উড়োজাহাজের হাত – শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য
অনেক দিন পর বাবা বাড়ি ফিরেছে। বাবাকে দেখতে পেয়েই মেয়েটি দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। আনন্দ, প্রচণ্ড আনন্দ এখন মেয়েটির হাতে পায়ে ছড়িয়ে। বাবাকে কতদিন পরে সে কাছে পেয়েছে।
মেয়েটিকে আমি লক্ষ করেছি। বাচ্চারা যখন আনন্দে তাদের সবচেয়ে প্রিয়জনের দিকে খুব দ্রুত এগিয়ে যায়, তখন সে এক অবাক করা দৃশ্য! বদমেজাজি মানুষও বিচ্ছিরি ঝগড়াঝাটির পর এমন কিছু দেখলে আপনাআপনি তার মধ্যে হাসি তৈরি হয়। মন শান্ত হয়, নরম হয় চোখ। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও তার মনে হয় পৃথিবী এই হাসির মতোই সুন্দর! এইসব কি আর শুধুই আমার চোখের সামনে ঘটে, চোখ খুললে এমন হাসি হামেশাই ফুটতে দেখা যায় পৃথিবীর সকল প্রান্তে। বাচ্চারা কোথায় নেই বলুন তো! মাসাইমারা, নিউইয়র্ক, বারামুল্লা, সাঁওতাল পরগনা, সেখানেও তো তারা উল্লাসে দাপিয়ে খেলে বেড়ায়, মা আব্বাজানকে দেখলেই দৌড়ে গিয়ে তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাসি ফুটে ওঠে।
যেমন ধরা যাক ইরাকের সেই গ্রামের কথা। আকাশ থেকে পাখির চোখে দেখলে বোঝা যায় ছোটোখাটো অনেক তাবু গিজগিজ করছে সেই গ্রামের একটিমাত্র রাস্তার দু-ধারে। এই রাস্তায় একই ধরনের বড়ো বড়ো গাড়ি যায় আর আসে। গাড়ির ভেতর সেমি-অটোমেটিক রাইফেল হাতে সেনাবাহিনী আর রাস্তার দুপাশের তাঁবুর ভেতর রিফিউজি বাচ্চারা থাকে। রাতে সেই বাচ্চারা রুটি খায়, কেউ রুটি না খেয়েই ঘুমায়, কেউ সারারাত জাগে। সকাল হলেই পাথুরে পাহাড়ের নিচে ল্যান্ড-মাইন খোঁজে তারা। দিনের আলোয় এই তাদের কাজ। জ্যান্ত মাইন পেলে বাজারে দাম ভালো পাওয়া যায়। অনেকটা এইধরনেরই কাজ করতে দেখা যায় প্যালেস্টাইনের গাজা স্ট্রিপের রিফিউজি ছেলেমেয়েদের। সেখানে ঘরবাড়ি বলতে তেমন কিছুই নেই। বোমারু বিমানের লাগাতার আক্রমণে সবই প্রায় কংক্রিটের টুকরো। খটখটে রোদের আলোয় ভাঙাচোরা কংক্রিটের স্তূপের মধ্যে বালতি হাতে ঘুরে বেড়ায় ন বছরের ছেলে আবু মুস্তাফা। সে জানে তার ঘরের দেয়ালগুলো চুরমার হয়ে এখানেই কোথাও একটা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সে কংক্রিটের টুকরো তুলে বালতি ভরে। বাজারে এগুলোর ভালো দাম পাওয়া যায়।
ফিরে আসি ইরাকের সেই গ্রামে।
মাইন তোলা বাচ্চাগুলোর মধ্যে আফরান নামে ছেলেটির একটা হাত নেই। কাঁধ থেকে কাটা পড়েছে। কীভাবে ঠিক জানি না তবে যুদ্ধ সংক্রান্ত কোনও ঘটনার ফলেই হবে। ফেরহাদের আবার একটা পা নেই। এর কারণ অবশ্য জানা গিয়েছে। খেলতে খেলতে ভুল করে মাইন ফিল্ডের ভেতর ঢুকে পড়েছিল ফেরহাদ। ব্যাস! হাঁটু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পায়ের বাকিটা ছিটকে পড়েছিল তিনফুট দূরে। এই ফেরহাদের বন্ধু আফরানই সমস্ত রিফিউজি বাচ্চাদের লিডার। সবাই তাকে খুব মান্যগণ্য করে। বয়সেও সে সবার থেকে বড়ো। কে কোথা থেকে মাইন জোগাড় করবে সকাল সকাল সেই সবাইকে পাখি পড়ানোর মতো করে বুঝিয়ে দেয়। তারপর বাচ্চারা হই হই করে ছড়িয়ে পড়ে মাইন ফিল্ডের এদিক ওদিক। ঝকঝকে সকালগুলোয় শুরু হয় এন্তার মাইন খোঁজার কাজ।
বেশ কিছুদিন হল নতুন একজনকে দেখা গিয়েছে রিফিউজি ক্যাম্পে। একটা বাচ্চা মেয়ে। কত আর বয়স হবে। বড়োজোর তেরো। আফরানের চেয়ে সামান্য ছোটো। সেই মেয়েটিকে কে খেয়াল রাখে তার ঠিক নেই সে নাকি আবার পিঠে আরও একজনকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বছর তিনেকের একটা ছেলে। ছেলেটি আজব। কিছু বলতে চাইলে তার মণি দুটো চোখের চারপাশে গোল গোল ঘুরতে থাকে। ছেলেটি আসলে অন্ধ। প্রথম প্রথম আফরানের সঙ্গে মেয়েটি একেবারেই কথা বলত না। দেমাক নিয়ে ঘুরে বেড়াত রুক্ষ মুখে। কিন্তু মাইন তোলার কাজ পেতে হলে সেই তো ভরসা। সেই তো লিডার। আফরান নিজের তাগিদেই মেয়েটির সঙ্গে একদিন আলাপ জমায়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সে জানতে পেরেছে মেয়েটির নাম জারা আর তার পিঠে পেলিন। আফরান কথা দিয়েছে বাজার থেকে বুলেটওয়ালা লকেট এনে জারাকে দেবে আর পাহাড়ে যে নীল রঙের পাখি আসে তাকে দেখাতে নিয়ে যাবে। এই নীল পাখি নাকি খুব শুভ। পেলিনের দিকে সেই পাখি তাকালেই তার চোখ নিমেষে ঠিক হয়ে যাবে। জারা সবই মন দিয়ে শোনে, কোনও উত্তর দেয় না। মুখে হাসি তো দূরের কথা মনে হয় সবসময় যেন সবকিছুর ওপর রেগে আছে। অথচ জারাকে দেখলেই কে জানে কী এক নিয়মে আফরান একেবারে জবুথবু হয়ে পড়ে। মুগ্ধতায় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে পেলিনকে পিঠে নিয়ে জারার যাত্রাপথ। তাকে আফরান নীল পাখি দেখাবেই।
জারা চুপচাপ মাইন তোলে। পাহাড়ের দিকে হেঁটে যায়। বালতি করে জল নিয়ে আসে। এই সময়ে পেলিনকে বেঁধে রাখতে হয় গাছের সঙ্গে। পায়ে মোটা দড়ি। এই দড়ি তাকে আফরানই যোগাড় করে দিয়েছে।
রিফিউজি ক্যাম্পের ব্যাপারস্যাপারই আলাদা। বাচ্চাদের সকাল হলেই নিয়ম মেনে পড়তে বসা নেই। নাক টিপে হরলিক্স খাওয়ার যন্ত্রণাও নেই। আফরানের সঙ্গে কিছু কথা সেরে তারা নিজের নিজের জায়গা বুঝে ল্যান্ড মাইন খোঁজা শুরু করে। এখানে একটা কথা না বললেই নয়। আফরান লিডার হলে কী হবে সবাই কিন্তু তাকে খুব ভালোবাসে। এলেন্দি তো আফরানকে ভগবানের চোখে দেখে। আফরান যখন আঙুল নাচিয়ে অনর্গল কথা বলতে বলতে তাদের কাজের জায়গা ভাগ করে দেয় তখন সে আফরানের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। চোখের পলক পড়ে না। বুঁদ হয়ে তার অমৃত বাণী শোনে এলেন্দি। নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে তাকে আফরান বাঁচিয়েছিল একদিন। পা টিপে টিপে মাইন ফিল্ডে ঢুকে এলেন্দিকে বার করে এনেছিল। এলেন্দি তখন কত ছোটো! তারা সবাই জানে আবার যদি যুদ্ধ শুরু হয় আফরানই তাদের বাঁচাবে।
সেদিন আফরান পেলিনকে তার সাইকেলে বসিয়ে কাঁটাতারের পাশ ঘেঁষে কয়েক চক্কর লাগিয়েছে। কাঁটাতারের ওপাশেই চেকপোস্ট। মেশিনগান হাতে প্রহরীর চোখ ছিল তাদের দিকেই। তাদের নজরদারির আওতায় থেকেই একটু দূরের ভাঙাচোরা কামানগুলোর পাশে পেলিনকে নিয়ে লুকোচুরিও খেলেছে। কে জানে কী এক নিয়মে আফরানকে খুব মনে ধরেছে পেলিনের। সাইকেলে আসার সময় সারাক্ষণ অদ্ভুত সব শব্দ করেছে। দারুণ আনন্দে পেলিন এমন শব্দ করে। এই প্রথমবার তার সাইকেলে চড়া। আফরানের গালে সে হাত বোলায়। তার চুল ধরে টানে। আফরান টুকি বলে লুকিয়ে পড়ে। পেলিন এদিক-ওদিক এলোপাথাড়ি হাঁটে। চোখের মণি গোল পাকায়। বাবা বাবা বলে চেঁচায়। আফরানের গন্ধ পেলেই দৌড়ে আসে তার দিকে। আফরানের মুখে আপনাআপনি হাসি তৈরি হয়। নরম হয় তার চোখ। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও এই রিফিউজি ক্যাম্পকেই তার চমৎকার বলে মনে হয়। পেলিন হাত বাড়িয়ে তার কোলে উঠতে চাইলে এক হাতের জোরেই পেলিনকে সে ঠিক কোলে তুলে নেয়। একের পর এক চুমু খায়। পেলিন হাসে। মজা পায়। আফরান গভীরভাবে নীল পাখির কথা মনে করে সেই সময়। ফেরার পথে সে ভাবে জারার ছোটো ভাইটা তাকে দেখলেই বাবা বলে কেন ডেকে ওঠে। ভাবতে ভাবতে কখন যে সে ফিক করে হেসে ফেলে নিজেই বুঝতে পারে না।
রাতে আকাশ থেকে পাখির চোখে দেখলে পাহাড়ের কোলে এই গ্রামকে অন্যরকম দেখায়। মনে হয় আকাশের তারাগুলো হুড়মুড়িয়ে মাটিতে নেমে এসেছে। আসলে কিছুই না, ঘুটঘুটে অন্ধকারে তাঁবুর ভেতরে আলোগুলো মিটমিট করে জ্বলে। সেই আলোয় বড়োজোর পেলিনের মুখটুকু আবছা দেখা যায়। সামান্য কিছু বেঁচে থাকা আলোয় চোখে পড়ে কাছের আরও একটি পরিবার। দলা পাকিয়ে শুয়ে। ঘুমোচ্ছে। জারার কিন্তু ঘুম আসে না। এপাশ-ওপাশ করে। পেলিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। পলক পড়ে না। তার মুখের পেশিগুলো শক্ত। চোখে প্রচণ্ড রাগ। পেলিন নিজের মনে খেলে। শব্দ করে। হাততালি দেয়। ক্যাম্পের স্যাঁতস্যাঁতে হাওয়াকে খুব কাছের মানুষ মনে করে জড়িয়ে ধরতে চায়। জারার এসব দেখতে একদম ভালো লাগে না। তার গা-পিত্তি জ্বলে। কানদুটো লাল হয়ে ওঠে। বেশ কয়েকটা থাপ্পড় কষায় পেলিনের মুখে। ভ্যা করে কেঁদে ফেলে সে। ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ে। কিছুদিন আগেই জারার মনে হয়েছিল পেলিনকে মাইন ফিল্ডের ভেতর ছেড়ে দিয়ে আসবে। অন্ধ ছেলেটা ঠিক মাইনের ওপর পা দেবেই। তারপরেই জারার মুক্তি। সেদিন পেলিনকে কাঁধে নিয়ে মাইন ফিল্ডের পাশ দিয়ে যেতে যেতে এসব কথাই সে ভাবছিল আর ঠিক তখনই পেলিন মা বলে ডেকে ওঠে। আজও তাই হল। সঙ্গে সঙ্গে পেলিনকে জড়িয়ে ধরল জারা। খুব করে তার গালে কপালে চুমু খেল।
