ওরাও পাহাড়ে চড়ল – সৌরভ কুমার চলিহা অনুবাদ : অভিজিৎ লাহিড়ী

ওরাও পাহাড়ে চড়ল – সৌরভ কুমার চলিহা অনুবাদ : অভিজিৎ লাহিড়ী

শেয়ার করুন

[লেখক পরিচিতি : সৌরভ কুমার চলিহা, বিখ্যাত অসমিয়া ছোটো গল্পকার। লেখকের আসল নাম সুরেন্দ্রনাথ মেধী। ১৯৩০ সালে অসমের দরং জেলার, মঙ্গলদৈ শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে তাঁর ছোটোগল্পের সংকলন ‘গুলাম’-এর জন্য তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান। ২০১১ সালে গুয়াহাটিতে তাঁর মৃত্যু হয়।]

—দূরে ওটা কীসের আলো?
—মশালের। ওটা একটা খাসিয়া গ্রাম, স্মিট বা ওরকমই কিছু নাম। হয়তো লাইটকর। বা লুম সিয়েম।
—তুমি ভালো করে জানো না?
—বহুদিন হল, ভুলে গেছি।
—কী হচ্ছে ওখানে?
—আজ উৎসবের রাত।
—নংক্রেম নাচ?
—না, নংক্রেম নাচের সময় বোধহয় এটা নয়। হয়তো শাড সুক মিনসিয়েম বা অন্য কোনো উৎসব।
—আর ওটা কীসের শব্দ?
—ঢোলের। আর বাঁশি, ওই শোনো গানের সুর। শুনতে পাচ্ছ? ওই যে গিটারের ঝংকার।
—ওটা গিটারের আওয়াজ?
—হয়তো বা দোতারা। খাসিয়া বাদ্যযন্ত্র। স্প্যানিশ গিটারের মতো।
—এতদূর থেকেও বেশ ভালো শোনা যাচ্ছে।
—আর এত দূর থেকেও মশালের ছোটো ছোটো আলো বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। আর একটু উঠলেই দেখতে পাবে, তলে, নীচে অসংখ্য ছোটো ছোটো আলোর বিন্দু।
—ওটা কী?
—ওটাই শিলং।
—তুমি ওই পাহাড়ের কোথায় কী আছে সব জানো? ওই গ্রামটায় কীভাবে যাওয়া যায় জানো?
—সব জানি না, কিছু কিছু জানি।
—ওই পাহাড়ের কথাই কি তুমি আমায় লিখেছিলে? এই পাহাড়েই কি তুমি একা চড়তে এসেছিলে?
—হ্যাঁ, এটাই তোমাকে লেখা সেই পাহাড়। এই পাহাড় চড়তেই মাঝে মাঝে আসতাম, যখন তোমার কথা খুব মনে পড়ত। প্রথমে একা আসিনি। শুরুতে বিভা-নিভাদের সঙ্গে ভোর ভোর থাকতে ঘুরতে আসতাম। খুব ভোরে। পরে নিজে নিজেই পাহাড়টা চিনতে পারতাম।
—বিভা-নিভারা তখন খুব ছোটো ছিল, তাই না?
—ছয় আর আট বছর। এখন তো বেশ বড়োসড়ো হয়েছে। পাঁচ বছর আগের কথা। ক্লান্ত লাগছে?
—না, একেবারেই নয়।
—আর একটু চড়তে পারবে?
—পারব, পারব। তোমার শিলঙের আলো দেখার ইচ্ছে আমারও হচ্ছে।
—এই পাহাড়ে এলেই মনে পড়ে যায় বহুদিন আগে পড়া একটা গল্পের কথা। গল্পটা মনে নেই, শুধু নামটা মনে আছে, “ওরা পাহাড়ে চড়ল”।
—ওরা পাহাড়ে চড়ল। নামটা তো বেশ।
—আমি তোমার কথা ভাবতাম। ভাবতাম, তুমি আর আমি পাহাড়ে চড়ব, সবচেয়ে উঁচু, সবচেয়ে বন্ধুর পাহাড়টায় চড়ব। ভাবতেই পারিনি কখনও সত্যি হবে।
—কিন্তু আজ তো তোমার সঙ্গে পাহাড়ে চড়ছি।
—আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমরা এভাবে পাহাড় চড়তে পারব। আমি শুধু পাহাড়টায় চড়তে চাই না, শুধু পাহাড় নয়, পাহাড়ের সঙ্গে সেখানে তোমাকেও চাই, ঠিক যেমন পাহাড়টার সঙ্গে তার নুড়ি পাথরগুলো আর ঝর্নাটাকেও চাই, ঘাস আর সরল গাছগুলোকেও চাই।
—পাহাড়টা তোমার, ঝর্না আর গাছগুলোও তোমার।
—আমার একটা ইচ্ছা আজ পূর্ণ হল।
—আর অন্য ইচ্ছাটা?
—অন্য ইচ্ছাটা পূর্ণ করার সাহস আর নেই। পাঁচ বছর আগের ইচ্ছা। এখনও মাঝে মাঝে মন চায়, কিন্তু আজকাল আর সাহস হয় না, অধিকার নেই। দেখতে পাচ্ছ কিছু?
—না। কী?
—অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর কুয়াশা পড়বে। তোমার পায়ের তলায় নুড়িগুলোর শব্দ শুনতে পাচ্ছ?
—পাচ্ছি।
—আর সরল গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে বাতাসের সো-সো শব্দ?
—হুঁ।
—আর দূরে কোথাও ঝিঁঝির ডাক।
—হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি।
—একটা বইয়ের নাম মনে পড়ছে। জাপানি কবিতা। ‘ভরা চাঁদ আর ঝিঁঝির ডাক’। আজ আকাশে চাঁদ নেই, কিন্তু তারা আছে।
—ভরা চাঁদ আর ঝিঁঝির ডাক। কী সুন্দর নাম। তুমি কত কী যে পড়েছ!
—আর লিখেছি। আমার পাঁচ বছর আগের চিঠির কথা মনে আছে? কীভাবে মাসির বাড়ির নাম করে শিলঙে চলে আসতাম, আর তোমার কথা ভাবতাম।
—মনে আছে। তুমি লিখেছিলে সন্ধ্যার অন্ধকার নামার আগে পাহাড়ের একটা পাথরের ওপর তুমি এসে বসেছ। অনেক নীচে মোটা একগাছা সুতোর মতো একটা ঝর্না বয়ে চলেছে, তার কুলকুল শব্দে নির্জন পাহাড়ের সন্ধ্যাটা ভরে উঠেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোনো মানুষের দেখা নেই, শুধু মাঝে মাঝে হঠাৎ কোনো এক খাসিয়া কাঠুরিয়া কাঁধে খড়ির বোঝা নিয়ে পাহাড়ের কোনো এক বাঁক থেকে বেরিয়ে এসে তোমার পাশ দিয়ে আঁকা-বাঁকা পথে নীচে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, আর এই পাহাড়, আর ঝর্না আর সরল গাছগুলো আর তোমার সমস্ত চিন্তা-ভাবনা আর আকাঙ্ক্ষার ওপর দিয়ে হু-হু শব্দে বাতাস বয়ে চলেছে, তোমার চুল আর গলার মাফলার বিশৃঙ্খল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
—তোমার ঠিকই মনে আছে। সেই চিন্তার আর সেই আকাঙ্ক্ষার শেষ আজও হয়নি, কিন্তু আগের মতো সাহস আর নেই, অধিকার নেই। ঠান্ডা লাগছে?
—না। বাতাসটা ঠান্ডা নয়, বরং ভালোই লাগছে। তোমার মাফলার এনেছ?
—হ্যাঁ, তুমি আমার ওভারকোটটা নেবে?
—না, থাক। তোমার জুতোর নীচে নুড়ি আর ঘাসের শব্দ আমিও শুনতে পাচ্ছি। রাতে শিশির পড়লে কি ঘাসের এমন শব্দ শোনা যাবে?
