খুরশিদ খানুম, উদিত হও—দীপ্তি ছড়াও – “বি” অনুবাদ: রাজীব কুমার ঘোষ

খুরশিদ খানুম, উদিত হও—দীপ্তি ছড়াও – “বি” অনুবাদ: রাজীব কুমার ঘোষ

শেয়ার করুন

[ ‘দারি’ ভাষায় মূল গল্পটি লেখা। ‘দারি’ আফগানিস্তানে ফার্সি ভাষার একটি প্রকার। অনেকে একে আফগানি ফার্সি নামেও চিহ্নিত করে থাকেন। আফগানিস্থানের সংবিধানে দুটি সরকারি ভাষার মধ্যে ‘দারি’ একটি। আফগানিস্তানের এই লেখকের পরিচয় গোপন আছে। ‘অথর বি’ বলে উল্লেখিত হয়েছে। পারওয়ানা ফায়েজের অনুবাদ থেকে বাংলায় অনুদিত করা হয়েছে। গল্পটি ২০২০ সালে রচিত, ইংরাজিতে অনুবাদও সেই বছরে। ইংরাজিতে মূল গল্পের নাম ‘Khurshid Khanum, Rise and Shine’ ]

সে ফোন করল কিন্তু কেউ ফোনটা ধরল না। নম্বরটায় বার বার চেষ্টা করছিল সে। সারাদিন ধরেই নম্বরটায় সে ফোন করে গেল কিন্তু ফোনের রিং ছাড়া আর কিছু শোনা গেল না। সে মনে করতে পারছিল না শেষ কবে তার স্ত্রী এত দীর্ঘ সময় ধরে বাড়ির বাইরে ছিল। সে আন্দাজ করতে চাইল ব্যাপারটা কী হতে পারে! হতে পারে ছোট্ট খুরশিদ অসুস্থ তাই সে ব্যস্ত। হতে পারে এমন কিছু হয়েছে যার ফলে সে ফোন ধরতে পারছে না।

শেষ পর্যন্ত রাত ন’টা নাগাদ কেউ ফোনটা ধরল। যখন একটি মহিলা কণ্ঠ ‘হ্যালো’ বলে উঠল, উত্তেজনায় তার দম বন্ধ হয়ে আসল। কাবুলে পড়ার সময় আলিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কটা গড়ে ওঠে। সেই সময়ে সে আলিয়াকে ফোন করলে এপ্রান্ত থেকে সাড়া দিত না যতক্ষণ পর্যন্ত না আলিয়া কথা শুরু করত। নিঃশব্দ থেকে সে শুনতে চাইত আলিয়ার হৃৎস্পন্দন। বার বার এরকম হবার পর আলিয়া ব্যাপারটা বুঝে গেছিল। তখন ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলার বদলে হালকা হাসি মাখানো গলায় বলে উঠত সে, ‘সুলেমান, তুমিই তো?’ কিন্তু এখন যে মহিলা ফোন ধরেছে তার কণ্ঠস্বর হাসি মাখানো মোলায়েম নয় উলটে এপ্রান্ত থেকে সাড়া না পেয়ে সে যা পরুষ বচন বর্ষণ করছে তার মর্মার্থ, যে হতভাগা ফোন করছে তার কি পেট মোচড় দিচ্ছে তাই কোনো কথা বলতে পারছে না? তার চোখ যে জলে ভরে উঠছিল তা শুকিয়ে গেল। তার মনে পড়ছিল না আলিয়া তার সঙ্গে কখনও এমন কর্কশভাবে কথা বলেছে কিনা!

তার মনে পড়ছিল, এক সময় তাদের ফোনে ভুতুড়ে কলের উপদ্রব হয়েছিল। কেউ বা কারা ফোন করত কিন্তু ফোন ধরলে কিছু বলত না, চুপ থাকত। সুলেমান অনেক সময়েই শাপ-শাপান্ত, গালির ফোয়ারা ছুটিয়ে দিত কিন্তু তাতেও কিছু কাজ হয়নি। অন্য প্রান্তের নীরবতা ভঙ্গ হবার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। আলিয়া তখন বলত, গালি দেওয়াটা উচিত নয় এমনকি যদি এইরকম কল একশোটাও ধরতে হয় তবুও না।

আর আজ! মহিলা কণ্ঠ অবশ্য ঠিক অভিশম্পাত দেয়নি শুধু বলেছে, পেট মোচড় দিচ্ছে কিনা। মহিলা কলটা কেটে দেবার পর সে আবার নম্বরগুলো টিপতে শুরু করল। এবার আর তার হাত কাঁপছিল না। জোরে জোরে নম্বরগুলো দাবাচ্ছিল সে।

অপরপ্রান্তে সেই মহিলা জোরে ‘হ্যালো’ বলে উঠল। একটু থেমে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে সে প্রশ্নটা করল, ‘আলিয়া কি আছে?’ সে বুঝতে পেরেছিল ফোনের ওপ্রান্তের মহিলা, আলিয়া নয়। এই মহিলা হ্যালো উচ্চারণটা টেনে টেনে করছে আর খুব জোরে উচ্চারণটা করছে। আলিয়া এই দু’টোর কোনোটাই করে না।

তার স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল যখন মহিলা বলে উঠল, ‘না। আপনি ভুল নম্বরে ফোন করেছেন।’

কিন্তু ফোন রাখা মাত্র তার মনে প্রশ্ন জেগে উঠল, মহিলা কি সত্যি বলল? উঁহু, কোনো মতেই সে ভুল নম্বর দাবায়নি। এই ব্যাপারে তার মনে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই উলটে একটা স্থির প্রত্যয় তার মধ্যে জেগে উঠল। সে আবার ফোন করল আর এবার নিজের পরিচয় দিল আলিয়ার দূর সম্পর্কের রিস্তেদার হিসাবে। এমন এক রিস্তেদার যে দূর প্রদেশ থেকে এসেছে আলিয়ার সঙ্গে একটা গুরুতর ব্যাপারে কথা বলবে বলে।

মহিলার কাছে যখন ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠল যে এটা ভুয়ো কোনো কল নয় তখন মহিলা মুখ খুললেন। মহিলা বললেন তারা এই বাড়ি বছর তিনেক আগে কিনেছেন এই বাড়ির আগের বাসিন্দাদের কাছ থেকে।

সে জানতে চাইল আগের পরিবারের লোকজনের নাম। মহিলা উত্তর দিলেন, ‘আকবরি। জারঘাম আকবরি।’ কোনো রকম সন্দেহের অবকাশ না রেখে মহিলা আরও যোগ করলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ার আকবরি।’

মহিলা বুঝতে পারল না ফোনের অপর প্রান্তের লোকটার তখন মূর্ছা যাবার উপক্রম হয়েছে। সুতরাং মহিলা আলিয়ার ‘দূর সম্পর্কের রিস্তাদার’কে খবরগুলো দিতেই থাকল। পরিবারটা ঠিক কোথায় আছে জানা নেই কিন্তু এটা জানা আছে যে তারা ‘চক-এ-গুল-হা’, খুব কাছের এক অভিজাত এলাকায় উঠে গেছে।

সুলেমান মুখের লালা সমেত একটা ঢোঁক গিলে জানতে চাইল এই ইঞ্জিনিয়ার আকবরির স্ত্রীর নাম আলিয়া কিনা। মহিলাটি যে শুধু সেটাই সুনিশ্চিত করল তা নয়, হাসতে হাসতে এও জানিয়ে দিল আলিয়ার বড়ো মেয়ের নাম ‘খুরশিদ’।

‘খুব সুন্দর মেয়ে। আমার তো ইচ্ছা ছিল আমার ছেলের বৌ করার। কিন্তু যা হবার নয় তা আর কী করে হবে। মেয়েটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেল আর আমার ছেলে এমন বৌ চায় না যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবে।’

মহিলা হতাশার শ্বাস ফেলে বলেই চলেছেন, ‘দুনিয়াটার হল কী! শহীদের মেয়ে কিনা বিশ্ববিদ্যালয় যাচ্ছে…’ এই কথাটা শুনেই সুলেমান ঘামতে শুরু করল। তার মাথায় কিছু ঢুকছে না। সে এলোমেলো স্বরে জানতে চাইল, ‘শহীদের মেয়ে…কোন শহীদ?’

