ঘুণমাটি – বনমালী মাল (পর্ব – ১)
।।১।।
‘আরেকটু বৃষ্টি ছড়িয়ে দাও। হ্যাঁ হ্যাঁ ওখানটায়। ওদিকটাতে না। দরকার না থাকলে দেবে কেনো? শস্যগুলো জল খাচ্ছে। ব্যাঘাত ঘটিও না। নদীর গলায় মালা নিবেদনের দিন কাল। জুতোগুলো খুলে ফেলুন। কাঁটা নেই, মায়া আছে। মায়েরা সব শূন্যে বসুন। এখনি মাথায় আসন বিছিয়ে দেওয়া হবে। এইযে, তুমি গিয়ে এখনই সুখ-কে ধরে নিয়ে এসো। চাবুক লাগাও দশ ঘা। খড়ের চাবুক। ওই সদ্য বিধবার সামনেই। তার সাহস হয় কী করে, ওকে না জানিয়ে চলে যাওয়ার? চামড়ার বেশ অভাব। সত্যি! এ তো ভাবনার বিষয়! ভাই তুমি বস। তোমার ব্যবসা আবার ফুলবে। প্রয়োজনে আকাশ থেকে কিছুটা চামড়া খুলে তোমায় দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। দিনের শেষ অবসরে সূর্যকে কান ধরে ওঠবোস করিয়ে নেওয়া হবে, সে কেন মেঘেদের প্রশ্রয় দেয় এত? চাঁদকে কাল আট ঘটিকায় আকাশে থাকতেই হবে সন্ধ্যাতারার পাশে। কবি রচনা করবেন মহাকাব্য। চাঁদকে আমি চিঠি লিখেছি, সন্ধ্যাতারাকেও রুমাল সংকেত পাঠানো হয়েছে। ওরা কাল থাকবেই পাশে কাছে গর্ব ভুলে গ্লানি মুছে। নন্দবাবাকে আমি কথা দিয়েছি, আমি যেদিন ‘আমি’ থাকবো না, ওই শিশুটির সুন্দর ঠোঁটের লালা হয়ে আমি ঝরে যাবো ওর অজান্তে। এই শুনে বাবা বাঁজা আমগাছের মুকুল হয়ে থেকে গেল। নন্দবাবা –’
বিকেলের শেষ আলোর সবটুকু ঝরিয়ে বকুল গাছটা অন্ধকার হয়ে আছে। দুটো কুকুর কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে খুনসুটির অপেক্ষায়। বকুল গাছের ছায়া মরে যাচ্ছে লেজ আর কুয়াশাচ্ছন্ন নাকের ফুটো পেরিয়ে ধবধবে হাসি ফোটানো সংকীর্ণ মাটির রাস্তায়। গাছটিকে বামহাতে একটু ছুঁয়ে কিংবা আদর করে কেউ একটু এগোলেই দেখতে পাবে, সামনে শুয়ে আছে এলানো মাঠ। হাত পা ছড়িয়ে পরিশ্রান্ত কর্মী। রামচকের এই ঘোড়া মাঠ অসংখ্য ঝাউগাছ নিয়ে সংসার পেতে আছে। ওরা কানাকানি করে। ঘুসোঘুসি। লোকের আড়ালে। বায়ু কোণের মাঠ মাথা উঁচিয়ে যেন দৃষ্টি রেখেছে গাছেদের প্রতি। বকুল তার প্রিয়।
এক ফালি মেঘ আকাশের গলা চেপে বসে আছে। কেউ মনে করতে পারে না কত আগের একদিনে, এক বিষন্ন, মাঠে ফসল পড়ে থাকা সকালে গলায় শালুক ফুলের মালা আর সিঁদুর-চন্দন কপালে মাখানো এক সাদা ঘোড়া এসে মুখ থুবড়ে পড়ে রামচকের এই খোলা মাঠে। লেজের কালো গোছা যেন এখুনি কোনো রাণীর হাতে ধোয়া হবে। আতুর। তার বাকি সারা শরীরে ক্লান্ত মুখ ফুটে আছে। ক্ষতের এমন রূপ রামচকের কেউ কোনোদিন দেখেনি। মুখে এখন তার গাঁজলা। মাটি ভিজে যাচ্ছে। আর এগোতে গেলেই পা পিছলে যাবে। সামনের দুটো হাঁটু বিঁধে আছে রামচকের খোলা মাঠে। পেছনের দুটো পা এইমাত্র নিঃশব্দে ভেঙে শরীরটাকে আছাড় দিল। সেইসময় নাকি একটা কুকুর সামনে দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে হাই তুলেছিল। রামচকের মানুষ সেদিন ভেবেছিল, লোভ আর বীর্য যেখানে শেষ, সেখানেই হোক পবিত্র প্রস্তুতির মুহূর্ত। সেই থেকে শুরু। আজ অব্দি রামচক গ্রামের প্রতি সভা হয় এই ঘোড়া মাঠেই। প্রতি সিদ্ধান্ত আর পরামর্শের শেষ চূড়া দাঁড়িয়ে থাকে লোভ আর বীর্যের শীতল মৃত্যুর উপর।
রাজার মত বসে আছে একজন। সবার সঙ্গে। বেশভূষা সবার মত। গোঁফ সুগঠিত। দাঁড়ি বলতে দু’ চার গাছি চুলের যত্ন। বেঁটে চেহারা। বসে আছে তাই, আর গম্ভীর মুখের জন্য বয়স ঠিক ঠিক আন্দাজ করা সহজ নয়। ধবধবে ফরসা মুখ আর চেহারা। যখন গোধূলি, সূর্যকে পেছনে ফেলে, সে বলে চলছে –
‘নন্দবাবা এক ঝুঁকে পড়া সন্ধ্যায় তার পিঠ কাঠসোজা করে আমাকে বলেছিল গ্রামের কোনো বিড়ালই নাকি কাঁদা-কাটি করলেও এখন আর ঢিল ছোঁড়া খায় না। বলতে বলতে নন্দবাবার মুখ সেই পোয়াতি অন্ধকারের যন্ত্রণায়ও না কুঁকড়ে প্রসারিত হয়ে বয়ে গিয়েছিল কুঁরগি ডাঙার রোগা নদীটির দিকে।’
বক্তা বসে আছে এক-গ্রাম পুরুষ মহিলা যুবক যুবতী শিশুর পাতা কোলে। তাকে মধ্যমণি করে রামচক গ্রামের অধিবাসীরা সূর্য ওঠায় নামায়। চাঁদকে ছোটো বড়ো করে। তারাদের আদেশ দেয়। বাতাসের গতি পাল্টে খোলা মাঠের ঝাউ বকুল আর কুঁরগি ডাঙার লম্বা ধারালো ঘাসগুলোয় তড়িৎ খেলায়। রামচকের কাছে টেনেটুনে এই একটাই বলাই। মাথায় ঘন চুল। সামনের কয়েকটা চুল পাকা হাতে ওর বয়স বুঝিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছে। তার সৌম্য স্বরে ওঠানামা করছে আদেশ নির্দেশ পরামর্শ। তার চোখের আর মনের পোক্ত ভালোবাসার গায়ে সবাই গা ঘষেছে বারবার। এই গ্রাম তার একার নয়। আরো গুছিয়ে বললে দাঁড়ায়, বরং এই গ্রামের সে অনেককিছু।
।।২।।
রামচক গ্রামে সবার হাত পা মুখ, একটা মাথাও আছে। তারা সবাই তাই মানুষ। বাঁশকঞ্চি কিংবা বাঁশের ছাল দিয়ে তৈরি ঝুড়ি বোনার দু’ চার ঘরের মাঝে মাটির পাত্র গড়তে পারা একঘর। শুকনো কাঠের ঠকাঠক শব্দ ওঠে কিছু ঘর থেকে। দিনের পর দিন মন আর প্রয়োজনের ছাঁচ মিলিয়ে গড়ে ওঠে আসবাব। মাঝে মাঝে কাঠের নরম অংশের বিঁধ ছেড়ে উঠে আসে ভেজা গোপন গন্ধ। পতাকাহীন রথহীন একই সূর্যকে দেখে প্রণাম করে তারা, গালিও দেয় পাশাপাশি ব’সে। মেজাজি রোদের তাতে মাটির কাঁচা পাত্র অকালে মৃত হলে দু’ দশ ঘর চাষী যারা সংখ্যায় আকাশ হয়ে আছে, দাঁতের পাটি চেপে ধরে জিভের সামনের দিকটা ঘষে ঘষে ‘এটা খুব খারাপ হল’ এমন ভাবের শব্দ তোলে।
কুঁরগি বেড়ে আছে রামচক। গ্রামের মাঝামাঝি কোনো একটা ঝাউগাছ চোখগুলো ঘোলাটে করে তাকে অরক্ষণীয়া ভাবতে পারে। যে আলগা কুঁরগি একটা ঢেউ খেলানো শাড়ি পরে সারাক্ষণ কথা বলতে পারে–দোষ ঢাকতে কিংবা লুকোনো শিশির দেখাতে। সারা বছর জল ধরে রাখতে পারার গর্বে অনেক কথা জমে ওঠে তার বুকে। চিৎকার করে না শুধু রামচকের পরনে সাদা দাগহীন কাপড়ের জন্য। সে কথা জানে ন্যাতানো জ্যোৎস্না আর দিনরাত তার বুকে সুড়সুড়ি দেওয়া সাদা ধবধবে রাজহাঁসগুলো।
।।৩।।
এখন বর্ষা। বৃষ্টি বললে অনেক কিছু বলা হয়। আকাশের কানা চোখ বেয়ে অবিরাম জল বৃষ্টি হয়ে নামলে রামচক নিজেকে সামাল দিতে বাঁশের মাথার দুলুনি হয়ে যায়। কুঁরগি আরো মোটা হয়। স্থূল দেহ দেখে এগিয়ে যায় কুঁরগির ডাঙা। বেনা ঘাস চেপে ধরে আঁকড়ে আছে এমন সতীও পা পা হেঁটে চলে কুঁরগির সোহাগে। সে ক্রমে রূপ ঝলমলে দেবফল হয়ে দেখা দেয় রামচকের আয়নায়। এক একটা রাজহাঁস, মূর্তিমান পুরুষ হয়ে ঘোড়ায় চড়ার ভঙ্গিতে একটা