সুকুমারী চিন্তার দিগন্তমিলন – সায়ন ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন


সুকুমারী ভট্টাচার্য বাংলার নবজাগরণের শেষ প্রতিনিধিদের অন্যতম। দেশ ও জাতি যখন প্রাচীনতার আবর্তে একটি ক্ষমতাশালী জাতীয়তাবাদ নির্মাণ করার চেষ্টা করছে তখনই সুকুমারী ভট্টাচার্য মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরছেন দেশীয় পুরাণ, কাব্য, মহাকাব্য কিংবা ধর্মগ্রন্থের কেন্দ্রীয় সংকট। সামাজিক পরিসরে সেই সব সাহিত্যকে কেন্দ্র করে ভক্তি কীভাবে জাতীয় জীবনকে বিপজ্জনক দিকে নিয়ে যেতে পারে, তিনি বিভিন্ন রচনা ও বক্তৃতার মাধ্যমে একটি জনমুখি কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করছেন। প্রকৃত সমাজতান্ত্রিকের যা কর্তব্য তিনি তাঁর পাণ্ডিত্যকে ঠিক সেই কাজেই ব্যবহার করছেন। ইতিহাস ও যুক্তির আলোয়, সাধারণ মানুষের জন্য লিখছেন প্রাচীন যুগের জটিল সমস্ত পাঠ্য বিষয়বস্তু। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে একটা বিরাট সংখ্যক জনগণের অজ্ঞতা এবং অন্যদিকে এই সাহিত্যের প্রতি চরম ভক্তিভাব ও ধর্মভাব একটা জাতির চিন্তার অন্ধত্বকে আরও প্রকট করে তোলে। একজন সমাজ শিক্ষকের মতো সুকুমারী ভট্টাচার্য বুঝতে পারছেন সেই অন্ধত্বকে অস্ত্র করে—মানবিক হিন্দুধর্মের বিপরীতে ক্ষমতার হিন্দুধর্মের গর্ভ থেকেই জন্মানো আর.এস.এস, শিবসেনা, কিংবা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ কীভাবে একটা মৌলবাদী পরিকাঠামো তৈরি করছে।

ভারতবর্ষে মার্কসবাদ অধ্যয়নের সঙ্গে আমাদের দেশের প্রাচীন শাস্ত্রগুলিও অধ্যয়ন করা খুব জরুরি। জরুরি এই কারণে, প্রাচীনকালের লিখিত ইতিহাসের অন্যতম প্রধান উপাদান পুরাণ ও মহাকাব্য। এই সমস্ত ধর্মশাস্ত্রগুলো থেকেই ইতিহাসকে খুঁজে বার করা যেতে পারে।

সুকুমারী ভট্টাচার্যের লেখা “গীতা কেন” একটি বহু পঠিত, বহু অনূদিত এবং বহুল চর্চিত গ্রন্থ। সেই সময়ে শ্রমজীবি মানুষদের শ্রেণিবিন্যাস, বর্ণ বিভাগ, সমাজে শূদ্রদের ভূমিকা এই বিষয়গুলি খুব সুন্দর ভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে এই বইটিতে।

বেদ নিয়ে সুকুমারী ভট্টাচার্যের ভাবনা আমাদের সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে জরুরি। আরও বেশি করে প্রয়োজন এই কারণে যে কেন্দ্রীয় সরকার বাহাদুর তো আবার মনে করেন ‘ব্যদেই সব আছে’! সংশয় জাগে—আর এখনকার সময়ে সংশয় থাকা মানেই আপনি নাস্তিক, আর তার মানেই দেশদ্রোহী। উনি তাই চিন্তা করছেন, যেন প্রাচীন আর সমকালের মধ্যে একটা তীব্র তর্ক বাধিয়ে দিচ্ছেন—সেই তর্কের ইতিহাস লেখা হচ্ছে ‘বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য’।

সংশয় ও নাস্তিক্যের বহুমুখী প্রকৃতিগত, ব্যাপ্তিগত এবং মাত্রাগত পার্থক্য আছে। সংশয় নাস্তিক্যের উপর সবসময় নির্ভরশীল না। নাস্তিক্যও সংশয়ের চেয়ে গভীর ও ব্যাপক। সাধারণ বিষয় নিয়ে আস্তিকেরও সংশয় থাকতে পারে। সংশয় পরিসরে ছোটো, গভীরতাতেও অগভীর। নাস্তিকের সংজ্ঞা হল ‘ঈশ্বর-প্রামাণ্যবাদী’ অর্থাৎ যিনি ঈশ্বরকে প্রামাণ্য বলে অস্বীকার করেন, এবং ‘বেদাপ্রামাণ্যবাদী’ অর্থাৎ বেদকে সর্বৈব মানতে নারাজ। আবার উপনিষদে দেখা যায়, পরলোকে অবিশ্বাসকারী সে-ও নাস্তিক। পরলোককে স্বীকার করলেও ঈশ্বরকে স্বীকার নাও করা যেতে পারে এবং এ দুটি স্বীকার করেও বেদের প্রামাণ্যতা যে মানে না সে-ও নাস্তিক।

হেমচন্দ্রের অভিধান বলে, নাস্তিকের প্রতিশব্দ হল, বাৰ্হস্পত্য, চার্বাক ও লোকায়তিক। যে ‘নাস্তি’ শব্দ থেকে নাস্তিক শব্দের ব্যুৎপত্তি, তার তিনটি অর্থ হতে পারে: যে ঈশ্বর মানে না, যে পরলোক মানে না এবং যে বেদের প্রামাণ্য মানে না। ঈশ্বর, পরলোক ও বেদে বিশ্বাস পরস্পর-নিরপেক্ষ; আবার তিনটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান ছিল বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের তিনটি মূল স্তম্ভ। পরবর্তীকালে বুদ্ধের আগেও বেদবিরোধী প্রস্থানের উদ্ভব হয়েছিল, তারা সকলেই বেদের প্রামাণ্যে অবিশ্বাসী, ঈশ্বরের অস্তিত্বেও আস্থাহীন। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই পরলোকে বিশ্বাসী; এর সঙ্গে বৌদ্ধ, জৈন ও আজীবিকরাও আছেন। কিন্তু প্রাচীনলেখ ও যুক্তি—পরলোক নিয়ে ব্রাহ্মণসাহিত্য, আরণ্যক ও উপনিষদে নানা সংশয়। শাস্ত্রমতে এ সংশয়ও নাস্তিক্য, তবে এ নাস্তিক্যের সংজ্ঞা শুরু হয় উপনিষদে।

আর্য, একটি প্রাচীন যাযাবর জাতি, পশুপালন যাদের জীবিকা নির্বাহের মুখ্য উপায়। বিরূপ প্রকৃতির বদৌলতে উন্নত রণকৌশল ও রাজনীতি নিয়ে মধ্য এশিয়া হয়ে বর্তমান ভারতবর্ষে প্রবেশের সময় প্রাগার্য জাতিদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। প্রাচীন ভূগোল অনুসারে মধ্য এশিয়া ভারতভূমির আওতায় পড়ত। এল.ডি. কাল্লা তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Home Land of the Aryans’ পাঠ করলে বোঝা যায় আর্য গোষ্ঠীর রাজনৈতিক অভিসন্ধির চেহারা। হয়তো এমনই কোনো সময়ে বা এরও আগে ইন্দ্রের বীরত্ব তাদের কঠিন কোনো যুদ্ধে জয়লাভ করতে সাহায্য করেছিল। যা পরবর্তী হাজার বছর পর্যন্ত গীত হয়েছে। প্রায় সব প্রাচীন ধর্মের নৈতিকতা অনুসারে আর্যরাও সামাজিক সমস্যার সমাধান খুঁজত যজ্ঞের মাধ্যমে। যজ্ঞের অগ্নিতে (অগ্নি ও সূর্য উপাসনা পৃথিবীর সব প্রাচীন ধর্মেই দেখা যায়) আহুতি দানের মাধ্যমে তারা অন্য দেবতাদের আহ্বান করত। অগ্নি অনেকটা divine messenger এর মতো—খুব সরল এবং সাধারণ। এই আহ্বান পরবর্তীতে অনেক জটিল রূপ ধারণ করে। ভারতবর্ষের উর্বর ভূমি (সম্পদ) আর প্রাগার্য সংস্কৃতির (শ্রেণিবিন্যাস) মিশ্রণ এর জন্য মূলত দায়ী। দ্বন্দ্বের কারণ খুব সহজেই বোঝা যাবে এবার। যেহেতু মানুষের হাতে সময় এবং সম্পদ বেড়ে গেছে তাই যেকোনো ফল লাভের জন্য যজ্ঞের উপর নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকে। এবং স্বাভাবিক ভাবেই অপ্রাপ্তি মানুষের মনে সংশয়ের উদ্রেক করে। সেখান থেকেই অবিশ্বাস এবং এর থেকেই নাস্তিকতা। বিদ্রোহের রূপ নেবে সমাজ কাঠামোয়—পরবর্তীকালে ধর্মীয় প্রতিবাদী আন্দোলনের পথ এইভাবেই নির্মাণ হয়েছে ইতিহাসের গতিশক্তির মধ্যে। এছাড়াও সময় অনেকগুলো বস্তুবাদী মতবাদ তৈরি হয়, চার্বাক মতবাদ এর মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বেদ বিরোধিতার সূত্র ধরে বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক মতবাদও চলে আসে। যজ্ঞ বিরোধিতার পর আত্মা নিয়ে বেশ আলোচনা শুরু হয় যা বৈদিক সাহিত্যের পরবর্তী ধাপের সাহিত্যগুলোতে স্থান পেয়েছে।

পরিশেষে কয়েকটা অপ্রিয় সত্যি কথা বলব যা আমার মনে হয়। একটি জাতি সুকুমারী ভট্টাচার্যের মতো একজন বিশ্বজয়ী মানবিক চিন্তাবিদকে তাদের মধ্যে পেয়ে যেতে পারে, কিন্তু তাঁকে নিয়ে চর্চা করতে হয়তো পারে না। তাঁর মহান শিক্ষার চেতনা, নবজাগরণীয় বোধ হয়তো আমাদের দেশের প্রগতিশীল, মুক্তচিন্তাবিদ, সমাজতান্ত্রিক, মার্কসবাদী কিংবা বামপন্থী—কারোর কাছেই খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। তাহলে আমাদের রাজ্যের শিক্ষার এতটা নিষ্প্রাণ দশা হত না। কারণ ভারতীয় সমাজের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ, শ্রেণি-শোষণের যে চেহারা প্রাচীন থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত বিরাজ করেছে তার সম্যক ধারণা না নিয়ে আমরা পাশ্চাত্য বামপন্থী কিংবা প্রগতিশীল আন্দোলন নিয়ে অনেক অগভীর ভাবে মেতে থেকেছি। এর ফল হয়েছে কার্য ও কাঠামোর মধ্যে বিরোধ। বিশ্বায়ন সেই সুযোগেই তার বিরাট থাবার আঁচড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে একটা দেশের সাংস্কৃতিক চেহারা। শুধু জন্মদিন পালন নয় সুকুমারী ভট্টাচার্যের গ্রন্থ, চিন্তা, মননের ছোঁয়া—নতুন প্রজন্মের হাতে আবার তুলে দেওয়ার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে আমাদের সংস্কৃতিকর্মী থেকে শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী থেকে বিপ্লবী সবাইকে। সুকুমারী ভট্টাচার্যের সৃষ্টি তো আসলে রম্যাঁ রলার ভাষায়, “সব দেশের মুক্তমনাদের, যারা কষ্ট পায়, যারা লড়াই করে, আর যাদের জয় হবেই।” ( ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’/ চিন্ময় গুহ/ পৃঃ ৫৮)

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *