শূণ্য সময়ের প্রফেট – পিয়াল রায়
দিবান যদি বলতেন পশ্চিমে যাও, তাহলে হয়তো পশ্চিমেই যেতাম। যদি পূর্ব, দক্ষিণ বা উত্তরের কথা বলতেন যেকোনো দিকেই বসতি হতে পারতো আমার৷ কোনো সূর্যোদয়ের দিনে জন্ম হয়নি দিবানের৷ কোনো মধ্য সূর্যের দিনে তাকে দেখা যায়নি শিশুদের নিয়ে হাঁটতে। দিবান তো আসলে একা একটা মানুষ। ঠিক পরিত্যক্ত প্রাচীন শহরের মতো। যার কোনো দেশ নেই; মাটি নেই; আকাশ নেই; আয়নার মতো স্বচ্ছতা নিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর জল নেই৷ দিবান আমার প্রথম প্রেম৷ দিবান আমার শেষ প্রেম৷ আর যা কিছু এসেছিল হাল্কা হাওয়ার গুঁড়ো, হাওয়াতেই ভেসে গেছে তারা। ঋজু, সুদর্শন এবং সুঠাম শরীরের দিবান মে মাসের এক মনোরম সন্ধ্যায় প্রথমবার দেখা দিয়েছিলেন আলো ঝলমল অথচ অপরিচিত শহরের নিষিদ্ধ রাস্তায়। সেইসব অস্থির দিনে তার সঙ্গ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল পোকা খাওয়া ঠোঁটগুলোর কাম তৃষ্ণা থেকে৷ অপূর্ব আলোয় নিজের চোখদুটো জ্বালিয়ে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন নির্ভীক মানুষের মতো৷ যার প্রতিটি পাতায় সবুজের চকমেলানো বারান্দা৷ আমি আতপ্ত বালুতে দগ্ধ হতে হতে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম সবুজ সাগরের দিকে। চকমেলানো বারান্দায় একের পর এক শান্ত ঢেউ উঠেছিল আর নেমে গিয়েছিল আদরের কোল ছুঁয়ে। চিরসত্যের মতো সফেদ দিবান বিশ্বাসের আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ঝিমধরা নেশারু রাতে দিবান আমাকে শুনিয়েছেন মৃত মানুষের থকথকে জমানো স্বর। যাদের অকালমৃত বাসনার প্ৰতি ইঞ্চির উপর নির্মাণ হয়েছিল ঐশ্বর্যময় নগরের বিলাসযাপন। সেইসব আর্তনাদে ভেসে উঠেছিল কবরের ঠান্ডা ভীরু ঝড়। তার স্রোতে ভেসে গেছে কত সুরসুন্দরীর অধরের রক্তরাগ। বর্ণিল বিলোল কটাক্ষ। কত শাহজাদা বক্ষলগ্না প্রেয়সীর উন্মুখ ঠোঁটের চুম্বনচিহ্ন নিতে নিতে নিথর হয়ে গেছেন।কত মরকত-চুনি-পান্না নিস্প্রভ হয়ে মিলিয়ে গেছে ব্যথাতুর গজলের ভিড়ে। এই শীত শীত রাতে প্রাচীন প্রার্থনায় জাগিয়ে রাখে তাদের। দিবান, এক আশ্চর্য প্রাচীন মানুষ, পারতেন শান্তরাত্রির সমস্ত রহস্য শেষ পর্যন্ত শুনে যেতে। চোখের পলকে তার একফোঁটা মৃদু তিতিরের কৃশ ও কম্পমান বক্ষের ছায়া তিরতির করে কেঁপে উঠতে চাইতো। সে মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের সামনে আমি বসে থেকেছি না জানি কত না দীর্ঘ সহস্র বছর। দিবান আমাকে দিয়েছিলেন আয়ু এবং হৃদয়ের সূক্ষ উপঢৌকন যা অবিরত বন্য টাট্টুর মতো পেড়িয়ে যেত উঁচুনিচু উপত্যকার সুড়িপথগুলো। সকালের টাটকা আলোয় সমস্ত পাথুরে ক্ষয়াটে জমিকে দেখেছি ধুয়েমুছে নিবিড় তৃণভূমি হয়ে উঠতে।
আমাকে একটা আয়না দিয়ে যান দিবান। প্রতিদিন তাকে ঘষেমেজে তাতে মুখ দেখবো আমি। আমার শৈশব, আমার যৌবন,আমার বার্ধক্য আর আপনার প্ৰতি আমার নিবিষ্ট প্রেম সেই আয়নায় ঝকঝক করে উঠবে। সরোবরে বিচরণরত মরালীর শান্ত অথচ উদ্বুদ্ধ গ্রীবাভঙ্গিতে ফুটে থাকবে অতীতের সৌন্দর্যসম্ভার। অদম্য প্ৰলোভন। একটা থমথমে শীত ঘিরে ধরছে আমার আপনার অন্তর্ধানের পর থেকে। গোটাকয়েক মাছি ভনভন করছে নাকের ডগায়। সম্ভবত আসন্ন কোনো লাশের গন্ধ ওরা পাচ্ছে। উৎসাহিত করছে আমাকে যাতে যত দ্রুত সম্ভব আমি নিভিয়ে ফেলি প্রদীপের শেষ আঁচটুকু৷ কারন ওদের অন্যত্র যাওয়ার তাড়া আছে৷ অন্য কোনো নিভন্ত নক্ষত্রের কাছে৷ আমার কনুই ছিঁড়ে গেছে! কপালের কোণে কালশিটে দাগ৷ গলায় ক্রমশ কুৎসিত হয়ে ওঠা একদা আদরের চিহ্ন বোবা কান্নার মতো তাকিয়ে থাকে৷ একঘেয়ে একনাগাড়ে বলতে থাকে, দিবান, আপনার প্রেম আমাকে দেয়নি কোনো অতিন্দ্রীয় অলৌকিকের সন্ধান। আপনার প্রেম আমাকে বাঁচতে শেখায়নি কোনো উদার প্রান্তরে উড়ে চলা পাখির সাঙ্গীতিক ধ্বনির মধ্যে যে আজ আমি নতুন করে মরে যেতে ভয় পাবো৷ তবুও তো ভালবাসায় নাক ডুবিয়ে নারী বেঁচে থাকতে চায়৷ সুনসান সড়কগুলো অজানা পান্ডুলিপির মতো পড়ে আছে এক কোণে৷ সুর্মা নেই, তাই নেই মেহফিলের আলোর রোশনাই৷ দিনগুলো পুষ্ট করার মতো কাহিনীরাও আর হাঁটাহাঁটি করে সরগরম করে তোলেনা বাজারের পশরা৷ তবু প্রত্যহ দুটি চোখ আমাকে বিদ্ধ করে। আমার দুহাতে সদ্যজাত শিশু৷ ঘন কালো চুলো ঢাকা পরিষ্কার একটা পুঁটুলি যেন৷ তার হাসিতে দুগালে স্পষ্ট নিখুঁত দুটি টোল অর্থহীন উদ্ভাসে ব্যাপ্ত৷ আমি দেখতে পাই শিশুটিকে ঘিরে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে ছায়া ছায়া মানুষের দল৷ তারা আসে, চলে যায়, আবার আসে। বোধহয় শিশুটির কালো চোখে ওরা সেই আলো খুঁজতে চায় যা ওরা কোনোদিন পায় নি৷ মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকতে থাকতে ওদের গায়ে স্যাঁতসেঁতে শ্যাওলার গন্ধ! জগতের প্রতিটি ঘটনাকে ওরা মেপে চলে সন্দেহ দিয়ে। যাদের মৃত্যু নিয়ে কোথাও কোনো শোক অনুষ্ঠিত হয়নি, জীবনের কোনো ব্যাখ্যাই তাদের সন্তুষ্ট করতে পারে না। অথচ এই মায়াবী শিশু তাদের রুক্ষতা মোড়া ঠোঁটে বুলিয়ে দিয়েছে শুভসত্যের পরিপূর্ণ ছাপ। ওরা সমবেত হাত তুলেছে আকাশের দিকে আর আশিৰ্বাদের ভঙ্গীতে ঝরে পড়েছে প্রাচীন প্রবাদ তা যেমন নরম তেমনই ঈশ্বরস্থানের মতো পবিত্র।
আমার একটা নাম চাই দিবান৷ যে নামে মিশে থাকবে আপনার অফুরন্ত আদর৷ অকারণ ধমকের সুরেলা ভালোবাসা৷ মনখারাপের রাতে যে নাম মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে৷ এমন একটা নাম যা শুধুমাত্র মনে রাখার নাম৷ প্রিয়জনের প্রেম বহন করে চলা অতি সাধারণ আটপৌরে এক ডাকনাম৷ নামের মধ্যে আমায় দিন আপনার স্বর্গীয় উপস্থিতি যা আমাকে বারবার ফিরিয়ে আনবে নৈরাশ্যের সেইসব জর্জরিত সময়ের সর্বগ্লানী সমগ্র হতে৷ আমি তাকিয়ে আছি আপনার দিকে অথচ বেশ জানি আপনি এথানে নেই৷ এই মুহূর্তে একটা অচেনা হাওয়া ভেসে আসছে ভাঙা মন্দির থেকে৷ এবরোখেবরো শিলাখন্ডে ডুবে যাচ্ছে খোলা নদীর বুক৷ একটা গোটা জনপদ জুড়ে আগাগোড়া পাগলিনী গর্জন
ভেঙে ভেঙে ছুটে যাচ্ছে৷ আমার মনে পড়ছে না কখন এসে দাঁড়িয়েছি পার্বত্য মুক্তাঙ্গনে৷ আমার কান্না আমাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে৷ আমি আর পারছি না কোনোমতেই এই রুদ্ধশ্বাস অন্ধকার পেরিয়ে যেতে৷ যে বিশ্বচরাচর আপনার অনির্বচনীয় আলোয় পরিবৃত, সে আলো আমাকে দিচ্ছে ভয়ঙ্কর অনুপস্থিতি৷ আমাকে বন্দী করে রাখছে মেঘের বলিষ্ঠ স্তরে স্তরে৷ দিবান, আপনার চমৎকার ফু্ৎকারে উড়িয়ে দিন আমার জবুথবু শোকার্ত দিনগুলো। আমার মাথার উপর জ্বলন্ত আকাশ ৷ পায়ের নিচে ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে ধরনীর শান্ত দ্বিপ্রহরগুলো৷ এই মধ্যরাতের স্তব্ধতায় আমি শুনতে পাচ্ছি আমার অস্থিসমূহের গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাওয়ার শব্দ৷ আমার হৃদয়ে একটা একটা ছিঁড়ে যাচ্ছে রক্তবাহী প্রেমজ জালিকাগুলি৷ ফুসফুস সংকুচিত হয়ে আটকে যাচ্ছে বাতাসের প্রবেশ৷ আমি কি মরে যাচ্ছি? আমি নিশ্চিত মরে যাচ্ছি। আমি ধরা পরে যাচ্ছি কোনো নিপুন ব্যাধের মোহময় ফাঁদে। আমাকে রক্ষা করুন, দিবান,আমাকে রক্ষা করুন৷ নিজেকে সামলে নিতে দিন আপনার বিজয়ী আলিঙ্গনে। সেইই আমার সব, আমার একমাত্র আনন্দ৷ আজকাল কেউ একজন আমার ভিতরে বসে অনর্গল গল্প বোনে। পছন্দ না হলে টান মেরে খুলে ফেলে গল্পের বুনোট। তারপর আবার বুনতে বসে। যেন সময়কে হার মানিয়ে তবেই সে চুমুক দেবে আঙুরের রসে। আসন পিঁড়ি বসে তুলে নেবে ক্ষ্যাপা কস্তুরির মাতাল ত্বকের ঘ্রাণ।
আমি অন্ধকারের দিকে বাড়িয়েছি আরো একধাপ পা৷ যমুনার জলে বিষাক্ত নীলছাপ৷ আমার ভাষা রচনার শক্তি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে৷ বাগানের যে গাছের নীচে আমাদের বলা প্রতিটি শব্দের উপর বাতাস লুটোপুটি করেছিল সেই লগ্নদৃশ্য এখন থমকে আছে৷ একটা অনামা পাখি তাকে আদর করে আর ছড়িয়ে পড়ে নতুন নতুন পাখিদের কণ্ঠে৷ রোদে দাঁড়িয়ে আপ্রান চেষ্টা করি জট গুলো খুলে ফেলার কিন্তু নিঃসঙ্গ পাখিটার তাতে বিস্তর আপত্তি৷ আপনার ভালোবাসা আমাকে ফালি ফালি করে প্রতিবার আর আপনি খুশি হয়ে ওঠেন, যেমন একটা বাচ্চা ছেলে খুশি হয় একটুকরো রসালো তরমুজের অধিকার পেয়ে। এই আপনাকে আমি চিনতে পারি না৷ যত বেশী সময় গড়িয়েছে আমাদের মধ্যে ততবেশী অচেনা হয়ে উঠেছেন আপনি৷ আমি বারবার বিশ্বাস করতে চাইছি পুরোনো অবিশ্বাসগুলোকে যারা ধূলো গায়ে এখন দাঁড়িয়ে আছে মূক দেওয়ালের গায়ে। আমি নিজেকে নিভিয়ে দিতে চাইছি৷ ফুরিয়ে দিতে চাইছি৷ মিশিয়ে দিতে চাইছি আপনার আবহমান সঙ্গীতের ভিতর৷ আমার বলিরেখার প্রতিটা দাগের ভিতর লুকিয়ে ফেলতে চাইছি মনখারাপের ভাঁজ। উত্তুঙ্গ মিনারের উপর জ্যোৎস্নালোকে ছলকে পড়ে ঝলসে দিতে চাইছে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা। শূণ্য থেকে আরো বেশী শূণ্যের দিকে মিলিয়ে যাচ্ছে উদ্বাস্তু বিকেল৷ তার দিকে হেঁটে আসা পায়ের ছোট ছোট ছাপ। আমি শুধু দাঁড়িয়ে আছি। চুপচাপ ভাবছি আমার চোখের মধ্যেও ডুবে আছে এক বিপুল সমুদ্র যার জলের স্বাদ লোনা। কিভাবে মুক্তোর খোঁজে এসে প্রাণবান শুক্তিগুলিকে দুপায়ে দলে গেছে পর্যটকের দল৷ আমি তাদের নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দেবো৷
আমাকে আর একবার আপনার বুকে মাথা রাখতে দিন দিবান। অনুভূতি ও ভাষার মোহনায় দাঁড়িয়ে আর একবার দেখে নিতে দিন চাইলেই রুখে দেওয়া যায় না স্তব্ধ দুপুরের গান। আর তাই বোধহয় এত এত মৃত্যুর মাঝেও আমাদের একদিনের দাম্পত্য বেঁচে থাকে উজ্জ্বল পৃথিবীর মতো৷
চিত্র: মনীষ দেব