একটা ঢেউ ভাঙে। নিজের আকারের উপত্যকা বানায়। আবার ঢেউ তোলে। রামচক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। নন্দবাবা দেখে। বলাইও। সামনের কয়েকটা সাদা চুল বাতাসে উড়তে দিয়ে নিশ্চিন্ত সে। যেন অমলিন লীলা তাকে মুগ্ধ করছে। কবিও আছে আলুথালু ভাবনায়। এমন অবাধ মনোহর চালচিত্র দেখে কোনোদিন রামচক বমি করেনি। চোখে হাত চাপা দিয়ে বিধান চায়নি। যা স্বাভাবিক, তাকে চোখ কানের সামনে পেতে তারা ঝুলন্ত মেঘ হয়ে থাকে। এইসব বিশ্বাসকে বিশ্বাস করার জোরেই বৃষ্টি আসে রামচকে। ঘাসের ডগা মোলায়েম হয়। পরিচ্ছন্ন সংসার গড়ে ওঠে।
এক কিশোরী মূর্তির ছায়া কেঁপে উঠে মিলিয়ে যায় কুঁরগির জলে। কবি আনমনা হয়ে ভাবছে এই বেনা ঘাসগুলোও কীভাবে লম্বা হওয়ার স্পর্ধা সঞ্চয় করছে। ওই কিশোরী মূর্তির ছায়া ধরে একদিন এরাও তার ভাবনায় আসন পাতবে।
‘কী কবি মশাই! কী ভাবনা চলছে?’ – কবির পিঠে সহাস্য হাত বলাইয়ের। নন্দবাবা এতক্ষণে ঝুঁকে ঝুঁকে দুজনের সমান ছায়া ফেলেছে কুঁরগিতে। ভাবনার পিঠে যেন কেউ কত সহজে পূর্ণচ্ছেদ এঁকে দিল। –‘চপলার কথা।’ অমলিন একটা হাসির সঙ্গে চোখে বিষন্নতার ছবি এখনও এঁকে চলেছে কবি। চপলা ছাড়িয়ে সে এখন তীক্ষ্ম স্রোতের সামনে হাঁ করে একটা সাদা বিড়ালের ধ্রুবতারা চেয়ে থাকার মুহূর্ত কল্পনা করে। তলপেটে জল লাগছে। হিম হয়ে আসছে সারা শরীর। বিড়ালটা এখুনি দু’ হাত ছড়িয়ে বুক আলগা করবে। ছেয়ে যাবে পলাশ আর মেঘবিছানার মৃদু আলো। ধীরে ধীরে জলের ছোঁয়া ছেড়ে পাড়ে এসে বসবে, জিরোবে আর মনের কোথাও রেখে যাবে জলের পাথরমূর্তি। ক্ষয় নেই কিংবা মৃত্যুর জীবনদাতা সে।
চপলা এখন কিশোরী। বছর দুই পর সে যুবতী হবে, নাকি পোয়াতি সেকথা ভেবে রামচকের কেউ মাথা খাটায় না। মূল মাটির অনেক গভীরে ছড়িয়ে থাকলেও রামচকের অধিবাসীরা ফুল নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি করে না। তাদের কাছে কাণ্ডের সোজা নীরোগ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটাই চিলেকোঠার মত সহজ অথচ অপ্রচারিত সত্য। চপলা দৃষ্টি ছাড়িয়ে দৃষ্টি ভেদ করতে পারে না। মায়াময় চোখে বাড়ির সামনের কালাচের পেটের মত মৃদু সাদা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রতি বিকেলে কবি দেখে আনমনা চপলা মায়াময় বিকেলের সব মায়াটুকু ছেনে সন্ধ্যাতারার একাকিত্ব নিয়ে বসে আছে। পরনে গোলাপী ফ্রক ওড়না বিহীন। উন্মুক্ত হাঁটু ঝুলে আছে উঠোনের সিঁড়িতে।
(ক্রমশ)
অসাধারণ একটা শুরু। কখনো কখনো মনে হচ্ছে কাব্যোপন্যাস পড়ছি। কখনো আবার গদ্যের রোদে ডানা মেলে উড়ছি আমি। এভাবে উড়তে উড়তে লৌকিক স্তরে ঘুরে ফিরে এলাম নিজের কাছে। কুয়াশাচ্ছন্নতা তোমার লেখার একটা বৈশিষ্ট্য সেটা বুঝি। তবে তোমাকে একটা সমালোচনা না করে থাকব না— ক্রিয়াপদের ব্যবহারে আরও একটু সচেতন হতে পারো তাহলে দেখবে তোমার গদ্যে কবিতার আঁচ থাকলেও তোমাকে কেউ বলতে পারবে না যে, তোমার গদ্য কবিতার মতো। এই উপন্যাসে ভাষার খোলস আর কাহিনির বহুবিস্তার প্রথম পর্বেই আমাকে খুব আকর্ষণ করল। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।