—না, রাতে এমন শব্দ হয় না। তুমি সো সো থামের নাম শুনেছ?
—সো সো থাম? না শুনিনি। খাসিয়া নাম?
—একজন খাসিয়া কবি। মারা গেছেন। তোমার কথায় তার একটা কবিতা মনে পড়ে গেল :
“ভোরে শিশিরবিন্দু আলোতে ঝলমল করে ওঠে। আমিও মুক্তার খোঁজে চলে যাবো বাড়ি থেকে বহুদূর। বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে আমার খুব কষ্ট হবে। তখন চোখের কোলে জমে থাকা জলই হবে আমার মুক্তা।” আমিও আজ পাঁচ বছর বাড়ি ছেড়ে অনেক ঘুরলাম… তুমি আবার হোঁচট খাচ্ছ, আমার হাত ধরো। আর মাত্র দুটো ধাপ, তারপর তুমি একটা সুন্দর জিনিস দেখতে পাবে।
—শিলঙের আলো?
—না, অন্য একটা আলো। বহুদিন আগের একটা আলো। আজও হয়তো আছে।
—কী? বল না, কী?
—একটু পরেই দেখতে পাবে। এসো, আমার হাত ধরো। আর একটু উঠতে হবে, এসো।
—কীসের আলো জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে, খুব কৌতূহল হচ্ছে।
—আর একটু দূর।
—তোমার ইচ্ছাটা পূরণ কর না কেন? এই ক’বছরে চার-পাঁচবার তোমাকে ফিরিয়েছি, ফেরাতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু এখন আমি তো তোমার সঙ্গে, আজ তো আমি তোমার সঙ্গে তোমার পাহাড়ে চড়ছি…?
—তা ঠিক। আর এই চার-পাঁচবারের পর তুমি আমাকে বলেছিলে, যে ইচ্ছাপূরণ হওয়ার কোনো আশ্বাস নেই, কোনো প্রতিশ্রুতি নেই, সেই ইচ্ছা আমি যেন আর না করি। আমি তোমাকে বলেছিলাম, বেশ, তাই হবে।
—সত্যি, অবস্থার চাপে আমি তা-ই বলেছিলাম। বলতে বাধ্য হয়েছিলাম পরিস্থিতির চাপে।
—হুঁ, তা-ও ঠিক।
—তুমি কি সেই কথাই ধরে থাকবে?
—ধরে না থাকলে কি তুমি খুশি হবে? তোমাকে কথা দিয়েছিলাম ।
—হ্যাঁ, তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে। আর সেই কথা তুমি আঁকড়ে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক… আর কতদূর? কীসের আলো জানতে বড়ো ইচ্ছে করছে।
—আর একটু। ততক্ষণ বরং শোনো আরও একবার, শোনো, দূরের সেই খাসিয়া গ্রামটিতে ঢোল আর গিটার, আমাদের গল্প আর ওদের গান, ঝিঁঝির ডাক, ঝলমলে মশালের আলো আর রাশি রাশি স্থির শান্ত তারা… এই তো এসে গেলাম, এই ধাপটার ওপরে উঠে এসো। এই সরল গাছ দুটির মধ্যে দিয়ে দেখো… দেখেছ?
—হ্যাঁ দেখেছি। একটা তারা। একটা সুন্দর তারা।
—সরল গাছ দুটোর মাঝে কীভাবে হেলে স্থির হয়ে রয়েছে। কখনও তারাটা সেখান থেকে সরে যায়, তখন আমাকে অন্য একটা পাথরের ওপরে বা অন্য কোথাও গিয়ে দাঁড়াতে হয়। তাহলে তারাটা ঠিক এভাবে সরল গাছ দুটোর মধ্যে দিয়ে দেখা যায়। কখনও বা তারাটা বহু ওপরে বা অনেক নীচে নেমে যায়, তখন তারাটাকে কোনোভাবেই আর সেই আগের জায়গায় আনা যায় না।
—তখন তোমার খুব খারাপ লাগে?
—তখন আমার খুব খারাপ লাগে।
—এত সুন্দর একটা তারা!
—আমার তারা, আমার আলো, আমার সত্তা। তোমার তারা।
—আমার তারা?
—তোমারই তারা। তারাটা তোমাকে দিলাম।
—ধন্যবাদ। এটা তাহলে এখন আমার সম্পত্তি? আমার যেভাবে ইচ্ছে ব্যবহার করতে পারব? সে আমার কথা শুনবে তো?
—কেন শুনবে না? দরকার হলে তোমার জন্য সে প্রাণ দেবে।
—ও। তোমার দেওয়া তারা! নিশ্চয়ই আমার কথা শুনবে, নিশ্চয়ই দরকারে নিজের প্রাণও দেবে।
—তুমি আমাকে আমার পাহাড়টা দিলে, আমি তোমাকে তোমার তারা দিলাম। আজ খাসিয়া গ্রামে উৎসবের রাত, আজ ঝিঁঝির ডাক, ঝর্নার কুলুরব আর সরল গাছের শিস-দেওয়া বাতাসকে ছাপিয়ে পাহাড়ের বুকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে খাসিয়া তরুণ-তরুণীদের গান আর গিটার আর ঢোলের আওয়াজ, আজ খাসিয়াদের আনন্দের রাত, আজ তাদের প্রাপ্তির রাত, আজ তারা-ভরা আকাশ, আর শহরের আলোকমালাকে নিষ্প্রভ করে হাজার হাজার মশালের আলো, আজ এখন খাসিয়া তরুণ-তরুণীদের অঙ্গে অঙ্গে উত্তেজনা, তাদের বাহুতে আর পায়ে স্বতঃস্ফূর্ত নৃত্যের ছন্দ, আজ এখন দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে ঢোলের তাল, আজ এখন তোমার জন্য সঞ্চয় করে রাখা তারাটা তোমাকে দিলাম, তোমাকে দেওয়ার ইচ্ছে আমার পূর্ণ হল।
—আর আমার কাছে চাওয়ার ইচ্ছাটা? আমার কাছে চাওয়ার ইচ্ছাটা পূর্ণ করছ না?
—তোমাকে তো বলেছি, সেই ইচ্ছা আমি পূর্ণ করতে পারব না, তার জন্য একটা নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি চাই, আমার ইচ্ছা পূর্ণ হবে এমন আশ্বাস চাই, সুনিশ্চিত আশ্বাস চাই।
—কী হলে তুমি সেই আশ্বাস পাবে? কীসে তোমাকে তোমার কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেবে?
—আমি বলতে পারব না, আমি জানি না।
—আমিই কি সেই প্রতিশ্রুতি নই?
—না, তুমি সেই প্রতিশ্রুতি নও, কারণ তোমার প্রতিশ্রুতিই আমার চাই। অন্য কিছু, অন্য কিছু।
—অন্য কিছু? বেশ, তাহলে অন্য কিছু। কিছুক্ষণ পরেই আমরা পাহাড়টার সবচেয়ে উঁচু শিখরে উঠব, শিলঙের আলো আমাদের চোখে পড়বে, আমরা আবার শহরে আমাদের জীবনে ফিরে যাব। তার আগে তাহলে একবার দেখে নাও দূরের সেই উৎসবের আলো, আবার, আরও একবার শুনে নাও সেই দূরের নাচের তাল, ইচ্ছাপূরণের সংগীত, তোমার ইচ্ছাপূরণেরও সংগীত এটাই, আমিই তার প্রতিশ্রুতি, তোমার চাওয়া আশ্বাস আমিই তোমাকে পারব দিতে… তুমি তা মানো, মানো না কি, যে আকাশ থেকে উল্কা খসে পড়া দেখলে যা চাওয়া যায় তা-ই ফলে? দেখো, চেয়ে দেখো সরল গাছ দুটোর মধ্যে দিয়ে কীভাবে আমার তারাটা খসে পড়ছে, কীভাবে আমার জন্য সে তার প্রাণ দিতে চলেছে…

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২