জারার তাঁবু থেকে বেশ খানিকটা দূরেই আফরানের ঘর। ঘর বলতে একটা মরা ট্যাঙ্ক। গ্রামের লোকেরাই তার থাকার জন্য ব্যবস্থা করেছে। কত সাহায্যই না সে করে গ্রামের লোকেদের। দেশ বিদেশের খবর পৌঁছে দেয়। এটা-ওটা সারিয়ে দেয়। সমস্ত কাজ সেরে রাতে ট্যাঙ্কের পেটের ভেতর সে শোয়। ট্যাঙ্কের খোলামুখ দিয়ে রাতের আকাশে চোখ রেখে সে নীল পাখির কথা ভাবে। সে পাখির মতোই আকাশে উড়তে চায়। এই পাহাড় থেকে সেই পাহাড়। নদীর ওপরে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে অবিরাম সে উড়তে চায়। জারাকে কাল আবার সে নীল পাখির কথা মনে করিয়ে দেবে।
সকাল হতেই আফরান সমস্ত রিফিউজি বাচ্চাদের ডেকে এনে জড়ো করে। সভা বসে। ট্যাঙ্কের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে সে যুদ্ধের কথা বলে। গতকাল সে স্বপ্ন দেখেছে, আবার নাকি যুদ্ধ শুরু হবে। শুধু তার নিজের নয় গ্রামের লোকেদেরও বিশ্বাস আফরানের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। সমুদ্রের ওপার থেকে আকাশ চিরে প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে আসবে অনেক উড়োজাহাজ। বোমা ছুঁড়ে মারবে এই গ্রামে।
সভা শেষ হতেই ফেরহাদ আর এলেন্দিকে নিয়ে সে শহরের দিকে যায়। লক্ষ অস্ত্র বাজার। অনেক ঘুরে শেষে দরদাম করে পনেরোটা জ্যান্ত মাইন বেচে একটা মেশিনগান তিন মাসের জন্য ভাড়া নেয়। সঙ্গে বেশ কয়েক রাউন্ড কার্তুজ। দোকানি বলে কার্তুজ কম পড়লে আবার এসে তারা যেন নিয়ে যায়। সেবার দাম একটু কম নেবে। এলেন্দি আর ফেরহাদের নজর বাঁচিয়ে সময় করে একটা বুলেটওয়ালা লকেটও আফরান কিনে নেয়। ফিরে এসে প্রথমেই আফরান যায় জারার কাছে। তাকে যুদ্ধের কথা বলে। বোমারু উড়োজাহাজের কথা শোনায়। জারা সব শোনে কিন্তু একেবারেই ভয় পায় না। উলটে সে আফরানকে নীল পাখির কথা জিজ্ঞেস করে। আফরান বলেছিল নীল পাখি দেখতে পাহাড়ের অনেক ওপর নাকি উঠতে হয়। জারা আজই সেই জায়গাটা দেখতে চায়। আফরান তো দারুণ খুশি। হাজার হোক জারা শেষ পর্যন্ত কিছু একটা তো চেয়েছে তার কাছে।
অনেকটা পথ হেঁটে পাহাড়ের অনেক উপর এসে তারা হাজির হয়। একটা খাদের ধার ঘেঁষে দুজনে দাঁড়ায়। একটু নিচেই পাহাড়ের খাঁজে একটা বাদামি গাছ। পাতাগুলো হলুদ। আফরান বলে এই গাছটার চারপাশেই নীল পাখিরা এসে জড়ো হয় খুব ভোরের দিকে। জারা নিচের দিকে তাকায়। গাছের ওপারে এখনও সাদা কুয়াশা। সবই আবছা কিন্তু বোঝা যায় এই খাদ খুব গভীর। আফরান পকেট থেকে বুলেটের মালা বার করে জারাকে দেয়। জারা কোনও কথা বলে না। লকেটটা নিয়েই জোরে হাঁটা দেয় তাঁবুর দিকে। আফরান এতেই খুশি। জারার চলে যাওয়া সে দু-চোখ ভরে দেখতে থাকে। তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। এদিকে আজ তার অনেক কাজ। গ্রামের লোকেদের এখনও যুদ্ধের কথা তো জানানোই হয়নি।
