জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী) – অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ( পর্ব ৭ )

জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী) – অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ( পর্ব ৭ )

শেয়ার করুন

মূল স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

পর্ব – ৭

ওই ঘরে একটা তাকের উপর সাধু-সন্তদের প্রমাণ মাপের মূর্তি ছিল। সেগুলো গির্জার মূর্তির তুলনায় অনেক বেশি জীবন্ত, কিন্তু অন্ধকারাচ্ছন্ন। ওখানে ঘুমোতেন দাদুর এক তুতো বোন ফ্রান্সিসকা সিমোদোসেয়া মেহিয়া। তাঁকে আমরা ডাকতাম ‘তিয়া মামা’[১] বলে। তাঁর বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকে এই বাড়িতেই থাকতেন এবং এমনভাবে থাকতেন যেন তিনিই এ বাড়ির গিন্নি। আমি শুতাম ঠিক তাঁর পাশে একটা হ্যামক টাঙিয়ে আর প্রচণ্ড ভয় পেতাম ওই সব মূর্তিগুলোকে দেখে। অনির্বাণ পবিত্র দীপের আলোয় তারা মিটমিট করে জ্বলত। সকলের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত সেই দীপ নেভানো হয়নি। আমার মাও বিয়ের আগে ওই ঘরে শুতেন আর ওই মূর্তিগুলো দেখে তিনিও ভয় পেতেন।

বারান্দার একেবারে শেষের ঘর দুটোয় আমার ঢোকা নিষিদ্ধ ছিল। প্রথম ঘরটায় থাকত এক মামাতো বোন—আমার মামা হুয়ান দে দিয়োসের এক মেয়ে সারা এমিলিয়া মার্কেস। দাদু-দিদিমাই তাকে মানুষ করেছিলেন। বিয়ে হওয়া পর্যন্ত সে ও ঘরেই ছিল। খুব ছোটো থেকেই তার মধ্যে ছিল এক সহজাত স্বতন্ত্রতা ও দৃঢ় ব্যক্তিত্ব। তার জন্যই আমার মধ্যে প্রথম সাহিত্যের প্রতি আগ্রহের সূচনা হয়। তার সংগ্রহে ছিল কাইয়েখা প্রকাশনীর বহুবর্ণে চিত্রিত একটা দারুণ গল্পের বই। কিন্তু কোনোদিন সে বইতে আমায় হাত দিতে দেয়নি, পাছে নষ্ট করে দিই। সেটাই ছিল লেখক হিসেবে আমার প্রথম তিক্ত হতাশা।

তারপর একেবারে শেষের ঘরটায় ছিল পুরোনো আসবাব ও তোরঙ্গ রাখার জায়গা। ওই ঘরের প্রতি আমার যে কতদিন ধরে কী অদম্য কৌতূহল ছিল! কিন্তু কোনোদিনই আমাকে সেসব জিনিস আবিষ্কার করতে দেওয়া হয়নি। অনেক পরে জেনেছিলাম যে ওখানেই ছিল সেই সত্তরটা মূত্রধানী যা আমার মা তার সহপাঠিনীদের ছুটি কাটানোর জন্য বাড়িতে নিমন্ত্রণ করলে কেনা হয়েছিল।

এই ঘরদুটোর উলটোদিকে ওই একই বারান্দার পাশে ছিল বড়ো রান্নাঘর। সেখানে ছিল পুরোনো দিনের পোড়া পাথরের তৈরি কয়েকটা তোলা উনুন আর দিদিমার নিজস্ব কাজের জন্য একটা বিরাট চুলা। দিদিমা কেক ও পেস্ট্রি তৈরি করতেন বিক্রির জন্য। চিনির মঠের ছোটো ছোটো জন্তুজানোয়ার তৈরির রসালো গন্ধে সকালটা ভরে থাকত। ওখানেই ছিল বাড়ির মেয়েদের ও পরিচারিকাদের রাজত্ব। দিদিমার বিভিন্ন রকমের কাজে তাঁকে সাহায্য করার সময় তারা সবাই একসঙ্গে গান গাইত। দিদিমাও তাদের সঙ্গে যোগ দিতেন। তখন আরেকজন তাদের সঙ্গে গলা মেলাত—লোরেন্সো এল মাগনিফিকো, একশো বছর বয়সের এক টিয়াপাখি, প্রমাতামহের কাছ থেকে উত্তরাধিকারীসূত্রে প্রাপ্ত। পাখিটা স্পেন-বিরোধী শ্লোগান দিত আর স্বাধীনতা যুদ্ধের গান গাইত। সে এতটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল যে একবার কড়ার ঝোলের মধ্যে পড়ে যায়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে গিয়েছিল, কারণ ঝোলটা তখন সবেমাত্র ফুটতে শুরু করেছে। আরেকবার, সেদিন ছিল বিশে জুলাই, দুপুর তিনটের সময় প্রচণ্ড চিৎকার করে একেবারে বাড়ি মাথায় করে তুলল:

—‘ষাঁড়! ষাঁড়! ষাঁড় আসছে!’

বাড়িতে তখন শুধু মেয়েরা ছিল। ছেলেরা গেছে স্বাধীনতা দিবসে এলাকার ষাঁড়ের লড়াই দেখতে। পাখির চিৎকার শুনে মেয়েরা সবাই ভেবেছিল বুড়ো বয়সে ওর মতিভ্রম হয়েছে বুঝি। এমনকি পাখিটার সঙ্গে যারা কথা বলতে জানত, তারাও তার চিৎকারের অর্থ কেবল তখনই বুঝতে পারল যখন লড়াইয়ের একটা ষাঁড় আটকে রাখার জায়গা থেকে পালিয়ে এসে প্রচণ্ড গর্জন করে রান্নাঘরের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল আর অন্ধের মতো বেকারির সব জিনিস ও উনুনের উপর রাখা বাসনপত্র মুহূর্তের মধ্যে তছনছ করে দিল। তখন আমি যেদিকে যাচ্ছিলাম তার ঠিক উলটোদিক থেকে ঝড়ের গতিতে ছুটে আসা মেয়েরা আমায় কোলে তুলে নিয়ে ভাঁড়ার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। ওদিকে রান্নাঘরে সেই ছাড়া পাওয়া ষাঁড়টার প্রচণ্ড গর্জনে ও সিমেন্টের মেঝের উপর তার খুরের আওয়াজে গোটা বাড়িটা যেন কাঁপছে। পরমুহূর্তে তাকে দেখা গেল ঘরের একটা ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে। তার নিশ্বাসের জ্বলন্ত বাষ্প ও বড়ো বড়ো লাল চোখ দেখে ভয়ে আমার রক্ত হিম হয়ে এল। তারপর লড়াইয়ের লোকেরা এসে ষাঁড়টাকে বাগে এনে ফের মাঠে নিয়ে গেল। কিন্তু ততক্ষণে বাড়িতে শুরু হয়ে গেছে নাটকের মহড়া। সেটা চলেছিল এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে। কাপের পর কাপ কফি আর কেক সহযোগে সেই উত্তেজিত, দুর্যোগ-অতিক্রান্ত মহিলার দল একই গল্প বার বার বলে চলেছিল আর প্রতিটি গল্প ছিল আগেরটার চেয়ে বেশি বীরত্বপূর্ণ।

উঠোনটা যে খুব বড়ো ছিল, তা নয়। কিন্তু সেখানে অনেক রকমের গাছ ছিল। আর ছিল মাথা খোলা একটা স্নানের জায়গা। তার মধ্যে বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্য একটা চৌবাচ্চা। তাছাড়া একটা লকপকে মই বেয়ে তিন মিটার মতো উঠতে হত এমন একটা উঁচু প্ল্যাটফর্মে রাখা ছিল দুটো বিরাট বড়ো বড়ো কাঠের পিপে যেগুলোতে দাদু প্রতিদিন ভোরবেলা হাতে চালানো পাম্পের সাহায্যে জল ভরতেন। তার ওপাশে ছিল অমসৃণ কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি আস্তাবল ও পরিচারকদের থাকার ঘর। আর একেবারে পেছনে বিশাল আকারের খিড়কি বাগানে ছিল অনেক ফলের গাছ ও একমাত্র বাথরুম, যেখানে আদিবাসী পরিচারিকারা সারা দিন ধরে বাড়ির সব মূত্রধানী খালি করত। গাছেদের মধ্যে সবচেয়ে ঘন ও ছায়াপ্রদায়ী একটা বাদাম গাছ দাঁড়িয়ে থাকত এই পৃথিবীর একেবারে শেষ প্রান্তে, সময়েরও প্রান্তসীমায়। তার ছায়ানিবিড় প্রাচীন শাখা-প্রশাখার নীচে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে করতে নিশ্চয়ই মারা গিয়েছিলেন দুজনেরও বেশি মানুষ। তাঁরা গত শতাব্দীর অসংখ্য যুদ্ধের অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক।

আমার জন্মের সতের বছর আগে যখন ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি কলাচাষের একচেটিয়া দখল নেওয়া শুরু করল তখন আমার দাদামশাইয়ের পরিবার আরাকাতাকায় আসে। সঙ্গে এনেছিলেন তাঁর একুশ বছরের ছেলে হুয়ান দে দিয়োস ও দুটি মেয়ে, উনিশ বছরের মার্গারিতা মারিয়া মিনিয়াতা দে আলাকোকে আর পাঁচ বছরের লুইসা সান্তিয়াগা, আমার মা। আমার মায়ের জন্মের আগে দুটি যমজ সন্তান দিদিমার গর্ভাবস্থায় চারমাসের মাথায় হঠাৎ মারা যায়। তারপর আমার মা গর্ভে আসলে দিদিমা বলে দেন যে এটাই শেষবার। তখন তাঁর বয়স বিয়াল্লিশ। প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে একই বয়সে এবং অবিকল একই রকম পরিস্থিতিতে একাদশ সন্তান এলিহিও গাব্রিয়েলের জন্মের সময় আমার মা হবহু একই কথা বলেছিলেন।

দাদু-দিদিমার কাছে আরাকাতাকায় আগমন ছিল অনেকটা বিস্মরণের দিকে যাত্রা। তাঁরা সঙ্গে করে এনেছিলেন দুজন গুয়াখিরো[২] ছেলে–আলিরিয়ো ও আপোলিনার এবং একটি মেয়ে–মেমে। নিজেদের গ্রামেই তাদের কিনেছিলেন, মাথাপিছু একশো পেসো করে দিয়ে, যদিও তার অনেক আগেই দাসপ্রথা অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কর্নেল প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন অতীতকে আবার গড়ে তোলার জন্য, তবে অতীতের দুঃস্বপ্ন থেকে দূরে, যতটা সম্ভব দূরে। কেন-না আত্মমর্যাদার জন্য একটা মানুষকে তিনি মেরে ফেলেছিলেন। সেই ভয়ংকর অনুতাপ তাঁকে ক্রমাগত তাড়না করে বেড়িয়েছিল। অনেক বছর আগেই তিনি এই অঞ্চলটি দেখেছিলেন, একবার একটি যুদ্ধে যোগ দিতে যাওয়ার পথে এবং অন্যবার জেনারেল হিসাবে নেরলান্দিয়া চুক্তির সময় উপস্থিত থাকার জন্য সিয়েনাগা হ্রদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়।

অবশ্য নতুন বাড়ি তাঁদের জীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনল না। অনুতাপের রেশ এত বেশি ধ্বংসাত্মক ছিল যে তাদের কোনো পাগলাটে প্রপৌত্রকেও তা সংক্রামিত করার ক্ষমতা রাখত। আমরা সেই ঘটনার একটা ক্রম তৈরি করেছিলাম দিদিমা মিনার আবেগতাড়িত ও বহুবার বলা স্মৃতিচারণ থেকে, যদিও ততদিনে তিনি অন্ধ এবং অর্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। যাই হোক, যে ট্রাজেডি ঘটতে চলেছিল সে সম্বন্ধে অনেকে অনেক কিছু জানলেও মিনাই ছিলেন একমাত্র মানুষ যিনি তা জানতে পেরেছিলেন দ্বন্দ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর।

ঘটনাটা ঘটেছিল বাররানকাসে। বাররানকাস সিয়েররা নেবাদা পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত একটি শান্ত ও সমৃদ্ধ জনপদ। সেখানে কর্নেল তাঁর বাবা ও ঠাকুরদার কাছ থেকে সোনার কাজ শিখেছিলেন। শান্তিচুক্তি হওয়ার পর তিনি আবার সেখানেই ফিরে যান। তাঁর প্রতিপক্ষ মেদার্দো পাচেকো ছিল খুব বড়োসড়ো চেহারার এক গরিব, খ্রিস্টধর্মে (ক্যাথলিক) বিশ্বাসী কৃষক। দাদুর চেয়ে বয়সে ষোল বছরের ছোটো। তবে কর্নেলের মতোই সে ছিল নিবেদিতপ্রাণ উদারপন্থী। কিছুদিন হল বিয়ে করেছে, দুটি সন্তানও আছে। কর্নেলের কাছে এটা খুবই দুঃখজনক ছিল যে যুদ্ধক্ষেত্রের অগণিত অচেনা শত্রু যাদের সঙ্গে তিনি মোকাবিলা করেছেন তাদের বদলে নিজেরই এক পুরোনো বন্ধু, একই দলের লোক এবং হাজার দিনের যুদ্ধের সহযোদ্ধার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত মরণপণ লড়াইতে নামতে হয়েছিল। আবার তা ঘটেছিল ঠিক সেই সময় যখন দুজনেই ভাবছিলেন যে তাঁরা শান্তি অর্জন করতে পেরেছেন।

সেটাই ছিল বাস্তব জীবনের ঘটনা প্রথম ঘটনা যা আমার লেখক সত্তাকে নাড়া দিয়েছিল এবং এখনও পর্যন্ত যে ভূত ঘাড় থেকে নামাতে পারিনি। যবে থেকে চিন্তাভাবনা করতে শিখেছি তখন থেকেই বুঝতে পেরেছি ওই ঘটনার কী প্রবল চাপ আমাদের পরিবারের উপর পড়েছিল। কিন্তু তাঁর খুঁটিনাটি ছিল অন্ধকারে আবৃত। আমার মা, তখন তাঁর বয়স ছিল বছর তিনেক, ঘটনাটাকে সবসময় মনে করতেন একটা অসম্ভব স্বপ্নের মতো। বড়োরা ঘটনাটাকে আমার সামনে অকারণ জটিল করে বলতেন যাতে আমি বিভ্রান্ত হই। বস্তুত আমি কোনোদিনই ধাঁধাটা সম্পূর্ণ করায়ত্ত করতে পারিনি, কেন-না দু’পক্ষের সবাই নিজের নিজের মতো করে তাকে সাজাত। সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য বয়ানটি হল, কর্নেলের একটি বাজে মন্তব্যে মেদার্দো পাচেকোর মা অপমানিত বোধ করেন এবং ছেলেকে তার প্রতিশোধ নিতে প্ররোচিত করেন। কর্নেল তা অস্বীকার করেন, বলেন যে তা মিথ্যা এবং প্রকাশ্যে তার ব্যাখ্যাও দেন। কিন্তু তাতে মেদার্দো পাচেকোর বিদ্বেষ দ্রবীভূত হয় না। বরং সে লাঞ্ছিত থেকে লাঞ্ছনাকারীর ভূমিকায় উত্তীর্ণ হয় ও কর্নেলের উদারপন্থী আচরণ সম্পর্কে একটি গভীর অবমাননাকর মন্তব্য করে। যদিও সেই মন্তব্যটা কী ছিল তা আমি আজও জানতে পারিনি। এরপর অসম্মানিত কর্নেল তাকে আমৃত্যু দ্বৈরথের চ্যালেঞ্জ জানান, তবে নির্দিষ্ট কোনো দিনের উল্লেখ তখন তিনি করেননি।

