আত্মহত্যা – বনমালী মাল

আত্মহত্যা – বনমালী মাল

শেয়ার করুন

বছর দুয়েক আগেই। শুকনো বাঁশপাতায় ভর্তি জায়গাটা মাড়িয়ে যেতে যেতে কমল দেখল, তার বাঁ পাশের হাত খানেক দূর দিয়ে কী একটা সোঁ করে চলে গেল।
‘গেল ত গেল…’
‘কী দরকার ছিল, আগ বাড়িয়ে তার পথ আটকানার?’
কমল শুধু পথে বেড়ি দিয়েই ক্ষান্ত হল না, যখন জানতে পারল, তার সম্মুখে সাক্ষাৎ মৃত্যু বুক বেয়ে শীতল রাগ দেখাচ্ছে, তার দিকে এগিয়েই গেল সে।
কী অলক্ষুণে চিন্তা কমলের!
‘মরার সাধ হছে নাকি লোকটার!’
একটু দূর আড়ালে শৌচ করতে করতে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে মৃদুল।
মনে হয় কালাচ!
এখানে গোপন কর্মটি করতে এসে মৃদুল গোপনেই থেকে যেতে চায়। দেখতে চায় কমলের আগাগোড়া পাগলামি। পা বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছোবল খেল লোকটা। ছোবল মারতে দিল।

রে রে পড়ে গেল গোটা পাড়ায়। কমলকে সাপে কামড়েছে। কমল নিজে দেখেছে, কালাচ। অন্ধকার দেখতে শুরু করার আগেই কমলকে তোড়জোড় করে নিয়ে যাওয়া হল পীতপুরে। জোড়া সিরাম পড়ল। সুজাতা কেঁদে নিল একচোট। আবার কাঁদবে হয়তো। স্বামীকে বাঁচানোর তাগিদটা তারই বেশি। এরপর নিজে হাতে সংসার টানা সম্ভব নয় যে। একটা বছর পাঁচেকের ছেলে যার ভবিষ্যত উজ্জ্বল হবেই, ভেবে নিয়েছিল দুজনেই। পাড়ার লোকে হিংসা করলেও, সমীহ করে অনেকটা। এসব কমলের জন্যই। প্রথমে কালাচের সঙ্গে খেলা করে তারপর টানা দু’দিন কালাচের বিষের সঙ্গে যুদ্ধ করে কমল ঘরে ফিরল। সুজাতা সিঁদুর পরল মোটা করে। দুপুর আর রাতে পালা করে কতগুলো মেনু দিয়ে রান্না করল। আর সবশেষে পাড়ার সবথেকে জাগ্রত শ্যামসুন্দরের মূর্তিতে মালা দিল জন্মাষ্টমীর পুণ্যলগ্নে। পাড়া খাওয়ানো হল ধুম করে। অপঘাতে এমন অকালে মানুষটা চলে গেলে খুব ক্ষতি হয়ে যেত যে!

পীতপুর হাসপাতাল থেকে ফিরে কমল দু’ দণ্ড জিরোবার নাম করে সর্বক্ষণ ভেবে যেতে লাগল মৃদুলের কথা।
মৃদুলের সঙ্গে একবার দেখা করা উচিত।
জ্ঞান হারিয়ে যাওয়ার আগে অব্দি সে মনে করতে পারছে, মৃদুলই তাকে ওই বাঁশের জঙ্গল থেকে তুলে নিয়ে পাড়ায় এসেছিল। মানে, মৃদুল হয়তো আগাগোড়া সবই দেখেছে। হয়তো কেন? নিশ্চই দেখেছে। অতএব মৃদুল কাউকে কিছু বলার আগে ওর সঙ্গে বোঝাপড়া করে নেওয়া দরকার।

—তুমি কী গ! মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি!

