পেটুক প্রেমিকা – বিদিশা মন্ডল
কুনাল রেস্টুরেন্টে ঢুকেই দেখল শ্রেয়া মোটি মোমো ঠুসছে। ওকে দেখেই রে রে করে তেড়ে এলো কুনাল-” এই ঢেপসি, তুই আবার খাচ্ছিস ,আচ্ছা খাওয়া ছাড়া কি তোর আর কিছু মাথায় আসে না।”
শ্রেয়া বিন্দুমাত্র ওরদিকে না তাকিয়েই বলল-” আমি খাচ্ছি তো তোর বাপের থুড়ি তোর কি? জানিস না আমি খাদ্যরসিক।”
চাপা স্বরে কুনাল বলল-” ওটাকে খাদ্যরসিক না রাক্ষসী বলে।”
-” কি বললি তুই, এই এই, কি বললি আরেকবার বল।”
-” না ইয়ে মানে বলছিলাম, এতো খাস না শরীরখারাপ করবে।”
-” আমি যদি না খেয়ে থাকি তাহলেই আমার শরীরখারাপ করবে বুঝলি। বাড়িতে তো খাবার জো নেয়, একটু বেশি ভাত চাইলেই মা বলে এরপর নাকি আমাকে আর কেউ বিয়ে করবে না। তুইই বল বিয়ের মতো তুচ্ছ ব্যাপারের জন্য খাবারকে ত্যাগ করা যায়। কাভি নেহি। তাই এখন মোমো খাচ্ছি, এরপর দেড়প্লেট বিরিয়ানী অর্ডার করেছি। আসল বলে।”
-” ভালোই করেছিস আমার জন্য হাফ প্লেট বলে, একপ্লেট আমি খেতেই পারিনা।”
-” তুইও খাবি নাকি। এমা আমি তো তোর জন্য অর্ডার করিনি। এই দাঁড়া এক্ষুনি করে দিচ্ছি… এসকিউজ মি ওয়েটার…”
-” মা মা নে এ এ।। দেড়প্লেট বিরিয়ানী তুই একা খাবি?”
-” ধূর আমি তো দুপ্লেটও খেতে পারি, মোমোটা খেলাম বলে হাফ প্লেট কম বললাম আর ওয়েট ওয়েট তুই যেন কি বলছিলি একপ্লেট বিরিয়ানী খেতে পারিস না… ছ্যা ছ্যা মানসম্মান আর কিছু রইল না আমার। আমার বয়ফ্রেন্ড হয়ে আমার সাথে প্রেম করে তুই খেতে পারিস না এই কথাটা বলতে পারলি।”
-” কি আর করব আমার পোড়া কপাল, যখন প্রেম করেছিলাম তখন ছিলিস আলিয়া ভাট আর এখন হয়েছিস ফরিদা জালাল। পুরনো প্রেম তাই ছাড়তেও পারিনা।”
-” কিইইইইই? এতো বড়ো কথা বললি তুই? মানে আমি ফারিদা জালাল। তাহলে তুই কি? তুই হলি কাঞ্চন মল্লিক। শা* পুরনো প্রেম বলে ছাড়তে পারছিস না তাইতো। ওকে আমি তোকে মুক্তি দিচ্ছি। ব্রেক আ আ প।”- কথাটা বলেই শ্রেয়া রেস্টুরেন্ট থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো। কুনাল বুঝে গেছে হাওয়া গরম আছে, সেও পেছন পেছন দৌড়াতে লাগল-” এই ঢেপসি না ইয়ে আমার আলিয়া ভাট শোন শুনে যা, বলছি বিরিয়ানী না খেয়েই চলে যাচ্ছিল। রেস্টুরেন্টের লস হয়ে যাবে যে।”
-” কি কি বলতে চাস তুই, আমার একটুখানি না খাওয়াতে এতোবড় রেস্টুরেন্টের লস হয়ে যাবে, মানে আমি পুরো রেস্টুরেন্টের খাবার একাই খাই তাইতো?”
-” কি বললাম আর কি বুঝলি, আরে শোন রাগ করিস না, চল তোকে নিজামসের রোল খাওয়াব।”
রোলের কথা শুনে শ্রেয়ার পেটে একটু একটু খিদে এসেছিল কিন্তু আজ ওর আত্মসম্মানে চাপ লেগেছে তাই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল-” নো নেভার, তোরসাথে আমি কিছু খাবো না। তোরসাথে সরু গিলগিলে শাকচুন্নীর বিয়ে হবে। আমি অভিশাপ দিলাম।”- শ্রেয়া বাস ধরে বেরিয়ে গেলো। কুনাল মাথা চুলকে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকল।
বাড়ি ফিরে শ্রেয়া ফ্রিজ থেকে টপাটপ কয়েকটা রসগোল্লা মুখে পুরে মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করল, ওদিকে মা সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে ষাঁড়ের মতো-” ওরে হতচ্ছাড়ি মেয়ে, ওগুলো খাস না।মিষ্টিগুলো আজ তোকে বিকেলে যে ছেলেবাড়ির লোকেরা দেখতে আসবে তাদের জন্য রাখা ছিল।” শ্রেয়ার মুখে তখন তিনটে রসগোল্লা ঢোকানো, ওই অবস্থায় ও রেগে গিয়ে বলার চেষ্টা করল-” আউমাকে বউলো নি কে এ থো আথে?”
-” কি কি সব বলছিস, মিষ্টিগুলো গিলে স্পষ্ট করে বল?”
মিষ্টিগুলো কোনরকমে অর্ধেক চিবিয়ে গিলে নিয়ে শ্রেয়া বলল-” আমি বলোনি কেনো আগে? ”
-” কাল তো বললাম বিকেলে, তুই তো তখন কানে হেডফোন লাগিয়ে রসমালাই গিলছিলিস।”
-” ছি মা গিলছিলি কি কথা বলো স্বাদ অনুভব করছিলাম। তুলতুলে ছানায় মোড়া রসমালাই দুধে নিমজ্জিত তুলোর বলের মতো… আহ… ইয়ে আমি কি যেনো বলছিলাম, হ্যাঁ।।আমি কতবার বলেছি যে আমি এখন বিয়ে করব না। আমার এখনো কতকিছু খাওয়া বাকি।বিয়ের পর বর যদি খেতে না দেয়।”
-” শুধু খাওয়া খাওয়া, এই মেয়েকে নিয়ে যে কি করি আমি। দেখতে দেখতে ৭৫ কেজি ওজন হয়ে গেছে। এরপর তোর কি আর বিয়ে দিতে পারব।”
-” ধূর মা বিয়ে করে কি হবে, খাওয়ায় জীবন। ভালো ভালো খাও আর জীবন কাটাও।”
-” হ্যাঁ হতভাগী সেইতো বলবি। বাপের ঘাড়ের উপর বসে সারাজীবন খাবি আর বাড়িতে বসে থাকবি।”
-” মা আআআ। তুমি এরম কথা বলতে পারলে আমাকে। বেশ আমি চলে যাবো তোমাদের সবার থেকে অনেক অনেক দূরে, কেউ খুঁজেই পাবে না আমাকে। তখন বুঝবে।”
-” হুঁ, দূরে যাবে। যখন পেটে খিদের টান আসবে অমনি সুড়সুড় করে বাড়িতে ফিরে আসবি। ওইসব ভয় আমাকে দেখাস না। যা যা দূর হয়ে যা চোখের সামনে থেকে। বিকেল বেলা ছেলের বাড়ির লোকের সামনে একটু ভদ্র হয়ে থাকিস তাহলেই অনেক কৃতজ্ঞ থাকব।”
শ্রেয়ার চোখে তখন জল এসে গিয়েছে। যারা খেতে ভালবাসে তাদের মনটা খুব নরম হয় শ্রেয়াও তার ব্যতিক্রম নয়। মায়ের শাসন সে সইতে পারল না, নিজের ঘরে গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল কিছুক্ষণ। তারপর চোখ বন্ধ করে ভাবল এই জগতে তার আপনজন বলতে সত্যিই কেউ নেয়, তার বাবা মা এমনি কুনালও ওর উপর বিরক্ত। তাহলে ওর এইভাবে নির্লজ্জ হয়ে সবার সামনে পরে থাকার কোনো মানেই হয়না। শ্রেয়া ঠিক করল সে আজ সত্যি সত্যি অনেক দূরে কোথাও চলে যাবে, তাহলেই হয়তো সবাই ভালো থাকবে…
রাগের মাথায় শুধু ফোন আর পার্স নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো শ্রেয়া। ওর মা তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল। রাস্তায় নেমেই ওর ফার্স্ট মনে হলো ওর যাবে কোথায়? কোনো বন্ধুবান্ধবের বাড়ি গেলে তো মা বাবা খুঁজে নেবে ওকে। আর কুনালের সাথেও ব্রেকআপ করেছে তাই ওরকাছেও যাওয়া যাবে না। কুনালের কথা মনে পরতেই আবার চোখে জল এলো শ্রেয়ার। কত ভালবাসে কুনালকে ও আর কুনাল ওকে শুধু শাসন করে। মনে পরে যায় কলেজের প্রথম দিনেই লম্বা ছিপছিপে চেহারার ছেলেটা শ্রেয়াকে জিজ্ঞাসা করেছিল-” এই তোর নাম কি রে?”
-” নাম জেনে কি হবে সেই তো একদিন মরেই যাবি”- মিটমিট করে হেসে বলেছিল শ্রেয়া।
-” কলেজে এসেছিল কেন তবে সেইতো একদিন মরেই যাবি। যতসব ঢং।”
-” এই এই একদম বাজে বকবি না বলে দিলাম। কলেজের প্রথম দিনেই মেয়েদের নাম জিজ্ঞাসা করে আবার আমাকে বলছে। ফ্লার্টিং করার ধান্দা, সব বুঝি বাওয়া।”
-” এতো চাপ নিচ্ছিস কেনো দিদিমা। তোর থেকে অনেক সুন্দরী মেয়ে আছে ফ্লার্ট করার জন্য। তোর মতো হেদলীর সাথে কেও প্রেম করবে নাকি।”
-” ভারী অভদ্র ছেলে তুই।”
-” আমি শুধু ইটের বদলে ইট দিতে জানি বুঝলি।”- এই ছিল ওদের দুজনের প্রথমদিনের কথোপকথন। তারপর একটা জিনিস ওদের কাছাকাছি এনেছিল সেটা হলো কলেজের এনুয়াল ফাংসানে হওয়া নাটক অর্থাৎ ড্রামা। দুজনেই অভিনয় করতে ভালবাসে। সেইমতো নামও দিয়ে দেয় দুজনে। তারপর সিলেকশন পর্ব পার করে দুজনকে দেওয়া হয় দুটো চরিত্র যেখানে দুজনে ছিল স্বামী-স্ত্রী। দুজনেরই প্রবল অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্যারকে সাহস করে কেউই বলতে পারেনি ওরা কতটা অনিচ্ছুক। তারপর নাটকের রিহার্সাল শুরু হয়ে যায় প্রবলভাবে। কুনাল আর শ্রেয়ার বেশিরভাগ সিনই ছিল একসাথে। তাই বিভিন্ন সময়ে চরিত্রগুলো আরো জীবন্ত করার জন্য আলাদাভাবে ডিসকাস করত ওরা দুজন, স্বাভাবিকভাবে ক্রমেই দুজনের মধ্যে একটা সরল বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।
-” চল ভালবাসার মেঘ মেখে বন্ধু হবো দুজনে, চলো সুখের চাদরে শিশির জমিয়ে বন্ধু হবো দুজনে, চলো কুয়াশা মাখা ভোর নিয়ে বন্ধু হবো দুজনে, সারাটা জীবন পথ চলব একসাথে বন্ধু হবো দুজনে।”- নাটকের শেষ দৃশ্যপটে স্টেজে দাঁড়িয়ে কুনাল শ্রেয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলতেই অডিটরিয়াম জুড়ে দর্শকের হাততালি শোনার গেলো। শুধু নাটকের স্ক্রিপ্টে লেখা কথাগুলো আবেগ হয়ে একে ওপরের মনের তার জুড়ে দিলো অলিখিতভাবে। তারপর ওদের প্রেমের উপাখ্যানে রঙিন রঙিন নৌকার পালতোলা স্বপ্নগুলো জমাট বাঁধতে থাকে ধীরে ধীরে। কলেজ পাশ করার পরেও ওদের সম্পর্কটা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে। এরমাঝে মাথাচারা দিয়ে ওঠে শ্রেয়ার খাদ্যপ্রেম। বরাবরের খাদ্যরসিক শ্রেয়া এখন দেশি বিদেশী সমস্তরকম খাবারের একনিষ্ঠ ভক্ত। এরফলে ওজন বাড়তে থাকে ওর, এইনিয়ে কুনালও বেশ চিন্তিত হয়ে পরে শ্রেয়াকে নিয়ে। মোটা রোগায় বিভেদ সে করে না কিন্তু শ্রেয়ার শরীরের কথা ভেবেই ও শ্রেয়াকে পরিমিত খাওয়ার কথা বলেছে। তবু শ্রেয়া শোনেনি, কুনাল তবু তার অবুঝ, পাগলি প্রেমিকাকেই বড্ড ভালবাসে, আগলে রাখে।
শ্রেয়া খানিকটা হেঁটে গিয়ে নিজের কাছে থাকা কিছু টাকা দিয়ে বাসে করে বেশ কিছুটা দূরের স্টপিজে নামল। জায়গাটা ওর পরিচিত মাঝেমাঝেই শ্রেয়া এখানে আসে বিশেষ করে ওর মনখারাপ করলে আরসালানের বিরিয়ানী আর চিকেন চাপ খেয়ে মন ভাল করতে। কুনালের সাথেও বহুবার এসেছে এখানে। ও শুধু জ্ঞানের লম্বা ফিরিস্তি শোনতো শ্রেয়াকে-” বিরিয়ানী খাওয়া হেলথের পক্ষে ভালো না, ঘি, কত স্পাইস, তুই আমি মিলে এক প্লেট খাবো কেমন।” শ্রেয়া গুজবে যথারীতি কান না দিয়ে একপ্লেট বিরিয়ানী আর চিকেন চাপের বড়ো লেগ পিস সাঁটিয়ে ঢেঁকুর তুলে বলত-” আহ পেট শান্তি তো জগত শান্তি।”- কুনালের নিজের দেওয়া জ্ঞানগুলো যে সব ভস্মে ঘি ঢালার মতো হয়েছে সেটা বুঝতে পেরে নিজেকেই নিজে খিস্তাতো। ওদিকে বাড়ি থেকে অনেকবার ফোন এসেছে, একবারের জন্যও ধরেনি শ্রেয়া। ওতোগুলো রসগোল্লা পেটায়স্থ করার পর পেটের খিদেটা এখনো চাগাড় দিয়ে ওঠেনি তাইতো শ্রেয়ার বিপ্লবী মনোভাব এখনো বেশ সজীব হয়ে আছে, মনে তখনও রাইমসের মতো আওড়ে যাচ্ছে-” এবার বুঝবে কত ধানে কত বিরিয়ানী না মানে চাল। মেয়ে থাকতে মেয়ের মর্ম বোঝোনা। কি ভেবেছিল যে আমি ওদের দাসত্বে পরে থাকব চিরকাল, আমি দূরে কোথাও চলে যেতে পারব না তাহলে ওরা ভুল ছিল আর এতোক্ষনে সেটা বাবা মা ভালই বুঝতে পেরেছে। আচ্ছা কুনাল যখন শুনবে তখন কি ওর আমার জন্য একটুও মনখারাপ করবে নাকি বলবে বাঁচা গেছে আমার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে, সামনে পেলে না একদম চটকে চটপটি বানিয়ে দিতাম।” যাইহোক এবার মনের সব ময়লা দূর করে শ্রেয়া আরসালানের বিরিয়ানী খেতে গেলো এমন সময় ওর মনে পরল ওরকাছে তো আর টাকাই নেয়। তাড়াহুড়োতে ভুলেই গেছে যে পার্সে কুড়িটাকা পরেছিল। মায়ের দেওয়া কালকের দুশো টাকা দিয়ে চিকেন জাফরানী তন্দুরী সাঁটিয়েছে, সেটা তো বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল শ্রেয়া। এখন বাসভাড়াও টাকা নেয় ওরকাছে সেখানে আরসালানের বিরিয়ানীতো স্বপ্নে দেখা বিরাট কোহলী। অগত্যা আরসালানের সামনেই ফুটপাতে বসে রইল সে। ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গিয়ে সুইচ অফ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে। পালানোর আগে একটু চার্জও দিতে ভুলে গেছে আসলে প্রথমবার পালাচ্ছিল তো তাই ছক কষতে পারেনি ঠিকঠাক। রাস্তায় ইতিউতি তাকিয়ে কি করা যায় সেটাই ভাবতে শুরু করল শ্রেয়া, একবার ভাবল ট্রাফিক পুলিশকে জানাবে তারপর ভাবল পুলিশ যদি ওকেই জেলে ভরে দেয় বাড়িতে না বলে পালিয়ে যাবার অপরাধে তারপর তো সে আর জীবনে লজ্জায় মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারবে না, তার থেকে বরং এখানেই বসে থাকায় শ্রেয়।
ওদিনে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে গিয়েছে, ছেলের বাড়িতে ফোন করে তাদের আসতে বারণ করা হয়ে গিয়েছিল। শ্রেয়ার বাবা মা ব্যাকুল হয়ে পরেছেন, শ্রেয়ার মা কান্নাকাটিও আরম্ভ করেছেন ততক্ষণে। শ্রেয়ার বাবা প্রদীপবাবু স্ত্রীকে বেশ কয়েকবার ধমক দিয়ে বলেছেন-” কি দরকার ছিল মেয়েকে ওতো কথা শোনানোর মেয়েকে, নাও এবার সামলাও।”
শ্রেয়ার মাও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললেন-” আমিতো ওর ভালোর জন্যই বলেছিলাম।। ওমা আমার কি সর্বনাশ হলো গো।”
একএক করে প্রদীপবাবু শ্রেয়ার সমস্ত বান্ধবীদের বাড়িতে ফোন করেন কিন্তু শ্রেয়ার কোনো খোঁজ নেয়। শ্রেয়ার বান্ধবী সুরভির মাধ্যমে কুনাল সবটা জানতে পারে। সবটা শোনার পরই কুনাল নিজেকে স্থির রাখতে পারেনি, ছুট্টে গেছে শ্রেয়ার বাড়িতে। কুনালকে দেখে প্রদীপবাবু জিজ্ঞাসা করলেন-” তোমাকে চিনতে পারলাম না তো”
-” আমি শ্রেয়ার কলেজের বন্ধু। আমাকে কি বলবেন যে আসলে কি হয়েছিল।”
শ্রেয়ার মা সবটা বিস্তৃতভাবে জানায় কুনালকে আর জানায় এখন শ্রেয়ার ফোন সুইচ অফ বলছে। কুনাল বুঝতে পারে প্রিয়জনদের কাছ থেকে আঘাত পেয়েই মনখারাপ করে পাগলিটা ঘর ছেড়েছে।আজ নিজেকেও দায়ী করে সে, ওরকথাতেও বেচারি কতটা আঘাত পেয়েছিল, তার উপর আবার মায়ের বকুনি।খানিকক্ষন চিন্তা করে কুনাল বলল-” কাকু কাকিমা আমার মনে হয় আমি জানি শ্রেয়া কোথায়?”
-” তুমি জানো ও কোথায়?”
-” আসলে কলেজে পড়তেও ওর মনখারাপ হলে আমরা বন্ধুরা মিলে আরসালান যেতাম ওর মন ভালো করার জন্য। আমি যদি খুব ভুল না হয় তাহলে ও আজ ওখানেই গেছে।”
কুনালের কথা শোনামাত্র শ্রেয়ার বাবা মা আর কুনালে রওনা দিলো আরসালানের দিকে। ওখানে পৌঁছে উদ্বিগ্ন মনে ব্যাকুল হয়ে ছুটল রেস্টুরেন্টের ভেতরে। সেখানে গিয়ে ওরা তিনজন যা দেখল তা দেখে থ মেরে গেলো পুরো। শ্রেয়া দিব্যি আয়েস করে একটা টেবিলে বসে বিরিয়ানী আর চিকেন চাপে কামড় বসাচ্ছে আর ওর সামনে বসে প্রদীপবাবুর বন্ধু শ্রেয়ার প্রিয় নিরুকাকু। প্রদীপবাবুদের দেখা মাত্রই শ্রেয়া বোকার মতো হাসি দিতে লাগল যেনো মামারবাড়ির আব্দার ওর এই ছেলেমানুষী সবাইকে অবলীলায় ভুলে যেতে হবে। কুনাল নিজেকে সামলাতে না পেরে বলেই দিলো-” এসব কি ছেলেমানুষী শ্রেয়া, তোমার জন্য কাকু কাকিমা চিন্তায় মরে যাচ্ছেন আর তুমি এখানে নির্লজ্জের মতো খাচ্ছো।”
-” বকছ কেনো আমি তো খেতে চাইনি। নিরুকাকুই খাওয়াচ্ছে।টাকাও ছিলনা আমার কাছে। নিরুকাকুর সাথে দেখা হয়ে গেলো। আসলে নিরুকাকুও আমার মতো খাদ্যরসিক কিনা, তাই মাঝেমাঝেই আরসালানে ঢুঁ মারেন।। হেহেহে।”
এরপর আর কি বলবে কুনাল শ্রেয়াকে। বাচ্চাদের মতো সরল হাসি দেখে ওরও হাসি পেয়ে গেলো। ওদিকে শ্রেয়ার নিরুকাকু ওরফে নিরঞ্জনবাবু শ্রেয়ার বাবা মায়ের কৌতূহলটা বুঝতে পেতেই বললেন-” আমি এখানে মাঝেমাঝে খেতে আসি সেতো তোরা জানিসই। হঠাৎ শ্রেয়া মায়ের সাথে দেখা। দেখি শুকনো মুখে , মুখ কালো করে বসে আছে। আমাকে দেখেই কেঁদে ফেলল পাগলিটা তারপর গরগর করে সব বলে দিলো আমার কাছে। আমিও বকলাম ওকে যে এইভাবে বাড়ি থেকে চলে আসাটা খুব ভুল কাজ, অন্যায়। তারপর বেচারীকে বললাম আগে তুই খেয়ে নে তারপর তোকে বাড়ি দিয়ে আসব, তারমধ্যেই তোরা চলে এলি।”
প্রদীপবাবুরাও আর কিছু বললেন না মেয়েকে। ওর নিষ্পাপ চোখের চাওনি দেখে সাহস পেলেন না।
নিরঞ্জনবাবু এবার কুনালের দিকে মনোনিবেশ করে বললেন-” তুমি কুনাল তো? তোমার বিষয়েও শ্রেয়া মা আমাকে সব বলেছে।তুমি কিন্তু খুব অন্যায় করেছো বাবা। আর প্রদীপ এবার মেয়ের বিয়ের আয়োজন কর। তোর খাদ্যপ্রেমী মেয়ের বিয়ের মেনু কিন্তু আমিই করব বলে দিলাম। হাহাহা।”
প্রদীপবাবুর গম্ভীর হয়ে শ্রেয়াকে বললেন-” কবে থেকে চলছে এসব?”
-” আমরাতো কিছুই জানিনা। এইজন্য মেয়েতে ছেলেদেখার কথা বললেই বিয়ে করব না করব না বলত।”- শ্রেয়ার মা বলল।
শ্রেয়া এবার খাওয়া থামিয়ে বলল- ” ওরসাথে তো আমার ব্রেকআপ হয়ে গেছে। তোমরা অন্যছেলে দেখো মা।”
-” একি কথা বলছ শ্রেয়া, এতোদিন সহ্য থুড়ি ভালবেসে এলাম আমি তোমাকে আর এখন তুমি আমাকে ত্যাগ দিচ্ছ। কালই তোমাকে বিবেকানন্দ পার্কের ফুচকা খাওয়াব। প্রমিস।”- কুনাল ঠিক জায়গায় মোক্ষম চালটা দিলো।
-” সত্যি, ওকে। তাহলে মা তোমাকে অন্য ছেলে দেখার প্রয়োজন নেয়। একেই করে নেবো বিয়ে।”
শ্রেয়ার বাবা মা একসাথে কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন-” কি মেয়ের জন্ম দিয়েছিলাম রে বাবা, মা বিপদতারিনী ওকে রক্ষা করুক, অবুঝ পেটুক কিন্তু ভারী সরল…”
কুনালও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল অবশেষে ওর ” পেটুক প্রেমিকা” ওকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে এই ওর ভাগ্য…
চিত্রঋণ মৌমিতা ভট্টাচার্য্য