পেলিন ঘুমোচ্ছে। দড়ি দিয়ে তার পা দুটো বাঁধা। জারা তাকিয়ে থাকে পেলিনের দিকে। নীল পাখি তার দিকে তাকালে সে দেখতে পাবে জারাকে। তার মাকে। ভোরে সামান্য আলো ফুটতেই জারা পেলিনকে পিঠে তুলে নেয়। এগিয়ে চলে পাহাড়ের দিকে যেখানে নীল পাখি আসে। পেলিন তার গলা আঁকড়ে ধরে থাকে। জারার গা-পিত্তি জ্বলে। কানদুটো লাল হয়ে ওঠে। পুরোনো কথা আবার তার মনে পড়ে যায়। ট্যাঙ্কের ঘড়ঘড়ে আওয়াজ। তাদের ঘর মাটিতে মিশে গিয়েছিল। বাবার কী হয়েছিল সে আজও জানে না। মার জিভ কেটে শিরদাঁড়া ভেঙে তাকে মেরে ফেলার পর লোকগুলো তার পিছু নিয়েছিল। সে পালাতে চেষ্টা করেছিল যেভাবে ডানা ঝাপটে মুরগি পালিয়ে বেড়ায় ঘাতকের হাত থেকে। পারেনি। কতল করে মুরগির ছাল ছাড়ানোর মতোই তার জামা কাপড় ছিঁড়ে ফেলেছিল তারা। তারপর একের পর এক উঠে এসেছিল জারার শরীরের ওপর। অনেকদিন পর জারার পেট যখন আস্তে আস্তে ফুলে ওঠে সে তখন নিজেকে এবং নিজের সঙ্গে পৃথিবীকে নতুন করে চিনে নেয়। আজ জারা মুক্তি চায়। খাদের ধার ঘেঁষে সে তাকায় নিচের দিকে। এখন কুয়াশা আরও ঘন। পেলিন মা বলে আজ আর ডাকতে পারে না। তার মুখ জারা অনেক আগেই কাপড় দিয়ে বেঁধে দিয়েছে। পেলিনের চোখের মণি দুটো খুব দ্রুত কেবল ঘুরতে থাকে।
এদিকে সকাল থেকেই ফেরহাদ আর এলেন্দি আফরানের কথা-মতো বাচ্চাদের আবার জড়ো করে। মেশিনগান কীভাবে চালাতে হয় আজ তার তালিম দেওয়া হবে। সবাই আছে কিন্তু জারা নেই। তাঁবুতেও খোঁজ করা হয়েছে। গ্রামেও। এলেন্দি আর ফেরহাদ তন্নতন্ন করে খুঁজেও জারাকে কোথাও খুঁজে পায় না। আফরান এই খবরটা পেয়ে কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে যায়। তার একটি মাত্র হাতের আঙুলগুলো কাঁপতে থাকে। মাটির দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবে সে, তারপর ছুটে যায় পাহাড়ের দিকে যেখানে নীল পাখিরা আসে। খাদের ধার ঘেঁষে সে দাঁড়ায়। জারা আর পেলিনের জুতো সেখানে রাখা। একটার ওপর অন্যটা। খাদের নিচের দিকে তাকিয়ে আফরান চিৎকার করতে থাকে জারা আর পেলিনের নাম ধরে। কোনও সাড়া নেই। সে ডাকতেই থাকে। ক্রমাগত। গলা ভেঙে যায়। ডুকরে কেঁদে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে আফরান। হাঁটু গেড়ে বসে মাইন তোলার অভ্যেসে জুতোগুলো সে তুলে নেয়। তারপর আকাশের দিকে তাকায়। আকাশে উড়োজাহাজ। উড়োজাহাজের ডানা আছে। তার হাত নেই। কিংবা বলা যায়, এই পৃথিবীতে উড়োজাহাজের হাত আছে, আফরানের ডানা নেই। আকাশ থেকে মুখ ফিরিয়ে সে খাদের একটু নিচে বাদামি গাছটার দিকে তাকায়। কে জানে কী এক নিয়মে আজ বড়ো অসময়ে সেখানে দুটো নীল পাখি এসে বসেছে।
ঋণ: টারটেলস ক্যান ফ্লাই, ২০০৫
পরিচালক– বাহমান ঘোবাদি।
অন্যান্য গল্প পড়তে গল্প ক্যাটাগরিতে করুন।
খুব ভালো লিখেছেন।
‘উড়োজাহাজের হাত’ , খুব সুন্দর।
আপনপাঠ কে ধন্যবাদ।
অনবদ্য গল্প।