ফিটিংস – সৌগত ভট্টাচার্য
ছোট্ট পিতলের ধুনুচিটাকে ঘুরিয়ে তাকের ওপরে রাখা। গণেশ আর বিশ্বকর্মার ছবিতে সন্ধ্যাবাতি দিয়ে একটা মশা মারার কয়েল জ্বালিয়ে নিজের টুলের ওপর বসে অজয়। কাটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে টুলের একটা গদি বানিয়ে নিয়েছে সে। টুলে বসে সেলাই মেশিনের প্যাডেলে পা রেখে একটা প্যান্ট রিফু করছিল অজয়। আজ এখনও রিন্টুর পাত্তা নেই। সূর্য ডোবার পর থেকে রিন্টুর আসার অপেক্ষা করে অজয়। ধূপের গন্ধ ভালো লাগলেও চোখে ধোঁয়া লেগে চোখ জ্বলছিল অজয়ের। সন্ধে নামলেই সব লোক রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে, সারাদিন গাড়ির আওয়াজ লোকজন চলেই যাচ্ছে কোথায় যেন, অজয় দেখে। দোকান থেকে তাকালেই শুধু গাড়ি আর মানুষ। কিছুদিন আগে অবধি অজয়ের দোকানের ঠিক উলটোদিকে একটা বিরাট ফাঁকা জমির অনেকটা পেছন দিকে একটা পুরানো ভাঙা মতো বাড়ি ছিল। সেলাই করতে করতে আগাছা ভর্তি সবুজ জমিটার দিকে তাকালে অজয়ের চোখ যেন একটু আরাম পেত। ফোঁড় সেলাইয়ের মতো রাস্তা দিয়ে লোকজন গাড়ি ঘোড়া চলে যায় সারাদিন। শহরের ঠিক মাঝখানে এরকম ফাঁকা জমি এতদিন পরে থাকার কথা না। বছর খানেক ধরে বিরাট একটা বিল্ডিং হচ্ছে অজয়ের দোকানের ঠিক উলটোদিকে। রাতের বেলায় দিনের মতো আলো করে কাজ হয়। রাস্তার ওপার থেকে আলো এসে পড়ে অজয়ের ঊষা সেলাই মেশিনে…
চায়ের কাপ নামায় রিন্টু। সন্ধ্যায় দুজনেই একসাথে চা খায়। দেশলাইয়ের আগুনটা অজয়ের মুখের দিকে বাড়িয়ে রিন্টু বলে, “বাবু কাল আসবে তাই শিপ্রাকে নিয়ে একটু বাজারে গেছিলাম…”
“বাবু তো অনেকদিন পর আসছে, ওর মেয়ে হওয়ার পর তো দেখিইনি…বাবুরও মেয়ে…!” বলে অজয়। “সময় কি আর তোর আমার জন্য থেমে থাকবে নাকি!” রিন্টু উত্তর দেয়।
“বাবুর জন্য ছিট কাপড় কেটে ফ্রক কতদিন পর্যন্ত বানিয়েছি… এখন ওর মেয়ের জন্য ফ্রক বানাতে হবে দেখছি!” সন্ধ্যার পর রিন্টু আসলে সারাদিনে একটাই সিগারেট খায় অজয়। “বাবু আমাকে আজ একটা জামা পাঠিয়েছে। সেগুলো আমার তো আর পরা হয় না!” বলে রিন্টু। রিন্টুর মেয়ে অনেকদিন হলই বাসিন্দা, মাঝেমাঝেই বাবার জন্য জামা কাপড় পাঠায় অনলাইনে। রিন্টুর সেগুলি পছন্দ না। “আমার বানানো জামা প্যান্ট আর সীতারামের বানানো হান্টিং ছাড়া তুই অন্য কিছু কি কোনোদিন পরেছিস!” “জাঙ্গিয়া গেঞ্জি মোজা এগুলোও কি তোদের বানানো?” রিন্টু ফোন দেখতে দেখতে বলে। “কবে থাকি কবে থাকি না, এবার রেডিমেড জামাকাপড় পড়ার অভ্যাস কর তুই!” রিন্টু গ্লাসের মধ্যে পরে থাকা চায়ে সিগারেটের শেষ আগুনটা নিভিয়ে বলে, “চল তোকে নামিয়ে বাড়ি ঢুকি!”
শহরটা গ্যাস বেলুনের মতো ফুলে ওঠার আগে অজয় এই শহরে সকলের জামা প্যান্টের মাপ জানত। নিখুঁত ছিল অজয়ের কাটিং ক্ষমতা। একদিন পুজোর আগে আগে অজয়ের দোকানের সামনে একটি নতুন ইয়াসদি মোটর সাইকেল দাঁড়ায়। একজন ইয়াং লোক মোটর সাইকেল থেকে নেমে একটু ঝুঁকে হেঁটে আসে। অজয় তখন ববিনে সুতো ভরছিল। বিশ্বকর্মা পুজোর পর থেকে মুখ তুলে তাকানোর সময় পেত না অজয়। চারজন দিন রাত কাজ করেও সময় মতো ডেলিভারি দেওয়া যায় না। অজয় মাপ অনুযায়ী কাপড় কাটত বাকি কর্মচারীরা দেড় হাজিরায় স্টিচ করত। পুজোর এক মাস আগে থেকেই অর্ডার নেওয়া বন্ধ। সেরকম ব্যস্ততার এক বিকেলে চোখে সানগ্লাস শার্টের বুকের বোতাম দুটো খোলা বড়ো কলারের লাল একটা জামা নীচে সোনার চেন ড্রেনপাইপ টেরিকটনের প্যান্ট হান্টিং সু আর মাথায় কাউ বয় হ্যাট পরে চেনের মধ্যে লাগানো বাইকের চাবি ঘোড়াতে ঘোড়াতে একজন অজয়ের সমানে এসে দাঁড়ায়। অজয়ের সেই দিনটার কথা জীবনেও আর ভোলা হল না। তারপর থেকে তিরিশ বছর কেটে গেলেও জামা প্যান্ট বানানোর বন্ধুত্ব আর রিন্টুর এই ড্রেস কেউ কাউকে ছেড়ে যায়নি।
“অনেক নায়কের মত ড্রেস বানিয়েছি, একবার রাজেশ খান্নাকে দেখে গুরু কালার উঠল, একবার ব্যাগি কিন্তু কোনো ভিলেনের স্টাইলে ড্রেস বানাইনি বাপ জীবনে!” রিন্টুর জন্য জামার কাপড় কাটতে কাটতে সন্তোষকে বলেছিল অজয়। “কার নকলের ড্রেস এটা?” অজয়ের দোকানের কর্মচারী সন্তোষ জিজ্ঞেস করে। “বুঝিস না এটা হিন্দি বইয়ের রঞ্জিতের স্টাইল!” অজয় উত্তর দিয়েছিল। পাপু দাঁত দিয়ে সুতো কাটতে কাটতে বলেছিল। “আমি তো হিন্দি বই দেখিই না! শুধু বাংলা বই দেখি! তাই বুঝি নাই এই ইস্টাইলটা!” “আরে আমি যেটা বলব সেটাই স্টাইল এই শহরে!” এই শহরের অলিখিত ফ্যাশন ডিজাইনার অজয় সন্তোষকে বলত একসময়। “সেই তো দেখি! সবাই তোমার থেকে এসে জানতে চায় পায়ের ঘের কত দেবে জামার পুট কত দেবে!” “আরে এই রিন্টুই একবার প্যান্ট বানিয়ে নিয়ে গেল তারপর নাকি খুলতেই পারছিল না, আমি বারবার বলেছিলাম ও মানল না আমার দেওয়া মাপ!” “কী স্টাইলের ড্রেস চলছে সবাই তোমার থেকে জানতে চায় কেন?” পাপু বোতাম লাগাতে লাগাতে জিজ্ঞেস করত মালিক অজয়কে। “ছোটোবেলা থেকেই ভালোই এমব্রাডায়ারি করতাম, মাসুদ ছিল আমার ওস্তাদ। ওর দোকানেই কাজ করতাম। ওস্তাদ সব সময় বলত সেলাই একটা শিল্প। আমরা যারা সেলাই করি তারা শিল্পী। এক জামা কখনও দুইবার বানাই না। প্রত্যেক মানুষের শরীরের মাপ আলাদা। তাই জামা কাপড়ও আলাদা! দ্যাখ, শহরে এত দার্জি থাকতে রিন্টু আমার কাছে আসে কেন!”
