ভাঙা সংসার – শ্রীপান্থ অনুবাদ: ড. পদ্ম কুমারী চাকমা
লাকড়ির বোঝাটা নামাতে না নামাতেই একজন বাঙালি ক্রেতা জিজ্ঞেস করল “কত?” শীলপুদি বলল, “দুই টাকা।” লোকটি কিছুই বলল না। লাকড়িগুলি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ‘চাক’ করে শব্দ করে চলে গেল। শীলপুদি অবাক— তাহলে লাকড়িগুলি কি খুব খারাপ! ভাবে, এরচেয়ে আর কত ভালো লাকড়ি পাবে। দিন দিন শেষ হয়ে আসছে। লাকড়ি সংগ্রহ করতে এখন অনেক দূরের জঙ্গলে যেতে হয়। দিনের রোজগার এই লাকড়ির বোঝা। লাকড়ি শেষ হয়ে গেলে কী করে বাঁচবে এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না শীলপুদি। বোঝাটাকে চেয়ে দেখে এবং ভাবে, আজকে জানি কত টাকা পাবো!
এক ঝটকায় চুলের খোঁপাটা বেঁধে নিল। প্রচণ্ড গরম। গরম থেকে রেহাই পেতে আঁচলের একদিক আলগা করে বাতাস করতে লাগল। শরীরের ঘাম শুকালেও মনঃকষ্টের ঘা কিন্তু শুকাল না। শীলপুদির জীবনে এই ঘা শুকোবার নয়। প্রতিদিন এই লাকড়ির বোঝা নিয়ে আসা। প্রথম প্রথম ভীষণ লজ্জা পেত সে। পেটের দায়ে ধীরে ধীরে তার লজ্জা শরম চলে গেছে। কিন্তু তার আর ভালো লাগছে না। তাই “ক’দিন আর হে ভগবান বুদ্ধ—এই জীবন …আমাকে তুলে নাও”, বলে তার দু’চোখ জলে ভিজে যায়। নিজেকে সামলে নেয়। হতাশ হয়ে চিন্তা করে তার স্বামী কান্তারামের কথা। “হায় রে পুরুষ, দুঃখ দেওয়ার জন্য কি বিয়ে করে? কোনো চাহিদা কি নেই এ জীবনে? আক্কেলহীন পুরুষ।” কেউ নেই তার যে কিনা একটু সান্ত্বনা দেবে। একা একা দুঃখের সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে সে। সে আর সহ্য করতে পারছে না। তাই গতকাল নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু আদরের বাচ্চাটার মুখ ভেসে ওঠায় তাকে ফিরে আসতে হয়েছে। শেষে ঠিক করল যেভাবেই হোক ছেলেটাকে বড়ো করতে হবে। সে অন্যের আশ্রয়ে থাকে। কিন্তু কখনও মনে হয়নি পরের বাড়ি বলে। বাড়ির মালিক তাকে খুব ভালোবাসে। মালিকের অবস্থাও সঙ্গিন। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। শীলপুদি যেদিন কিছুই জোগাড় করতে পারেনি, সেদিন উপোষ থেকেছে। কারো কাছে হাত পাতেনি সে। এমনকি শ্বশুর বাড়ি থেকে সাহায্য করতে চাইলেও সে ফিরিয়ে দিয়েছে। কোনোমতেই মাথা নিচু করবে না সে। শীলপুদির ব্যবহার, আচার-আচরণে সন্তুষ্ট বাড়ির মালিক। তাকে ভীষণ ভালোবাসত। সেও মালিককে বাবার সম্মান দিত। এভাবেই বাবা-মেয়ের সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
দশ বছর বয়সে শীলপুদির বিয়ে হয় ধনী কান্তারামের সঙ্গে। কান্তারাম ছিল অলস এবং গালগল্পে ওস্তাদ। মা-বাবা, স্ত্রী-সংসার, বন্ধু-বান্ধব তার কাছে গুরুত্বহীন। মদটাই তার কাছে প্রধান এবং জীবন হয়ে ওঠে। বাবার একমাত্র ছেলে, খারাপ সঙ্গে পড়ে নানা বদনাম পেয়েছে। তারপর একদিন মা-বাবা, স্ত্রী-পুত্র ফেলে কোথায় চলে যায় কেউ বলতেও পারল না। অনেকের সন্দেহ মারা গেছে। এতে শীলপুদি খুব দুঃখ পেয়েছে। তার বিশ্বাস তার স্বামী বেঁচে আছে, তাকে ছাড়া বেশিদিন থাকতে পারবে না। একদিন না একদিন তার কাছে ফিরে আসবে। এইভাবে চার বছর কেটে যায়, কান্তারামের দেখা নেই। শীলপুদিও আশা ছাড়ে না, অপেক্ষায় থাকে। সময় আপন গতিতে এগিয়ে যায়। একদিন শাশুড়ির কুমন্ত্রণার ফাঁদে পা দিয়ে শ্বশুর শীলপুদিকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়।
