থিমপুজো – হেমন্ত জানা
এই শহরের ‘হংসমিথুন’ সর্বজনীনের এবারের থিম আদিবাসী গ্রাম। উল্টোরথে খুঁটি পুজোর দিন থেকে থিমের কাঠামো গড়া শুরু। শিল্পীর হাতের মায়ায় ধীরে ধীরে রূপ পায় পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডির এক আদিবাসী গ্রাম। নকল শালতরু, খড়োচালের মেঠোঘর, তার চারধারের নানা নকশা, আদিবাসী রমণীদের নৃত্যরত মডেল, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আদিবাসী ঢঙের প্রতিমা। খুঁটি পুজোর দিন থেকেই এলাকায় পুজো-পুজো ভাব। সকলের মধ্যে অনন্ত কৌতূহল ছিল কেমন হবে সেই আদিবাসী গ্রাম। পুজো কর্তারাও বিষয়টি নিয়ে মৃদু টেনশনে ছিলেন। কারণ হংসমিথুনের পুজোর নাম আছে। প্রতি বছরই পুরস্কার জেতে। এ বছর হাতছাড়া হলে আর মান থাকবে না পুজো কর্তাদের। কিন্তু থিমের নিখুঁত নির্মাণ দেখে সকলেই খুশি।
মহালয়ার দিন প্রভাতফেরি দিয়ে পুজোর সূচনা হল। তারপর একের পর এক অনুষ্ঠান। পুজোর বিভিন্ন দিনে আসতে থাকলেন মন্ত্রী–আমলা–সিরিয়ালের উঠতি অভিনেতা–অভিনেত্রীরা। তাঁরা প্রতিবছরই আসেন। শুধু বছর বছর তাঁদের মুখ বদলে যায়। তা নিয়ে কারও তেমন উৎসাহ ছিল না। তাদের এবার যত আগ্রহ আদিবাসী পুরুষ–মহিলাদের নিয়ে। তাঁদের নিয়ে সিনেমা–সিরিয়ালে কত কথা শুনেছে। শহরের অভিনেত্রীর আদিবাসী ঢঙে কথাবার্তা এখনও কানে বাজে। এবার একেবারে জীবন্ত আদিবাসী রমণীরা তাদের অঙ্গণে। পুরুলিয়ার এক গ্রাম থেকে তাঁদের পয়সা দিয়ে ভাড়া করে আনা হয়েছে। আদিবাসী মেয়েদের নাচ দিয়েই হবে দেবীর বোধন। তাই যষ্ঠীর সকালে লটবহর নিয়ে চলে এসেছেন আদিবাসী যুবক–যুবতীরা। তাঁদের দেখতে এলাকার লোকজন হইহই করে বেরিয়ে এল। এমন মানুষ তারা কখনও দেখেনি। বিস্ময়ে তাদের চোখ ছানাবড়া। কেউ কেউ বলল, ‘এরাই বনমানুষের পূর্বপুরুষ। এখনও জঙ্গলে থাকে। শিকার করে বেড়ায়।’ শহর মানুষের কৌতূহলী চোখের সামনে আদিবাসী মহিলারা বেশ কুণ্ঠিত ও আড়ষ্ট। কানে মাগড়ি পরা ছেলেরা হামলে পড়ল তাঁদের দেখতে। কেউ কেউ মোবাইলে ছবি তুলে সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে পোস্ট করল। তার মধ্যে এক আদিবাসী যুবকের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাঁর ধামসা–মাদলে টোকা মারতেও শুরু করল কেউ কেউ। বোধনেই সাঁওতাল কন্যাদের নাচ–গান মন কেড়ে নিল যুবক থেকে প্রৌঢ়ের। পুজো কর্তাদেরও মন খুশি খুশি। সেই টেনশনটা আর নেই। এলাকার মানুষজন ধন্য ধন্য করছে। তাদের ঘরে আসা আত্মীয়–স্বজনেরাও এবারের পুজোর থিম দেখে মুগ্ধ। হংসমিথুনের পুজোর থিম ছেয়ে গেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। আদিবাসী রমণীদের সঙ্গে সেলফি তুলেই পোস্ট। তাতে কমেন্টেস আর লাইকের ঝড় বইছে ফেসবুকে। সকাল থেকে ডিমি–ডিমি মাদলের বোল। মহিলারা মাথায় ঘট নিয়ে নৃত্য করছেন। একেবারে আদিবাসী গ্রামের পরিবেশ। যুবকদের নজর শুধু অদিবাসী রমণীদের দিকে। পুজোর সব কিছু ছেড়ে তাদের আলোচনার একমাত্র বস্তু এখন জঙ্গলমহলের পিঁড়াগোডার বছর একুশের এক তন্বী। তার নাম রূপসা মুর্মু। অন্য মহিলাদের থেকে রূপসা একটু অন্যরকম। গায়ের রঙ একটু উজ্জ্বল। দোহারা চেহারা। পাছা পর্যন্ত চুল। বুকটাও বেশ উন্নত। যে কোনও যুবককেই টানবে। দীপন, রাজেশ, সায়ন, রাপ্পা, ঋকদের আলোচনার রসদ এখন রুপসার বক্ষযুগল। দীপন, রাজেশ, ঋকদের লক্ষ্য ওদের সর্দারকে হাত করে মেয়েটির কাছাকাছি যাওয়া।
দীপনের এক ছিলিম শহুরে গাঁজাতেই বশ হয়ে গেলেন ওদের সর্দার রহিন হাঁসদা। সরল মনে তিনি অনুমতি দিলেন মেয়েদের সঙ্গে আলাপের। কথা হল খাওয়া–দাওয়া পর দুপুরে আসার। সর্দারই আলাপ করে দেবেন মেয়েদের সঙ্গে। সকলেরই সুপ্ত ইচ্ছা ভাল করে ভাব জমিয়ে পুজো চারদিনের অন্তত একদিন তাদের ফাঁকা ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে মেয়েটিকে তোলা। একমাত্র ঋকের ফ্ল্যাটই ফাঁকা। জলপাইগুড়ির ছেলে ঋক। এখানে একা থাকে। আইটি সেক্টরে কাজ করে। পুজোয় মস্তি করবে বলে বাড়ি যায়নি। বাকিদের ফ্ল্যাট বাবা–মা, আত্মীয়–স্বজনে ভরা। সর্দার আলাপ করে দিয়েছেন। দীপন, রাজেশ, ঋকরা যা ভেবেছিল তা নয়, আদিবাসী মেয়েটি তাদের কোনও টোপই গিলছে না। সর্দারকে টাকা দিয়ে হাত করা আছে। সর্দার বলেছেন তাঁর কোনও আপত্তি নেই। শহরের বাবুর ছেলেরা যদি তাঁদের মতো গরিব আদিবাসী মেয়ের হিল্লে করে দেয় আপত্তি থাকার কথা নয়। বরং সুখের কথা। কিন্তু আদিবাসী নাচ–গান খানপিনায় সপ্তমী, অষ্টমী কেটে নবমীর বিকেল গড়াল। রাত পোহালেই রুপসারা বাঘমুন্ডি ফিরে যাবেন। রাজেশ, ঋক, দীপন, রাপ্পাদের রক্ত ফুটছে। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা, আজকের রাতটা তাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। আদিবাসী মেয়েদের যতটা সহজলভ্য ওরা ভেবে ছিল তা নয়। বরং আত্মসম্মান বোধ শহরের মেয়েদের চেয়ে প্রখর।
রূপসাকে তুলে নিয়ে যাবে ওরা। সর্দারই সেই সুযোগ করে দেবেন। রূপসা সম্পর্কে সর্দারের মামাতো বোন। সর্দার শহরের ছেলেদের পরিকল্পায় খারাপ কিছু দেখেননি। ছেলেগুলো রূপসাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে বলেছে। এটা–ওটা কিনে দেবে যদি বাড়ির লোকের মনে ধরে যায় তাহলে চিন্তার নেই। গাঁয়ের গরিব মেয়েটার একটা গতি হবে। এমন এখন হচ্ছে, শহুরেবাবুরা গাঁয়ে গিয়ে আদিবাসী মেয়েদের পছন্দ করে বিয়ে করে আনছে। তারা শহরে বেশ সুখে আছে। ছেলেপুলে নিয়ে মাঝে মাঝে গাঁয়ে আসে। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। গত বছরই কেলো মুর্মুর মেয়েটার এভাবেই বর জুটে গেল। বাবার সঙ্গে পুজোয় শহরে নাচ করতে এসেছিল। সেখানেই ছেলের পছন্দ হয়। ছেলে আবার বিদেশে থাকে। ছেলের পছন্দ হতেই বাবা–মা আদিবাসী মেয়েকে মেনে নিলেন। রূপসারও যদি এমনটা একটা হিল্লে হয়ে যায় ওর বাবা–মা রহিনকে দু–হাত তুলে আশীর্বাদ করবেন। রহিন সেসব সুখের কথা ভেবেই ছেলেগুলোকে অনুমতি দিয়েছেন রূপসাকে নিয়ে যেতে। কিন্তু মেয়ে মোটেই রাজি নয়। সে সঙ্গীদের ছেড়ে একা যেতে চায় না। রহিনকে বলেছে, ‘দাদা তুমি আমাকে একা পাঠাচ্ছো কেন। ওদেরও নিয়ে যেতে বলো, তাহলে যাবো।’ রহিন বলেছেন, ‘বোকা মেয়ে, তোর ভালোর জন্যই পাঠাচ্ছি। ওরা সবাইকে পছন্দ করছে নে। তোকেই ওরা চায়। কেলোর মেয়ে সোনালির মতো তুই দেখবি এ শহরের বউ হয়ে যাবি।’ কিন্তু ছেলেগুলোকে দেখে পছন্দ হয়নি রূপসার। রূপসা যেতে চায় না তাদের সঙ্গে। কিন্তু রহিন সর্দার যে ছেলেগুলোর কাছ থেকে টাকা নিয়ে বসে আছেন।
ছেলেগুলোকে কথা দিয়েছেন রহিন, তাঁর বোনকে ঠিক পৌঁছে দেবেন তাদের কাছে। রাতে একটা নাগাদ আসতে বলেছেন। ছেলেগুলোকে একটা জায়গায় অপেক্ষা করতে বলেছেন। বারোটা পর্যন্ত নাচের অনুষ্ঠান হয়েছে। মেয়েগুলো শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। রূপসাকে পুজোর কর্তারা ডাকছেন বলে ডেকে তুললেন রহিন। ঘুমজড়ানো চোখে দাদার সঙ্গে একটু এগোতেই ছেলেগুলো জোর করে গাড়িতে তুলে নিল রূপসাকে। রহিনকে ওরা বলল, তার বোনকে নিয়ে শহরের বড় বড় ঠাকুর দেখবে তারা। একটু গিয়ে গাড়ি বাঁক নিল উল্টো পথে। আগে থেকেই হোটেলের ঘর বুক করা ছিল। মাদকের ঘোরে মেয়েটা কিছুই বুঝতে পারল না। রাজেশ, ঋক, দীপন, রাপ্পা, সায়নরা পর পর ভোগ করল রূপসাকে। রহিন তাঁর বোনের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল। আর হোটেলের একটি ঘরে যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকল রূপসা। নবমীনিশি অবসান হল।
One Comment