‘করোনা বিষে’ চলছে দুনিয়াদারি, তালাবন্দি শুধু স্কুলের ক্লাসবাড়ি – দীপক সাহা
ঘটমান বাস্তব হল করোনা দুর্যোগে থমকে আছে দেশের শিক্ষাপ্রবাহ। পড়ুয়াদের স্কুলজীবন স্তব্ধ। প্রায় সারাবছর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাঙ্গনে পঠনপাঠনে অভ্যস্ত পড়ুয়ারা এখন স্কুলের পথ ভুলে গিয়েছে। করোনা সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়বে এমনই ইঙ্গিতে শিক্ষাঙ্গন কেন্দ্রিক শিক্ষা নিয়ে অভিভাবকদের শঙ্কা আরও বেড়ে গেছে। বিগত নির্বাচনে আকাশ বাতাস ‘খেলা হবে’ ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে কম্পমান থাকলেও শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভোটজীবিরা আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। অনেক টালবাহানার পর বাতিল হল মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। ফলে নানা প্রশ্ন ভিড় করছে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মনে। এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষার ভবিষ্যৎ কী? টেলিভিশনের পর্দায়, পত্রিকার পাতায় বা সোশ্যাল মিডিয়া ঘেঁটে এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করছে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। শিক্ষা বিভাগ থেকে এ বিষয়ে কোনো সঠিক তথ্য পাচ্ছে না তারা। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার কিছু প্রতিবেদনে বিভ্রান্তও হচ্ছেন অনেকে। চলমান জীবনের সব চলছে আপন তালে, শুধু তালকাটা সুরে সাজছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাত্রছাত্রীহীন হয়ে সারাবছর।
কিন্তু করোনাকালের বাস্তব চালচিত্র হল গ্রামের শিশুরা কেউই গৃহবন্দি নয়, তবুও ওদের ক্লাসঘর খোলা নেই। বইপত্রের সঙ্গে অধিকাংশের যোগাযোগ প্রায় ছিন্ন। পড়াশোনার দৈনিক অভ্যাসের মধ্যে ওরা তেমনভাবে নেই এখন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুশাসনে নির্দিষ্ট সময়ের গণ্ডিতে থাকতে হচ্ছে না বলে করোনা ভূতকে ফুৎকারে উড়িয়ে সারাদিন টো-টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ মাছ ধরছে, পারিবারিক ফাইফরমাশ খাটা থেকে একটু ফুরসত পেলেই ওরা দলবেঁধে বৃষ্টিভেজা কাদামাঠে ফুটবল নিয়ে দাপাদাপি করছে, সুযোগ পেলে আমবাগানে হুড়োহুড়ি, কেউ কেউ বর্ষার ভরা পুকুর নদীতে জলকেলি করছে। প্রকৃতির সঙ্গে লেপ্টে আছে গ্রামের ছেলেমেয়েরা। আগে মাঝেমধ্যে কেউ কেউ অভিভাবকের সঙ্গে মাঠে যেত চাষের কাজে সাহায্য করতে, খাবার দিতে। এখন সারা বছরই ছুটি। তাই প্রায় প্রতিদিনই বাবার সাথে মাঠে যেতে বাধ্য হচ্ছে বাচ্চারা। দেশের মাথারাই যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পারছেন না তখন এই পড়ুয়াদের হতদরিদ্র পিতামাতারা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে কায়িক পরিশ্রমে উপার্জনের উপায় খোঁজার দিকে ঠেলে দিচ্ছে তাদের সন্তানদের। ছুতোর মিস্ত্রি বা রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজে লেগে পড়েছে গ্রামগঞ্জের মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী, কারণ ভাতের ঠিকানা খুঁজতে তো কয়েক বছর পর ভিনরাজ্যে পাড়ি দিতেই হবে।
গ্রামের সচ্ছল পরিবারের শিশুরাও তাদের জীবনের মূল্যবান সময়কে অবহেলায় অপচয় করে দিন কাটাচ্ছে। কেউ মোবাইলে ভিডিও গেম খেলছে। বাচ্চারা বাবা-মার সাথে দীঘার সমুদ্র বা কাঞ্চনজঙ্ঘায় মেঘের ভেলা দেখতে যাচ্ছে। আসল কথা হল করোনাকালে প্রথম কয়েকদিন ছাড়া তারা ঘরবন্দি হয়ে নেই আজকাল। তাদের গ্রামে করোনা রোগ নিয়ে আতঙ্ক নেই। প্রথম প্রথম মনে ভয় হলেও এখন কারো সেটা নিয়ে ভয়-ডর নেই।
বছর ঘুরে গেল। এখনও স্কুলগুলোর ক্লাসরুমে তালা। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষায় সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভরশীল প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়ারা লেখাপড়া ভুলে যেতে বসেছে এবং জীবিকার তাগিদে নানা কাজে জড়িয়ে পড়ায় শিক্ষাঙ্গন থেকে ঝরে পড়ার আশঙ্কা প্রবলতর হচ্ছে। প্রান্তিক দরিদ্র-আদিবাসী-দলিত-সংখ্যালঘু-অসচেতন পরিবারের পড়ুয়ারা শিশুশ্রমে যুক্ত হয়ে পড়ছে। স্কুল বন্ধ থাকার ফলে প্রত্যন্ত এলাকায় স্কুলছুটের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কিন্তু খাতাকলমের বাইরের এই হিসেবে খোঁজ কী রাখে উপরওয়ালা।
অভিভাবকদের বাঁধা-ধরা কাজের অভাবে দৈনন্দিন আয় কমে যাওয়ায় বহু দিনমজুর পরিবারের শিশুরা করোনাকালীন সময়ে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। অপুষ্টিতে ভুগে ওরা লড়াই করছে জীবনের সঙ্গে। আগে স্কুলে গেলে নির্দিষ্ট সময়ে ভরপেট রান্না করা খাবার পেত, এখন সেটাও নেই।
গ্রামের শিক্ষার্থীদের অনেকের মোবাইল ফোন আছে, তবে স্মার্টফোন নেই। এই শিশুরা অনলাইনই জানে না আর অনলাইন ক্লাস তো বহুদূর-বছরের ভবিষ্যৎ চিত্রপট। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া রয়েছে কিছু পরিবারে। এদের অধিকংশ কিছুদিন পরপর অভিভাবকদের কাছ থেকে টাকা চায় ‘ডেটা’ কিনবে বলে। অনেক অভিভাবক ভাবেন ফোন নাড়াচাড়া করতে কেন এত টাকা লাগে! এ নিয়ে বিস্মিত। পেট চালাতে যে টাকা লাগে তা থেকে অনেকাংশই ফোনে আঙুল ছোঁয়াতে দিয়ে দিলে সামনের দিনগুলোতে না খেয়ে মরতে হবে বলে জানিয়েছেন কোনো কোনো অভিভাবক।
প্রথমদিকে অনলাইন ক্লাস চালু হওয়ার সময় নানা সাহায্য-সহযোগিতার কথা বলা হলেও গ্রামের কোনো শিক্ষার্থীই সে ধরনের সাহায্য না পেয়ে তাদের বঞ্চনার কথা জানিয়েছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে টিভিতে পাঠদানের কর্মসূচির ব্যর্থচিত্র সবার জানা। গ্রামাঞ্চলে অর্থনৈতিক সক্ষমতা কম ও প্রযুক্তিগত সুবিধা সামান্যতম। ফলে তারা অনেকে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশাগ্রস্ত। অনেকে আবার আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নেটনির্ভর গেম ও পর্নোগ্রফিতে আসক্ত হয়ে বিপজ্জনক বিকৃত জীবনযাপনের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। এ অভিযোগও অনেক।
তবে করোনার দুর্যোগে এ বছরে স্কুলমুখী হতে হয়নি বলে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মেয়ে শিক্ষার্থীরা। গ্রামের ছোটো ছোটো মেয়েরা মায়ের সাথে ঘরকন্নার কাজ শিখতে ব্যস্ত আর স্কুলগামী কিশোরীদের অনেকেই পাত্রস্থ হয়েছে করোনাকালে সামাজিক কুসংস্কারের বলি হয়ে। ফলস্বরূপ ‘বেটি বাচাও–বেটি পড়াও’, ‘কন্যাশ্রী-রুপশ্রী’-র মতো মেয়েদের রক্ষকবচকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাল্যবিবাহ বেড়েছে অনেকগুণ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বন্ধ থাকায় ওদের জীবনের দৈনন্দিন ছন্দ কেটেছে, অনিশ্চয়তায় স্বপ্ন ভেঙেছে। বান্ধবীদের অনেকের এই কঠিন সময়ে নানা পারিবারিক সমস্যার কারণে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় নিজেদেরও বিয়ে হয়ে যেতে পারে—এ আশঙ্কায় মানসিক অবসাদে ভুগছে কেউ কেউ।
আচ্ছা দেশে তো অনেক কিছু খোলা! শুধু স্কুলঘর বন্ধ কেন? এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব কঠিন মনে হলেও গ্রামের মানুষ বলছেন—করোনা আমাদের অসুখ নয়। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। আমাদের সারাদিন কাটে রোদে, জলে, ঘামে ভিজে। আমরা দিনযাপন করি ভাঙা বেড়ার ঘরে। সকাল হলেই কাজে যাই। রাতে নাক ডেকে ঘুমাই। যারা পায়রার খুপরির মতো বন্ধ দালান ঘরে ঘুমায়, জানালা বন্ধ গাড়িতে চড়ে আর গায়ের ঘাম বের করে না—সেসব বড়লোকের অসুখ ওটা! আমাদের গ্রামে কতজনের জ্বর-কাশি হল। ওসব অসুখে এখনও কেউ মরেছে বলে শুনিনি। সবাই সব জায়গায় যাচ্ছি, সবকিছু করছি, শুধু স্কুল-কলেজ বন্ধ। খালি খালি গ্রামের ছেলেমেয়েদের স্কুল বন্ধ করে ভবিষ্যৎ জীবনটা নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে।
অভিযোগ, আসলে আমরা আমাদের গ্রামগুলোর সঙ্গে রাজধানী অথবা বড়ো বড়ো শহরের পার্থক্যকে অস্বীকার করে চলেছি। প্রতিদিন করোনার আপডেটেড তথ্য শুধু শহরকেন্দ্রিক। সেখানে গ্রাম থেকে আসা কতজন রোগী এল-গেল তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই। শহরের শিশুরা ঘরে বসে অনলাইনে পড়াশোনা করছে। গ্রামের শিশুরা বঞ্চিত। তারা বাড়িতেও পড়ার সুযোগ পাচ্ছে না—বিধিনিষেধ আরোপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গেট তাদের জন্য খোলা নেই। তাই শিক্ষার সুযোগ হারিয়ে ঘাটে-মাঠে ঘুরে অন্ধকারে তাদের দিন কাটে। সুস্থ-সুন্দর পরিবেশে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে বঞ্চিত করে কোটি কোটি গ্রামীণ শিশু-কিশোরকে অজ্ঞানতার গহিন আঁধারে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। গ্রামের করোনা সংক্রমণহীন পরিবেশে ঘরের বাইরে ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়ানো মাটির সন্তানরা পড়ালেখা ভুলে শুধু কি অজ্ঞ, অশিক্ষিত হয়েই থাকবে? যেখানে সাধারণ অবস্থাতেই গ্রামের পড়ুয়ারা আধুনিক সুযোগসুবিধা থেকে বহুবছর পিছিয়ে আছে শহর থেকে।
রাজধানী তথা শহরে বসে মৃত্যুভয় সামনে রেখে নিজেদের শিশুদের আধুনিক প্রযুক্তি সুবিধা দিয়ে পাঠদান চলছে, অথচ গ্রামে করোনার প্রকোপ না থাকা সত্ত্বেও শিশুদের জুজুবুড়ির ভয় দেখিয়ে পড়ালেখার সুবিধাবঞ্চিত রেখে এ কোন্ অসম উন্নয়ন ঘটাচ্ছি আমরা? শিক্ষায় শহর ও গ্রামের মধ্যে এহেন আঞ্চলিক বৈষম্য ও বৈপরীত্যে ভবিষ্যৎ পিছিয়ে পড়া গ্রামীণ প্রজন্ম কি কখনও ক্ষমা করতে পারবে?