নীলাভ নৈঃশব্দ্যের ছায়া – শান্তনু ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

কথাটা বলার সময় সে একবাক্যে সেরে নিয়েছিল একটি ভূমিকা: মানুষের প্রাগৈতিহাসিক শরীরতত্ত্বের গহনে কোন্ রহস্যরেণু লুকিয়ে আছে, কে জানে!… ভূমিকার পরে ভগ্নাংশ সময় থেমে, নতুন অনুচ্ছেদের আগে ফাঁক দেওয়াটা ছিল বোধহয় বিষয়ের ভার নির্ধারণ ও সরলীকরণের চেষ্টা। যদিও সে চেষ্টা প্রাথমিক সফলতা পায়নি। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে সে পুরোনো বাক্যেই বিষয়টা পুনরায় টানটান করে মেলে ধরেছিল আমার সামনে। কেবল মাঝে একটা ‘কি’ এবং শেষে একটা জিজ্ঞাসাচিহ্ন বসিয়েছিল অতি যত্নে, যা তার প্রথম উচ্চারণে ছিল না। আমি নিশ্চুপ এবং চোখজোড়া জিজ্ঞাসা নিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছি দেখে সে ধুলো সরিয়ে দিয়েছিল বিষয়ের ওপর থেকে: এক পূর্ণবয়স্ক পুরুষ যখন গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়ে, তখন চূড়ান্ত মুহূর্তে তার পুরুষাঙ্গ কি শক্ত হয়ে ওঠে, মাথা তুলে দাঁড়ায় এবং শুরু হয় তুমুল বীর্যপাত?

সে কেন এমন একটা প্রশ্নকে তার ভাবনার মধ্যে তুলে আনল এবং মস্তিষ্কের গভীর কোশে তৈরি হওয়া মূল্যবান প্রশ্নটা কেন আমার সামনেই রাখল, তা ভেবে দেখার সুযোগ না নিয়েই আমি তলিয়ে গিয়েছিলাম আদিম নির্জনতায়। সেই রুক্ষ নির্জনতায় দাঁড়িয়ে আমি দেখছিলাম এক নগ্ন পুরুষ কী নিদারুণ তৎপর করে তুলছে নিজেকে! স্বপ্নচ্যুত দুটো চোখের ওপর থেকে ঘুম সরিয়ে দু-হাতে সম্পূর্ণ করে তুলছে মৃত্যু-আয়োজন। জীবনে দাঁড়ি বসাবার সহজতম বন্দোবস্ত সেরে পুরুষটি নিজেকে তুলে নিয়ে গেল শূন্যে। খানিক দেহ কাঁপনের মধ্যেই মাথা তুলে দাঁড়াল তার রহস্যময় সুপুষ্ট দেহাংশটি এবং কয়েক পলক পরেই তার অতল থেকে ছলকে-ছলকে উঠে আসা অতি ঘন শ্বেত রক্তস্রোত তুমুল গতিতে ছড়িয়ে পড়ল মাটিতে।

সে তার উত্থাপিত বিষয়ের দিশা-সূত্র এবং উত্তর খুঁজতেই মানব মন ও দেহ বিষয়ক জটিল-গভীর-গোপন সব তথ্য জড়ানো কথা বলে যাচ্ছিল। গ্রন্থি, স্নায়ু, মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া, মনের স্তরবিন্যাস—বিভিন্ন বিষয়ে জুটিয়ে রাখা তার জ্ঞান সে বিভিন্ন মাপে সাজিয়ে দিচ্ছিল আমার সামনে। কিন্তু সেগুলো ছুঁয়ে দেখার মতো মানসিক আবহে আমি ছিলাম না তখন। আমি শূন্যে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকেই দেখছিলাম, যদিও তার মুখজুড়ে নেমে আসা গাঢ় অন্ধকারে আমি চিনতে পারছিলাম না তাকে! আমি দেখছিলাম, ক্রমশ শক্তি হারিয়ে মাথা নত করে নেওয়া তার দু-পায়ের মাঝে থাকা মাংসখণ্ডটিকে। সেটি স্থির। স্থির হয়ে গেছে মানুষটাও। তার মুখের ওপর নেমে আসা অন্ধকার ভেদ করে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না তার চোখের পাতা দুটি খোলা আছে কিনা! আমার মনে হচ্ছিল, খোলা আছে। শুধু আমাকে দেখবে বলেই সে এখনও খুলে রেখেছে তার মৃতপ্রায় দুটি চোখ। চোখের ওপর নামতে থাকা গাঢ় অন্ধকার ঠেলে সরিয়ে আমাকেই দেখছে পুরুষটি! সাধ মিটে গেলেই সে চিরতরে বুজিয়ে নেবে চোখ জোড়া… অনেকটা চেষ্টার মধ্যে দিয়ে, ভীষণ কষ্টের মধ্যে দিয়ে, কঠিন অন্ধকার ভেদ করে শেষ পর্যন্ত মানুষটির মুখমণ্ডলে পৌঁছাল আমার দৃষ্টি। আমি চিনতে পারলাম মানুষটিকে!

পুনরায় সে উচ্চারণ করেছিল তার প্রশ্নটা। উচ্চারণের অভিব্যক্তিতেই বোঝা গিয়েছিল, সে প্রশ্নটার উত্তর চাইছে আমার কাছ থেকে। উত্তরের সপক্ষে এতক্ষণ মানব দেহ-মন সংক্রান্ত যে-তথ্যগুলি সে আওড়াচ্ছিল তাতে তার তেমন নির্ভরতা নেই বলেই মনে হচ্ছিল আমার। মনে হচ্ছিল, সে উত্তরজনিত নির্ভরতা চাইছে আমার কাছ থেকেই। আমি কিছুটা সময় আগলে রেখেছিলাম নিজের জন্য। তার প্রশ্নের বিপরীতে কথা সাজাবার আগে উগড়েছিলাম কিছুটা শ্বাস, বলেছিলাম, এ-প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আরও দু-একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিতে হবে— ১. পুরুষ কাকে বলে, নারী কাকে বলে? ২. আত্মহত্যা—মানে, নিজেকে খুন করার প্রবণতায় কে এগিয়ে, নারী নাকি পুরুষ? ৩. মানুষের আবিষ্কৃত আত্মহননের পদ্ধতিগুলোর মধ্যে কোনটি সহজতম এবং কোনটি দৃষ্টিনন্দন? ৪. একটা মানুষ, নারী হোক অথবা পুরুষ, ন্যূনতম কত বছর বয়সে আত্মহত্যার জন্য প্রস্তুত করে তোলে নিজেকে? ৫. প্রস্তুতিপর্বে কোন্ দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে নিজের আগতপ্রায় নিথর শরীরটার দিকে?…

আমি দেখছিলাম, আমার একের পর এক প্রশ্নের মুখে সে কেমন অসহায় হয়ে পড়ছে। ছায়া নামছে তার মুখময়। বুঝেছিলাম, আমার প্রশ্নের চোরাস্রোতে ভেসে যাচ্ছে সে, আপ্রাণ চেষ্টা করেও খুঁজে পাচ্ছে না ডাঙা। চারপাশের মনোরম নীরবতাটুকু বজায় রাখতে আমি আরও খানিকক্ষণ চুপ ছিলাম। তারপর বলেছিলাম, মানুষ সম্পর্কে সমস্ত প্রশ্নের উত্তরই খুঁজে বের করেছে মানুষ, কিন্তু মুশকিল হল, সেসব উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারছে না মনুষ্যকুল। ফলে, স্থিরতা আসছে না তার।

মনে হয়েছিল, আমার এই এক টুকরো কথাতেই বাতাস পেল সে। মুখের ওপর থেকে ছায়া সরিয়ে সপ্রতিভ করে তুলল নিজেকে। বলল, ধরা যাক, এক আততায়ী একদানে অনেকজনকে খুন করবে বলে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল এবং মানসিক প্রস্তুতি ও পদ্ধতিগত প্রস্তুতিমতো আততায়ী বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিল অনেকজনকে। তারপর খুন করে ফেলল নিজেকে—এমন খুনের সংখ্যাতত্ত্ব ঘাঁটলে দেখা যাবে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই, আততায়ী যে পদ্ধতিতে অন্যকে খুন করেছে, সেই পদ্ধতিতেই শেষ করেছে নিজেকে। নিজের জন্য বিকল্প কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করেনি। কিন্তু ইচ্ছা করলেই সে নিজেকে বুলেট ফুটিয়ে শেষ না করে অন্যভাবে শেষ করতে পারত। আসলে, একসঙ্গে অনেককে খতম করার সহজতম উপায়টার গভীরে ঢুকে পড়েছিল সে, বলা যায়, নেশায় জড়িয়ে গিয়েছিল, যেখান থেকে নিজেকে আর ছাড়িয়ে আনতে পারেনি!

আমি গুরুত্ব দিইনি তার কথাগুলোতে। বুঝেছিলাম, কোত্থেকে একটা উটকো বিষয় নামিয়ে এনে সে পালিয়ে যেতে চাইছে আমার প্রশ্নের মুখ থেকে। আমি আর তাকে বিব্রত করিনি। পা এগিয়ে দিয়েছিলাম আমার নিজের তৈরি প্রশ্নগুলোর দিকেই। তবে তার ‘একদানে অনেক খুন’ কথাটা আমার খুব ভালো লেগেছিল—ঠিকই, যে-কোনো খুনই তো আসলে একটা খেলা!

সে কীসব বলে যাচ্ছিল, আমি শুনছিলাম না, আমি তখন তার নীরবতার বিপরীতে জানানো আমার সেই কথাটার ভেতর হেঁটে যেতে চাইছিলাম—নিজের সম্পর্কে মানুষ কী তথ্য খুঁজে পেয়েছে? খুঁজে পেয়েছে: মানুষকে কেমন দেখতে, মানুষ কেমন করে কথা বলে, মানুষ কেমন করে ভালোবাসে, মানুষ কেমন করে দুঃখ পায়, মানুষ কেমন করে সুখ পায়… কিন্তু মানুষ কি উত্তর পেয়েছে, মানুষ অন্যকে খুন করে বেশি আনন্দ পায় নাকি নিজেকে খুন করে? উত্তর পেয়েছে, অন্যকে খুন করার আগে মানুষ বেশি ভয় পায় নাকি নিজেকে খুন করার আগে?

সে পুরোনো বিষয়ের ওপরেই হেঁটে যাচ্ছিল; বোধহয় ধরেই নিয়েছিল, তার সব কথা জলের মতো গড়িয়ে নামছে আমার মস্তিষ্কের অতলে। আমার মনে হল, তার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত আমার। কারণ, একটু আগে আমি মানুষ সম্পর্কিত যেসব কথা শুনিয়েছি তাকে, যা কিছু প্রশ্ন করেছি, তা সবটাই চালাকি থেকে; মানুষ সম্পর্কে অনেক জ্ঞান বহনের ভান করেছি আমি। আসলে তো আমি এ বিষয়ে সম্পূর্ণ জ্ঞানশূন্য!

যদিও ক্ষমাপ্রার্থনামূলক কোনো শব্দ আমি উচ্চারণ করিনি তার সামনে। তবে কথায় ফিরেছিলাম। বলেছিলাম, ঠিকই, প্রত্যেকটা খুনই আসলে একটা খেলা। সঠিক দান ফেলাটা এ-খেলার একটা জরুরি অঙ্গ।

তার মুখের ওপর সেই পুরোনো বিপন্নতার ছায়াটা ফিরে এসেছিল। আমি বুঝলাম, সে আমার এইমাত্র বলা কথাটা বুঝে উঠতে পারেনি এবং এ-ও বুঝলাম, তখন ‘একদানে অনেক খুন’ কথাটা সে কিছু না ভেবেই শুধু উচ্চারণের মজায় উচ্চারণ করে ফেলেছে।

আমি যে-কোনো কথোপকথনের মাঝে যেটা প্রায়ই করি, এবং কৌশলগতভাবেই করি, সেটাই করেছিলাম, প্রসঙ্গ পালটেছিলাম—আজ বোধহয় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে…

আমার ফাঁদে পা দিয়েছিল সে—পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি, মেরুপ্রদেশে বরফ স্তরের পরিবর্তন, আহ্নিক ও বার্ষিক গতি, নিরক্ষীয় ও কর্কটক্রান্তি রেখা…

আকাশ ও মেঘসংক্রান্ত ফলিত বিজ্ঞান থেকে যে পরিমাণ জ্ঞান তার তহবিলে জমা হয়েছিল, উদার কণ্ঠে তা বিতরণ করতে থাকল সে। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করলাম তার স্বর ও আমার কানের মাঝখানে একটা দেওয়াল তুলে, একটু আগে তৈরি করা আমার নিজের প্রশ্নগুলোর ভেতরে রয়ে যেতে।

আমি প্রশ্নের ভেতরেই রয়ে গেছি। এখনও। চেষ্টা করি দৌড়ে আসা ক্লান্তিকর প্রশ্নগুলোর শৈত্যপ্রবাহ থেকে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয় আমার সে প্রয়াস। তুফান বেগে এগিয়ে এসে আমাকে বন্দি করে এক প্রশ্নপিঞ্জর। তার বর্ণচ্ছটায় নীল হয়ে উঠি আমি। একসময় মুক্তিও পাই। তবে তা সাময়িক। মুক্তির ওই ভগ্নাংশ মুহূর্তে চেষ্টা করি স্বপ্নের ছায়ায় আশ্রয় নিতে। স্বপ্নও তো নীল! নীল স্বপ্নের ভেতর মুখোমুখি হই শূন্যে দাঁড়িয়ে থাকা সেই নগ্ন পুরুষটির। চেষ্টা করি ক্ষণিকের মধ্যে তার সঙ্গে সেরে নিতে কিছু কথা। আসলে এ-ও আমার এক প্রবঞ্চনা। কথা বলার অছিলায় আমি তার দিকে এগিয়ে দিই নীলচে প্রশ্নগুলো, বারবার। সে উত্তর দেয়—একই উত্তর, বারবার। ভেসে আসা তার উত্তর ধীরে ধীরে তলিয়ে যায় আমার গভীরে। খণ্ডিত সময়টুকু শেষ হয়ে যায় একঘেয়ে দ্বৈত-পুনরুচ্চারণের মধ্যে দিয়ে। কথায় দাঁড়ি পড়ার আগে শূন্যে থেমে থাকা মানুষটি প্রতিবার আমার দিকে এগিয়ে দেয় একটি প্রশ্ন, একটিই প্রশ্ন: পুরুষ কাকে বলে? আমি জানি, এ-প্রশ্নের গায়ে লেগে থাকে অতি উজ্জ্বল এক উপহাস। জানতাম, যে উপহাস থেকে পালাতে একদিন আমাকে দাঁড়াতেই হবে শূন্যে। চেনা পুরুষটির সঙ্গে সেদিন মুছে যাবে সব দূরত্ব, শূন্যযাত্রার প্রস্তুতিপর্বের সেই পুরোনো দৃষ্টিতেই আমি তাকিয়ে থাকব তার দিকে।

আকাশে কি কালো মেঘ ভাসছে এখন? আর কতক্ষণ পর সূর্য উঠবে পুবপ্রান্তে? কখনও না-থামার প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাঁটতে শুরু করা ঘড়ির শীর্ণ সোনালি কাঁটা দুটো কি থেমে গেছে ঘরের বদ্ধ বাতাসে?—এসব প্রশ্নের প্রয়োজনীয়তা অবশ্য এখন আর আমার নেই। আমি জানি না, আমার শরীর থেকে বেরিয়ে আসা ঘন তাজা শ্বেতরক্তে পায়ের নীচের মাটি ভিজে গেছে কিনা! শুধু জানি, শূন্যে দাঁড়িয়ে থাকা আমার চেনা সেই পুরুষটি তার নগ্ন শরীর নিয়ে প্রত্যাশা মতোই আজ আশ্রয় নিয়েছে আমার ভেতরে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

One Comment

  1. বেশশ ভাল লেখা।।।।অন‍্যরকম গদ‍্য।।।।।।।।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *