ফিরে দেখা – রণবীর সরকার

শেয়ার করুন


                                                                  (১)                     

আজ তাহলে গল্প হোক কৌশিককে নিয়ে। আচ্ছা কৌশিকের পরিচয়টা দিয়ে নেওয়া ভালো আগে। কৌশিক হল আমার ছোট্ট বেলার বন্ধু , মানে ঠিক বন্ধু না, কারণ বন্ধু কন্সেপ্টটা যখনও ঠিকঠাক বুঝিনি,তখন থেকেই আমাদের মেলামেশা। তাই কখনও ওকে বন্ধু হিসেবে ভাবা হয়নি। যাকগে, আমার আর ওদের বাড়ি ছিল এক্কেবারে লাগোয়া। ছোটোবেলায় দুটো বাড়ির মাঝের দেওয়াল টেওয়াল বলে কিছু ছিল না, ছিল একটা ছেঁড়া কাঁটা তারের বেড়া। ওই বেড়ার ফাঁক দিয়েই চলত আমাদের আসা-যাওয়া। এখন অবশ্য উচুঁ প্রাচীর দিয়ে সুবিভক্ত দুই বাড়ির সীমানা।      আজ ভাবতে বসলে ঠিক মনে পরে না কবে প্রথম ওকে দেখেছিলাম। তবে আমি যখন নার্সারিতে পড়তাম, তখন হয়তো ওর সাথে আমার অতটা মেলামেশা ছিল না। সেটা আমি বুঝেছি আমার পিসিমণির বিয়ের ভিডিও ক্লিপিংস দেখে। পুরো ভিডিও‍তে কোথাও কৌশিককে দেখিনি সেখানে। চোখ বন্ধ করে ভাবলে প্রথম যে ছবিটা মাথায় আসে তা হল আমরা একসঙ্গে ভ্যানে ইস্কুলে যেতাম। তখন অত গলায় গলায় কিছু ছিল না।তাই স্কুলেও আলাদা আলাদা বসতাম, কথাও কম হত। মেলামেশা বাড়ে ক্লাস ওয়ানে ওঠার পর। ও লটারিতে জিলা স্কুলে চান্স পেয়ে যায়। আমি ওই স্কুলেই থেকে যাই। স্কুল আলাদা হবার পরই আমাদের মেলামেশা বেড়ে যায়। বেশির ভাগ সময়ই ও আমাদের বাড়িতে থাকত। ও ছাড়া ছোটোবেলায় খেলার সাথি বলতে আমার কাকাতো ভাই, টিকলি। তিন জন মিলে সারাদিন অদ্ভুত সব খেলা খেলতাম। কখনও আমি ড্রাইভার হতাম, ওদের একজন খালাসি আর একজন প্যাসেঞ্জার হত, আবার কখনওবা ওরা কেউ নাপিত হত, আর আমি কাস্টোমার। এসব খেলার জন্য বাড়িতে মারও খেয়েছি অনেক আমরা। কিন্তু আমরা থামতাম না। চলত আমাদের খেলা। খেলা থামত দিনের শেষে , তুমুল ঝগড়া দিয়ে। সেখানে আমি আর টিকলি মিত্র শক্তি আর ও একাই অক্ষ শক্তি। শেষমেশ মারপিট করে একজন আর একজনের মুখ না দেখার প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে, সবাই নিজের নিজের  বাড়ি চলে যেত। অবশ্য প্রতিজ্ঞার মেয়াদ ছিল মাত্র এক রাত । পরের দিন সকালেই আমরা বেরিয়ে পড়তাম আমাদের কাল্পনিক খেলার ঝুড়ি নিয়ে, সেদিন হয়তো আমরা সকলে জেলে, আমাদের কাল্পনিক সরঞ্জাম নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম কাল্পনিক পুকুরে জল ছেঁকে মাছ ধরতে। কৌশিক আমাদের বন্ধু হলেও পাড়ার ছেলেরা ওকে যখন মোটা বলে খ্যাপাতো, আমরাও সেই সু্যোগ ছাড়তাম না। সবাই মিলে একসাথে ‘মোটা’ ‘মোটা’ বলে তাড়া করতাম ওকে।  কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে যেত কৌশিক। সু্যোগ পেলে কৌশিক ও ছাড়তো না আমাকে। বলে রাখি, ছোটোবেলায় আমার কান গুলো মাথার তুলোনায় একটু বড় ছিল (ওবামার মত)। সেটার জন্য ওরা আমায় ‘ছোটা হাতি’ বলে খ্যাপাতো। এ নিয়ে একদিন তুমুল মারপিট বাধে। প্রসঙ্গত কৌশিকের হাইপোথাইরয়েডিসমের প্রবলেমের জন্য ওর শরীরটা ছিল খুব বড়। আমার থেকে অনেক বড়-সড় চেহারার হলেও আমরা দুজন মিলে ওকে লাফিয়ে লাফিয়ে মারতাম। আশে পাশের প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে দৃশ্যটা ছিল দলবদ্ধ বাঘের হাতি শিকারের মতো। এমনিতে অনেক সহ্য ক্ষমতা থাকলেও সেদিন রাগের মাথায় কৌশিক সজোরে একটা ঘুসি মেরেছিল নাকে। সাথে সাথে নাক ফেটে রক্ত বেরিয়ে গেছিল। কাঁদতে কাঁদতে আমি আর আমার ভাই ঠিক করি, আর কোনোদিন কৌশিকের বাড়ি যাবো না, কথা বলবো না, আজীবনের কাট্টি ।কিন্তু আমাদের মাথায় যে গুরু দায়িত্ব, পরের দিন যে আমাদের কাল্পনিক সেনাবাহিনী যাবে কাল্পনিক  সীমানায় শত্রু পক্ষকে ধ্বংস করতে। অতএব আমাদের মহৎ উদ্দেশ্যের কাছে তুচ্ছ প্রতিজ্ঞা হার মানত। বেরিয়ে পড়তাম তিনজনে দেশসেবায় ব্রতী হয়ে।এভাবেই চলত জীবন। কিন্তু না!! ভাঙন ধরল আমাদের ইউনিটিতে। টিকলি চলে গেল মালবাজারে পড়াশোনার স্বার্থে। টিকলির চলে যাওয়ার দিন আমরা খুব ভোরে গেছিলাম ছবি তুলতে স্টুডিওতে। ক্যমেরাম্যান কাকুকে ঘুম থেকে তুলে আমরা তুলেছিলাম একটা ছবি। ওটাই ছিল হয়তো আমাদের তিনজনের একসাথে তোলা শেষ ছবি। আর কোনোদিন সুযোগ হয়নি ছবি তোলার। যাকগে, টিকলি চলে যাওয়ার সময়, আমি ওকে দিয়েছিলাম, আমার খুব প্রিয় একটা ময়ূরের পালক, আমার একটা puzzle সেট। আর কৌশিক দিয়েছিল ওর কিছু প্রিয় রং পেনসিল।     ছবির মতো মনে আছে দিনটা। ছোট্ট টিকলি ছল ছল চোখ নিয়ে বাসে উঠে গেল। আমরা দুজন দাঁড়িয়েছিলাম, কিছু অনুভূতি হচ্ছিল না। বুকটা শুধু ফেটে যাচ্ছিল। কৌশিক সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে বাড়ি নিয়ে এসেছিল। সেদিন বুঝেছিলাম প্রথম বিচ্ছেদ যন্ত্রনা।                                                                                 (২)
টিকলি চলে যাওয়ার দুঃখটা মনে বিধে ছিল গভীরভাবে। খেতে বসে কাঁদতাম, পড়তে বসে কাঁদতাম, স্কুলে গিয়ে কাঁদতাম। সারাদিন শুধু কাঁদতাম। সেই ছোট্ট আমি ছিলাম মারাত্মক unexpressive। কিছুতেই আমি আমার ইমোশনগুলো কাউকে দেখাতে পারতাম না। বেশির ভাগ সময় কান্না পেলে বাথরুমে গিয়ে কাঁদতাম। যাক গে সেসব! প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে আসতে আসতে ক্ষতগুলো শুকোতে শুরু করল। হয়তো অবলম্বন হিসেবে কৌশিক আমার মনের আরো কাছে চলে আসল। সব সময় কৌশিকের সাথে ঝগড়া করতাম, কিন্তু কৌশিক ছাড়া চলত না আমার এক লহমা। সারাদিন আমরা খেলতাম, কৌশিক আমায় শেখাল সাইকেল চালানো। ক্রিকেট খেলা। সবসময় অভিভাবকের মতো আগলে রাখত আমায়। আমিও অনেক ভালোবাসতাম ওকে। কিন্তু কোনো দিন বলতে পারিনি সেভাবে কথাগুলো।
এবার বলে রাখি, আমাদের বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। পুজোর সময় টিকলি বাড়ি ফিরলে তিনজন মিলে তরতর করে ছুটে বেড়াতাম সারা বাড়ি। খাটতাম ফাইফারমাশ। ছুট্টে গিয়ে পেরে আনতাম বেলপাতা বা যজ্ঞডুমুরের ডাল। কৌশিক তখন নিজের বাড়ি আর আমাদের বাড়ির মধ্যে কোনো তফাত করত না। রাতের বেলা ওর মা ওকে মেরে মেরে ঘুরতে নিয়ে যেত। আমাদের বাড়ির পুজো ছেড়ে ,ও ঘুরতে পর্যন্ত যেতে চাইত না। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলত এটা নাকি ওরই বাড়ির পুজো। এসব শুনে আমাদের মধ্যে আবার সেই পুরোনো ‘আমরা’ জেগে উঠত।আবার কৌশিককে ‘মোটা’ উপাধি দিয়ে বলতাম “ভাগ এইখান থেকে! নিজের বাড়ি যা।” কৌশিকও খেপে গিয়ে বলত “ছোটা হাতি! তুই ভাগ! এইটা আমার পিসির বাড়ি!! বুঝছিস?”ব্যাস লেগে যেত নারদ-নারদ। পুরো পুজোবাড়ি নেমে পড়ত ঝগড়া থামাতে।
সবই ঠিক চলছিলো। ব্যাট নিয়ে মারপিট, সাইকেল নিয়ে মারপিট, আমাদের বন্ধুত্ব থুড়ি অঘোষিত প্রেম চলছিল নিজের তালে। ধীরে ধীরে আমরা ক্লাস এইটে উঠলাম।
   এবার কৌশিকের ব্যাপারে আরও কিছু তথ্য জানানো দরকার বলে মনে হচ্ছে। আগেই বলেছি কৌশিকের ছোটো থেকে থাইরয়েডের সমস্যা ছিলো, তার জন্য সে ছিল একটু বেশি মোটা, হয়তো হাইপোথাইরয়েডিসমের কারণেই পড়াশোনাতেও ও ছিল খুব অমনযোগী। ক্লাস এইটে ও ফেল করে গেল। আমিও বেশি গল্পবই পড়া আর খেলার জন্য খারাপ রেজাল্ট করলাম খুব। তাই অনেক মারধর করে বাবা ক্লাস নাইনে আমায় ঢুকিয়ে দিল গাদা খানেক টিউশনে। ওর মাও ওকে সারাদিন পড়াতে শুরু করল।
ওদিকে টিকলির বাবা আর আমার বাবার মধ্য বেধে গেলো শরিকি ঝামেলা। বস্তুত আমরা তিন জনই হয়ে গেলাম একদম একা।
আস্তে আস্তে সবকিছু ভুলে পড়াশোনাটাকেই জীবনের ধ্রুবতারা হিসেবে বেছে নিলাম।তারপর একটা বছর পুরো ব্ল্যাংক। কারণ পড়াশোনা করে আর যাই হোক, মেমোরি তৈরি হয় না।
তারপর এক্কেবারে মনে পড়ে সেই সন্ধ্যার কথা, ওর মায়ের সাথে ও আসলো আমাদের বাড়িতে। কৌশিকের পা-হাত ফুলে গেছে। এসে চুপ করে আমার পাশে বসল, বুঝতে পারছিলাম না কি বলব। ভেতরে অনেক কথা ঘুরপাক খেলেও , স্বভাবত মুখে আসছিল না। নীরবতা ভাঙল কৌশিকই, “নীচে দেখলাম, রেঞ্জার সাইকেল কিনছিস। চালাইতে দিবি একদিন?? তুই আমায় দিস চাবি। আমি বৌদির থেকে টাকা নিয়ে দোকান থিকে তোর নাম লেখা স্টিকার লাগায় আনবো”
-“আগে সুস্থ হ।”-“ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছি দেখাইতে। ঠিক হয়েই যাব”
চলে গেল কৌশিক। তাকিয়ে থাকলাম দরজার দিকে যতক্ষণ না অদৃশ্য হল ও।
                       তারপর আবার কখন হারিয়ে গেলাম পড়ার মাঝে। জীবনের লক্ষ্য তখন একটাই , বাবা-মার মুখে হাসি ফোটানো।
তারপর একদিন খবর পেলাম, কৌশিক ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। জলপাইগুড়ির একটা বেসরকারি নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়েছে। ওকে নাকি বার বার প্লাজমা দেওয়া হচ্ছে। বুক কেঁপে উঠেছিল।
একদিন বিকেলে ঠাকুমার সাথে চলে গেলাম ওকে দেখতে। হাতে দু প্যাকেট খেজুর। ভেবেছিলাম বার বার রক্ত যখন দিতে হচ্ছে, তাহলে খেজুর খেলে শরীরে রক্ত তৈরী হবে, ও ভালো হয়ে যাবে। তাই মা কে বলে দু প্যাকেট খেজুর আনিয়েছিলাম।ভেতরে ঢুকেই দেখলাম কৌশিক শুয়ে আছে। নাকে নল গোঁজা। হাত পা ফুলে আছে। কত কি যন্ত্র লাগানো। একটাও কথা বললাম না। ওর সামনে টেবিলটায় প্যাকেট দুটো রেখে , সরে গেলাম ঘরের কোণের জানলাটার দিকে। তাকিয়ে থাকলাম দূরের পুকুরটার দিকে, মনে পড়ল আমাদের কাল্পনিক পুকুর ছেঁকার অভিযানের কথা। ঠাকুমা কথা বলল ওর মায়ের সাথে, সান্ত্বনা দিল অনেক। আমি পুরো সময়টা পুকুরটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কানের ভেতরে বাজছে “ডিগ ডিগ ডিগ ডিগ………….”- কাল্পনিক মাছ ধরার সময় কৌশিক আর টিকলির মুখ দিয়ে করা কাল্পনিক জেনারেটরের আওয়াজ।
এক্কেবারে শেষে কৌশিক আমার ঠকুমাকে উদ্দেশ্য করে বলল “পিসি, বাবুজির মুখের সাদা দাগটা কিন্তু শ্বেতির মতো হয়ে যাচ্ছে”। (ওই সময় আমার মুখে একটা ফাঙ্গাল ইনফেকশন হয়ে একটা ছোটো সাদা দাগ হয়েছিল, যা পরে সেরে যায়)আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্টো হাসি দিলাম। তারপরই দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম।
এর পর আবার সপ্তাহ খানেক কেটে গেল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওকে কলকাতায় নিয়ে যেতে বলল। 
কৌশিককে ওরা বাড়িতে নিয়ে এসেছিল কলকাতায় যাওয়ার আগে। ওইদিনই বিকালবেলা বেরিয়েও গেল ওরা। আমি যাইনি দেখতে। সিঁড়ির ঘরের ফুটো দিয়ে দেখছিলাম নীচে। আ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে। কৌশিককে তোলা হল। কৌশিক এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। হয়তো আমায় খুঁজছিল। আমি সিঁড়ির ঘরের ফুটো দিয়ে দেখছিলাম আর কাঁদছিলাম। আমি আমার কান্না কাউকে দেখাবো না, “what ever it takes”।
কলকাতায় ধরা পড়ল কৌশিকের লিউকেমিয়া।
নিয়ে যাওয়া হল ওকে মুম্বাই টাটা হাসপাতালে। চলল কেমো। শেষের কটা দিন কোমায় কেটেছিল ওর।
শুনেছিলাম কোমায় যাবার আগের দিন মাকে বলেছিল “সোনাদাদের বাড়ির পুজাটা এইবার কি কইরে হবে? আমি তো থাকতে পারব না। বাবুজি তো হোদল। কিস্সু পারে না।”
চোখ বন্ধ করলে আজ শুধু ভেসে ওঠে নিথর শরীরটা। অনেক ভিড়ের পেছন থেকে দেখছিলাম দুলতে দুলতে যাচ্ছে ওর শরীরটা। কেমোর জন্য মাথায় চুল নেই। শরীর আরো ফুলে গেছে। যেন এক সন্ন্যাসী শুয়ে শুয়ে দুলতে দুলতে চলে যাচ্ছে।
আজও ঘুম ভেঙে যায় স্বপ্ন দেখে। 
” বাবুজি তোর সাইকেলের চাবিটা দে… বৌদির থেকে টাকা নিয়ে আমি ওইটার  মধ্যে তোর নাম লিখায় আনবো…”

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *