মানচিত্র, অশ্বমেধ, রক্তের দাগ ইত‍্যাদি… – রাজীব দত্ত

শেয়ার করুন

এই বিভাগের অন্যান্য লেখা পড়তে ছবি-কথা ক্যাটেগরিতে ক্লিক করুন।

জানি তোমাদেরও ক্লান্ত লাগে আজ-কাল। কী করব বলো? এইসব স্মৃতি বারেবারে ভাগ করে নিতে হয়। পর্যায় শেষে সন্ততিকে উত্তরাধিকারে দিয়ে যেতে হয়… আমাদেরও তো পরকাল আছে নাকি?

এই যে ক‍্যানভাসের মেঝে থেকে ঠেলে উঠছে মৃতদেহের স্তূপ, স্বপ্নাদ‍্য কাবাবের মতো মানুষের, মানুষের বাচ্চাদের সুস্বাস্থ্য, গা-ঘিনঘিনে, নির্লিপ্ত মাংস— যেন মনে হয় না, ওই বিস্তৃত ঈশ্বরের হাত তাকে শেষ বেলায় একটু ছায়া দিতে চেয়েছিল?

এমনটা সত্যি হতেই পারত, অন্তত হলে তো ভালোই হত। তবে কিনা আমরা যারা— মানে ধরো তুমি, আমি, ভাস্করদা এবং আরও যাদের কবে ডাক আসবে নগর কোতোয়ালি থেকে অথবা নেহাতই অলক্ষ্যে, বিনা চিকিৎসায়, কিংবা স্রেফ খেতে না পেয়ে মারা পড়ব বেঘোরে, সেই মাহেন্দ্রক্ষণের গণনাতেই খাওয়া ঘুম মাথায় উঠল— এমনটা তাদের দিকের সত‍্য নয়।

তো কোথা থেকে শুরু করি বলো? ধরো ভ্রূণ থেকেই। উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী জেলা। মে, ২০১৯ থেকে জুলাই, ২০১৯ অবধি একটিও কন‍্যা সন্তান জন্মায়নি। ১৩২টি গ্রামে তিন মাসে ২১৬টি শিশু জন্মেছ প্রত‍্যেকেই পুরুষ। কি বলছ? বিচ্ছিন্ন ঘটনা? নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রকের তথ‍্য অনুযায়ী গুজরাট(সর্বোচ্চ), হরিয়ানা(দ্বিতীয়), রাজস্থান(তৃতীয়) সহ ১৭টা বড়ো রাজ্যে অবাধ কন‍্যাভ্রূণ হত‍্যার কারণে কন‍্যা জন্মের হার কমছে অত‍্যন্ত দ্রুত। আমেদাবাদ, চন্ডীগড়, আম্বালা, গাজিয়াবাদের প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোর বাইরের নর্দমা আঁকশি দিয়ে ঘাঁটো। রাশি রাশি গোলাপি মাংসের মতো পরিত‍্যক্ত ভ্রূণ উঠে আসবে, আমাদের আদরের মেয়ে হত যারা।

কিন্তু আমরাই বা কীসের আশায় মেয়েগুলোকে বড়ো করতাম বলো?

ন‍্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো ২০১৫-এর হিসেব অনুযায়ী ভারতে প্রতিদিন গড়ে ৩২ জন মহিলাকে বৈবাহিক পণের জন্য হত‍্যা করা হয় অথবা আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেওয়া হয়। পণজনিত মৃত্যুর ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ চতুর্থ এবং দাম্পত্য হিংসার ঘটনায় প্রথম স্থানে রয়েছে।

ন‍্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো ২০১৭-এর হিসেবে, সর্বাধিক নথিভুক্ত ধর্ষণ মধ‍্যপ্রদেশে, ৪৩৯১ জন। দ্বিতীয় স্থানে মহারাষ্ট্র, ৪১৪৪ জন। তৃতীয় স্থানে রাজস্থান, ৩৬৪৪ জন।

শিল্পী: ভাস্কর প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

প্রশ্ন করতেই পারো, মানুষের সভ‍্যতা নাহয় বড়ো হতে হতে মানুষখেকো হয়ে গেছে, তাই বলে মায়েরা কি ছিল না? তাদের জরায়ু কি বর্ম হয়ে ঠাঁই দিতে পারত না এইসব মাংসপিণ্ডকে? তাহলে জরায়ুর কথা শোনো।
২০১৬ থেকে ২০১৯ তিন বছরে মহারাষ্ট্রের বিদ, ওসমানাবাদ, সাংলি, সোলাপুর ইত‍্যাদি জেলায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আখ চাষের হতদরিদ্র নারী শ্রমিকরা অপারেশন করে নিজেদের জরায়ু বাদ দিয়েছেন গণহারে, ঋতুস্রাবের দিনগুলোতে কাজ করতে না পারলে ছাঁটাই হবার আতঙ্কে। সর্বস্বান্ত নারী শ্রমিককে জরায়ুহীন করে গড়ে উঠছে ‘সমৃদ্ধ ভারত’। মাস হিস্টিরিয়া আর মাস হিস্টেরেক্টমি— কি কাছাকাছি শব্দবন্ধ না?

চাষের প্রসঙ্গ এলে মনে পড়ে যাবে, ফসলের খেত জুড়ে আত্মঘাতী কৃষকের মিছিল। ন‍্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ১১৩৭৯ জন, ২০১৮ সালে ১০৩৫৭ জন, ২০১৯ সালে ১০২৮১ জন কৃষক দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেছেন। (২০১৭ সালে কৃষক মৃত্যু সংক্রান্ত কোনও তথ্যই দাখিল করেনি সরকার!) সোজা কথায়, এদেশে দেনার দায়ে প্রতি বছর দশ হাজারেরও বেশি চাষী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন।
২০০১ সাল থেকে ২০১৭ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত রাজ‍্য সরকারের হিসেব অনুযায়ী, ১৭ বছরে শুধুমাত্র মহারাষ্ট্রে আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা ২৬ হাজার ৩৩৯ জন।

আলুর দাম না পেয়ে অশ্বত্থের ডাল থেকে ঝুলন্ত চাষী দেখেছ কখনও? তার পায়ের পাতা? কুনোব্যাঙের চামড়ার মতো খসখসে, নীলচে।

তোমার অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহের মতো গাছেদের কবন্ধ হয়ে যেতে দেখেছ কখনও? দিগন্তে দেখেছ সেইসব বৃক্ষের সারি সারি কঙ্কাল?

এমন নয় যে, এই চোখ ধাঁধানো ইন্দ্রপ্রস্থের প্রতিষ্ঠার আড়ালে যে বীভৎস খান্ডবদহন চলছিল, তার গতিপথ মসৃণ, প্রতিরোধহীন ছিল। ঈশ্বরের রথ আর আমাদের চৌদ্দপুরুষের আবাদের মাঝে আমরা, আমাদের মৃতদেহগুলো দুর্লঙ্ঘ‍্য প্রাচীর হয়ে উঠেছিল।
তামিলনাড়ুর তুতিকোরিণে জনপদ উচ্ছেদ করে স্টারলাইট কর্পোরেশনের আকরিক তামা নিষ্কাশনের কারখানার সম্প্রসারণ চলছিল। এত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় তীব্র রাসায়নিক দূষণের আশঙ্কায় স্থানীয় মানুষজন স্টারলাইট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ২২শে এবং ২৩শে মে বিক্ষোভে সমবেত হয়েছিলেন। তামিলনাড়ুর পুলিশ প্রতিবাদ সমাবেশের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১৩ জন মানুষকে ঘটনাস্থলেই হত‍্যা করে। আহত ১০২ জন।

২৩শে অক্টোবর ২০১৬, উড়িষ্যা-অন্ধ্রপ্রদেশ সীমান্তে মালকানগিরিতে ‘মাওবাদী সন্দেহে’ ৩০ জন আদিবাসীকে হত‍্যা করল যৌথ বাহিনী। ২২শে এবং ২৩শে এপ্রিল ২০১৮, মহারাষ্ট্রের গড়চিরোলিতে দু-দিন ধরে ৪১জন আদিবাসীকে ‘মাওবাদী সন্দেহে’ হত‍্যা করল যৌথ বাহিনী। ছত্রিশগড় আর মহারাষ্ট্রের সীমানায় ইন্দ্রাবতী নদী থেকে সেই সব লাশ উদ্ধার করেছিল তাদের পরিজনেরা। এই রকমই বস্তারে, নিয়মগিরিতে, দান্তেওয়াড়ায়, বিদর্ভে, আরও অসংখ্য বার—

তবু খান্ডবদহনের ঈশ্বর রথে বসে অসহায় দেখেছেন আমরা আটকে দিয়েছি বেদান্ত, স্টারলাইট, কুড়ানকোলাম, নন্দীগ্রাম, হরিপুর—

এত কিছুর পরেও যে ভূখণ্ডের কথা আজকের আলাপচারিতায় উঠে না এলে ক‍্যানভাস জুড়ে ছড়ানো এই ছিন্নভিন্ন দেহাংশের শনাক্তকরণই সম্পূর্ণ হবে না, এখন তার কথায় আসা যাক।

৮ই জুলাই, ২০১৬ ভারতীয় সেনার হাতে বুরহান ওয়ানি নিহত হবার পর থেকে কাশ্মীরের গণ আন্দোলনের যে চারিত্রিক বদল ঘটেছে, আমি বিশ্বাস করি, তার উদ‍্যমে আজও ভাটা পড়েনি একটুও। কেন ‘বিশ্বাস করি’ সেকথা যথাসময়ে।

যে নির্বিচার হত‍্যার পথ রাষ্ট্র বেছে নিয়েছে, বেছে দিয়েছে নিজেরই ভূমিপুত্রদের জন্য, এতদূর থেকে তা-ও তোমাকে আবছা চিনতে হবে লাশের গুনতি দিয়েই। ২০১৪ সালে যেখানে তথাকথিত জঙ্গি ও নিরাপত্তা কর্মীর মৃত্যুর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১১০ জন এবং ৪৭ জন, ২০১৭ সালে সেখানে সংখ্যাগুলো প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, যথাক্রমে ২১৮ জন এবং ৮৩ জন। মরিয়া পাথরের জবাবে একতরফা চলেছে পেলেট, ইনস‍্যাস রাইফেল আর বেনামী গণকবর। চলেছে, যতদিন না ২০১৯ সালের আগস্ট মাস আসে।
৫ই আগস্ট ২০১৯, ভারতীয় সংসদ একতরফা এবং অসাংবিধানিক ভাবে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সংবিধানের ৩৭০ ধারা এবং ৩৫-এ অনুচ্ছেদ খারিজ করল। স্বাধীনতা এবং মর্যাদার দাবিতে কাশ্মীর জুড়ে চলা গণআন্দোলনকে প্রতিহত করতে ব‍্যাপক গ্রেপ্তারি এবং নির্যাতন চালাল প্রশাসন। মাসাধিক কাল বন্ধ রাখা হল ইন্টারনেট, সংবাদপত্র সহ বিভিন্ন গণমাধ্যম। নিখোঁজ এবং রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের কোনও সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব নয়, কারণ ভারত রাষ্ট্র না তো কোনো স্বশাসিত সংস্থাকে কাশ্মীরে সরেজমিনে পর্যবেক্ষণের অনুমতি দিচ্ছে, না কোনো সঠিক পরিসংখ্যান দাখিল করছে।

সেই থেকে বেমালুম নিখোঁজ কাশ্মীর। ঠিক নিশ্চিত নই, এই প্রাচীন জনপদের দিকে ইনস‍্যাস রাইফেলের মতো উদ‍্যত সর্বগ্রাসী থাবাকে আটকাতে পারবে কিনা বৃদ্ধ চিনার। তবু ঐ যে বলেছিলাম বিশ্বাস করি, এখনও গাছের আড়ালে আপাত শান্ত সরাইখানায় টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব‍্যলেস্টিক মিসাইল, অব‍্যর্থ নিক্ষেপের আগে সমবেত হওয়ার অপেক্ষায়। জানার তো কোনো উপায় নেই, তাই বিশ্বাস করি—

নিশ্বাস নিলে কিছু কম বাতাস পাচ্ছ কি ফুসফুসে? এখনই হাঁফিয়ে উঠো না, আরও আছে—

২৮/০৯/২০১৫ উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে মহম্মদ আখলাক, ফ্রিজে গোমাংস রাখার অভিযোগে।

০৫/০৪/২০১৭ রাজস্থানের আলোয়ারে পেহেলু খান, গরু পাচারের গুজবে।

২৯/০৬/২০১৭ ঝাড়খণ্ডের রামগড়ে মহম্মদ আলিমুদ্দিন, গোমাংস রাখার অভিযোগে।

০২/০৭/২০১৭ মথুরাগামী ট্রেনে হাফিজ জুনেইদ খান, গোমাংস রাখার অভিযোগে।

১২/১১/২০১৭ রাজস্থানের আলোয়ারে উমর খান, গরু পাচারের গুজবে।

০৬/১২/২০১৭ রাজস্থানের রাজসমুন্দে আফরাজুল ইসলাম, ভিন্ন ধর্মে সম্পর্কের অভিযোগে।

২৭/০৩/২০১৮ রাণীগঞ্জ, পুরুলিয়া এবং উত্তর ২৪ পরগণায় তিনজন, রামনবমীর মিছিলের দাঙ্গায়।

২০/০৭/২০১৮ রাজস্থানের আলোয়ারে আকবর খান, গরু পাচারের গুজবে।

২১/০৬/২০১৯ ঝাড়খণ্ডের সরাইকেলায় তাবরেজ আনসারি, ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করে…

ঝাপসা আলোয় ঠিক ঠাহর হচ্ছে না, ছবি থেকে কাটা হাত-পা-মাথারা উঠে সংখ্যাগুলোর উপর ছড়িয়ে পড়ল, নাকি সংখ্যাগুলোই শরীর নিয়েছে মৃতদেহের!
আর যেটুকু বাকি রইল দেখার, ভাস্করদার মৃত্যুপূর্ব ইচ্ছাপত্রের মতো এই চিত্রপট জুড়ে আলো আর রেখা আর রং-এর অন্তর্ঘাতের ভাঁজে ভাঁজে যে অগুনতি মৃত্যুর বিস্তার রেখে দেওয়া আছে, ওই সর্বগ্রাসী হন্তারক বাহু তাকে বেমালুম নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে কিনা!

লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে রাজীব দত্ত ট্যাগে ক্লিক করুন।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *