ভাষার মাতৃত্ব সংক্রান্ত চাট্টি কুকথা – অভিষেক ঝা
পৃথিবীতে যত ট্যাবু রয়েছে তার মধ্যে কৃষ্টি ও ভাষা ট্যাবু থেকে মুক্ত মানুষের সংখ্যা হয়তো বা সবচেয়ে কম। একজন আধুনিক মননের মানুষ যত অনায়াসে ‘ধর্ম’ ও ‘জাতিসত্তা’ কে প্রশ্ন করেন, যত সহজে ভেঙে ফেলতে পারেন ‘সামাজিক’ সব বিধি আরোপ, তছনছ করতে পারেন ‘বিধিবদ্ধ’ যৌনরুচি, ঠিক ততটা আয়াসে মাতৃকৃষ্টি ও মাতৃভাষাকে ( সমাজ ভেদে পিতৃও হতে পারে) নিয়ে প্রশ্ন করতে স্বস্তি বোধ করেন না । আমি যতটা সহজে নিজের ভোটার আই-ডি তে থাকা ‘ভারতীয়’ জাতিসত্তাকে একটি কাল্পনিক নির্মাণ মনে করি, বা , ফর্ম ফিলাপের সময় ধর্মের জায়গায় থাকা ‘হিন্দু’ ধর্মীয় সত্ত্বাকে একটা অতিরিক্ত বোঝা মনে করি, ঠিক ততটা সহজে কি প্রশ্ন করি মাতৃভাষা হিসেবে থাকা বাংলাকে? উত্তরটা নেতিবাচক । অথচ ‘ভারতীয়ত্ব’, ‘হিন্দুত্ব’ এরই মতো তো বাংলা ভাষাটাকেও তো আমি নিজ ইচ্ছায় নিজের মাতৃভাষা হিসেবে টিক মার্ক দিইনি। যে যুক্তিতে ভারত আমার দেশ হয়েছে, যে কুযুক্তিতে আমি হিন্দু হয়েছি, সেই একই যুক্তিক্রম অনুযায়ী আমার মাতৃভাষা বাংলা । সুতরাং মেনে নেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে, ‘জাতিসত্তা’ ও ‘ধর্ম’ যে অর্থে ট্যাবু, মাতৃভাষাও সেই একই অর্থে ট্যাবু । এই ভাষা আমার উপর আরোপিত এবং আমার ব্যক্তিসত্তার সীমাহীন পরাধীনতার বিস্তারের একটি পরিশীলিত হেজেমনিক বাধ্যতামূলক অনুশীলন আর সেই অনুশীলনের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া আপাদমস্তক সংস্কারগ্রস্ত অহমিকার নাম মাতৃভাষা । তাই মাতৃভাষা নিয়ে সোচ্চারে নারা দিতে থাকা প্রজাতিরা “ভারত মাতা কি জয়!” বা “গর্বের সাথে বল আমি হিন্দু” এই প্রজাতিদের সঙ্গে তুতো ভাবে সম্পর্কিত।
বস্তুত ভাষার সঙ্গে মা কে মোটিফ হিসেবে ব্যবহার করে যে ‘পবিত্রতা’ ও ‘চিরানুগত্য’ লেজুড় হিসেবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে তা সামন্ততান্ত্রিক পিতৃতন্ত্রের পরিচায়ক । জন্ম ও লালনপালন সূত্রে পাওয়া একটি ‘উত্তরাধিকার’ কি করে একজন ব্যক্তির সহজাত হিসেবে ধরে নেওয়া হয় তা নিয়ে ভাবলে বিপন্ন হতে হয় । একটা খুব ইন্টারেস্টিং ঘটনা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যাক । ১৯৮০ থেকে ২০০১ অবধি লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ ও মেক্সিকো থেকে প্রচুর স্প্যানিশ মাতৃভাষী অভিবাসী ঢুকতেন আমেরিকায় সেইসব দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার হেতু। মার্কিন ইংরাজি মাতৃভাষা বিশিষ্ট শিশুদের দেখভালের জন্য এই সমস্ত অভিবাসীদের মহিলারা নিয়োগ হতে থাকেন যথেচ্ছ ভাবে । আশির দশকের শেষ থেকেই ‘অসুবিধাটা’ পরিলক্ষিত হয়: ইংরাজি মাতৃভাষা বিশিষ্ট শিশুরা স্প্যানিশে বেশ দড়ের হয়ে উঠছে ইংরাজির চেয়েও । মাতৃভাষাকে বাঁচাবার উদ্দেশ্যে প্রত্যেক স্প্যানিশভাষী শিশুপালিকাদের মার্কিন ইংরাজি ভাষায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং বাধ্যতামূলক নির্দেশ দেওয়া হয় শিশুদের সঙ্গে শুধুমাত্র মার্কিন ইংরাজিতে ( ভাঙা ভাঙা হলেও) কথা বলার ও শোনার। [ সূত্র: ‘ ডুয়ালিটি অফ ল্যাংগুয়েজ’ , মরিস রিমব্রন্ড, জুন, ২০০৫, “দ্য আদার ভয়েস” ]। এই নির্দেশকে আপাত দৃষ্টিতে ‘মাতৃভাষা বাঁচাও’ এর নিরীহ নিক্তি ঠেকলেও, একটু তলিয়ে ভাবলেই দেখা যাবে এক সামন্ততান্ত্রিক লেঠেল ভয় পাচ্ছে আরেক লেঠেল তাকে যদি উৎখাত করে দেয় ।মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে বাধ্যতামূলক এই নির্দেশ সকল ও সমস্ত আস্ফালন এই ধারণাকেই জোরদার করে যে গা জোয়ারি ছাড়া যেমন ধর্ম ও জাতিসত্তা রক্ষা করা যায় না, ঠিক একইভাবে, হরেকরকমের নরম ও গরম পন্থা ব্যতীত মাতৃভাষাকে রক্ষা ও বিস্তৃত করা যায় না ।
হিন্দি মাতৃভাষীদের ভারতবর্ষের উত্তর-১৯৪৭ নরম পন্থাটি হল বলিউডকে ভারতীয় সিনেমা বলে চালানোর চেষ্টা, আর গরম পন্থাটি হল ভারতীয় কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে মূলত হিন্দিভাষী প্রশাসন করে তোলা । এই আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য শিবসেনা মারাঠি অস্মিতা দিয়ে , বা তামিলরা নিজদের ফেকলোরগুলোকে সত্যি বানানোর চেষ্টা দিয়ে, বা সাম্প্রতিক কালে কিছু ডন কিয়োতে মার্কা পশ্চিমঙ্গীয় ‘জয় বাংলা’ দিয়ে যা করে থাকেন তা কাউন্টার-ফান্ডামেন্টালিজম ছাড়া আর কিছুই নয় ।আর যে সমস্ত ভাষার এই মাতৃভাষা নামক হেজেমনিক আগ্রাসন প্রবণতা নেই, তাদের গ্রাস করে ফেলে অন্যের মাতৃভাষা। টোটো ও রাভা ভাষার ভূমে এসে ডায়াস্পোরিক সাদ্রী ভাষা গ্রাস করে ফেলে টোটো ও রাভা ভাষাকে; বাংলা ভাষা রাজবংশীয় তীব্র প্রতিরোধের আগে প্রায় গিলে নিতে চেয়েছিল রাজবংশীয় স্বাতন্ত্র্য; গোর্খালি নামক এক কাল্পনিক মাতৃভাষার নির্মাণ করে মুছে ফেলা হয় লিম্বু, রাই, লেপচাদের ভাষা স্বাতন্ত্র্য; রাজমহল পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পুরো মালদার গাঙ্গেয় সমভূমির দ্বারভাঙ্গিয়া মাতৃভাষীদের সরকারি পরিষেবা পাওয়ার জন্য সরকারি ফর্মে মাতৃভাষা হিসেবে লিখে দিতে হয় বাংলা । এই সমস্ত কিছুই দেখায় যে মাতৃভাষা মূলত এক শক্তি রাজনীতির স্তম্ভ যা নিয়ে ট্যাবুগ্রস্ত হয়ে থাকে আপাতভাবে সংস্কারহীন মুক্তমনন । এটিই মাতৃভাষার সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।
Osadharon….
বেশ তো