কর্নেলের চরিত্র বৈশিষ্ট্যের একটি উল্লেখযোগ্য দিক প্রকাশিত হয় প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ জানানো ও দ্বৈতযুদ্ধের দিনের মধ্যে সময়ের একটা দীর্ঘ ব্যবধান রাখার মধ্যে দিয়ে। তিনি একেবারে নিঃশব্দে তাঁর সমস্ত কাজকর্ম গুছিয়ে নিতে লাগলেন যাতে পরিবারের সুরক্ষায় কোনো ফাঁক না থাকে। কারণ নিয়তি তখন তাঁর সামনে দুটি মাত্র পথ খোলা রেখেছে: হয় মৃত্যু নয় কারাবাস। সর্বশেষ যুদ্ধের পরে নিজের যেটুকু যা অবশিষ্ট ছিল বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে তা বিক্রির ব্যবস্থা করলেন। যৎসামান্য যে সম্পত্তি তাঁর ছিল তা হল একটা স্যাঁকরার দোকান ও বাবার কাছ থেকে পাওয়া একটা ছোট্ট খামার, যেখানে ছাগল পালন করতেন ও একটা অংশে আখের চাষ করতেন। ছ’মাস পরে প্রাপ্ত সব অর্থটুকু আলমারির পেছন দিকের একটা খোপে লুকিয়ে রাখলেন এবং নিঃশব্দে সেই দিনটার অপেক্ষা করতে লাগলেন যা তিনি নিজেই স্থির করে দিয়েছিলেন: ১৯০৮-এর ১২ই অক্টোবর, আমেরিকা আবিষ্কারের বর্ষপূর্তির দিন।

মেদার্দো পাচেকো গ্রামের বাইরে বাস করত। কিন্তু দাদু জানতেন যে ‘বিরহেন দেল পিলার’[৩]-এর শোভাযাত্রায় সে না গিয়ে থাকতে পারবে না। তাকে খুঁজতে বেরনোর আগে কর্নেল স্ত্রীকে একটা ছোটো, স্নেহপূর্ণ চিঠি লিখে রেখে যান। চিঠিতে বলে দেন কোথায় তিনি টাকা লুকিয়ে রেখেছেন আর ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শেষ কয়েকটি নির্দেশ মাত্র। তাঁরা যে বালিশে শুতেন তার নীচে চিঠিটা রেখে দিলেন যাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় তাঁর স্ত্রীই একমাত্র তা আবিষ্কার করেন। তারপর কাউকে কোনো রকমের কোনো বিদায় না জানিয়েই সেই দুর্ভাগ্যের উদ্দেশ্যে নির্গত হলেন।

এমনকি যেসব রটনা প্রায় ভিত্তিহীন বলা যায় তাতেও এই একটি ব্যাপার নিয়ে কোনো দ্বিমত ছিল না যে দিনটা ছিল ক্যারিবিয়ার অক্টোবর মাসের এক মঙ্গলবার। সেদিন নীচু মেঘ থেকে বিষণ্ণ বৃষ্টি পড়ছিল আর বাতাস ছিল বিষাদগ্রস্ত। মেদার্দো পাচেকো রবিবারের পোশাক পরে সবেমাত্র একটা কানা গলিতে ঢুকেছে, সঙ্গে সঙ্গে কর্নেল তার পথ রোধ করে দাঁড়ালেন। দুজনেই সশস্ত্র। বহু বছর পরে আমার দিদিমা তাঁর অসংখ্য প্রলাপের মধ্যে বলতেন: ‘ঈশ্বর নিকোলাসিতোকে একটা সুযোগ দিয়েছিল ওই বেচারা লোকটাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য, কিন্তু সে তার সদ্ব্যবহার করতে পারল না।’ দিদিমা একথা ভেবেছিলেন সম্ভবত এই কারণে যে কর্নেল তাঁকে বলেছিলেন প্রতিপক্ষকে যখন হঠাৎ পথের মাঝে আটকে দিয়েছিলেন তখন তার চোখে অনুতাপের একটা ঝলক দেখতে পেয়েছিলেন। এছাড়াও কর্নেল তাঁকে বলেছিলেন সেইবা বৃক্ষের মতো সেই বিরাট দেহটা যখন ঘাসের জঙ্গলে নেতিয়ে পড়ল, সে কোনো কথা বলেনি, ‘ভিজে বেড়ালছানার মতো’ শুধু একটা শব্দ করেছিল। তারপর গ্রামপ্রধানের কাছে আত্মসমর্পণের আগে কর্নেল গুরুগম্ভীর এক প্রবাদ বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন: ‘ক্ষমতার অস্ত্রকে সম্মানের অস্ত্র পরাজিত করেছে।’ সেই সময়ে উদারপন্থী মতবাদীদের কাছে এই বাক্যটা খুবই মূল্যবান ছিল। কিন্তু দাদুর মেজাজের সঙ্গে এই কথাটাকে আমি কোনোদিন খাপ খাওয়াতে পারিনি। সত্যি বলতে কি এই ঘটনার কোনো সাক্ষী ছিল না। কোর্টে আমার দাদু ও তাঁর সময়কার দুই পক্ষের অন্যান্যদের দেওয়া জবানবন্দি একটি বিশ্বাসযোগ্য উৎস হতে পারত, কিন্তু কিছু কাগজপত্র সেই সময় থাকলেও পরবর্তীকালে আর তাদের ছায়াটুকুরও অস্তিত্ব ছিল না। আর সেই ঘটনা সংক্রান্ত যে অসংখ্য গল্প আমি আজ পর্যন্ত শুনেছি তার কোনো দুটোর মধ্যে কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পাইনি।

এই ঘটনাটা গোটা গ্রামের মৃতের পরিবারসহ সব পরিবারকে দু’দলে ভাগ করে দিল। একটা দল যখন এর প্রতিশোধ নিতে চাইল, তখন অন্য দলটা ছেলেমেয়েসহ ত্রাঙ্কিলিনা ইগুয়ারানকে তাদের বাড়িতে জায়গা দিল যতক্ষণ না প্রতিশোধস্পৃহা স্তিমিত হয়ে যায়। এই সব খুঁটিনাটি বর্ণনা ছেলেবেলায় আমাকে এমন প্রভাবিত করেছিল যে নিজেকেও পূর্বপুরুষের সেই পাপের ভাগীদার বলে মনে হত। শুধু তাই নয়, এখন যখন একথা লিখছি নিজের পরিবারের থেকেও মৃতের পরিবারের প্রতি বেশি সহমর্মিতা অনুভব করছি।

নিরাপত্তার খাতিরে পাপালেলোকে প্রথমে রিওয়াচা ও পরে সান্তা মার্তায় নিয়ে যাওয়া হয়। সান্তা মার্তায় তাঁকে এক বছর কারাবাসের শাস্তি দেওয়া হল, যার অর্ধেক সময় নির্জন কক্ষে ও বাকি অর্ধেক সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে। জেল থেকে মুক্ত হয়ে অল্প সময়ের জন্য তিনি পরিবার সহ সিয়েনাগা জনপদে বাস করেছিলেন। তারপর পানামায় চলে যান, সেখানে বিবাহ-বহির্ভূত একটি কন্যা জন্মায় তাঁর। সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত অস্বাস্থ্যকর ও বন্ধুহীন ছোট্ট শহর আরাকাতাকায় আসেন, অর্থদপ্তরের আঞ্চলিক অফিসে কর-আদায়কারীর কাজ নিয়ে। তিনি জীবনে আর কখনও অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় বের হননি, এমনকি কলা কোম্পানির অরাজকতার সময়েও নয়। শুধুমাত্র বালিশের নীচে একটা রিভালবার নিয়ে ঘুমোতেন, পরিবারের সুরক্ষার জন্য।

টীকা:

১। তিয়া মামা: ইংরাজিতে এর অর্থ Aunt Mama
২। গুয়াখিরো: কলোম্বিয়া ও ভেনেসুয়েলার এক বিশেষ আদিবাসী সম্প্রদায়।
৩। বিরহেন দেল পিলার: মা মেরীকে কেন্দ্র করে ক্যাথলিক ধর্মের একটি উৎসব।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২