লড়াইটা ছিল একই ব্রিটিশ জাতির দুটি ভিন্নমুখী বাণিজ্যদর্শন ও অর্থনীতির ফারাকে। একদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের সমর্থক রক্ষণশীল বর্ণবাদী ইংরেজ, অন্যদিকে অবাধ বাণিজ্যের সমর্থক উদার ইংরেজ—সংক্ষেপে ছােটো ইংরেজ ও বড়ো ইংরেজ। ১৮২৯-এ লন্ডনে A view of the Present State and Future Prospects of the Free Trade and Colonization- এ পরিষ্কার হয়েছিল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার থেকে সাধারণ ইওরােপীয়রা বঞ্চিত হওয়াতে যুক্তি, সাধারণ বােধ এবং বিজ্ঞানের সূত্র সমস্ত কিছুকেই হেলাফেলা করা হয়েছে। ১৮২৯-এ লন্ডন থেকে প্রকাশিত Asiatic Journal জানাচ্ছে, বিশপ হেবার নাকি একটি গােপন পত্রে জানিয়েছিলেন, নীলকুঠির সাহেবদের কাণ্ডকারখানা ইংরেজ জাতের মুখে কালি মাখাচ্ছে। সেই সঙ্গে এও জানাতে ভােলেননি এদের ধরে ধরে সাগরপারে চালান করার অধিকার স্থানীয় গভর্নমেন্টের হাতে থাকা খুবই জরুরি। বড়ো ইংরেজ আর ছােটো ইংরেজদের মধ্যে রাজনৈতিক ভেদরেখা টানার কাজ বােধহয় তখন থেকেই।

গল্পের শুরু আবার ১৮৫০-এ। দেখতে পাই শিল্পপুঁজির প্রতিনিধিদের স্বার্থে ও বাণিজ্যপুঁজির প্রতিনিধিদের কোলকুঁজো করার জন্য ব্রিটেনের পার্লামেন্টে একটার পর একটা আইন পাশ হয়ে চলেছে। নিজেদের মধ্যে এফোঁড়-ওফোঁড় আক্রমণে পলকা হয়ে যাচ্ছে ইংল্যান্ডীয় জাতিবন্ধন। এরপর ১৮৫৮-এর প্রশাসনিক রদবদল। সাগরপারের ঝড়ের হুটোপাটি এবার উপনিবেশে। শিল্পপুঁজির অবাধ ক্রিয়াকে যথেষ্ট লম্বা করার জন্য ভারতবর্ষেও তড়িঘড়ি খোঁজা হতে থাকে নীলকরদের ঠাঁইনাড়া করার একটি বুদ্ধিগ্ৰাহ্য ছক। আর এই উদ্যোগের হাতিয়ার হয়ে গেল নীলদর্পণ। সেদিন ইংরেজ সমাজের টানাপােড়েনের খেসারত দিতে হয়েছিল দীনবন্ধুর নাটকটিকে।

তখনও পর্যন্ত দীনবন্ধুরা বুঝি বুঝে উঠতে পারেননি উদারনীতি ও প্রতিক্রিয়ার তফাত নিয়ে যতই মাতামাতি হােক না কেন আসলে দুইই হল একই সাম্রাজ্যবাদের দুই আলাদা প্রকাশভঙ্গি। তাই রাজনৈতিক চিন্তায়-দর্শনে, অর্থনৈতিক সুবিধে-অসুবিধের প্রশ্নে যখন সরাসরি গােল বাঁধছে ব্রিটিশ প্রশাসন ও নীলকরদের মধ্যে ঠিক তখনই দীনবন্ধুর মতাে নিপাট ভদ্রজনরা প্রায় কচিকাঁচার সারল্যে ভেবে বসেছিলেন, এদেশের বর্ণবাদী অত্যাচারী নীলকররা হলেন ছােটো ইংরেজ আর ইংল্যান্ডের গণতন্ত্রপ্রেমী ইংরেজরা হলেন বড়ো ইংরেজ। গল্পটিকে সাজিয়ে দিলেন সেইভাবে। সাধারণ-বিশেষ, ভালাে-খারাপ ইংরেজের গুঁতোগুঁতি জমিয়েই। এক নির্ভেজাল নির্ভরতায় বড়ো ইংরেজের সহজাত উদারনীতির কাছে জানালেন তাঁর সদিচ্ছা। ন্যূনতম কিছু রাজনৈতিক সংস্কার যা কিনা অন্তত তাঁর মতে ছােটো ইংরেজকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে।

বাঙালির বিশ্বাস অর্জনে ভালাে ইংরেজের সহায় হল নীলদর্পণ। পশ্চিমবঙ্গ লেখ্যাগার থেকে প্রাপ্ত সরকারি নথি বলছে—সাধারণ কৃষকদের ফাটাফাটি প্রতিক্রিয়ায় বিমূঢ় বাংলার ছােটোলাট কৃষকদের আনুগত্য ফিরে পেতে কতখানি ব্যস্ত হয়েছিলেন। অতএব পড়ি কি মরি করে ভিড়ে পড়া যাক নীলদর্পণ নিয়ে বাঙালির অনুভূতিতে। অস্ত্রটি বরং বাগিয়ে ধরা হােক কেবল নীলকরদের বিরুদ্ধে। দর্পণের ফাঁকে বঙ্গবাসীর বিরুদ্ধে নিজেদের আদত মন ও আগামী কারিকুরিটি সাময়িক গুটিয়ে রেখে ভালাে ইংরেজ হিসেবে কিছুটা ধোপদুরস্ত হতে উদ্যোগী থাকলেন প্রশাসকদের এক মহল। নীলদর্পণ নিয়ে বাঙালি ভদ্রলােকের সঙ্গে প্রশাসনের লড়াইয়ের আপাত বিরতি।

ভদ্রলােক বাঙালির এই থুম হয়ে থাকা থকথকে রাজনীতিচর্চার ব্যাখ্যায়ন নিয়ে ঘাের তর্ক হতেই পারে। ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় বিভ্রান্ত ভদ্রলােকেরা দেশভক্তির এতটুকু পরিমাণকেই হয়তাে ধার্য করে রাখছিলেন। ধার্য করে রাখছিলেন তখনকার মতাে। তবে এ অবশ্যই বলব, সে সময়ের নাটককারদের এই আধাখ্যাঁচড়া রাজনৈতিক হয়ে থাকার সংকল্পে তাঁরা যত না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন তার থেকেও বেশি সমর্থ হয়ে উঠছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। প্রশাসন কিছু বাড়তি সময় চাইছিল। নাটকটি নিষিদ্ধকরণে ইচ্ছেকৃত ঢিলেমি করে ভালাে-খারাপি ইংরেজের গােলকধাঁধায় আরও খানিক জড়িয়ে রাখতে চাইছিল। সাম্রাজ্যবাদের খেলনাপাতিগুলাে আরও তকতকে করার অপেক্ষায় তখন ইংরেজকুল। তাই ১৮৭২ থেকে সাধারণ রঙ্গালয়ে নীলদর্পণের নিয়মিত অভিনয় শুরু হয়ে গেলেও আলটপকা ক’দাগ কাটছাঁট ছাড়া আর কিছুই করল না সরকার। ১৮৭৬-এর নাট্যনিয়ন্ত্রণেও নীলদর্পণ নজর-আন্দাজ। পিছলোতে পিছলােতে শেষমেশ ১৯০৮-এ নীলদর্পণের নিষিদ্ধকরণ প্রশাসক মহলের এই অকথিত ওপরচালাকিকেই দেগে দেয়। বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর পর্যটনলিপিতে লিখছেন—

“In 1899 when I was in Ispahan in Persia (Iran), Rev. Edward Stewart, then much advanced in years, was the Bishop of Ispahan he used to tell me how he and Rev. James Long suffered for the peasants in the great indigo Planters case. He told me that every incident in Dinobandhu’s Nil Darpan was true and correct.”

সূত্র:–

১. অনুরাধা রায়, ‘বাঙালি বুদ্ধিজীবীর চোখে ব্রিটিশ শাসন’, উনিশ শতকের বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতি, স. স্বপন বসু ও ইন্দ্রজিত চৌধুরী

২. Nares Chandra Sen Gupta ed- Selections from the writings of Hurrish Chunder Mookerji, compiled from the Hindu Patriot

৩. গােলাম মুরশিদ, আশার ছলনে ভুলি

৪.পশ্চিমবঙ্গ লেখ্যাগার থেকে প্রাপ্ত তথ্য

ক) বিচারবিভাগ, সেপ্টেম্বর ১৮৬০, ক্রমিক সংখ্যা: ২২৪-২২৮
খ) বিচারবিভাগ, সেপ্টেম্বর ১৮৬১, ক্রমিক সংখ্যা: ৬৯

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২