ঘটনাটা এরকম। একদিন বিকেলবেলায় শীলপুদি চাল বাছছিল। সে সময় তার সামনে এসে দাঁড়ায় শ্বশুর যাত্তারাম। শীলপুদি শ্বশুরের উপস্থিতি টের পায় কিন্তু তাকাবার সাহস হয় না। তবুও মাথার কাপড় ঠিক করে শ্বশুরকে প্রণাম করে। সে বুঝতে পারে নিশ্চয় কিছু বলতে এসেছে। চুপ করে অপেক্ষা করে। শ্বশুর ধীরে ধীরে গম্ভীর স্বরে বলে মা তোমাকে একটা কথা বলার আছে।
শীলপুদি কোমল স্বরে বলল হ্যাঁ বাবা বলুন, সবই আমার কপাল।
—কী বলব মা! তোমার সব খরচপত্র আমি দেব, যদি মানুষের বাড়িতে… গেলে ভালো হবে মনে হয়।
শীলপুদির মাথায় বজ্রাঘাত। ওদিকে সব কথা চুপি চুপি শুনছে দজ্জাল শাশুড়ি।
—বাবা… তুমি তাহলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছ!
একটু সময়ের জন্য শক্ত হয়ে যায় শীলপুদি।
—না মা না, তোমার ভালোর জন্যই বলছি।
শীলপুদির মন মুহূর্তেই ভেঙে গেল। তার চোখে অবিরাম জলধারা। চারদিক অন্ধকার। শরীর অসাড় লাগছে তার। কখন আঁচল খসে পড়ছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। তা দেখে শ্বশুর ঘরে ঢুকে যায়।
“কী হয়েছে তোর পোড়ারমুখী, ঠাকুরের মতো তোকে আর পুজো করতে পারব না। ভালোয় ভালোয় চলে যা নাহলে লাথি মেরে বের করে দেব, পোড়ারমুখী, আমার ছেলে কোথায়? আজকে এক বছর পার হয়ে গেল’’, এভাবে গালিগালাজ করতে করতে দজ্জাল শাশুড়ি এল।
শীলপুদি সামনে পড়াতে রেগে ফেটে পড়ে বলে, “পোড়ারমুখী এখনো যায়নি, মরেও না, লাজলজ্জা নেই, খানকী মেয়ে।”
শীলপুদি কিছু বলার চেষ্টা করেও বলতে পারল না। অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়ল।
এই দেখো না, নমুনা। শেষ কথা বলে দিচ্ছি এক মুহূর্ত যাতে এখানে আর না দেখি। যাও বেশ্যাগিরি করে সংসারের ভালোবাসা অর্জন করো।
এরপর শীলপুদি ঠিক করল সে আর শ্বশুর বাড়িতে থাকবে না। না খেতে পেয়ে মরে গেলেও না। শীলপুদির চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। ছটফট করছে, কী করলে শান্তি পাবে বুঝে উঠতে পারছে না। বসে বসে ভাবে, অভিশপ্ত নারী জীবন। অজান্তে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। নিজেকে থিতু করার রাস্তা খুঁজে পায় না।
এসব ভাবতে ভাবতে বেলা পড়ে যায়, শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে লাকড়ির বোঝাটা একটাকা দিয়ে বিক্রি করে। দু-এক কেজি চাল নিয়ে সূর্য ডোবার আগেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
ঝড়ো হাওয়া বইছে। বাতাসের দাপটে পাছড়া এদিক ওদিক হতে সে শক্ত হাতে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে এক পা এক পা করে সে বাজারটা পেরিয়ে যায়।
গদাচাঁন প্রতিদিন শীলপুদির অপেক্ষায় থাকে। গদাচাঁন শীলপুদিকে পছন্দ করত। এর আগে অনেক যুবতী মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, কিন্তু কেউ রাজি হয়নি। মনোদুঃখে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে সে আর যুবতী মেয়ে বিয়েই করবে না। আর তাই শীলপুদিকে বিয়ে করার মনস্থ করেছে। কিন্তু পোড়া কপাল তার, কীভাবে সামাল দেবে বুঝতে পারছে না। তিনবার বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার পরও পরোক্ষে না করে দিয়েছে। শীলপুদি বলেছে “আমি পরস্ত্রী, তোমাকে কীভাবে বিয়ে করব, তুমি বরং আরেক জনকে দেখো”।
মনে মনে শীলপুদি গদাচাঁনকে পছন্দ করত না। মুখ ফুটে সে কথা বলতে পারে না। আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয় যে কোনোভাবেই সে তাকে বিয়ে করতে পারে না। প্রতিদিন কত জ্বালা সহ্য করা যায়, শেষে অধৈর্য হয়ে পড়ে। নিজে নিজে খুব দুঃখ পায়। জীবনটা দুঃখে দুঃখে কেটে যাচ্ছে, সুখ কী জিনিস জানতেই পারল না। স্বামী কান্তারামের কথা মনে পড়ে, মনটা খুশিতে নেচে উঠে, পরক্ষণেই বিলাপে ভরে যায় মন। গদাচাঁন ঠিক করে এভাবে আর নয়, জোর করে শীলপুদিকে তুলে নিয়ে যাবে। বন্ধুদের মদ খাইয়ে জড়ো করল। তাদেরকে রাস্তার ধারে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে বলল। নির্দেশ দিল, ইশারা করলে চলে আসতে। কথামতো তারা চুপচাপ ইশারার অপেক্ষায় বসে থাকে। এদিকে শীলপুদিকে বাড়ি থেকে বের করে আনার ফন্দি খোঁজে। তার মাথায় বুদ্ধি আসে এবং শীলপুদির কাছে গিয়ে বলে “কান্তারাম এসেছে, অপেক্ষা করছে, কথা বলতে চায়।” শীলপুদির আর তর সয় না। দুম করে বেরিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে। কথামতো গদাচাঁন বন্ধুদের ইশারায় জানিয়ে দিল শীলপুদি আসছে।
এদিকে শীলপুদি কাছে আসলে গদাচাঁন এক নোংরা হাসি দিয়ে বলে “কান্তা দাদা এসেছে। তোমাকে খুঁজছে।” শীলপুদির মন কেমন করে উঠল। “তাহলে কি সত্যিই…”, কিছুক্ষণের জন্য হতাশ হয়ে ওঠে। ভিতরে ভিতরে মনে প্রশ্ন জাগে, দেখতে কেমন হয়েছে, কোথায় ছিল, কীভাবে এল, নাকি বদলে গেছে, আগের মতো থাকবে কি? যদি গ্রহণ না করে তাহলে কী উপায় হবে? স্পষ্টভাবে কান্তারামের মুখ ভেসে উঠল।
বেহায়াভাবে গদাচাঁন হাতটা তুলে দিলে, এক ঝটকায় হাতটা নামিয়ে দিয়ে শীলপুদি বলে “লজ্জা করে না…।” গদাচাঁন মুচকি মুচকি হেসে মুহূর্তেই নিজেকে বদলে নিল এবং এক লাফ দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। বন্ধুদের হাত নাড়িয়ে ডাকল। ঝোপের আড়াল থেকে একে একে সবাই বেরিয়ে এল।
শীলপুদির গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কী ব্যাপার, কী হচ্ছে! ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল। ভাবে আজকে নিজেকে আর বাঁচাতে পারবে না। নিজেকে বাঁচানোর কোনো রাস্তা নেই আর। ভীষণ অসহায়বোধ করছে। চোখের জল পড়াও বন্ধ। শুকনো গাছের মতো দাঁড়িয়ে রইল। চিৎকার করার চেষ্টা করেও সফল হল না।
এদিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে দুষ্ট বেহায়া গদাচাঁন। কি জানি কি করবে! এদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে গদাচাঁনের সব বন্ধুরা।