মহিলা বোধহয় অনেকদিন বাদে কথা বলার জন্য কাউকে পেয়েছে, বেশ আগ্রহের স্বরে সে প্রায় ধমকে উঠল, ‘আপনি কেমন আত্মীয় যে, এই খবর রাখেন না।’

সে চেষ্টা করল এলোমেলো কিছু একটা ব্যাখ্যা দেবার কিন্তু মহিলা তার তোয়াক্কা না করে আবার বলতে শুরু করল, ‘আমি বেশি কিছু জানি না। প্রতিবেশীদের মুখে শুনেছি মেয়েটা শহীদের মেয়ে। আগের স্বামী শহীদ হবার বছর দু’য়েক পরে আলিয়া তার স্বামীর এক কমরেড, এক স্থপতিকে বিয়ে করে। ওপরওয়ালার দোয়া পেয়েছে ওরা, আলিয়ার আরেকটা বাচ্চা হয়েছে। আমরা যখন এই বাড়িটা কিনেছিলাম তখন সবে বাচ্চাটা হয়েছে, একটা ফুটফুটে ছেলে। নাম রেখেছে ‘সুলেমান’।

তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। সে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল, ‘সুলেমান’। তারপর সে ফোনটা কেটে দিল।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সে হাতে ধরা ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে তার স্ত্রী আবার বিয়ে করেছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে সেই ছোট্ট খুরশিদ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে তার বন্ধু জারঘাম এখন আলিয়ার স্বামী আর ওরা তাদের ছেলের নাম রেখেছে তারই নামে। তার গলায় একটা কষ্টের দলা পাকিয়ে উঠল। ঠোঁটদুটোকে পরস্পরের ওপর সে দৃঢ়ভাবে চেপে ধরল।


পরের দিন সে বিছানা ছেড়ে উঠে জানালাটা খুলে দিল। সে ধরা পড়ে বন্দি হবার পর ছ’বছর কেটে গেছে। জলের জগটা তুলে গ্লাসে না ঢেলেই সে সরাসরি জগটা থেকে জল মুখে ঢেলে দিল। ঢক ঢক করে জল পান করছিল সে আর জল উপচে ভিজিয়ে দিচ্ছিল তার বুক। জল পান করার পর জগের বাকি জলটা সে মাথায় ঢেলে আবার বিছানায় ফেরত গেল। সে আপশোশ করছিল কেন সে জারঘামকে তার বৌয়ের গল্প করেছিল। মাথার চুলে আঙুলগুলো চালাতে চালাতে এটাই ভাবছিল সে। একটু সান্ত্বনা তার ছিল যে, সে সরাসরি তার সেই বাড়িতে চলে যায়নি, ভাগ্যিস ফোনটা করেছিল। চলে গেলে প্রতিবেশীরা নির্ঘাৎ চিনতে পারত।

চোখ বুজে আসল তার, গলায় একটা দলা যেন আটকে আছে। তারপর সে ফোনটার দিকে তাকাল। সেই নম্বরটা সে আবার ডায়াল করল, আবার সেই মহিলার জোর গলা ভেসে আসল, ‘আগের দিন ফোনটা রেখে দিলে কেন ভাই?’ উত্তরের অপেক্ষা না করেই মহিলা আবার সোৎসাহে বলে চলল, ‘আমি শবরিকে কল করেছিলাম। ও হল আকবরির পুরনো প্রতিবেশী। বলেছিলাম ওদের আত্মীয় খোঁজ করছে। ও বলল ও নিজেও ঠিক জানে না ওরা কোথায় থাকে। আমার মতোই ও জানে যে চক গুলহাতে থাকে। কিন্তু ও জানিয়েছে আলিয়া শুক্রবার, শুক্রবার কবরখানায় যায়। ওই যে অনামী শহীদদের জন্য টিলার ওপরের যে কবরখানাটা, ওটাতে যায়।’

‘আচ্ছা একজন বৃদ্ধা ওদের সঙ্গে থাকতেন না?’

মহিলা তাকে থামিয়ে বলতে শুরু করে দিল, ‘আরে জানেন না কী হয়েছিল! আপনি কি বিবি জানের কথা বলছেন? যখন আমি ওদের মহাল্লায় থাকতাম তখনই তিনি অসুস্থ ছিলেন, কথা বলতে পারতেন না। প্রতিবেশীদের কাছে শুনেছি ছেলের শহীদ হবার খবর পেয়ে তার একটা স্ট্রোক হয়েছিল। বেচারি এরপর এক বছর বেঁচে ছিল। কথা বলা শেষ হলে মহিলা ফোন রেখে দিলেন। সুলেমান পাশের কিছু একটার ওপর হেলে পড়ল। সে হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করল।