সেই তিরিশ বছরের আগে থেকে মাথায় হ্যাট বুকের বোতাম খোলা বড়ো কলারের জামার নীচে সোনার চেন আর ড্রেন পাইপ প্যান্টের নীচে সাদা বা কালো হান্টিং সু নিয়ে কাটিয়ে দিল রিন্টু। এখনও বাড়িতে সিল্কের লুঙ্গি যে পড়ে সেটাও অজয়ের থেকেই সেলাই করে নিয়ে যায়। নায়ক হয়ে থাকতে চায় অনেকে কিন্তু সারাজীবন একজন ভিলেনের স্টাইল নকল করে যাওয়া খুব দেখা যায় না। শহরের লোক রিন্টুর ভিলেন চেহারায় ভয় না পেলেও আশ্চর্য হয়। যেন সাজ পোশাকের মধ্যে ভিলেন মানুষটাই লুকিয়ে আছে, যে সাজপোশাক তৈরি করে অজয়। যেন এক ভিলেনকে সে সেলাই করে ফুটিয়ে তোলে। রিন্টুর কম কথা বলার স্বভাব তার হিন্দি সিনেমার রঞ্জিত-ভিলেনের স্টাইলকে যেন আরও ফুটিয়ে তুলেছে ব্যক্তিত্বের সঙ্গে।
রাস্তার ওই পারের বিল্ডিংটা যত আকাশ ছুঁতে থাকে অজয়ের দোকান দিনের বেলায় তত অন্ধকার হয়ে যায়। একযুগ হল সন্তোষ, পাপু যাঁরা অজয়ের কর্মচারী ছিল বিদায় নিয়েছে। কিছু লেপের ওয়ার সেলাই, মশারির লেস লাগানো, বালিশের কাভার তৈরির কাজ কিছুদিন আগেও আসত। এখন রিফু আর জোড়াতালির কাজ ছাড়া কিছুই আসে না। এখন তো মিটার হিসেবে জামা প্যান্টের কাপড়ের দোকানও প্রায় উঠে গেছে শহর থেকে। কয়েকজন পুরানো চেনা জানা মানুষ এখনও পায়জামা পাঞ্জাবি বানাতে আসে। যদিও রিন্টু যেন কোত্থেকে ওর জামা প্যান্টের জন্য কাপড় জোগাড় করে সেই রঞ্জিতের স্টাইলে অজয়কে দিয়েই বানিয়ে নেয়। রিন্টুর জামা কাপড় বানানোর সময় অজয় নিজের ভেতরের শিল্পী সত্ত্বা খুঁজে পায়। ফেলে আসা সময়কে ফিরে পায় বড়ো কলার কাটতে কাটতে। জোড়াতালি দিয়ে আর কতদিন চলবে অজয় জানে না। এই বয়সে এসে অন্য কোনো কাজ করা ওর পক্ষে সম্ভব না। এটা তো শুধু পেট চালানো নয়। সেলাইয়ের সাথে অজয়ের একটা শিল্পী সত্তা, একটা শিল্পী মন জড়িয়ে আছে। চাইলেই তো আর অন্য কাজ করা যায় না! আকাশে আশ্বিনের মেঘ জমলে অজয়ের পুজোর আগে নতুন কাপড়ের গন্ধ যেন আজও নাকে আসে। অজয় একটা আশ্বিনের আকাশের মতো জিন্সের প্যান্ট রিফু করে যায়।
বিশ্বকর্মা পুজোর পর থেকেই জোর তৎপরতা শুরু হয়েছিল বিল্ডিংটার কাজে। লাইট কাচ মার্বেল হাজার হাজার লোক কাজ করছে। একটা বিরাট গ্লোসাইন বোর্ড টাঙানোর পর বোঝা গেল এটা একটা শপিং মল হচ্ছে। দেশের সব জায়গায়ই এখন এই কোম্পানির শপিং মল আছে। এখানে দুইটা ফ্লোর জুড়ে শুধু জামা কাপড়ের ডিপার্টমেন্ট। মহালায়র দিন উদ্বোধন। শহরের নানা জায়গায় পোস্টার পড়েছে। কোম্পানি পুজোর বাজার ধরতে চাইছে।
মহালয়ার দিন সকালে মলের বাইরে সারি সারি নতুন চাকরি পাওয়া কর্মচারীরা দাঁড়িয়ে আছে কালো প্যান্ট ছাই রঙা জামা কালো জুতো আর গলায় আইকার্ড ঝুলিয়ে, সকলেরই বয়েস কম। নিজের হাতে বানানো পোশাক ছেড়ে এই প্রথমবার অজয় কোম্পানির দেওয়া রেডিমেড পোশাক পড়েছে। বারবার আই কার্ডটা সোজা করে গলায় ঝুলিয়ে নিচ্ছে। কার্ডে নামের নীচে লেখা টেইলর মাস্টার। শপিং মলে জামা কাপড় কিনতে আসা খরিদ্দারের জামা কাপড় শুধু অল্টার করবে অজয়। মাস মাইনের চাকরি। অজয় শপিং মলে ঢোকার আগে রাস্তার ওই পারে বন্ধ হয়ে থাকা নিজের দোকানের দিকে তাকায়। পঁয়ষট্টি বছরের এক মানুষের চল্লিশ বছরের কাজ ছেড়ে আসায় চোখের কোণে যে জল চিকচিক করে ওঠে তা মলের জোড়ালো আলোতে দেখা যায় না!
জামা কাপড়ের ফ্লোরের পাশেই একটা গোডাউনের মতো ঘরে থাকথাক পিস বোর্ডের প্যাকেট রাখা। এগুলো নতুন পুজোর মাল এসেছে। এই ঘরেই অজয়ের সেলাই মেশিন পাতা। বাইরে গিয়ে কাস্টমারের মাপ নিয়ে আসতে হয়। কাস্টমারকে স্যার বা ম্যাডাম বলাতে এখনও পঁয়ষট্টির অজয় সড়োগড়ো হয়ে উঠতে পারেনি। নিজের দোকান থাকার সময় ডাক খোঁজগুলো অন্য রকম ছিল। ফিতে দিয়ে মাপ নিয়ে জিন্সের পায়ের লম্বা বা কখনও মেয়েদের জামায় হাত লাগাতে হয় বা চাপিয়ে দিতে হয়। কোথাও নতুন কাপড় কেটে নতুন জিনিস তৈরির যে আনন্দ সেটা না পেলেও অজয় মাস গেলে স্থায়ী মাইনে তো পায়। ওস্তাদ মাসুদ বলেছিল, টেইলারিং একটা শিল্প। অজয়ের এসিতে ঠান্ডা লাগে। কাস্টমার না থাকলে সে মাঝেমাঝে হ্যাঙ্গার তাকগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকের সারিসারি সাজানো চৌত্রিশ কোমড়ের প্যান্ট বা চল্লিশ সাইজের জামা দেখে অজয়ের অবাক লাগে। ওস্তাদ মাসুদ তো বলত সব মানুষের জামা প্যান্টের সাইজ আলাদা। তাহলে মাত্র এই কয়টা সাইজেই পৃথিবীর সকলের মন মত সাইজ হয়, এঁটে যায়। নিশ্চয়ই মনমত সাইজে ফিটিং হয় না হলে এই জামাকাপড়ের এত কদর কেন। এগুলোও তো অজয়ের মতো কেউই তো বানায়! নাকি কোম্পানিগুলোই সব মানুষকে একই মাপে আঁটিয়ে দিতে চায়। শুধু লম্বা কেটে খাটো করে দিলেই বাকি সব একই কয়েকটা মাত্র সাইজ। সারা পৃথিবীকে কি একই রকম ইউনিফর্ম পড়াতে চায় কোম্পানিগুলো! এখানে তো কেউ এসে রিন্টুর মতো পোশাক খোঁজ করে না! এখানে কোনো শিল্প নেই, শুধু মেশিনে ফেলে দেওয়া মাপ আছে। যেই এক মাপে সকলকে পুরে ফেলা যায়। অজয়ের মাপ আর ফিটিং ব্যাপারটা আজকাল খুব রহস্য লাগে!
অনেক বছর পর অজয় কাজের চাপ অনুভব করছিল। আজ পঞ্চমী তাই বেশির ভাগ কাজ ডেলিভার্ড হয়ে গেছে। যদিও সবই অল্টারের কাজ। অজয়ের ছুটি হতে আরও আধ ঘণ্টার মতো বাকি। বাইরে বৃষ্টি হয়ে গেছে কখন ভেতর থেকে বোঝা যায় না। শপিং মলের তিন তলার কাচের দেওয়ালের সমানে এসে দাঁড়ায় অজয়। কাচের মধ্যে কোম্পানির নাম স্টিকার দিয়ে লাগানো। কাচটা বাষ্পে ঝাপসা হয়ে আছে। অজয় হাত দিয়ে একটা স্টিকারের গায়ে লেগে থাকা ঝাপসা বাষ্প মুছে নীচের দিকে তাকায়। এত উপর থেকে সে কখনও নিজের শহরকে দেখেনি। ওপর থেকে দেখতে তার অচেনা লাগে। এতদিন অজয় রাস্তার ওপারে নিজের দোকান থেকে এই শপিং মলকে দেখেছে। আজ শপিং মল থেকে রাস্তার ওপারে নিজের দোকানকে দেখছে। হঠাৎ অজয়ের চোখ আটকে যায় নিজের বন্ধ দোকানের সামনে। সে আধুনিক মলের ওপর থেকে দেখে, বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় একটা বছর পঁয়ত্রিশের পুরোনো ইয়াসদি মোটর সাইকেল নিয়ে হান্টিং সু পরা বড়ো কালারের জামার বুক পর্যন্ত খোলা ভেতরে চেন ঝুলছে একটা কাউবয় হ্যাট পরে অজয়ের দোকানের সমানে দাঁড়িয়ে কয়েক দশক আগের একজন মানুষ বাইকের চাবিটাকে চেনে লাগিয়ে হিন্দি সিনেমার ভিলেন রঞ্জিতের মতো ঘোরাচ্ছে আর অপেক্ষা করছে অজয়ের ছুটির পর তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্যে! যার জামাকাপড় শপিং মলে কিনতে পাওয়া যায় না।