মৃদুল কমলের থেকে বয়সে ছোটো। বছর পাঁচেকের। কমলকে সে মানে, শ্রদ্ধা করে। কমলের পেশাগত সাফল্য পাড়ায় গ্রামে যেমনভাবে সজনে ফুল ছড়ায় তেমন আনন্দ মৃদুলেরও ছিল। একটা গর্বও ছিল বৈকি। সেই মৃদুল যখন সেদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষটাকে এমন একটা ঘটনা ঘটাতে দেখল, তখন থেকেই তার মনে কমলের মানসিক অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে। এখন কমলকে দেখতে পেয়েই তাই ঝোঁকের বশে পরপর এতগুলো কথা বলে ফেলল। কমল মৃদুলের কাছে বসে। চোখে চোখে মৃদুলের কাছে মিনতি জানায়।
‘কালাচ তাকে কামড়েছে। অসাবধানতা বশত পা পড়ে যায় তার গায়ে।’

সেই বছর দুয়েক আগে থেকেই এরকম ছোটোখাটো নানা চেষ্টা কমল করে যাচ্ছে। আত্মহত্যা করার। একটি নামী কলেজে অধ্যাপনা করে সে। মাইনে ভালো। নিজে দেখেশুনে বউ করেছে। ঘরের লোক আপত্তি করেনি। যদিও ঘরের লোক বলতে কাকা কাকিমা। হাঁড়িগত দিক থেকে ভিন থাকে কিন্তু যোগাযোগ আছেই। নিজের বলতে এরাই। বাবা মা অনেকদিন আগেই মারা গেছে কমলের। এতদিন নিজেই নিজেকে যত্ন করেছে কিংবা বলা ভালো নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলেছে। সমাজের কাছে নিজের পেশার কাছে আর সর্বোপরি নিজের বউ বাচ্চার কাছে নিজেকে উঁচু করে রাখার একটা প্যাশন কমলের ছিল। আছে। হয়তো সেই জন্যই কলেজের চাকরিটা সে মুঠোর মধ্যে আনতে পেরেছে।

এখনও একা থাকলে কমল সেই সন্ধ্যার কথা মনে করে, যেদিন সে চাকরির খবরটা পেয়েছিল। প্রথমে কাউকে জানায়নি। একলা বাতাস আর ধান কেটে নেওয়া মাঠের সঙ্গে কিছুটা সময় বইয়ে দিতে চেয়েছিল। এই চাকরির আকালে নিজেকে সে মোটেই ভাগ্যবান মনে করেনি। বরং নিজেকে যে সে যোগ্য মনে করত, যোগ্য দেখাত, আজ সেটা মনে মনে লালন করছে।
অমৃত বাবুও আমাকে এখন থেকে বাবু বলবে।
চাঁদ যেভাবে ভূগোল পেরিয়ে সাহিত্যে সুন্দর হয়েছে, সেও হবে।
জ্যোৎস্নার কমনীয়তা একা কেবল তারই প্রাপ্য।
মাঠ আর আকাশ ছাড়িয়ে সে যেন হেঁটেই চলেছে। তার হাঁটার ভঙ্গিটাও পালটে গেছে। তারই অজান্তে।

কলেজেও কারো সঙ্গে দৈবাৎ কথা বলত।
অমুকের থেকে আমি যোগ্য
তমুক কোনোভাবেই এই চাকরির যোগ্য নয়
অহংকারী সে কখনোই ছিল না। নিজের জায়গাকে শক্ত করে নিজে বোঝার চেষ্টা করত, আর কতখানি গ্রহণ করার ক্ষমতা তার মধ্যে আছে কিংবা কোন্ কোন্ জায়গাগুলো তাকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। নিজেকে একটা সুপিরিয়র পজিশনে বিলং করানোর এই ধাত ক্রমশ বেড়েই চলতে থাকে।

কমল যা মাইনে পায়, অবাধে একটা ফ্ল্যাট নিতে পারে মহানগরের বুকে। একটা স্বচ্ছল জীবনযাপন করতে পারত সে। এই অজ পাড়াগাঁয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। কিন্তু সে থাকে। থাকে কেবল পরিচিত একটা জগৎ তাকে সম্মান করবে বলে। নগরে সে সুবিধা নেই। পাড়ার যারা তাকে এতদিন সাধারণ বলে ভেবে এসেছে, তারা তাকে বাবু বলবে, স্যার বলবে, তাদের কথা বলার ভঙ্গি বদলে যাবে—এই মোহ কমল হয়তো কোনোদিন ত্যাগ করতে পারবে না।

কিন্তু বছর দুয়েক আগে থেকে কমলের আচরণ তার নিজের কাছেই অস্বাভাবিক ঠেকছে। কমল এতদূর আসতে পেরেছে বোধহয় তার একটা বিরোধী গুণ আছে বলেই। আত্মপক্ষ সমর্থনের পাশাপাশি নিজেকে সামনে বা পেছন থেকে খুঁটিয়ে সমালোচনা করতে পারে। নিজের চরিত্রে একটা বদ অভ্যাস লক্ষ করছে সে। যখন তখন মেজাজ হারায়। মেজাজ ঠিক হলে অনুশোচনা করে। এমন করা উচিত ছিল না মনে করে নিজের এমন আচরণের কারণ খোঁজে।

—ও তো দেখনদারি মাল। ঘটে কিচ্ছু নাই। শুধু ভান করে।
কলেজের এক কলিগের এই কথাটি কানে আসে কমল বাবুর। এগিয়ে গিয়ে ঝগড়া করবে সে? না তা হয় না। কমল সাঁতরা কোনোদিন নিজেকে অত নীচে নামাবে না। ফেটে যাওয়ার অভ্যেস থাকলে হয়তো সবকিছুই ঠিকঠাক চলত। কিন্তু ভেতরে গুমরে ওঠার আরেক নাম ব্যাঘাত। মানসিক ভাবে কোনকিছুতে মন দিতে পারছে না সে। ঘরে ফিরে সুজাতার ওপর ঝাল মেটায়। নিজেকে নিয়ে কী এক আপদে পড়েছে। ছেলেটাকে নিতে পারে না। নেয় না। বইয়ে মুখ গুঁজে নিজেকে সম্পূর্ণ করার পথে কিংবা সন্ধ্যার আকাশের তলায় ভাবনার গতিকে পুষ্ট করে তোলার ক্ষেত্রে যখন ক্রমাগত বাধা আসতে থাকে তখন থেকেই কমল এই পথ বেছে নেয়।

এই পথ বেছে নেওয়ার জন্য তাকে অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
পেশায় অধ্যাপক হয়ে একজন মানুষ আত্মহত্যা করলে, জীবনকালে সে যেটুকু সম্মান অর্জন করেছিল, মৃত্যুর পর তা অবজ্ঞা কিংবা দায়সারা গোছের একটি শোক হয়ে যায়। পাড়ার লোকেদের কাছে শুধু এই বিদ্রুপ সয়ে সুজাতাকে বাকি জীবন কাটাতে হবে যে,
‘বোধহয় ভেতরে কিছু কালা ছিল দুজনের মধ্যে। নাহলে এরকম একটা ছোকরা মরে যায়!’
তাছাড়া সুজাতারও তো অভিমান কম হবে না। বিয়ের পর থেকে সুজাতা যেমন যেমন ভাবে নিজেকে—নিজের সংসারকে গড়ে তুলতে চেয়েছিল, পেরেছে। এখনও হয়তো কিছুটা অভাব থেকে গেছে। প্রাপ্তিজনিত কিংবা না পাওয়া থেকে। আর কিছুদিন, কয়েক বছরের ভেতর সেগুলোও পেয়ে যাবে। কিন্তু এখন যদি হঠাৎ করে কমল আত্মহত্যা করে, আত্মহত্যার কথা ভাবে…

কিন্তু পারে না তো… পারে কি? মানুষটা নিজেকে নিংড়ে নিংড়ে একটি খিরিশ গাছের টঙের গোছা ফুল হওয়ার আশায় ছিল, মানুষটা ফুল হল। কিন্তু কোনো শিশু হাতের নাগাল এসে তাকে ছুঁতে পারল না। শান্তিতে তাই আত্মহত্যা করার কথাও ভাবতে পারছে না কমল। আত্মহত্যা ও করবে অথচ নিজের সম্মান বজায় থাকবে, এমনটা চায় সে। সেই থেকেই এমন একটা অপঘাত চেষ্টা করছে, কিন্তু সফল হচ্ছে না।

বছর দুয়েক আগের সেই বাঁশ বাগানে–সেদিন যদি মৃদুল না থাকত, সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নিত, কমলটা…

এর পরেও কি সে চেষ্টা করেনি? করেছে। কমল অজস্রবার চেষ্টা করেছে, নিজেকে শেষ করে দেওয়ার। পেশা-সমাজ-পাড়া সবজায়গায়—যেখান থেকে তার অনেক অনেক প্রাপ্তি ছিল, অথচ কেউ গোপনে, কেউ মুখে মুখে তাকে, তার অবস্থানকে অস্বীকার করে এসেছে, তাদের সঙ্গে একই সমাজে সে থাকবে না থাকতে চায় না। শুধু সুজাতাকে বাঁচিয়ে আর ছেলেটাকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাওয়ার পথে বাধা তৈরি না করে।

কলেজে যখন সদ্য পচা-গলা মুখগুলো সে দেখে, মনের ভেতর ভেতর সবকিছু শেষ হয়ে গেছে মনে হয়। কেউ যেন আছড়ে ফেলে গেছে তাকে তার স্ব-নির্মিত একটা চূড়া থেকে। তিল তিল করে এতদিনের গড়ে তোলা অদম্য প্রয়াস, নিজেকে যোগ্য হিসেবে স্থাপন করার অনিমেষ মুহূর্তগুলো তার কাছে মিথ্যে ঠেকে। মনে হয় কলেজের পেছনের দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করা কোনো ঝোপ থেকে এই দিনে দুপুরে একজন উলঙ্গ মানুষ বেরিয়ে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে যাবে ক্যাম্পাসের রাস্তা দিয়ে। কিংবা এমন কোনো জাদু, যা দুধে আর জলে মিশতে না দিয়ে ওই পচা গলা মুখগুলোর সামনে ফেলে দিয়ে যাবে। ফেরার পথে কমল এক একদিন সত্যিই অন্যমনস্ক থাকে। যেদিন থাকে না, ইচ্ছে করেই রাস্তার মাঝ বরাবর হাঁটে। কোনো গাড়ি পেছন থেকে এলে সাময়িক ঠোঁটের কোণে এক ছিটে হাসি দেখা যায় কিন্তু সেই হাসি উবিয়ে গাড়িটা পাস কাটিয়ে চলে যায়। ব্যর্থতার এমন অধ্যায় অনেকবার পড়েছে কমল। প্রতি পৃষ্ঠার এমন খেয়াল শূন্যতার মধ্যে দিয়ে শেষ হয়।

কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না যে, কমল সাঁতরা আত্মহত্যা করেছে। নেহাত নিষ্ঠুর মৃত্যু একটা প্রাণ কেড়ে নিয়ে গেল—সবাই এই ভাবনা ভাবুক। তাতে তার মান অন্তত বজায় থাকবে। দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছে কমল। সুজাতা, যে কমলকে শুধু সংসারের লোক হিসেবেই দেখতে চেয়েছিল, সেখানে কমল আর তার রস উগরে জাল বুনতে পারছে না। দেওয়ালে দেওয়ালে ঠোকর খেতে খেতে সে জীবনটাকে আরো তুচ্ছ করে তুলতে চাইছে। যে উদ্যম নিয়ে কমল চাকরি পেয়েছিল, যে আশা নিয়ে সে সমাজের কাছে স্ত্রী-এর কাছে প্রাপ্য সম্মান চেয়েছিল, সেই উদ্যম আর আশা একযোগে সে তাক করে আছে একটি মৃত্যুর দিকে।

দু’হাজার আঠারো সালের নামি বর্ষায় বিস্তীর্ণ এলাকা জলের তলায় চলে গিয়েছিল। রাস্তা জলজমি, পুকুর একে অন্যের থেকে আলাদা করা যাচ্ছিল না। কমলের পাকা বাড়ি। ভয় ছিল না। দিন দুয়েক পর, ভেসে ওঠার দৌলতে জানা গেল, কমল জলডুবি হয়ে মারা গেছে। রাস্তা আর পুকুর পাশাপাশি হওয়ায় বিপদটা নাকি এড়ানো যায়নি। দু’দিন পর ফুলে পচে যাওয়া কমলের দিকে অনেকেই তাকাতে পারেনি। যারা দেখেছিল, তারা বলে—
‘আমরা গত কয়েক বছরে কমলের এমন উজ্জ্বল হাসিমুখ কোনোদিন দেখিনি।’

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২