যখন সে চোখ মেলল তখন সকাল। বৃহস্পতিবার সে শহরে বেড়িয়ে পড়ল। একদা আলিয়া আর খুরশিদকে নিয়ে যে যে জায়গায় সে ঘুরত, সেই সমস্ত জায়গাগুলো ঘুরল সে। পুরনো স্মৃতিকে তাজা করে তোলার জন্য যেখানে তারা একসঙ্গে বসত, এক পরিবার হিসাবে, ঠিক সেখানেই সে আবার বসল।

সন্ধেবেলা সে দাড়ি কামাল। ক্ষৌরকার যখন তার ঘাড়ের ওপর জটপাকানো চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে ছাঁটছিল তার সুড়সুড়ি লাগছিল। তার মনে পড়ছিল বাগদানের পর আলিয়া তাকে দাড়ি কামাতে বারণ করেছিল। সে বলেছিল নারীর সৌন্দর্য্য তাদের দীর্ঘ অলকগুচ্ছে আর পুরুষের পুরুষত্ব তাদের শ্মশ্রু আর গুম্ফ-তে। যখন সে প্রথমবার তার দাড়ি রাখল আলিয়ার চোখে সে একটা ঝিলিক দেখেছিল। সে উচ্ছসিত হয়ে তাকে বাহবা দিয়েছিল, বলেছিল দাড়িতে তাকে খুব সুন্দর লাগছে, একেবারে যেন দেবদূত।

তার মনে পড়ছিল আলিয়া পেন্টিং করত। সেই সময়ে আলিয়া দেবদূতদের নিয়ে একটা ছবিতে কাজ করছিল। ছবির দেবদূতদের সবার দীর্ঘ আলুলায়িত কুন্তল ছিল। সে আলিয়াকে মনে করাতে চেষ্টা করেছিল দেবদূত কিন্তু নারীরাও হয়। আলিয়া কর্ণপাত করেনি। পেন্টিংটা শেষ হবার পর আলিয়া ওটা সুন্দর করে মুড়ে তাকে উপহার হিসাবে দিয়েছিল।

সুলেমানের দাড়ি এখন কামানো। পড়ে আছে শুধু গোঁফ। সে গোঁফটা স্পর্শ করল। ক্ষৌরকার বার বার জানতে চাইছিল গোঁফটাকেও কি ফেলে দিতে হবে নাকি। সুলেমান ওপরের দিকে চোখটা রেখে বলেছিল, ‘তোমার কি মনে হচ্ছে, গোঁফে আমাকে মানাবে?’ ক্ষৌরকার ক্যাপটা সরিয়ে তার পিঠ চাপড়ে বলেছিল, ‘গোঁফ ছাড়া একজন পুরুষ, পুরুষই নয়।’ সুলেমান হেসে উঠল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে আয়নায় দেখল। সে নিজেই নিজেকে চিনতে পারছিল না।


পরের দিন সকাল সকাল সে কবরখানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। নিরাপত্তা রক্ষীর ঘরই তখনও খোলেনি। কয়েক ঘণ্টা চলে গেছে এখন সে শুয়ে আছে একটা উইলো গাছের তলায়। মাথার তলায় বালিশ হিসাবে তার ব্যাগটা রেখেছে। চেয়ে চেয়ে দেখছে ওপরে, ঝুঁকে পড়া ডালপালাগুলোকে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে এই গাছটা বার করেছে সে। অনামী শহীদ চিহ্নিত নিজের কবরটাকে খুঁজে বার করা ছাড়া এখন তার কাছে আর কোনো রাস্তা খোলা নেই। অথচ অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সে নিজের নামে চিহ্নিত কোনো ফলক খুঁজে পায়নি। এখন কার্যালয়টা খোলার অপেক্ষা ছাড়া কিছু করার নেই। কার্যালয়ের লোকটা আসার পর সুলেমান তাকে তার নাম আর পদবীটা দিল। লোকটা দেখে বলল কর্তৃপক্ষ এই সুলেমান-এর জন্য একটা জায়গা ঠিক করেছিল কিন্তু তার মেয়ে এতে বাধা দেয়। তার জোরাজুরিতেই এই সুলেমান-কে নিখোঁজের তালিকায় রাখা হয়েছে। তাই এখানে এই নামে কোনো ফলক নেই। কর্মচারী তাকে জানাল, ‘মেয়েটা প্রতি শুক্রবার তার মাকে নিয়ে এখানে আসে। প্রথমে এখানে আসে তারপর অন্য শহীদদের কবরগুলো দেখে ঘুরে ঘুরে। এখানে অফিসেও বহুবার এসে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। মেয়েটা প্রতিবার জানতে চায় তার বাবার সম্পর্কে কেউ খোঁজ করেছিল কিনা। এই প্রশ্নটাই প্রতিবার করে। অসংখ্য পরিবার এখানে এসে তাদের হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের খোঁজ করে। তাদের মানসিক সান্ত্বনার জন্য বহুকাল আগে যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া সেইসব যোদ্ধার অবশেষ হিসাবে আমরা অনেক সময় তাদের হাতে হাড়-গোড় বা অন্য কিছু দেহাবশেষ যত্ন করে মোড়ক বেঁধে তুলে দিই।’

সুলেমানের করতল ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেছিল। চোখ বন্ধ করে ফেলল সে, তারপর কর্মচারীকে ধন্যবাদ জানিয়ে সে চলে আসতে চাইছিল তার নিজের কবর খোঁজাখুঁজি থেকে বা হয়তো নিজের কাছ থেকেই। একটা ঠান্ডা হাওয়া উইলোর ঘন পাতাদের মধ্য দিয়ে ছুটে আসল। সুলেমান গাছটায় পিঠ দিয়ে বসে আছে এখন। তার পা দু’টো মুড়ে বুকের কাছে রেখে জাপটে ধরে আছে, থুতনিটা হাঁটুর ওপর রাখা। সকালে আলো আঁধারি খেলা করছিল কবরগুলোর ওপর, সূর্য অনেকটা উঠে এখন তাদের সরিয়ে দিয়েছে। হাওয়াতে ভাসছে বৃষ্টির গন্ধ। ভেসে আসছে বুনো রু বীজ পোড়া ধোঁওয়া। সময়ে সময়ে ভেসে আসছে প্রার্থনার শব্দ। চারপাশে এখন অনেক লোকজন।

তার মনে পড়ছিল সেই দিনটার কথা যেদিন সদ্যোজাত খুরশিদকে তারা হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে এসেছিল। মেয়ে হয়েছে এটা জানার পর বিবি জান সেটা ঠিক মেনে নিতে পারেনি। সুলেমান যদিও আনন্দে ভেসে গেছিল। বাচ্চাটাকে বুকে চেপে আলিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিল কী নাম রাখতে চায় সে। আলিয়া কেবল তার মাথা নাড়িয়েছিল। তারপর সে বাচ্চাটার মাথায় চুমু খেয়ে বলেছিল, ‘আমি ওর নাম রাখব। ও হল ওর বাবার খুরশিদ, বাবার ‘সূর্য’।’

খুরশিদ যখন বেড়ে উঠছিল, তারা এত জোরে জোরে কবিতা পড়ত যে আলিয়া বাধ্য হত তাদের বাধা দিতে। বাগানে তারা জলাশয়ের পাশে সাজানো পুষ্পাধারগুলোর মধ্যে হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়াত। সে চেঁচাত জোরে, ‘খুরশিদ খানুম, উদিত হও এবং ছড়াও তোমার দীপ্তি। তোমার বাবাকে হ্যালো বলো, খুরশিদ খানুম।’ এরপর সুলেমান গান গেয়ে উঠত।


সে যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে নিথর। সে বুঝতে পারছে তার হৃৎস্পন্দন ধীর হয়ে আসছে। সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এই তো আলিয়া–সুলেমানের আলিয়া। সে ব্যাপারটা হজম করতে পারছে না। অবিশ্বাসে চোখ পিটপিট করছে। তারপর সে নিজেকে সামলে নিল অনেকটা, ভাবল, ‘শেষ পর্যন্ত তুমি এলে।’ আলিয়ার সঙ্গে একটা মেয়ে। তার সমান চেহারার, মাথায় একটা স্কার্ফ পরে আছে, হাসছে। আলিয়ার কাঁধের পাশে তার কাঁধ।

সে নিজের মনে বলে উঠল, ‘এ অবশ্যই তারাই। আলিয়া আর আমার খুরশিদ খানুম।’

গাছের গুঁড়ির আড়ালে সে গা ঢাকা দিল, মুখের সামনে তুলে ধরল তার ব্যাগটা যাতে তাকে চেনা না যায়। আবার মনে মনে বলে উঠল সে, ‘মেয়ে বড় হয়ে গেছে।’

খুরশিদ তার ব্যাগ থেকে কিছু বার করছে–খেজুরের একটা প্যাকেট। মাথায় সবুজ স্কার্ফের তলায় তার অলকগুচ্ছ দৃশ্যমান। প্রয়াতদের প্রতি সে খেজুর উৎসর্গ করছে। সে একেবারে মায়ের মতোই দেখতে হয়েছে। তাকে দেখে তার প্রথম দেখা আলিয়ার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।

খুরশিদ সহসা থমকে দাঁড়াল যেন কেউ তাকে ডেকেছে। একজন ব্যক্তি আর ছোটো একটা ছেলে তার দিকে এগিয়ে আসছে। আলিয়া ছোটো বাচ্চাটাকে লোকটার হাত থেকে নিয়ে নিল। জারঘামকে দেখে তার মনে হল বেশ বয়স হয়েছে চুলগুলো ধূসর হয়ে গেছে।

সুলেমানের মনটা ভেঙে গেছে। সে ফোঁপাচ্ছিল। আলিয়া জারঘামকে অনুসরণ করল, খুরশিদও চলে গেল। সুলেমানের মনে হল তার ভেতরটা যেন ফেটে যাচ্ছে। সে মাটিতে পড়ে গেল। উইলো গাছের তলায় নরম মাটিতে মুখ গুঁজে সে আর্তস্বরে কেঁদে উঠল। তার হাতের মুঠিতে উঠে আসছিল মাটি। তার কান্না থামছিল না। সে চাইছিল তার শ্বাস যেন চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। সে চাইছিল তার হৃৎপিণ্ড যেন থেমে যায়। অশ্রুর বন্যা তার চোখ ধুইয়ে নেমে আসছিল তার পরিস্কার কামানো কুঁচকে যাওয়া ভাঁজ পড়া মুখের ওপর দিয়ে। সে হাঁটু ভাঁজ করে মাথা তুলে বসল তারপর সজোরে মাথাটা ঠুকল মাটিতে, বার বার। ওদের সে কী করে হারাতে পারে!

তার হাঁটু দু’টোও চোখের জলে ভিজে গেছে। আলিয়া চলে গেছে। জারঘাম আর ছোট্ট ছেলেটাও চলে গেছে যার নাম তারই নামে। একজন কেউ মেয়ে যাকে আলিয়ার মতো দেখতে কার্যালয়ের দিকে চলেছে। তার স্কার্টে হাওয়া খেলা করছে। কী জোরেই না সে চলেছে। অবশ্যই সে খুরশিদ হবে। কার্যালয়ের কর্মচারীকে তার একটা প্রশ্ন করার আছে–বহুকাল ধরে বারবার করা সেই একই প্রশ্ন।

সুলেমান উঠে দাঁড়াল, ব্যাগটা তুলে নিল, হাতটা ঝেড়ে নিল তারপর কার্যালয়ের দিকে চলল সে। তার পদক্ষেপ ছিল মন্থর, পা কাঁপছিল। তার মনে হচ্ছিল সে নিজে বোধহয় পা দু’টোকে পেছনে টেনে নিয়ে চলেছে। খুরশিদ দাঁড়িয়ে আছে। কর্মচারী একটা ফোনে ব্যস্ত। এখনও খুরশিদ প্রশ্নটা করার সুযোগ পায়নি। সুলেমান দাঁড়িয়ে পড়ল, সে আশ্চর্য হয়ে ভাবছিল সে কি তাকে বরাবরের মতো হারাতে চায় নাকি চায় না! চোখের জল তার পুরো মুখ ধুইয়ে দিয়েছিল। সে খুরশিদকে হারাতে পারে না, সে তা চায়ও না। সে এবার দৃঢ় পদক্ষেপে তাড়াতাড়ি চলতে শুরু করল, যত তাড়াতাড়ি মেয়েটার কাছে যেতে পারে। এখন তার পেছনেই সে, তার নিশ্বাস ধীর হয়ে আসল।
কর্মচারীটির ফোনে কাজ শেষ হয়েছে, সে এবার চোখ তুলে তাকাল। মেয়েটা প্রশ্ন করল, ‘কাকু, কেউ আমার বাবার সমাধির খোঁজ করতে এসেছিল?’ কর্মচারী উত্তর দেবার জন্য মুখ খুলল, তার দৃষ্টি তখন স্থির ছিল সুলেমানের ওপর।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২