“তুমি কেন থিয়েটার করো?” – অতনু
একটি তুলাযন্ত্রের দুই আলাদা পাত্রে সবসময় অবস্থান করে রাষ্ট্র এবং থিয়েটার। উভয়ের ভারসাম্যেই একটি সমাজ সুস্থিত থাকতে পারে। কিন্তু ক্ষমতার বাটখারা স্বভাবতই রাষ্ট্রের পাত্রে বেশি আশীষ বর্ষায়। আর তাই থিয়েটার হালে পানি পায় না।
মহামারী অধ্যুষিত এই মহানগরীতে মানুষ নবজাগরণের স্বাদ পেয়েছে। মুখোশের আড়ালে মুখ ও বিবেককে আড়াল করতে শিখে গেছে। কানে তুলো চোখে ঠুলি তো ছিলোই- মুখে কুলুপের ষোলআনা পূর্ণ করেছে করোনার কল্যাণ। আর তার পূর্ণ ফায়দা তুলতে মত্ত্ব এক শ্রেণী। না তাদের কেবল রাজনৈতিক পরিচয় পত্র খুঁজে লাভ নেই- সুযোগ সন্ধানীর ছলের অভাব হয় না।
আমরা যারা মঞ্চে বাঁচি- তারা খুব ভালোই জানি বাইরের জগৎটার মতো এই মঞ্চ সভ্যতায়ও অনেক শ্রেণীবিন্যাস আছে। জানি না সমাজতত্ত্বের কোন অধ্যায়ে এই শ্রেণী বিন্যাসের উল্লেখ আছে কিনা কিংবা বিশ্বের শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাসেও এই অসম লড়াই কোনদিন ঠাই পাবে কিনা। তবু আমাদের সে লড়াইএর কথা আজ কিছু বলতে চাই।
“ তুমি কেন থিয়েটার কর?”
এই একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়নি এমন থিয়েটার কর্মী বোধহয় সৎ রাজনীতিবিদের থেকেও দুর্লভ। প্রত্যেকেরই নিজস্ব উত্তর থাকে এই প্রশ্নের কিন্তু তবু কিছু পক্ক কেশ- বা তামাটে কেশ বোদ্ধা বুদ্ধিজীবিদের কিছুতেই সেই সব উত্তরে সন্তুষ্ট করা যায় না। মনে পড়ে যায় ক্লাস সেভেন এইটের দিনগুলোর কথা যখন ক্লাস টিচার তার প্রাইভেট টিউশানে শিখিয়ে দেওয়া উত্তর ভিন্ন অন্য কোন উত্তরকে সঠিক উত্তরের মান্যতাই দিতেন না। সেই স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবিরা কিছুতেই মানতেই চাননা না যে আমরা একটা নতুন দিনের স্বপ্ন দেখি বলেই থিয়েটার করতে চাই। নতুন দিন দেখতে ভুলে যাওয়া সেই সব বুদ্ধিজীবিদের কাছে আমাদের জবাব যেন মোল্লা নাসিরুদ্দিনের চুটকির মতো শোনায়। তারা বিশ্বাস করতে এবং বিশ্বাস করাতে ভুলে গেছেন যে থিয়েটারে দিন বদলানো যায়। অথচ দিন বদলানোটাই থিয়েটারের মূল মোক্ষ হওয়ার কথা ছিল।তবে হল কই?
যাক সে প্রসঙ্গে না হয় পরেই আসব। বরং যে শ্রেণীভেদের কথা দিয়ে উবাচ শুরু করেছিলাম সে বিষয়ে একটু ফিরে যাওয়া যাক। শহর কেন্দ্রিক সভ্যতায় রাজধানি বরাবরি গুরুত্বের শিখরে অবস্থান করে। কোলকাতাও স্বভাবতই তার ব্যতিক্রম নয়। এবং তাই বাংলার থিয়েটার বলতেই আমাদের উন্নাসিক শহুরে শ্লাঘা বোঝে এ শহরের কতিপয় থিয়েটার মঞ্চকেই।। তার মধ্যে সরকারি হল গুলোর প্রসঙ্গ বাদই দিলাম- গেল কয়েক জন্মে পূণ্যার্জন করলেই তবে সে মঞ্চে ওঠার শিকে ছেড়ে অপরিচিত দলগুলোর ভাগ্যে। কিন্তু যদি ফিরে তাকাই বেসরকারী হলগুলোর দিক তাহলে এ শহরের থিয়েটারীয় রূপরেখা একেবারে স্পষ্ট হয়ে যাবে। ণূন্যতম পরিষেবা হীন হলগুলিতেও ৭০০০/৭৫০০ টাকা কাঞ্চনমুল্য গুণলে তবে পাওয়া যায় প্রবেশাধিকার। এরপর তো সেট আলো প্রসাধনের খরচ রয়েইছে। আর এসবের পর রয়েছে তথাকথিত বড় নামী দলের অদৃশ্য দাদাগিরি। তাদের পছন্দের দিনে আপনার দরকার থাকলেও আপনি হল পাবেন না। তখন আর হল কর্তৃপক্ষ পেনসিল বুকিং এর শিষ্ঠাচারকেও গ্রাহ্য করবেন না। আমাদের সবার জানা শনি রবিবার হোল দর্শকের হল অভিমুখে আসার শ্রেষ্ঠ দিন। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে হল কর্তৃপক্ষ নিয়েছে এক আজব ফর্মূলা। শনি রবিবার হল বুক করতে হলে আপনাকে দুটো স্লট বুক করতেই হবে। ভেবে দেখুন- দুটো স্লট মানে ১৫০০০ টাকা। হাজারো প্রতিকুলতার সাথে লড়াই করে টিকে থাকা থিয়েটার দলগুলির পক্ষে ১৫০০০ টাকা জোগাড় করা কার্যত অসম্ভব। সম্ভব কিছু বড়লোক দলের পক্ষেই। অর্থাৎ হল এবং অর্থবান দলের এক অন্যায় আঁতাতের শিকার আমাদের মতো ছোট দলগুলি।
তবে কেবল হল কর্তৃপক্ষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এখন থিয়েটারকে লড়তে হচ্ছে আর হাজারো প্রতিকুলতার সাথে। একটা সময় ছিলো যখন থিয়েটারকে মনে করা হত যাপন। দিনের পর দিন নির্দেশকের তত্ত্বাবধানে তর্ক বিতর্ককে সাথে করে এক একটা টেক্সটের নির্যাস পান করত কুশীলবরা। আর এভাবেই চরিত্র সংলাপ এবং নাটকে মাখামাখি হয়েই তৈরি হতো থিয়েটার। তখন অভিনেতাকে আর চরিত্রকে আলাদা করা যেতো না- একে অপরের তন্ত্রীতে মিশে যেতো। বাঙালী তখনো দু মিনিটের ফাস্ট ফুড খেতে শেখেনি সেভাবে। অনলাইনে পিৎজা পাওয়া যেতো না। ক্রেডিট কার্ডে মধ্যবিত্ত ইউরোপ ভ্রমণের স্বপ্ন দেখার সাহস পায়নি।সময়ের চাকার সাথে পাল্লা দিয়ে খিড়কি দোরে এলো উন্নয়ন। দীর্ঘ রিহার্সালের বদলে ৮ দিনের ওয়ার্কশপ ভিত্তিক প্রোডাকশান। ধর তক্তা মার পেরেকের জয়গান। এখন, ফাস্ট ফুড সুস্বাদু হয় ঠিকই। খালি এর তাৎপর্য বোঝে বাড়ির মা-মাসি এবং ডিসপেন্সারির ডাক্তারেরাই।তেমনি হাল এই সব ওয়ার্কশপ নির্ভর প্রোডাকশানের।একটা কিছু ঝকঝকে পরিবেশিত হয় ঠিকই। নতুন প্রজন্ম কম খেটে খ্যাতি পায় ঠিকই। কিছু মানুষ করে কম্মে খায় ঠিকই। কিন্তু থিয়েটারের যে মূল শর্ত তা কি আদৌ রক্ষিত হয়!
এই ওয়ার্কশপ মূলত পরিচালনা করেন কিছু বিখ্যাত- নামী- সেলেব্রিটি গোত্রের নাটয়কর্মী। মোটা কাঞ্চনমূল্যে তারা ওয়ার্কশপ পরিচালনা করেন আর মাত্র ৮/১০ দিনেই তারা নাকি অভিনয়ের যাবতীয় খুটিনাটি শিখিয়ে একেবারে প্রযোজনা প্রস্তুত করে ফেলেন। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় সেই জাতীয় প্রযোজনার কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকে আবার কোন বিক্রয় যোগ্য মুখ। তারাও ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণকারীদের দেওয়া কাঞ্চনমূল্যের ভাগ পায়। আর অংশগ্রহণকারীরা কি পায়? ৮ দিনে অভিনয়ের সব খুটিনাটী শিখে ফেলার প্রমাণ স্বরূপ একখণ্ড সার্টিফিকেট আর ওই নামী অভিনেতার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার সুযোগ। আর থিয়েটার কি পায়? লবডঙ্কা! থিয়েটারের মূল স্পিরিটকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এই ভাবেই রমরমিয়ে চলছে থিয়েটার ব্যবসা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এর ব্যতিক্রম কি নেই? অবশ্যই আছে।চাকচিক্য আর সেলিব্রিটির হাতছানি উপেক্ষা করে অনেক দলই কাজ করে চলেছে। শৈল্পিক সততাকে গুরুত্ব দিয়ে তারা গল্প বলে চলেছে। শূন্য দর্শকাসনের আনাচা কানাচে বসে থাকা কতিপয় মাথাতেই তারা তাদের বক্তব্য পৌছে দিচ্ছে।
হ্যা সততা! থিয়েটারের আরেক উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। নির্দেশক বা অভিনেতারা যা পেশ করেন তাতে তাদের সততার আভাষ না থাকলে দর্শকমনে এক ভুল বার্তা পৌঁছায়। আর মানবিকতার সেই বেসিক শর্তকেও উল্লঙ্ঘ করে চলার নমুনা আমাদের চারপাশে এখন মুঠি মুঠি। স্বৈরাচারী শাসকের সকল সুখ ভোগ করে- আনুকূল্য লাভের পরে কোন পরিচালক যখন সর্বহারা মানুষের দুঃখের কথা সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশনা করেন তখন সেই প্রযোজনার প্রতি ঘৃণা ভিন্ন আর কিই বা আসতে পারে। আসলে শাসক কিংবা শোষক সবাই জানে শোষিতের গল্পই বেশি বিক্রি হয়। কুমীরের কান্নাকে মুক্তো সাজিয়ে বেচায় অনেক মুনাফা। আর তাই সততাকে ব্যাকসিটে রেখে ব্রেখট থেকে উৎপল নিয়ে চলে যথেচ্ছ ভ্রষ্টাচার। কিন্তু তাই বলে দর্শক কি মূর্খ। তারা কি এই স্ট্রাটেজি বোঝে না?
সে তো আরেক প্রসঙ্গ। বহু যুগ হয়ে গেল বাঙালী বই পড়তে ভুলে গেছে। টেবিলে মানি প্ল্যান্ট লাগিতে লাগিয়ে অরজিনাল বট গাছের শিকড় খুজতে ভুলে গেছে। ইউটিউবের মার্কিনি জাঁতাকলে অন্যের বমি সুখাদ্য ভেবে তারা অডিও স্টোরি শোনে আর নিজের কল্পনার ডানাটাকে বুর্জোয়া কলমের কাছে বন্দক দিয়ে পপকর্ণের মজা নেয়। এহেন আত্মবিসৃত জাতির কাছে কি বা ভিট্টন আর কি বা ব্যারিকেড! খুব সম্প্রতি বাজার মাতিয়ে তুলেছে ম্যাকবেথের দেশীয় সংস্করণ। এক সুদর্শন নাট্য কর্মীর অত্যুর্বর মস্তিষ্ক থেকে নাকি ম্যাকবেথের এমন এক অ্যানালিসিস বেড়িয়েছে যা বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসের মাইল ফলক। জানি থিয়েটার প্রসঙ্গ থেকে সিনেমায় যাওয়া অবান্তর- তবু যেহেতু থিয়েটার কর্মীর নাম জড়িয়ে তাই একটু না বলে পারলাম না। সে অ্যাডাপ্টেশান ভালো না মন্দ সে প্রসঙ্গে আমি যাওয়ার কেউ নই- খালি একটা ভয় আমাকে গ্রাস করেছে। সেটা না বলে পারছি না। অরিজিনাল টেক্সট পড়তে ভুলে যাওয়া বাঙালী এই মন্দারকেই শেক্সপীয়ারের আসল ম্যাকবেথ ভেবে বসে থাকবে নাতো?
আমার এই আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক নয় তার একটা নমুনা দিই। উপচে পড়ছে অ্যাকাডেমি। মঞ্চস্থ হচ্ছে গালাগালি আর কু কথায় সজ্জিত ফ্যাতাড়ু। চরম মার্কিন বিরোধী সাহিত্যিক নবারুনের আদর্শকে সামনে রেখেই সে নাট্য নির্মাণ। এক একটা ব-কার বা চ-কারে হাততালি ফেটে পড়ছে। নির্দেশক বা স্বর্গীয় নবারুণের আত্মা হয়ত ভাবছেন তাদের উদ্দেশ্য সার্থক। এই নব প্রজন্মকে তারা পুরন্দর ভাটের কথা বোঝেতে পেরেছে। কিন্তু নাটক অন্তে দেখা গেল সেই দর্শকই গিয়ে ঢুকলো কে এফ সির স্টলে। ভিড় জমালো মলে। মেতে উঠল মার্কিনি মৌতাতে।অর্থাৎ যৌন সুড়সুড়ি আর অশ্লীল কথা কেবল তাদের পিটুইটারিটুকুই ছুলো। সুষুম্না কিন্তু বিকিয়েই রইল স্ট্যাচু অফ লিবার্টির পদতলে।
তাই ওই যে শুরুতে বলেছিলাম- তারা ভুলে গেছে থিয়েটারে দিন বদলানো যায়- কথাটা কি সত্যি খুব ভুল? তারা জানে দিন বদলের গল্প হাততালি আর পয়সা কুড়ানো যায়। তাই দিন বদলের বদলে বদলানো দিনের ব্যাবসায় মত্ত এই পক্ক কেশ বা তামাটে কেশগুলো।
রাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবীরা থিয়েটার চায় না চায় ধর্ম। রাজ্যের বুদ্ধিজীবীরা থিয়েটার চায় না চায় ব্যবসা। দর্শক থিয়েটার চায় না- চায় ইন্টারটেন্মেন্ট। এসবের মধ্যেও লড়াই চালিয়ে যাই আমরা। সোম মঙ্গল বুধবার অফিসে হাজারো মিথ্যে বলে- ফাঁকা প্রেক্ষাগৃহের দিন বদলের স্বপ্ন নিয়ে। আর একে অন্যের সাথে দেখা হলে ক্লান্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওই একটাই প্রশ্ন করি প্রশ্ন করি-
“তুমি কেন থিয়েটার কর?”